ইউজার লগইন

হৃদ মাঝারে অশ্রুসারি

তখন কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের হাওয়া লাগছিলো, লহমায় ছুটে যেতাম ঢাকার এ কোণা ওকোণা। সেবার প্রচন্ড শীত পড়েছিলো রাজশাহীতে, কাঁকনহাট শীতের রাতে অদৃশ্যপুরী হয়ে যেতো। দাদা দাদীর কবর উঠোনের কোনায়।রাতভর চুপচাপ বসে থাকতাম, জানালা দিয়ে দেখতাম ঘূটঘূটে আঁধার। প্রতি মঙ্গলবার হাট বসতো। সারা সপ্তাহ যে হাট ঝিমুতো শীর্ণ পাখির মতো, মঙ্গলবার ঠিক উৎসবে সেজে উঠতো। চায়ের দোকানে বসার ঠাই নেই, কুলিদের হাঁকে গমগম অথবা ভ্যানের টুনটুন আওয়াজে কানটা ভরে যেতো।

হাট শেষ হয়ে এল, আবারও সেই নিস্তব্ধতা। সেবার রাত করে হাটে গিয়েছিলাম কেরোসিনের খোঁজে। ঠান্ডায় দাঁত কপাটি একসাথে রাখার চেষ্টার অন্ত ছিলো। দোকান থেকে এক বোতল কেরোসিন কিনে যখন ফিরছিলাম তখন দেখি রসের হাড়ির পাশে একটা ছেলে শুয়ে শুয়ে কোকাচ্ছে। গায়ে ফিনফিনে কাপড়। এতরাতে এভাবে হেটে চলে গেলে রাতে ঘুমাতে পারবো না, তাই ছেলেটাকে ডেকে তুললাম।
: কিরে? শীতে তো মারা যাবি?
: কিছু কইবেন? ঘুম ধরছে। ক্ষুধা আর সহ্য হইতেছে না।
: নাম কি তোর?
: নাম দিয়া কি করবেন? হুদাই আইছে।

ছেলেটির বিরক্তির চাইতে ব্যাক্তিত্বটা মনে ধরলো। আমরা রাস্তাঘাটে হাটবার সময় এমন ছেলেদের দেখলে অহরহই মনে করি এই বুঝি হাত পাততে আসলো। বলবে দু'দিন ধরে কিছু খাইনি অথবা বাসায় মা অসুস্হ, দু'টো টাকা ভিক্ষা চাই। আমি হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম। গরম গরম পরোটা আর আলু ভাজি ১০ টাকার কিনে প্যাকেটে করে হাটা দিলাম ঐ ছেলেটির দিকে। গিয়ে দেখি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পাশে একটা কুকুর শুয়ে শুয়ে কাপছে। আমি ছেলেটিকে আবার ডেকে তুললাম। সামনে খাবার প্যাকেট টি রেখে হাটা ধরলাম বাড়ি আসার জন্য।

ছেলেটি প্যাকেট টা এক টানে খুলে খাওয়া শুরু করলো, আর ভরা মুখেই বলে বসলো,"আমার নাম রশীদ। রহমত কুলী আমার বাপের নাম। আপনি মাস্টর সাবের ছেলে না?"

আমি পিছু ফিরে বললাম,"আমার সাথে আসতে পারিস, সকাল হলে বাড়ি ফিরে যাস।"

ছেলেটি তার নাম কাথাটা গায়ে জড়িয়ে খাবার হাতে নিয়ে হাটা দিলো আমার পিছু পিছু। শীতের বেলা জ্বোনাক পোকার দেখা মেলে না, কুয়াশায় ঢেকে থাকা নিকষ অন্ধকার অনেকটা ফ্যাকাশে মনে হয়। টর্চের আলো খুব বেশী দূর আলোকিতও করে না। মাঝে মাঝে মনে হয় যখন পুরোনো ক্যালেন্ডার খুলে নতুন ক্যালেন্ডার ঝুলাই, তখন আমাদের জীবনে খুব বেশী নতুনত্ব যোগ হয় না। আমরা বৃদ্ধ হই এই ভেবে বয়সের সাথে এক বছর যোগ করি। আয়নায় চুল আচড়ানোর সময় খুজতে থাকি কাচাপাকা চুল। তখন খুব অল্প সময়ের জন্য ভাবি ছোটবেলায় হতে চেয়েছিলাম রকস্টার, বড় হয়ে হলাম অফিসের পেশকার। আর যারা দুই তিন সন্তানের বাবা মা, তারা আর বয়সের খাতা নিয়ে আফসোস করে না। আফসোস করে নিজের সন্তান বড় হলে কি করবে এই পন্কিল সমাজে এই ভেবে।

আমরা বাসা পৌছুলে ওকে কলপাড় দেখিয়ে বলি হাত পা ধুয়ে আসতে। আমি বাবার ঘরে গিয়ে দেখি হ্যারিকেনের আলোয় স্কুলের পরীক্ষা খাতা কাটছে।

: বাবা, আসবো?
: কিছু বলবি? কেরোসিন পাসনি?
: পেয়েছি। একটা ছেলে এই শীতে বাইরে শুয়ে কাঁপছিলো, ক্ষুধার্তও।

বাবা খাতা থেকে মুখ উঠিয়ে চোখে চশমাটা নামালেন। কাছে ডেকে বললেন খাটে বসতে। খাটে বসে দরজা দিয়ে আমি বাইরেই তাকিয়ে ছিলাম। রশীদের হাত পা ধোয়া শেষ। বারান্দার একটা টুলে বসে সেই পরোটা আর আলু ভাজি খুবলে খাচ্ছে। বাবা চেয়ার ছেড়ে আমার পাশে এসে বসলেন," আমি এখানে আছি প্রায় ৬ টি বছর। জানি না সামনে কোথায় ট্রান্সফার হবো। আমার স্কুলটায় মাত্র ৪ জন শিক্ষক আগে যে স্কুলটায় ছিলাম সেখানে ছিলাম মাত্র ২ জন। এখানে যারা পড়তে আসে তারা এতটাই গরীব যে তাদের পরনের জামা শেষ কবে পাল্টেছে জানা নেই। কেউ হয়তো দিনে এক বেলা খায় অথবা দু'দিনে এক বেলা। তারা স্কুলে আসে কারন কিছউ টিফিন পায় সেই লোভে। আমার ভয় হয় সামনের মাসে এদের কতজন স্কুলে দেখতে পাবো। তবু আশা ছাড়িনি। যখন স্কুলটা শুরু করেছিলাম তখন এখানে ছাত্র ছাত্র ছিলো মাত্র ১৪ জন। আজ ছয় বছর পর ২২০ জন। তোর বয়স কম, আজকে রাতে না হয় জায়গা দিলি, কিন্তু কাল? সামনের সপ্তাহে ঢাকায় চলে যাবি। তখন?"

আমি বাবার দিকে চেয়েছিলাম, বাবা হেসে ফেললেন, বললেন,"তোকে নিয়ে আমি খুব গর্ব করি। তুই ডাক্তার ইন্জ্ঞিনিয়ার কিছু হতে পারিস নি সেটা নিয়ে আমি কখনো দুঃখ করিনি। তুই মানুষ হয়েছিস এটাই আমার গর্ব। আয় আমার বুকে আয়।"

বাবা আমাকে বুকে টেনে নিয়ে কিছুক্ষন কাঁদলেন। আমি হতভম্ব হয়েছিলাম সেরাত। আমি রশীদকে তার পরের দিন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেই। বাবার তার পরের মাসে ট্রান্সফার হয়। কাঁকন হাটে আর যাওয়া হয়নি। জানি না রশীদ এখনও সেই হাটে ঘুমায় কিনা।

দেশের মানুষ অনেক এগিয়ে গেছে, পত্রিকা খুলে বিষাদের পাশাপাশি অনেক আশানিয়া খবর পড়ি। এমন কিছু খবর আছে যা পড়লে চোখটা ভিজে যায়। কিছু কিছু পন্কিলতা এখনও আমাদের খুবলে খাচ্ছে। সেই খুবলানো দগ্ধ ক্ষত থেকে নিঃসরিত হয় আমাদের ঘামে ভেজা রক্ত। যন্ত্রনায় কাতড়াতে থাকি। মনকে বুঝ দেই উপরে ঈশ্বর দেখছেন, একদিন তিনি এর প্রতিদান দেবেন। জানি না রশীদের মতো নিস্পাপ জীব সেই ঈশ্বরের কাছে খুব মূল্যবান কিনা।

তবে ইদানিং একটা প্রশ্ন মনের মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকে। শুনেছি তিনি নাকি দয়াশীল, ন্যায়বিচারক। অসীম ক্ষমতার অধিকারী। যদি তাই হয় তাহলে যে রশীদকে দেখে আমার মতো একজন পাপিষ্ঠের মন কেদে ওঠে, পাশে দাড়ানোর জন্য নিজের শেষ সামর্থ্যটুকু বিলিয়ে দেই, সেখানে উনি এতক্ষমতার আধার হয়েও এতটুকু দয়া, এতটুকু ন্যায়বিচারে কিসের এত বাধা?

খুব মন চায় ইদানিং কাঁকনহাটের হাটবারে বসে পরোটা দিয়ে এখটু আলুভাজি খেতে, সর পড়া চায়ে একটু তৃপ্তির চুমুক দিতে।

পোস্টটি ৬ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

আরাফাত শান্ত's picture


খুব মনে ধরছে লেখাটা, নিয়মিত লিখেন
দারুণ থাকেন!

দূরতম গর্জন's picture


জয়েন করছেন কবে? পোস্টিং কোথায়?

আরাফাত শান্ত's picture


এখনও নিয়োগই হলো না জয়েন ও পোষ্টিং তো পরের কথা!

দূরতম গর্জন's picture


হবে। একদিন আপনার মতো আলোকিত মানুষরাই দেশকে আলোকিত করবে। আমরা প্রতিরাতে যে স্বপ্ন গুলো দেখি রশীদের মতো ছেলেদের নিয়ে, আপনারাই সেই স্বপ্ন গুলো পূরণ করবেন। ততদিন আপনাদের মতো মানুষদের জন্য শুভকামনা

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


রশীদদের নিয়ে ভাবার মানুষের বেশ অভাব এখনো আমাদের সমাজে।
ভাল লাগলো লেখাটা

দূরতম গর্জন's picture


হয়তো কেউ কেউ ভাবে, তাইতো এরা বেচে থাকে। আর বেশীর ভাগমানুষ ভাবে না বলেই এরা বড় হয়ে সমাজকে দুমড়ে মুচড়ে প্রতিশোধ নেয়

ধন্যবাদ

আহসান হাবীব's picture


অনেক আবেগময়

দূরতম গর্জন's picture


ধন্যবাদ

জাকির's picture


অসাধারণ লেখা ছিল...

১০

দূরতম গর্জন's picture


আপনারা লেখাও অসাধারন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

দূরতম গর্জন's picture

নিজের সম্পর্কে

মহাশূন্যের গুন গুন শুনতে চাই, কান পেতে রই তারাদের আহ্বানে। দূরতম গর্জন যখন সৈকতে আছড়ে পড়ে, আমি পা ফেলে উপভোগ করি সাগরের কূর্ণিশ। মানুষ হয়ে জন্মাবার অহংকারই শুধু বিদ্যমান, অথচ নিত্য বেচে আছি তেলাপোকার শৌর্য্যে!