নিস্ফল সাফল্য
ভাবলাম একদিন দিগন্ত ছুতে বেরিয়ে যাবো। দিগন্তে কি আছে জানতে মন চাইতো, সেখানে কি রংধনু সারা বছর দেখা যায় অথবা লাল টুকটুকে সূর্য্যটা কি পরিপাটি হয়ে ঘুমিয়ে থাকে? এসব ভাবনা একসময় আমার কৈশোরবেলা জুড়ে ছিলো ভাবলেই হাসি পায় আনমনে।
: একা একা হাসছো যে?
: এমনি।
: বাড়ি যাবে না?
: আর কোথাও কি যাবার জায়গা আছে?
ইয়েল্দা তাকিয়ে আছে নিশ্চুপ, শুধু ঠোট টেপা হাসি। ঠোট দুটো গাঢ় লালের লিপস্টিক, চোখে টানা কাজল। আফগানী মেয়েদের কারো নাম যে ইয়েল্দা হয় জানতাম না, তাদের চুল এমন লালচে কালো হয় সেটাও ভাবনায় আসেনা।
: যাবে আমার সাথে? চলো কোথায় বসে কফি খাই।
আমি কিছু বললাম না। হাতের সিগারেটে শুধু একটাই টান দেয়া হয়েছিলো, বাকিটা হাতেই পুড়ে শেষ। কখন যে ভাবনার সাগরে ডুবে যাই তার কোনো ইয়েত্তা নেই। ইদানিং মনটাকে লাগাম দিতে পারছি না।
ইয়েল্দার বিএমডব্লু গাড়িটা বেশ উৎকট লাল রং এর। মেয়েদের পিংক রং এর প্রতি একটা আকর্ষন আছে, কিন্তু এর ঠোট আর গাড়ির রং দেখে মনে হচ্ছে এর অবসেশন লাল। গাড়ির ভেতরটা আরও লালচে। এ কোন দেশী বিএমডব্লু মাথায় খেলছে না।
: তারপর বলো, শুনলাম তুমি নাকি বাবা হচ্ছো?
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। বাবা হবার অনুভূতিটা কেমন যেনো আমাকে ছোয় না। বরংচ যখনই মাইমুনার প্রসঙ্গটা ঘুরে ফিরে মনে আসে তখন বাবার কথা মনে পড়ে। বাবার কথা মনে হতেই ছোটবেলায় বাবার অবাক করা কাজগুলো মনে পড়ে। বাবাকে আমি ঠিক নিজের হিরো বা আদর্শ মনে করতাম না। এমনকি সে খুব ভালো বন্ধুও ছিলো না। বাসায় মা কে দেখতাম তাকে খুব সমীহ করতো। আমিও তাকে সমীহ করতাম, হ্যা, একটা সময় তাকে অনুসরনও করতাম। তার আদর্শগুলো আমাকে মুগ্ধ করতো কিন্তু নিজেকে খুব নগন্য মনে হতো। হয়তো সে কারনেই একটা সময় পর আমি ঢাকায় পাড়ি দেই। কিন্তু তারপরও মনে হয়েছিলো আমি পথহারা পাখি ঠাঁই খুজে পাচ্ছি না। তার কিছুদিন পর আমাকে আশ্চর্য্য করে দিয়ে জানতে পারলাম বাবার ঢাকায় ট্রান্সফার হয়েছে। শিক্ষা বোর্ডে একটা ভালো পদ। নিজেকে তখন যেনো বুঝতে পারি, নিজের মাঝে ছিলো এক অনাবিল আনন্দ। সেই আনন্দকে ছিড়ে ফেলতে যে কতটা কষ্ট হয়েছিলো যেদিন নিজের জানের ভয়ে ইউরোপের পথে পাড়ি দেই। বাবা যেদিন মারা যায় সেদিন যে কি কষ্ট ছিলো বুকে, সেই কষ্টের আঁচড় এখনো বুকে বয়ে বেড়াই।
: এই, কি হলো?
আমার ঘোর কাটলো, ইয়েল্দা লিলিহোলম্যান পার্কিং এ গাড়ি থামিয়েছে। আমার হাত এখনও ঝাকাচ্ছে। আমি চমকে যাবার মতো ওর দিকে তাকাই।
: তুমি ঠিক আছো? আমি কতক্ষন ধরে বকবক করে যাচ্ছি কিন্তু তোমার কোনো সাড়া শব্দ নেই। শফি, কি হয়েছে তোমার?
: কই নাতো? একটু ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। ওহ! আমরা লিলিহোলম্যানে?
: কফি খাবে নাকি তোমাকে বাসায় ড্রপ করে দেবো?
: আরে চলো, কফি খেলে একটু চাঙ্গা হবো।
গাড়ি থেকে বের হয়ে দু'জনে ঢুকলাম ও'হেরীসে। ও'হেরীস কোনো কফির দোকান না, এটা একটা স্পোর্টস বার। আসলে সন্ধ্যার সময় যে কফি খাবো সেটা মাথাতেই ছিলো না যদি সামনে পড়ে যায় এমন জমজমাট কফি বার। ও'হেরীসে ঢুকতেই মনটা চাঙ্গা হয়ে গেলো। কখন যে ইয়েল্দার কোমরে হাত চলে গেলো খেয়াল নেই। ইয়েল্দা হাসছিলো, মাথাটা আমার বুকের সাথে রেখে হাটতে থাকলো আমার হাটার ছন্দে। দু'জনে বসলাম ভেতরের দিকে মুখোমুখি, প্রথমে এক গ্লাস, দু গ্লাস স্টার্ক ওঁল (এক ধরনের বীয়ার) তারপর একটু হুইস্কি, কয়েকটা শট। ইয়েল্দার হাত আমার রানের ওপর চলতে থাকলো। ওর লাল ঠোট দুটো আমাকে চুম্বকের মতো টানতে থাকলো। মাথায় ইয়েল্দার আগামাথাহীন কথা। আফগানিস্হানে ভালো ব্রা পাওয়া যায় না। এজন্য ইজিপ্টে গিয়ে ওর বয় ফ্রেন্ডের সাথে বীচে শুয়ে ছিলো। পরে একা শপিং করতে যায়, শপিং একটু আগে শেষ করে রুমে এসে দেখে ওর বয় ফ্রেন্ড হোটেলের সুন্দরী ওয়েটারকে ব্যাং করছে, এর পর বিয়ে দিয়ে এপ্লাই করা ভিসায় সমস্যা দেখা দেয়, টাকার সমস্যা, ব্লা ব্লা.....ওর কথাগুলো বন্ধ করার জন্য মনে হলো ওর ঠোট বন্ধ করা দরকার। আর জেন্টলম্যান হিসেবে হাত দিয়ে ঠোট বন্ধ করার চাইতে নিজের ঠোট দুটোকেই কাজে লাগালাম।
এরপর ওর বাসায় গেলাম, রাত দুটো পর্যন্ত বেহেড হয়ে ওর অন্তর্বাসের কালেকশন, লালে লাল সব শাহজালাল। ফোনটা বাজছিলো বেশ কিছুক্ষন ধরে, দেখি উদ্ভট নম্বর, নিশ্চয়ই বিদেশী কল(মানে সুইডেনের বাইরে)। পাশে ইয়েল্দা প্রায় নগ্ন হয়েই শুয়ে ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। আমার নেশার ঘোর তখনও কাটেনি। তবু টলতে টলতে বিছানা ছেড়ে দরজাটা অল্প খুলে ব্যালকনিতে রিসিভ করলাম, ওপাশ থেকে পরিচিত কন্ঠ,"হ্যালো, শফি?"
কন্ঠটা শুনে নেশাটা কেটে গেলো। যে দুটো পায়ে দাড়িয়ে ছিলাম, মনে হলো বহুবছর ধরে চলতে থাকা পা দুটো শক্তিহীন অবশ। আমার কাধদুটো যেনো নিজের সাথেই সম্পর্কহীন হয়েআছে। বুকের স্পন্দন বাড়ছে আস্তে আস্তে। রাতের নিস্তব্দ্ধতায় যেনো সেটাও শুনতে পাচ্ছি।
: হুমমম।
: সরি এত রাতে ফোন দিলাম। বাজে একটা স্বপ্ন দেখলাম। খুব অস্হির লাগছিলো।
: কি স্বপ্ন?
: আমি দেখলাম তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো, আমার সন্তানকে অস্বীকার করছো।আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছো।
: আমি কখনো কাউকে গালি দেই না। আর এগুলো স্বপ্ন, স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না।
: আমি জানি, কিন্তু স্বপ্নটা এতটাই বাস্তব ছিলো যে তোমার গালিগুলো শুনে মনে হচ্ছিলো আমার চামড়া, আমার দেহ পুড়ে যাচ্ছে। একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো?
: কর।
: তুমি কি সত্যি বিশ্বাস করো এ বাচ্চা তোমার? সত্যি করে জবাব দেবে প্লিজ।
এই প্রশ্নটা যেন বুকে বিঁধলো। এমনভাবে বিঁধলো ক্ষনিকের জন্য মনে হলো আমার মনটার এরকম অন্যরকম উদাসীভাবটা তালগোল পাকিয়ে গেলো। আমি অনুভব করলাম আমার শিরদাড়া বেয়ে ঠান্ডা কিছু নেমে গেলো, মাথাটা শূন্য হয়ে গেলো কিছু সময়ের জন্য। নিজেকে অপ্রচ্ছন্নভাবে সামলে নিয়ে বললাম,"হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন? একটা কথা বলি। তোমার কথা, আমাদের বাবুর কথা মনে পড়লে বাবার ছবিটা চোখে ভেসে আসে। তুমি জানো বোধ হয় বাবার সাথে আমার খুব বেশী কথা না হতো না কিন্তু আমার কৈশোর কেটেছে পুরোটা তার ছায়ায়। মাফ করো, আমা ভুলহয়ে গেছে। আসলে ইদানিং কেন যেন স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি!"
: আমি বুঝতে পারছি। তোমার এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার এসব কথায় কিছু মনে করো না। আমার শরীরে এমনসব পরিবর্তন, আর সবকিছু এমন তিক্ত লাগছে যে রাতে ভালো ঘুমাতেও পারি না। বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টায় ফ্লাইট।তোমার জন্য কিছু আনবো?
: না, আনতে হবে না।
: তুমি কি সত্যি ভালোবাসো আমায়?
মাইমুনার এ প্রশ্ন শুনে মেজাজটা হঠাৎ বিগড়ে গেলো। ফোনটা কেটে দিলাম। আর কথা বলতে চাইছিলো না।মন চাইছিলো এই পিচঢালা হাইওয়ে বরাবর হাটতে থাকি। হিসাবটা গন্ডগোল হয়ে গেছে। এত বড় গন্ডগোল যা এখন আর শুধরাবে না।
রুমে ঢুকে গায়ে কাপড় জড়িয়ে ইয়েল্দাকে না জাগিয়েই বেরিয়ে গেলাম। প্রচন্ড ঠান্ডা জ্যাকেট ছিদ্র করে আমার সারা শরীরে জমিয়ে ফেলছে। রাতের বেলা ইদানিং বেশ ঠান্ডা পড়ে তার সাথে যুক্ত হয় উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসা কনকনে হাওয়া। কিন্তু মাথার ওলটপালট আমার সমস্ত অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিচ্ছে। মনে হতে লাগলো আমার সাথে লেপ্টে থাকা নিজের ছায়াটাও আমাকে ভর্ৎসনা করছে, অভিসম্পাৎে জর্জরিত করছে।
পালানো দরকার।
এত অকেপট সত্য কেঊ বলেনা । যতই আপনার লেখা পড়ি, ততই মুগ্ধ হই । সত্যই লেখকের অন্ত্রে কখনো পাপ,নীচতা, নোংরামি থাকেনা । ধ্ন্যবাদ ।
আপনাকেও ধন্যবাদ
পাল্টানো দরকার।
সেটাই ভাবছি দিনভর
আপনার লেখা পড়লে মনে হয় "মাসুদ রানা" সিরিজ পড়ছি। এতো বছর ইউরোপ আছি, বাসার সামনের রাস্তাই ঠিক করে চিনি না আর আপনারতো দেখি অসাধ্য কিছুই নেই। যা ইচ্ছে হচ্ছে, হাসিল হচ্ছে। ব্র্যাভো
কথার টোনটা ধরতে পারলাম না
সত্যি একদিন দিগন্ত ছুতে বেরিয়ে যেতে ইচছা করে
মাঝে মাজে আমারও মনে হয় দিগন্ত ছুঁতে বেরিয়ে পড়ি। ভালো লেখেছেন।
মন্তব্য করুন