একই হুড়োহুড়িতে লিপ্ত পিপঁড়ে
সেদিন হঠাত করে কথাটা মনে পড়লো। লেখালেখির অপচেষ্টা করা হয় না অনেকদিন। আদ্যিকালে এই নামেই অভ্যাসটাকে নির্ণয় করেছিলাম। সেই কালে কখনো এমনও হয়েছে যে টানা প্রতিদিন লিখেছি। দিনে একাধিকবার লিখেছি। ব্লগে যদি কখনো দিনে একাধিকবার লেখা প্রকাশের দরকার পড়তো তাহলে পূর্বে খানিকক্ষণ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ হতো। কেন একাধিকবার প্রকাশের দরকার পড়লো সেই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে। কেননা নিজের প্রতি নিজের এক ধরনের মায়া মানুষের কাজ করেই। যার ঊর্ধ্বে ওঠাটা মোটেই সহজ নয়। তাই নিজের কাছে ভাল লাগলেও, আদতেই দু'টো লেখা একদিনে প্রকাশের মতো ভাল কি না- সেই প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি ছিল। জেনেও অবশ্য কিছু যেতো বা আসতো না। লেখা খারাপ হলেও প্রকাশ করে দেওয়া হতো। আদ্যিকালে শিশুতোষ আচরণেই জীবনযাপন করতাম।
আসলে লেখালেখি অপচেষ্টা না হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে কোনকিছু লিখতে বসার সঙ্গে সঙ্গেই ওরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হওয়া। মাথার ভেতর তো সবসময় সবার সবকিছু নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তাই লেখার কোন উপায় জুটিয়ে নিয়ে বসলেই, সঙ্গে সঙ্গে টিং করে বেজে উঠবে একটি বড় প্রশ্ন। কি লিখবো?
এই মেরেছে! কি লিখবো- তা তো ভাবি নি। লিখবো, কিছু একটা লিখবো। আগেভাগে অতোকিছু বলা যায় নাকি। হয়তো গল্প লিখবো। ভাগ্যের পরিহাসে সব হারানো কোন যুবরাজের নির্মম লড়াই এবং সবশেষে নিয়তির কাছে অসহায় আত্মসমর্পনের বিয়োগের গল্প। হয়তো লিখবো মুক্তগদ্য। গ্রামের দিকে মেঠোপথের চৌরাস্তা পাওয়া যায়। সেসব চৌরাস্তায় প্রায়শই অনেক বড় একটা গাছ থাকে সবকিছুর কেন্দ্রে। তার চারপাশেই এসে মেলে রাস্তাগুলো এবং ওগুলোর আশপাশের দোকানপাট, মানুষজন, রিকশা-ভ্যান সবকিছু। ওরকম গাছগুলোয় ছোট ছোট চড়ুইপাখিরা যেভাবে দিনভর এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফিয়ে বেড়ায় আর কিচিরমিচির করে, সেরকম ভাসবে আর সুর ছড়াবে আমার সেই হাওয়ায় মুক্ত করে দেওয়া শব্দগুলো। কিংবা হয়তো লিখে বসবো একটা কবিতাই, কে জানে!
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই পার হয়ে যায় লেখার বেলা। ডাক পড়ে যায় অন্য কোন কাজের জন্যে। মাথার ভেতর। শরীর চলে যায় সেদিকে। লেখার আয়োজন যেটা করা হয়েছিল, সেটা ওরকমই পড়ে থাকে। কয়েকদিন। তারপর কোন একসময় যখন ব্রাউজারের সবগুলো ট্যাব বন্ধ করে দিয়ে ল্যাপটপটাকে শাট ডাউন করি, তখন ওরা হারিয়ে যায়। মহাযন্ত্রজগতের আস্তাকুঁড়ে। আমার মনে হয়, মানুষের যেমন একটা মহাবিশ্ব রয়েছে, যন্ত্রদেরও তেমন মহাযন্ত্রবিশ্ব রয়েছে। সেখানকার অসীম আকৃতির আস্তাকুঁড়ে কোনকিছু হারিয়ে গেলে, সেটিকে আর খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
তবে লেখালেখির অপচেষ্টার সেই দিনগুলোকে আমার বেশি মনে পড়ে অন্য কারণে। লেখালেখির উপাদান সংগ্রহের জন্যই হোক আর যে কারণেই হোক, তখন লেখায় যেমন পরিবেশের বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করতাম; তেমন পরিবেশেই ঘোরাঘুরিটা চালু রাখতাম। কিংবা অন্যভাবে বলা যেতে পারে। যেসব পরিবেশে ঘোরাঘুরি করা হতো সেসময়, সেগুলোই আমার লেখায় উঠে আসতো। যেভাবেই হোক আমার ওই ধরনের পরিবেশগুলো দেখার আর অনুভবের সুযোগ হয়ে যেতো- যেটা ছিল উপরি পাওনা! মধ্যরাতে যদি নিয়ন আলোর নিচে বৃষ্টি হয় তাহলে সেই বৃষ্টিতে কিংবা বৃষ্টির পরপরেই রাস্তায় বাইক চালিয়ে চরমানন্দ রয়েছে। এমনকি আনন্দ রয়েছে টং দোকানের পলিথিনের ভেতর থেকে সেটা দেখার মধ্যেও। সে আনন্দকে বিপুলানন্দ বলে।
আজকাল বৃষ্টির সময় গ্রীলের বাইরে তাকিয়ে থাকি। শহরের বাতিঘরটা যে উচুঁ ঢিবিটায় দাঁড়ানো, সেই ঢিবিটা শুয়ে আছে অনেকখানি জায়গা জুড়ে। চলে গেছে আমার গ্রীলের সামনে দিয়েও। বৃষ্টিতে ঘন সবুজ গাছগুলোর পাতায় পানির নাচন দেখি আর ভাবি, ওদের জীবনটা কত সহজ! গাছের পাতা হয়ে কাটিয়ে দেওয়া। মাত্র এক মৌসুমের জন্য। তারপর চলে আসবে ঝরে পড়ার পালা। শীতকালকে সঙ্গে নিয়ে। শীত চলে গেলেই পুরোনো সবুজ পাতাদের জায়গা নিতে চলে আসবে নতুন সবুজ পাতাদের দল। ক'টা মাস আগেই যে পাতাগুলোয় বৃষ্টি পানির নাচন দেখা যেতো, সেগুলো হারিয়ে গেছে। মহাবিশ্ববাসী ঘটনাটি সম্পর্কে বেমালুম। পাতার জায়গায় পাতাই আছে। বৃষ্টির পানির নাচন চলছে স্বাভাবিক। আসলে মানবজাতিকেও যদি দুর থেকে দেখা হয়, তাহলে একই রকম লাগার কথা। সময় ফুরিয়ে গেলেই একজনের জায়গায় আরেকজন আসছে। দুর থেকে কোন পার্থক্য চোখে পড়ে না।
অথচ সামান্য এ জীবনটার মায়ায় মানুষের কি নিদারুণ সংগ্রাম! প্রতিটা মুহূর্তে চলছে। এক সেকেন্ডের বিরাম নেই কোথাও। সেদিন পাঙখা মামার চা'য়ের দোকানের ফুটপাথে বসে একটা চা পান করছিলাম, ধূম্রশলাকাসহ। দুই কানের ভেতর দশদিক থেকে দশ রকম শব্দ আসছিল। কোন বিরাম ছাড়া। যেদিকে তাকাচ্ছিলাম দেখতে পাচ্ছিলাম সংগ্রামরত মানুষ। সবাই ব্যস্ত। ক্রমাগত ছুটে বেড়াচ্ছে। আজ থেকে পাঁচ কিংবা ১০ বছর পরেও দৃশ্যগুলো একই থাকবে। কিন্তু মুখগুলো সব পাল্টে যাবে। দুর থেকে দেখে আলাদা করে কিছু বোঝা যাবে না। সংগ্রামরত মানুষগুলো কি তা জানে?
না জানার তেমন কোন কারণ দেখি না। তারপরও কোথাও এ অবস্থার বত্যয় ঘটিয়ে কাউকে আশার আলো ফুটিয়ে তুলতে দেখি না। জীবনটা আমাদের এভাবেই কেটে যাচ্ছে। কিসের যেন একটা আশায় অন্ধ আমরা ছুটছি। পিপঁড়ার সারিবদ্ধ লাইনের মাঝখানে কোন প্রতিবন্ধকতা ঢেলে দিলে যেমন পিপঁড়াগুলোর ভেতর একটা হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, তেমন হুড়োহুড়িতে লিপ্ত আমরা প্রতিটা মুহূর্ত।
আমার এ হুড়োহুড়ি ভাল লাগে না। আমি গ্রামের তালপুকুরের মতো নীরব, শান্ত একটা সকালের খোঁজে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই। ঘুণে ধরা কাঠের মতো পুরোনো একঘেয়ে দুপুর খুঁজি। সাগরপাড়ের বাতাসের মতো সজীব বিকেল খুঁজি। আসলে লিস্টি অনেক বড়! তাই খোঁজ মেলে না কোনকিছুর। জীবনের যে পথে হারিয়ে গিয়েছি সে পথেই ক্রমাগত ঘুরপাক খাই। দুর থেকে দেখলে আমাকেও সেই একই হুড়োহুড়িতে লিপ্ত একটি পিপঁড়েই মনে হয়। আর কিছু না।
---
মন্তব্য করুন