রক্তাক্ত পঁচাত্তরঃ চারটি অবশ্যপাঠ্য বই
বিখ্যাত তর্জনী উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধু
যে কোন কারনেই হোক, গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর গঠন ও ক্রমবিকাশ নিয়ে যৎকিঞ্চিত পড়াশোনা করছি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট আমাদের এই প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতা পরবর্তী এক দশকে নানাবিধ চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তবেই আজকের অবস্থানে এসেছে । এই পুরো দশকের মাঝেও আবার ’৭৫ এর মধ্য আগষ্ট থেকে নভেম্বরের প্রথমভাগ পর্যন্ত এই পৌনে তিনমাস সবচেয়ে বেশি ঘটনাবহুল। এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একের পর এক মোড় ঘুরিয়ে দেয়া তিনটি অভ্যুত্থান ঘটেছে এ সময়ে।
১৫ আগষ্ট, ৩ নভেম্বর এবং ৭ নভেম্বর।
সামরিক বাহিনীর ছোট-বড় বিভিন্ন অংশ এই অভ্যুত্থানত্রয়ের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল। ফলে, এদেশের সামরিক বাহিনীর ক্রমবিকাশ, এর ভেতরে-বাইরের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও সামরিক নেতাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় উত্থান-পতনের পথরেখা অনুসরনে এই অভ্যুত্থানত্রয়কে সামনে-পেছনে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে দেখার কোন বিকল্প নেই; সাথে সাথে এও মনে রাখতে হবেযে, এই দর্শন হতে হবে পুরোপুরি নিরাবেগ, ব্যক্তিনিরপেক্ষ এবং ইতিহাসের দাবীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
জেনারেল জিয়া: যখন রাষ্ট্রপতি
সন্দেহ নেই, বিগত সাড়ে তিন দশকে এর উপর বাঙলা-ইংরেজী মিলিয়ে অসংখ্য বিশ্লেষনধর্মী বই প্রকাশিত হয়েছে। এদের মধ্য থেকেই আমি স্বল্পজ্ঞানে আলাদা করে চারটি বাঙলা বই বাছাই করেছি।
বইগুলো হচ্ছেঃ
১. এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্যঃ স্বাধীনতার প্রথম দশক- মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীরবিক্রম; মাওলা ব্রাদার্স।
২. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর- কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীরবিক্রম; সাহিত্য প্রকাশ।
৩. তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা- লে. কর্নেল এম. এ. হামিদ; মোহনা প্রকাশনী।
৪. পঁচাত্তরের রক্তক্ষরণ- মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম; আফসার ব্রাদার্স।
এদের বাছাইয়ের কারন হিসেবে প্রথমেই যেটি বলতে হয়, সেটি হচ্ছে, এঁরা প্রত্যেকেই বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর একেবারে প্রথম দিককার কর্মকর্তা-এর ক্রমবিকাশের সাথে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিবর্গ। লে. ক. হামিদ বাদে বাকি তিনজনই খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। মে. রফিক ১৯৭২ সালেই অবসর নিলেও বাকি তিনজন '৭২-'৭৫ সামরিক বাহিনীর কেন্দ্রস্থলে ঢাকা সেনানিবাসে বসেই ঐ তিনটি অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ পেয়েছেন। ফলে, অন্যের কাছে না শোনা কথা না লিখে একেবারে স্বীয় অভিজ্ঞতাই তুলে এনেছেন এতে। দ্বিতীয়তঃ কর্নেল জামিল বাদে এঁরা কেউই অভ্যুত্থানগুলোর সাথে জড়িত ছিলেন না। কর্নেল জামিলও কেবল ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তৃতীয়তঃ এঁরা কেউই অভ্যুত্থানগুলোর বেনিফিশিয়ারী ছিলেন না, বরং উল্টোটাই ঘটেছে- অভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে কম-বেশি এঁদের সামরিক জীবনের ইতি ঘটেছে। ফলে, অন্যান্য বইগুলোতে যেখানে মূল ঘটনার সাথে অনাবশ্যক কৈফিয়ত ও দোষারোপ মিশ্রিত থাকে, সেখানে এই বইগুলো এই প্রকারের কৈফিয়ত ও দোষারোপের মিশ্রন থেকে অনেকটাই মুক্ত।
জাতীয় চার নেতা: ৩ নভেম্বরের বলি
১৯ মার্চ ’৭১ এ বিখ্যাত জয়দেবপুর বিদ্রোহের নায়ক সদ্য প্রয়াত মে. জে.(তৎকালীন মেজর) মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীরবিক্রম সম্ভবতঃ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা প্রথম সামরিক কর্মকর্তা। এদেশের সামরিক বাহিনীতে তাঁর মত নিষ্ঠাবান ও চৌকস কর্মকর্তা বিরল। সামরিক জীবনকে রাজনীতির উর্ধ্বে রাখার প্রত্যয়ে তিনি ’৭৫ এ সহকর্মীদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে মারামারি চলাকালীন সময়ে ক্ষমতার খুব কাছাকাছি বসে থেকেও নির্লিপ্ত থেকেছেন যার মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছে পছন্দের সামরিক জীবন থেকে বহুদূরে দীর্ঘ ১৬ বছর দেশের বাইরে প্রেষনে রাষ্ট্রদূতের চাকরি করে। সত্যি সেলুকাস! যাই হোক, তাঁর বইয়ে তিনি একেবারেই নির্লিপ্তভাবে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর সে সময়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। যা তিনি দেখেন নি, তা নিয়ে অপ্রয়োজনীয় কল্পনার রঙ চড়ান নি। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। অসাধারণ সামরিক নেতা হিসেবে জিয়াউর রহমানের প্রশংসা করেছেন। সেনানিবাসে প্রতিবেশী হওয়ায় জিয়া পরিবারের সাথে তাঁর পারিবারিক সম্পর্কও তুলে ধরেছেন। তাই বলে, নির্মমভাবে তাঁদের ভুলগুলো তুলে ধরতেও কার্পন্য করেন নি। ঐ তিনটি অভ্যুত্থানের সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত সকল ব্যক্তি ও নিয়ামকের পূর্বাপর বিশ্লেষন করেছেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়। বিশেষ করে, ‘দ্য রেইপ অভ বাঙলাদেশ’ এর বিখ্যাত লেখক অ্যান্থনী মাস্কারেন্সকে তথ্যগত বিভ্রান্তির অভিযোগে একেবারে ধুয়ে দিয়েছেন। দারুন সুখপাঠ্য বই।
‘৭৫ এ কর্নেল শাফায়াত জামিল ছিলেন ঢাকাস্থ ৪৬ বিগ্রেডের অধিনায়ক। মেজর ফারুক এবং রশীদ এই ব্রিগেডেই সে সময় কর্মরত এবং তাদের নেতৃত্বে এ ব্রিগেডের সৈন্যদের একাংশই ১৫ আগষ্ট অভ্যুত্থানে অংশ নেয়। সেনাপ্রধান মে. জে. শফিউল্লাহ তাঁকেই সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর সাহায্যার্থে সৈন্য পাঠাতে ফোন করেন, যা শেষপর্যন্ত পালিত হয় নি। মেজর রশীদ তাঁর কাছেই এসে প্রথম বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সংবাদ দেয়। আবার, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের অত্যন্ত ঘনিষ্ট হিসেবে জামিল ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ফলশ্রুতিতে, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে চাকুরিচ্যুত ও বিচারের সম্মুখীন হন। এ সকল কারনে তাঁর সাক্ষ্য ঐ সময়কার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্য। না পড়লে মিস হবে।
জিয়ার দুই পাশে কর্নেল তাহের ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ-সকলেই দূঃখজনক পরিণতির শিকার
১৫ আগষ্ট অভ্যুত্থানকালে ঢাকার স্টেশন কমান্ডার এবং পরবর্তী দুই অভ্যুত্থানকালে ঢাকার লগ এরিয়া কমান্ডার লে. ক. হামিদ পাকিস্তান প্রত্যাগত কর্মকর্তা। ’৭২ সালেই তিনি সপরিবারে পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। পাকিস্তানের কাকুল সামরিক একাডেমীতে জেনারেল শফিউল্লাহ ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের কোর্সমেট এই কর্মকর্তা জিয়ার খুবই ঘনিষ্ট(তুই-তোকারি সম্পর্কের) বন্ধু ছিলেন। এছাড়া, পাকিস্থান বাহিনীতে থাকাকালে জেনারেল এরশাদের সাথেও তাঁর সম্পর্ক ছিল। ফলে, এ সময়ের অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। সেগুলো তিনি অকাতরে বর্ণনা ও বিশ্লেষন করেছেন দারুন ভাষায়। জিয়াউর রহমানের সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহনের পর সেনাবাহিনীতে জে. এরশাদ ও জে. শওকতের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও অন্যান্য কারনে একের পর এক বিদ্রোহ দমনে জিয়ার ভুল পদক্ষেপের সরাসরি সমালোচনা করতে গিয়ে অপমানিত হলে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। ভাল কথা, এই ভদ্রলোক সনামধন্য ফুটবলার কায়সার হামিদের বাবা।
সর্বশেষ বইটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে লেখা নয়। তারপরেও এখানে এনেছি এর অথেন্টিসিটির জন্য। নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের এই সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধের উপর বস্তুনিষ্ঠ লেখকদের মাঝে প্রথম সারির। বিভিন্ন সহায়ক বই ও সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে রচিত এই বইয়ে ’৭৫ এর তিনটি অভ্যুত্থানের ঘটনাপ্রবাহ, কার্যকারন এবং দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের চেহারা উন্মোচন করেছেন। ছোট্ট পরিসরে ঐ সময়কে বোঝার জন্য এই বইটিই যথেষ্ট। পড়ার আমন্ত্রন রইল।
আপনার উদৃত করা ৪টি বই-ই সামরিক বাহিনীতে কর্মরত সামরিক সদস্যদের দ্বারা লিখিত। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের লেখা বই যে নির্ভরযোগ্য হতে পারবেনা সেটা না। কথা হল আপনি সাথে কয়েকজন বেসামরিক লেখকের বই ও সাথে পড়েন। তাহলে হয়তো আপনার পঠিত তথ্যগুলো ক্রস চেক হবে।
পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ।
অন্য বইগুলো পড়া হয় নি এমন নয়।
তবে, যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা প্রণীত এই বইগুলো বাছাই করেছি, তা তালিকার নিচেই ব্যাখ্যা করেছি।
আবার, ক্রস চেক করেই এগুলোকে বেশি বস্তুনিষ্ঠ বলে মনে হয়েছে। অবশ্য, কিছু ভাল বই বাদ যেতে পারে। সেটি আলোচনায় উঠে আসতে পারে।
আপনার লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো।কিন্তু একই লেখা অন্য একটা ব্লগেও দেখলাম।এবির নীতিমালা অনুযায়ীঃ
গ. "আমরা বন্ধু" তে শুধু নতুন লেখাই প্রকাশিত হবে। পুরনো লেখা রিপোস্ট করা যাবে না। অন্য কোনো কম্যুনিটি ব্লগে প্রকাশিত লেখা এবিতে প্রকাশ নিষিদ্ধ। এবিতে প্রকাশিত কোন লেখা ৪৮ ঘন্টার মধ্যে অন্য কোনো কমিউনিটি ব্লগে প্রকাশ করা যাবে না। ব্যক্তিগত ব্লগ এবং পত্রিকা এই নিয়মের আওতার বাইরে।
মডু আসার আগে কিছু একটা করেন।
নীতিমালাটি জানা আছে।
সে কারনেই অন্য লেখাগুলো এখানেই প্রথম পোষ্ট করেছিলাম।
আপনাকে ধন্যবাদ।
এই লেখাটায় যে তালিকাটি দিয়েছি তা আলোচনার দাবী রাখে - এমন ভেবেই হঠাৎ করে পোষ্ট করে দিলাম।
মডারেটর আপত্তি জানালে সরিয়ে নেব-সমস্যা নেই।
মডু এসে যা ইচ্ছা করুক আমি এটারে প্রিয়তে নিয়ে রাখছি।
কারন বইগুলো পড়তে চাই।

দারুণ তথ্যবহুল পোস্ট। বইগুলো পড়তে হবে।
ধন্যবাদ।
আলোচনা শোনার অপেক্ষায়। নির্মলেন্দু গুণের রক্তাক্ত নভেম্বর পড়ার জন্য যোগাড় করেছি। তায়েফ ভাইরে ইরাম পোস্টের লিগা বিশেষ ধইন্যা।
আপ্নেরে ওয়েলকাম!
তোমার পড়ে হলে রেখে দিও, আমি পড়ব। আমাকে দিয়ে দিও
৮১ পর্যন্ত সব ঘটনা নিয়ে লেখা বইগুলোর একটা পুর্নাঙ্গ তালিকা করার ইচ্ছা আছে।
ভাবছিলাম এইটা নিয়াই, আর দেখি এই পোস্ট।
আপনি তালিকাটা দিয়ে দ্যান।
আমার কাছে এই চারটা বেশি ভাল লেগেছে।
বই গুলা পরা হয়নি
সুযোগ থাকলে পড়ে ফেলুন।
সামরিক বাহিনীর লোকেদের লেখায় আমার কখনোই কোনো আগ্রহ ছিলো না। বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেও পড়তে ইচ্ছে হয়নি। এখন ভাবছি সুযোগটা হেলায় হারালাম।
ব্যাপার না।
আলোচনা ভালো লেগেছে।
ধন্যবাদ।
আপনার পোস্টটি জনগুরুত্ব সম্পন্য অথবা মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কোন পোস্ট নয়। নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় পোস্ট প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে দেয়া হলো। তবে আপনার পাতায় যথারীতি প্রদর্শিত হবে।
নীতিমালা রক্ষার প্রতি আপনাদের আন্তরিকতা দেখে খুশী হলাম।

উক্ত পদক্ষেপ আরো আগেই নিলে ভাল হোত। ২৪ ঘন্টার বেশি সময় ধরে নীতিমালাবিরুদ্ধ কাজ জারি রাখা ঠিক হয় নি।
পরবর্তীতে ও এই শ্রদ্ধাটুকু ধরে রাখবেন-এই আশা রাখছি।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন