ইউজার লগইন

শিথিল বাঁধন

ইদানিং মাঝে মাঝেই হারিয়ে যাই আমার অতীত সময়ে। বাবা আমাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়তেন। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে মাকে বাসায় রেখেআমরা ঘুরতে চলে যেতাম। এটা এলাকার ভেতর কারো বাড়ি বা অফিসের কাজকর্মের জন্য রাজশাহী সদর বা ঢাকা যাওয়া নয়, এটা ছিলো কোনো নাম না জানা গ্রামে ঘুরতে যাওয়া। সেখানে দিনভর ঘুরে তিনি ছোটবেলার বন্ধুদের খুজে বের করতেন। কয়েকদিন কাটাতাম, তারপর ফিরে আসতাম। বাড়ি এসে মনে হতো সময়টা থেমে ছিলো, কিছুই বদলায়নি যেন। বইয়ের পাতা যেখানে খোলা রেখে গিয়েছিলাম, সেটা সেভাবেই পড়ে আছে। জানালার ওপাশে যে ঘুড়িটা কলাগাছের পাতায় ঝুলে ছিলো সেটা বাতাসে সামান্য ছিড়েছে। খাবারের টেবিলে গ্লাসের পানিটা অর্ধেক পড়ে আছে।

মা তখন এত কথা বলতেন না, চুপচাপ থাকতেন। কেন যেনো মনে হতো বাবার সাথে যৌবনে তাদের বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক ছিলো না। এটা ছিলো অনেকটা অসীম শ্রদ্ধা এবং পারস্পরিক অবিচ্ছেদ্যতার এক জটিল সংমিশ্রন। হয়তো এ কারনে সম্পর্ক জিনিসটা আমার কাছে একটা কঠিন সমীকরন হয়েই আছে চিরটাকাল। পালিয়ে বাঁচতে চাই কিন্তু একটা অদৃশ্য বাঁধন বার বার আমাকে আটকে রাখে।

একবার সিলেটের কাছাকাছি একটা গ্রামে গেলাম বাবার সাথে। গ্রামে এসেই প্রথম ধাক্কা যেটা খেলাম সেটা হলো ওখানকার অধিকাংশ ঘর মাটির তৈরী। মাটি দিয়ে ওয়াল আর ওপরে অন্যান্য সাধারন ঘরের মতোই মাচা তার ওপর বাঁশের খাচা করে ছাউনি দেয়া। তখন বর্ষাকাল ছিলো। যখন তখন বৃষ্টি আর রোদ গায়ের খোলা অংশে পড়লে মনে হতো চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম,"বাবা বৃষ্টিতে ঘরগুলো ভেঙ্গে যায় না? মানুষ থাকে কিভাবে? পোকা, পিপড়া ধরে না?" বাবা শুধু হাসতেন।

আমাকে নিয়ে বাবা গেলেন সেখানকার এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, একজন শিক্ষকের সাথে দেখা করতে। খবর নিয়ে জানা গেলো যে শিক্ষককে বাবা খুজছিলেন তিনি সেদিন আসেননি, অসুস্হ। বাবা তার বাড়ির ঠিকানা নিলেন, আমাকে নিয়ে সোজা চলে গেলেন গ্রামের হাটে। হাটটা ছিলো অল্প পরিসরে শান্ত ছিমছাম। খুব একটা ব্যাস্ততা ছিলো না তবে টাটকা শাক সব্জী আর পাশে মাছবাজারের গন্ধ যেনো চিরচেনা আমেজটার ধরা দেয়। মুদীর দোকানের সামনে চা খেতে আসা লোকজন চা শেষ করে রেডিওর খবর শুনছে, গান শুনছে, অদ্ভুত সিলেটি ভাষায় কথা বলছে। আমার কাছে মনে হতে লাগলো একটা নতুন দেশে এসেছি।

বাবা এক প্যাকেট মিষ্টি কিনে আবার রওনা দিলেন সেই শিক্ষকের বাসার পানে। গ্রামটাতে এতবেশী গাছ ছিলো যে আকাশ মাঝে মাঝে দেখা যেতো না। সেদিন আকাশ পরিষ্কার ছিলো কিন্তু পুরো গ্রামটাই যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন। কোথাও যেতে হলে নির্দিস্ট কোনো পথ নেই, বাসার আঙ্গিনা পেরিয়ে ডোবা, তার ওপর সাঁকো, এর পর হয়তো একটা ছোট খালি জায়গা। সেই খালি জায়গাটা আবার আশে পাশে ঘন বিশাল গাছের সারির ছায়ার কারনে মনে হতো সন্ধ্যে গড়িয়েছে। আমরা হাটতে একটা মাটির বাড়ির সামনে এসে দাড়িয়ে পড়লাম। বাবা কাঁপা কন্ঠে বলতে থাকলেন,"শোন, আমরা যার সাথে দেখা করতে এসেছি সে আমার খুব আপন, তাকে তুমি কাকা বলে ডাকবা। অবশ্যই সালাম দিবা।" আমি বাবার চোখের দিকে তাকালাম, চোখ দুটো ভেজা।

এমন সময় সে বাড়ি থেকে একজন খোড়া লোক, গায়ে পাঞ্জাবী পড়া, চুলগুলো ব্যাকব্রাশ, বেরিয়ে এলেন। বাবার সামনে দাড়িয়ে চশমার ফাঁক গলো অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকলেন, চিনতে পেরে বাবাকে জড়িয়ে ধরলেন। বহুদিন পর পুরোনো বন্ধুকে খুজে পেলে যা হয় আর কি। আমার দিকে তাকাতেই বললেন,"আরে আমার ভাতিজা দেখি অনেক বড় হয়ে গেছে। আয়, আয় ভেতরে আয়।" আমাকে প্রায় বুকে জড়িয়ে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন।

সেই প্রথম আর সেই শেষবার আমি মাটির ঘরে ঢুকেছিলাম। ভেতর থেকে এত বিশাল এটা বাইরে থেকে ধারনা করার উপায় ছিলো না। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো রুমের কোনোয় একটা মাটির সিড়ি আছে যা দিয়ে ওপরের তলায় ওঠা যায়। ওপরে বাশের মাঁচা। আমি ওপরে উঠে দেখি সেটাও আরেক তলা। ওপরে ছাদ। পুরো ঘরটা খুবই শীতল। রাতের বেলা খেতা গায়ে দিয়ে শুয়েছিলাম।

রাতের বেলা বিশাল খাবারের আয়োজন করা হলো। পোলাও, বিশাল রুই মাছের তরকারী, মুরগীর তরকারী, মসুরীর ডাল আর খাওয়া শেষে পায়েষ। গলা পর্যন্ত খেয়ে ফেললাম। বাবা আমাকে বললো," তোর এই কাকু কিন্তু সত্যিকারের কাকু। তোর খ্যাপাটে দাদুর সাথে রাগ করে সেই যে চলে গেছে আর দেখা করেনি। মাঝে মাঝে চিঠি লিখতো আমাকে। তোর এই ইসমাইল কাকু অংকের জাহাজ আর খুব ভালো বাঁশিও বাজায়।"

আমি জিজ্ঞেস করলাম,"কাকা, আপনার পায়ে কি হয়েছে?"

তখন ইসমাইল কাকা পায়ের লুঙ্গিটা একটু খানি উঠিয়ে দেখালেন একটা বিশাল কাটা দাগ। ৭১ এ যুদ্ধে গিয়েছিলেন। সারা জীবন উত্তর বঙ্গে বড় হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন ঝিনাইদহে। তো এই কাটা দাগ কোনো গুলির দাগ না। এতো ডোবা আর পানির এলাকার মধ্যে একদিন রাতে পাকিস্তানীরা ধাওয়া করলে ডোবায় নলখাগড়া লেগে পা কেটে যায়। তার রক্তে পুরো ডোবা লাল হয়ে যায়। তখন তার সাথের গুলা তাকে ছেড়ে পালিয়ে যায় আর সে ঐ ডোবায় মরার মতো পড়ে থাকে। পাকিষ্হানীরা ডোবায় তার দেহ আর রক্ত দেহ বুঝে নেয় যে তাদের গুলিতে মুক্তি মারা গেছে। পাকিস্হানীরা চলে গেলে সে যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নামেনি। যুদ্ধ শেষ হলে সোজা বাড়ি আসে, ৭২ তে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় গনপাশ করে। ডিগ্রীটা কোনোমতে শেষ করে দাদার সাথে ঝগড়া করে এখানে চলে আসে।

গল্প শেষ হলে ইসমাইল কাকা উঠোনে পাটি বিছিয়ে আমাদেরকে বাঁশির সুর শোনান। আমি আকাশে উদাস হয়ে পূর্নিমার নিটোল গোল চাঁদ দেখছিলাম। ইসমাইল কাকু বাঁশির সুরের ফাঁকে ফাঁকে বলছিলো পরদিন বৃষ্টি হবে কারন চাদের আলোর চারপাশে রঙ্গিন একটা বলয়।

তার পরদিন প্রচন্ড বৃষ্টি হলো, আমরা সেই বৃষ্টি মাথায় করে বাড়ি ফিরলাম। তার কয়েকবছর পর কোনো এক শুক্রবার সকালে শুনতে পেলাম কাকু মারা গেছেন। দাদু শুধু একটু কেঁদেছিলেন। তারপর জুম্মার নামাজের জন্য ওজু করে মসজিদ পানে চলে গেলেন।

আমরা আমাদের রক্তের শিকড় নানা দিকে ছড়িয়ে দেই, মাঝে মাঝে ভুলে যাই কোথায় গিয়ে শেষ হলো অথবা কোথা হতে শুরু। হঠাৎ মহীরুহ বিশাল একটা ধাক্কা খেলে শেকড়ের প্রতিটা স্তর তার অস্তিত্বকে জানান দেয়, ঠিক তেমনি যখন কেউ হারিয়ে যায়, তখন মহীরুহও এক সময় ক্লান্ত হয়, থুবড়ে পড়ে।

পোস্টটি ১৭ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

এ টি এম কাদের's picture


সিমপ্লি দারুন !

দূরতম গর্জন's picture


ধন্যবাদ

উচ্ছল's picture


আমরা আমাদের রক্তের শিকড় নানা দিকে ছড়িয়ে দেই, মাঝে মাঝে ভুলে যাই কোথায় গিয়ে শেষ হলো অথবা কোথা হতে শুরু।

----------অসাধারণ

দূরতম গর্জন's picture


ধন্যবাদ

সারাহ্‌'s picture


ভালো লেগেছে।

দূরতম গর্জন's picture


জেনে ভালো লাগল

আরাফাত শান্ত's picture


এইটা টুউ গুড ছিল!

দূরতম গর্জন's picture


প্রশংসায় আপ্লুত হলাম

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


এই লেখাটা অনেক বেশি ভালো হইছে, আপনের লেখার প্রতি প্রত্যাশা কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিলেন।

ভালো থাকেন, অনেক ভালো। সবসময়।

১০

দূরতম গর্জন's picture


আপনিও ভালো থাকবেন

১১

জাহিদ জুয়েল's picture


মাঝে মাঝে সত্যি ভুলে যাই কোথায় গিয়ে শেষ হলো অথবা কোথা হতে শুরু। এক কথায় অসাধারন Smile
এই নিয়ে চারবার পড়লাম, তবুও আবার পড়তে ইচছা করছে......।

১২

দূরতম গর্জন's picture


অর্থহীন ছাইপাশ ৪ বার পড়েছেন শুনে কি লিখবো তার ভাষা খুজে পাচ্ছি না

১৩

তানবীরা's picture


ভাল লেগেছে।

১৪

দূরতম গর্জন's picture


ধন্যবাদ

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

দূরতম গর্জন's picture

নিজের সম্পর্কে

মহাশূন্যের গুন গুন শুনতে চাই, কান পেতে রই তারাদের আহ্বানে। দূরতম গর্জন যখন সৈকতে আছড়ে পড়ে, আমি পা ফেলে উপভোগ করি সাগরের কূর্ণিশ। মানুষ হয়ে জন্মাবার অহংকারই শুধু বিদ্যমান, অথচ নিত্য বেচে আছি তেলাপোকার শৌর্য্যে!