ইউজার লগইন

একজন ধনী মানুষের গল্প

হা জিন। চাইনিজ আমেরিকান গল্প লেখক। সমকালীন মার্কিন সাহিত্যে তার নামডাক আছে। বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। জন্ম ১৯৫৩ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লব চলতে থাকা চীনের লিয়াওনিং শহরে। তিয়েনয়ানমেন স্কয়ারে বিদ্রোহের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। ঐ সময়েই চীন থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। বর্তমানে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক তিনি। অনুবাদিত গল্পটা তার আন্ডার দ্যা রেড ফ্ল্যাগ বই থেকে নেয়া হয়েছে।

একজন ধনী মানুষের গল্প

আমাদের শহরের সবচে ধনী লোক লি ওয়ান। একসময় সেনাবাহিনীর চিকিৎসক ছিলো, ১৯৬৩’এ সেখান থেকে অব্যাহতি নেয়। তখন থেকেই একটা কমিউন হাসপাতালে আছে সে, তার স্ত্রী’ও একই জায়গায় সেবিকা হিসাবে চাকরী করে। তার একটা ডাকনাম আছে, দশ হাজারী, ব্যাংকে জমানো টাকার সাথে মিলিয়ে এমন নামকরণ। এর আগে তার অন্য একটা ডাকনাম ছিলো: মানুষ তখন তাকে হাজারী নামে ডাকতো, কারণ ঐসময়ে তার সঞ্চিত টাকার পরিমান পাঁচ অংকে পৌছয়নি।
লি বেশ কৃপণ ছিলো। সারা শহরেই তার কার্পণ্য নিয়ে কথা হতো। অনেক ছোটো ছোটো গল্প প্রচলিত ছিলো তাকে নিয়ে: সে টুথপেস্ট আর সাবানের বদলে সোডা ব্যবহার করে; স্ত্রীর জন্য সে নিয়ম জারী করে রেখেছিলো, নুডলসে যেনো চারটার বেশি ছোট চিংড়ি শুটকি না দেয়া হয়, সিগারেটের প্যাকেট না কিনে সেএকেকবারে চার’টা কি পাঁচ’টা কিনতো; টয়লেট পেপারের বদলে বাড়িতে খড়-বিচালী জমিয়ে রাখতো। মিতব্যয়িতা অবশ্যই একটা গুন। প্রায় সব বাড়ির কুলুঙ্গীতে রাখা উঠোনে চাষবাসের উপর পুস্তিকার শেষ পৃষ্ঠায় যেমন লেখা আছে,
একমুঠো শষ্য বাঁচাও প্রতি বেলা,
বছর গেলে জমবে তোমার এক ডালা।

কিন্তু তার মাসিক বেতন ছিলো ১১০ ইউয়ান, যা একজন সাধারণ শ্রমিকের প্রায় দ্বিগুণ। দুহাতে টাকা উড়ানোর ক্ষমতা রাখতো লি। অথচ বাজারে গিয়ে সে যেনো অনেক দাম দিয়ে ষাড় কিনছে এমন করে ডিম কিংবা সব্জী নিয়ে দামাদামী করতো, যা তাকে একেবারেই মানায় না। পাড়া-প্রতিবেশীর জন্য সে কালে ভদ্রে কোনো কিছু করতো, একটা বাচ্চা কখনো তার কাছে পেন্সিলের আশা করে না বা উৎসবে-পার্বণে কোনো বুড়োকে সে একটুকরো আঁখও খেতে দিয়েছে এমন শোনা যায় না। কখনোই সে এমন কিছু করে নি। মানুষের উপকার করার শিক্ষাটাই যেনো সে কখনো পায়নি। একজন স্বচ্ছল লোকের এমন কৃপণ স্বভাব ধরে রাখতে পারাটা বেশ কঠিন।

খুব কম মানুষ একই সাথে সামাজিক ও ধনী হওয়ার ক্ষমতা রাখে। লি ওয়ানের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিলো। যদিও চরিত্রগতভাবে তার খরুচে হওয়াটাই স্বাভাবিক। লি’র সংগ্রহটা অবশ্য খারাপ ছিলো না – একটা চকচকে সুতীক্ষ্ণ তলোয়ার, শহরের একমাত্র দোনলা বন্দুক, একটা জার্মান ক্যামেরা আর ইয়েলো রিভার মোটরসাইকেল। ডিসমাউন্ট দূর্গে কেবল আরেকজনের মোটরসাইকেল ছিলো, কিন্তু সার কারখানায় ওয়েল্ডিং বিভাগের চাকুরে লোকটা ছিলো ভীষণ বোকা। সে লোক দেখাতেই তার মোটর সাইকেল দাবড়ে বেড়াতো আর অপরিচিত মেয়েদের কাছে নিজের পরিচয় দিতো ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। কিন্তু লি’র ক্ষেত্রে এই জিনিসগুলি ছিলো যক্ষের ধনের মতো। কাউকে সে তার মোটর সাইকেল ছুঁতেও দিতো না চড়তে দেওয়া তো দূরের কথা।

উচু-নীচু বৈষম্যহীন সমাজে দুঃখবোধের কোনো জায়গা নেই; ধনী-গরীব ভেদাভেদ না থাকলে পরিপূর্ণতা নিয়ে বেঁচে থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রাচীনকালের কথাগুলোয় আসলেই অনেক বিবেচনাবোধ ছিলো। শহরের সব মানুষ অপছন্দ করতো লি’কে, তার রুঢ় আর কৃপণ স্বভাবে সবাই বেশ বিরক্ত ছিলো। অন্ততঃ লি’র মতো মানুষ কখনো সন্তানের আশা করতে পারে না, এই সিদ্ধান্তে কারো দ্বিমত ছিলো না।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু হওয়ার পর শহরের সবচে শক্তিশালি দুটি গণসংগঠন, মাওবাদীদের দল আর মাও জেদংপন্থী লীগ উভয়েই লি’কে দলে টানার চেষ্টা করেছিলো। এই টানাটানিতে কিন্তু টাকা পয়সা নয় বরং অতীতে তার বিপ্লবী বাহিনীর সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতাই ছিলো একমাত্র বিবেচনা। যে গণসংগঠন ধারালো তলোয়ার, বন্দুক, গ্রেনেড আর মাইন নিয়ে শ্রেণী শত্রুদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো, তার জন্য লি’র মতো চিকিৎসকের অনেক প্রয়োজন। লি কিন্তু কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে দুদলকেই ফিরিয়ে দিলো; উৎসাহী তরুণের দল রীতিমতো ফুসে উঠলো। চেয়ারম্যান মাও যেমন বলেছেন, “যদি তুমি জনগণের বন্ধু না হও, তবে তুমি জনগণের শত্রু”।

স্বাভাবিক ভাবেই মাও জেদংপন্থী লীগের কিছু সদস্য লি ওয়ানকে কি করে শাস্তি দেয়া যায় তা নিয়ে পরিকল্পণা করতে শুরু করলো। গরীব কৃষক পরিবারের সন্তান, একসময়কার পার্টি সদস্য আর সাদা চোখে বামপন্থী লি’কে ফাসানোটা যদিও ততোটা সহজ ব্যাপার ছিলো না। তবু তারা হাল ছেড়ে না দিয়ে তং ফেই নামের এক তরুণকে তার উপর নজরদারীর দায়িত্ব দিয়ে তক্কে তক্কে থাকলো। যখন সারা শহর বিপ্লবী দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত, এমন সময়ে একটা লোক সপ্তাহান্তে মোটর সাইকেল দাপিয়ে পিঠে চকচকে তলোয়ার আর বন্দুক ঝুলিয়ে রঙীন তিতির শিকারে যাচ্ছে এটা কীভাবে মেনে নেয়া যায়?

এক বিকালে তং উত্তেজিত হয়ে লীগের প্রধান কার্যালয়ে ঢুকে ভাইস ডিরেক্টর জিয়াও লুমিংসহ আরো বেশ কিছু নেতার সামনে হাজির হয়ে ঘোষণা করলো, “এবার লি হাজারীকে বাগে পাওয়া গেছে!”

সে একটা কাগজের পোটলা টেবিলের উপর রেখে খুলতে শুরু করলো। সেখান থেকে মাওয়ের ছবিওয়ালা একটা ভাঙা ব্যাজ বের হলো। সবাই হা হুতাশ করে উঠলো হাস্যোজ্জ্বল মাওয়ের এমন ভঙ্গুর পরিণতি দেখতে পেয়ে। উদ্বিগ্ন হয়ে জিয়াও স্বয়ং জিজ্ঞেস করলেন, “ কোথায় পেলে এটা!”
“ লি হাজারী ভিক্টরী রেস্তোরাঁ’র সামনে রাখা ময়লার গাঁদায় ছুড়ে ফেলেছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি!” গর্বিত ভঙ্গীতে বললো তং।

এমন ধৃষ্টতা কিভাবে মেনে নেয়া যায়! তারা সেদিন সন্ধ্যায় লি ওয়ানের বিচারের সিদ্ধান্ত নিলো।
একজন আহত পাথরশ্রমিকের দেখভাল করতে গিয়ে হাসপাতাল থেকে বেশ খানিকটা দেরী করে বের হলো লি। ছয়জন লীগকর্মী অপেক্ষায় ছিলো লি’র বাড়ির সামনে। তাকে গলির মোড়ে দেখতে পেয়েই তারা এগিয়ে গেলো, আর বেশ শক্ত গলায় বললো, “ আমরা তোমাকে একটা মিটিঙে নিয়ে যেতে এসেছি”।

“কীসের মিটিং?” রাগে ঠোট কামড়াতে শুরু করলো লি।
“তোমার বিচারের মিটিং”
“আমার বিচার! আমি কি প্রতিবিপ্লবী, শ্রেণী শত্রু নাকি?”
“হ্যা তুমি তাই। ভান করা বন্ধ করো। আমরা সবাই জানি তুমি চেয়ারম্যান মাওয়ের ছবিওয়ালা ব্যাজ ভেঙেছো”।
“আমি কেনো ভাঙতে যাবো! পোর্সেলিনের ব্যাজটা শক্ত মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেছে”।
তার কথায় লোকগুলো একেবারেই পাত্তা দিলো না। জোর করে ধরে তাকে কার্টার ইনের সামনে দলের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে গেলো। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা যখন আছে, তখন কেনো একটা শুয়ে থাকা ছায়াকে ভয় পাবো, ভাবতে থাকলো লি। সেনাবাহিনীতে যখন ছিলো তখন এমন ঘটনা বহু দেখেছে সে আর তার বন্ধুদের অনেকেই এখনো সেনাবাহিনীর বড় অফিসার। এইসব কীট-পতঙ্গকে কেনো ভয় পেতে হবে? আর তাই সে বেশ ঠাণ্ডা মাথায় তাদের অনুসরণ করতে থাকলো, এমনকি একটা সিগারেট রোল করে তাতে কষে টানও দিলো কয়েকটা।

ডাইনিং রুমে কয়েকশ লোক অপেক্ষা করছিলো তার জন্য। লি’কে দেখে তারা শ্লোগানে প্রকম্পিত হলো। কালো কালিতে “আজকের প্রতিবিপ্লবী” লেখা একটা প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে দেয়া হলো তার গলায়।

লীগের ডিরেক্টর লিন শু সবাইকে থামালেন ভাঙা ব্যাজটা তুলে ধরে, “কমরেডস, আজকেই আমরা এটা উদ্ধার করেছি ময়লার গাদা থেকে, জঘন্যতম অপরাধী লি ওয়ান এই কাজ করেছে, সে হয়তো আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে এমনই ঘৃণা করে”।

“প্রতিবিপ্লবী লি হাজারী নিপাত যাক!” জনতার ভীড় থেকে এক মধ্যবয়স্ক মহিলা চিৎকার করে উঠলো, বাকীরা মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে তার সাথে গলা মিলালো। তারা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলো লি কেবল সম্পদেই তাদের থেকে আলাদা নয়, তার বিশ্বাসও তাদের উল্টো। তার অপরাধ নিয়ে কারো কোনো সংশয় রইলো না আর।

তবে লি’ও সহজে দমবার পাত্র নয়। সে বাঁকা হাসি হেসে জোরগলায় বললো, “ তোমরা আমাকে প্রতিবিপ্লবী বলছো! বেকুব নাকি! যখন আমি জানবাজী রেখে মার্কিনী ভুতের সাথে যুদ্ধ করছিলাম কোরিয়াতে, তখন তোমরা কোথায় ছিলো বাপুরা! দুবার আমি বীরত্বের পুরষ্কার পেয়েছি। এই হাত দিয়ে কতো হাজার বিপ্লবীকে আমি বাঁচিয়েছি, যারা আজো আমার বন্ধু”। শত জনতার সামনে সে হাতপাখার মতোন মেলে দেখালো তার হাতদুটো।

“অতীতের উপর ভর করে না থেকে, এবার নতুন কিছু করো,” চিৎকার করে চেয়ারম্যান মাও’য়ের উদ্ধৃতি শুনিয়ে দিলো একজন।

“এবার দেখো”। লি ওয়ানের মুখে সপাটে একটা চর মারলো জিয়াও তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “নাকী কান্না কেঁদোনা! তোমার মাথা ভাঙবো আজকে। এখন তুমি একজন জোতদার”।

“নয়া জোতদার লি ওয়ান, নিপাত যাক,” ভীড় থেকে শ্লোগান তুললো একজন, বাকীরা একসাথে তাকে অনুসরণ করলো।
চর খেয়ে আর এই নতুন অভাবনীয় উপাধিতে লি ভড়কে গেলো বেশ, ছোট ছোট মঙ্গোলিয়ান চোখ নীচু করে মাটির দিকে চেয়ে রইলো কেবল। আড়ষ্ট গলায় বলতে চেষ্টা করলো, “আমি অপরাধী নই। এটা শুধুই একটা দুর্ঘটনা, কাজের সময় এই ব্যাজটা আমি পরতাম সবসময়। সেদিন হাত ধোয়ার সময় হঠাৎ মাটিতে পড়ে ভাঙলো...”

“সাক্ষী আছে?” লিন জিজ্ঞেস করলো।
“না, কিন্তু আমি যা বলছি তার প্রত্যেকটা বর্ণ সত্য, পার্টির মেম্বারশীপের কসম খেয়ে বলছি”।
“না! সে মিথ্যা বলছে,” অনেকেই বললো একসাথে। লি’র শান্ত স্বর তাদের ক্ষোভকে আরো উস্কে দিচ্ছিলো। অন্য যে কেউ এসময় হাটু গেড়ে মাফ চাইতে শুরু করতো, অথচ এমন পরিস্থিতির সাথে পরিচয়হীন যেনো লি।

এসময় চারজন লোক লম্বা লাঠি আর দড়ি হাতে সামনে এগিয়ে আসলো। তার দুপাশে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। “তুমি কি অপরাধ স্বীকার করছো, নাকি করছো না?” জিয়াও প্রশ্ন করলো।

ভয় পেলেও, লি জবাব দিলো, “ স্বীকার করার কিছু নেই আমার। আমি চেয়ারম্যান মাও’কে ভালোবাসি, তার জন্য প্রাণ দিতেও রাজী। কীভাবে তাকে ঘৃণা করতে পারি? তিনি আমার ইতিহাসকে বাচিয়েছেন। আমার দাদা-বাবারা জোতদারের ভূমিদাস ছিলো। চেয়ারম্যান মাও আমাদের পরিত্রাতা! তাকে কীভাবে ঘৃণা করবো আমি?”

“নাটক বন্ধ করো,” চিৎকার করলেন লিন। “কথার বাকোয়াজীর চাইতে যা কাজের জোর অনেক বেশী। চেয়ারম্যান মাওয়ের জন্য তোমার ভালোবাসার প্রমাণ দাও”।

“হ্যা, প্রমাণ চাই”।
“প্রমাণ করো আগে”।
পুরো ঘরটা থমকে গেলো হঠাৎ, সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ লি’র তেল চপচপে মুখে, যেনো তার গান শুনবার জন্য অপেক্ষায় আছে সবাই, অথবা এখনই প্রার্থনার মূদ্রায় নেচে উঠবে লি। অথবা এমন কিছু একটা করে দেখাবে, যাতে তার ভালোবাসার প্রমাণ হয়ে যাবে। বাইরে তখন একটা ঘোড়া ডাকতে শুরু করলো খুর দাপিয়ে।

লি মাথা উচু করে হাসলো। তারপর গলা খাকড়িয়ে বলতে শুরু করলো, “ আচ্ছা, তাহলে তোমাদের বলি। চার বছর আগে আমি চেয়ারম্যান মাও’কে কিছু খাদ্যশষ্য উপহার পাঠিয়েছিলাম, সব মিলিয়ে পঞ্চাশ কিলো’র মতো। দুর্ভিক্ষের সময় তোমরা না খেয়ে থাকো,, তাই না? আমিও। কিন্তু আমি তোমাদের মতো নই, প্রতিবেলাতেই আমি প্রয়োজনের চাইতে কম খেয়ে বাকী অংশ চেয়ারম্যান মাও’য়ের উপহার হিসাবে সঞ্চয় করি। কারণ তাকে আমি ভালোবাসি, কারণ আমি চাই না তিনি আমাদের মতোন উপোস করবেন। আমি সত্য বলছি। তোমরা আমার সেনাবাহিনীর বন্ধুদের কাছে খবর নিতে পারো। যদি আমার একটি বর্ণও মিথ্যা হয়, তোমরা আমার গর্দান নিয়ো”।
খানিক দোটানায় পড়ে গেলো জনতা। লি’র নির্বুদ্ধিতায় কয়েকজন হেসে উঠলো, চেয়ারম্যান মাও’য়ের কি এইরকম খাদ্যশষ্য উপহারের প্রয়োজন হয়! কিন্তু তার ভালোবাসা নিয়ে কারো মনে কোনো প্রশ্ন জাগলো না। লীগের নেতারাও দ্বিধায় পড়ে গেলো এমন অপ্রত্যাশিত আচরনে, তবে মুচকী হাসি সামলে রাখতে পারলো না...

“শান্ত হও সবাই, মনোযোগ দিয়ে শোন”। মুখে আঙুল বোলাতে বোলাতে ডিরেক্টর লি চিৎকার করলো।
জনতাকে অবাক করে দিয়ে হাই স্কুলের এক যুবক শিক্ষক হু মেংশিয়ান হঠাৎ সামনে চলে এলো। তাকে দেখে লি শিটকে গেলো খানিকটা, চশমা পড়া ছোটখাটো লোকটাকে সে চিনতে পারলো, এই লোক তার জার্মান ক্যামেরাটা ধার চেয়েছিলো একবার, সে উল্টো ধমকে দিয়েছিলো লোকটাকে। হু জনতার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, “এই লোকের কথায় কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। এটাও তার প্রতিবিপ্লবের কথাই প্রমাণ করে”। তারপর লি’র দিকে তাকিয়ে বললো, “নিজেকে তুমি অনেক বুদ্ধিমান মনে করো লি। কেউ তোমার শঠতা ধরতে পারবে না ভেবেছো? দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্যশষ্য উপহার পাঠিয়ে তুমি চেয়ারম্যান মাওকে আসলে ছোটো করতে চাও। তুমি তাকে খোঁচা দিতে চাও যে ‘তোমার নেতৃত্বের জন্যই আমরা আজ না খেয়ে আছি’”।

“না!” লি চিৎকার করলো, “ আমি উপোস করি চেয়ারম্যান মাও’কে ভালোবাসি বলে!”
“দেখো এই লোকের শব্দের ব্যবহার শোন সবাই!” হু জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “সে চেয়ারম্যান মাওয়ের উপর দোষ চাপাচ্ছে। চেয়ারম্যান মাওকে ভালোবাসে বলে তাকে না খেয়ে থাকতে হয়। মাওকে ভালো না বাসলে তাকে না খেয়ে থাকতে হতো না”।

জনতা আসলেই হকচকিয়ে গেছে ততোক্ষণে, তাদের মুখে কোনো কথা জাগলো না, তাদের সংশয়ী মুখে কেবল সত্যিটা জানবার আগ্রহের ছাপ। “তুমি মরো কচ্ছপের ডিম কোথাকার!” শিক্ষককে অভিশাপ দিতে দিতে বললো লি।
“মুখ সামলে কথা বলো”। তং ফেই চিৎকার করলো।
“আমি আমার কথা প্রমাণ করে দিতে পারবো,” হু আবারো বললো। “ চার বছর আগে সে উপহার দিয়েছে, তার পরের বছরই এই শহরে ফিরে এসেছে। সে কী মনে করেছে বেইজিংয়ের নেতারা তার চালাকি ধরতে পারে নি? তার মতলব তারা ঠিকই টের পেয়েছিলো। যে কারনে একজন চিকিৎসককে সেনাবাহিনী থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে আমাদের শহরের এই ছোট হাসপাতালে তাকে পাঠানো হয়েছে”।
এসব শুনে লি রাগে কাপতে শুরু করলো। যেনো তার মাথায় একটা কাঠের হাতুরী দিয়ে বারি মেরেছে কেউ, সে সব বুঝতে পারছে কিন্তু কোনো কিছু বলতে পারছে না। গাল বেয়ে অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়লো তার...

“কমরেড্স...” হু বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলছিলো, “আমি বলি কি, কাউকে পাঠানো হোক তার সেনা ইউনিটে সত্যটা জেনে আসার জন্য”।

“আমরা জানতাম চেয়ারম্যান মাও...আমাদের মতোন একই রেশন পান...” লি প্রায় গোঙাতে গোঙাতে বললো। পরিষ্কার করে কোন কিছু বলার মানসিক অবস্থায় সে ছিলো না। উপস্থিত জনতা তখন বুঝে নিয়েছে যে সে একটা মানুষ রুপী নেকড়ে। একেরপরএক শ্লোগান শুরু হলো তার বিরুদ্ধে। শেষে লাঠিওয়ালা লোকগুলো তার উপর ঝাপিয়ে পড়লো।

“আমাকে মেরে ফেলো, হ্যা, আমি আসলেই একজন প্রতিবিপ্লবী, এভাবে না পিটিয়ে আমাকে মেরে ফেলো তোমরা”।

“ওকে মারো!”
“পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলে নাও!”

সেরাতে লি’কে কার্টার ইনের আস্তাবলে ফেলে রাখা হলো। একদল লোক তার বাড়িতে গিয়ে দামী সম্পত্তি আর ব্যাংকের কাগজপত্র লুট করে নিলো। পর দিন থেকে সেই ইয়েলো রিভার মোটর সাইকেল আর জার্মান ক্যামেরা জনগণের সম্পত্তি হয়ে গেলো লীগের যে কেউ সেসব ব্যবহার করতে পারে (এভাবে আমাদের শহরের শ’খানেক লোক মোটর সাইকেল চালাতে শিখে গিয়েছিলো)। দোনলা বন্দুক আর ঝকঝকে তলোয়ার লীগের অস্ত্রাগারে জমা পড়লো। অবশ্য তিতির শিকারে আগ্রহ থাকলে লীগ বাহিনীর অনেকে সেগুলো নিয়ে পাহাড়ে চলে যেতো।

মাসখানেক বাদে লি ওয়ানকে শুদ্ধিকরণের জন্য সী নেস্ট গ্রামে পাঠানো হলো। ভাগ্য ভালো ছিলো, সেখানে তাকে মাঠে কাজ করতে হতো না। পাঁচ বছর ধরে খালি পায়ে ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা সেবা দিতে হলো সেখানে, অবশ্যই কোনো সম্মানি ছাড়া। এরমাঝে পূনর্বাসনের আকাঙ্খায় সে প্রায় শ’খানেক চিঠি লিখে ফেলেছিলো প্রাদেশিক প্রশাসনের কাছে।

ষষ্ঠ বছরের মাথায় তার বিষয়টা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হলো। ইতিহাস যাচাই করে বোঝা গেলো কখনোই সে প্রতিবিপ্লবী ছিলো না। তাকে গ্রামে ফিরিয়ে নেয়া হলো। ফিরিয়ে দেয়া হলো বাড়ি থেকে লুট হয়ে যাওয়া জিনিসপত্র, যদিও ভাঙ্গা মোটর সাইকেলটা তখন আর চলে না, ক্যামেরার লেন্সগুলোর কোনো হদিস পাওয়া গেলো না, আর বন্দুকের একটা নল ঝলসে গেছে। তবুও সে আবার ধনী মানুষ পরিচয়ে ফিরে যেতে পারলো কারণ ব্যাংকের যাবতীয় কাগজপত্র ফিরিয়ে দেয়া হলো তাকে। বাড়তি হিসেবে পেলো পাঁচ বছর গ্রামে কাজ করার সমস্ত সম্মানি। সবকিছু মিলিয়ে তার সঞ্চয় আগের চে দ্বিগুণ হলো এবার। যে দিন সে টাকাগুলো জমা দিলো ব্যাংকে, ক্যাশিয়ার মুহুর্তের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে দিলো শহরে। সপ্তাহের মধ্যেই লি’র নতুন নামকরণ “দশ হাজারী”-এর কথা ছড়িয়ে পড়লো দিগ্বিদিকে। এই নামকরণে লি বেশ খুশিই ছিলো মনে হয়। সৃষ্টি কর্তার কি অদ্ভুত বিবেচনা! লি আবার সবচে’ ধনী হয়ে ফিরলো শহরে। ব্যাংকে সে যে সুদ পেতো সেটাই একজন সাধারণ শ্রমিকের মজুরীর চাইতে বেশি। এই বৈষম্যমূলক বিষয়টা নজরে পড়লো সবার।

লি পাত্তাও দিলো না কাউকে। সে বরং নতুন একটা মোটর সাইকেল আর একটা ক্যামেরা কিনে ফেললো। যদিও দুটোই সাংহাইয়ে বানানো। পাহাড়ে শিকারের অভ্যাসটা ছেড়ে দিয়ে সে শখে মাছ ধরতে শুরু করলো। এর জন্য সে কিনলো দুটো বড় স্টিলের বরশী আর একটা বড় নায়লনের জাল। একটা রাবারের নৌকা কেনার কথাও সে ভাবতে থাকে। কিন্তু এরপরেও সে তার ক্যামেরাটা কাউকে ধার দিতে রাজী না। এতো কিছু ঘটার পরও সে কাউকে তার মোটর সাইকেলে চড়ায় না। বাজারে গিয়ে হকারদের সাথে দরদামেই তার ব্যস্ততা। মানুষের মুখে মুখে ফেরে তার এইসব বিরক্তিকর আচরনের গল্প। কেউ কেউ অবশ্য গোপনে আবারো তার বিরুদ্ধে বিপ্লবের কথা ভাবছিলো।

পোস্টটি ১০ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

ভাস্কর's picture


গল্পটা কপিপেস্ট করার পর ইনভার্টেড কমাগুলি হারাইয়া গেলো জানি কোথায়...

লিজা's picture


সকাল বেলায় দারুণ একটা গল্প পড়তে পারলাম । ধন্যবাদ ভাস্কর'দা Smile

আসিফ's picture


এই অনুবাদটা একটা মাত্র মন্তব্য 'ডিজার্ভ' করে না।

যদিও লেখায় অনেক বানান ভুল রয়ে গেছে। একটু তাড়াহুড়ো করে দেওয়া কি? Smile

তানবীরা's picture


এই অনুবাদটা একটা মাত্র মন্তব্য 'ডিজার্ভ' করে না।

অসাধারণ। দারুন।

টুটুল's picture


একমুঠো শষ্য বাঁচাও প্রতি বেলা,
বছর গেলে জমবে তোমার এক ডালা।

চমৎকার একটা গল্প পড়লাম... ভাষ্করদার অনুবাদ ভাল হয়... কুন্ডেরা শেষ করতে পারতেন

বিষাক্ত মানুষ's picture


বেশ ভাল লাগছে। Smile

স্বপ্নের ফেরীওয়ালা's picture


দারুন।

“আমাকে মেরে ফেলো, হ্যা, আমি আসলেই একজন প্রতিবিপ্লবী, এভাবে না পিটিয়ে আমাকে মেরে ফেলো তোমরা”। ... মূল গল্প এইখানে শেষ হলেই ভাললাগতো

~

গৌতম's picture


যদিও মূল গল্প পড়া হয় নি, কিন্তু অনুবাদটা ভালো লেগেছে।

ভাস্কর's picture


পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। মূল গল্পটার কোনো সফ্টকপি না থাকায় দেয়া গেলো না। তবে আমি মূলানুগই ছিলাম গল্পটার ক্ষেত্রে। হা জিন'এর গল্প অনুবাদ আমার জন্য খানিকটা স্পর্শকাতর হয়...কারণ তার কমিউনিস্ট যূগের সমালোচনামূলক টোনটা বেশ সেনসেটিভ, এইটা যতোটা কমিউনিস্ট দর্শনের সমালোচনা তার চাইতে অনেকবেশি কমিউনিস্ট যূগের শাসন কাঠামোর ভেতরে থাকা ক্ষমতা চর্চার ইঙ্গিত।

১০

রায়েহাত শুভ's picture


দারূণ গল্প...

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

ভাস্কর's picture

নিজের সম্পর্কে

মনে প্রাণে আমিও হয়েছি ইকারুস, সূর্য তপ্ত দিনে গলে যায় আমার হৃদয়...