দিননামা...
আজকে বাসায় ফেরার সময় পরিচয় ঘটলো লোকটার সাথে। জগদ্দুনিয়ার উপর মহা বিলা খাওয়া। বাসের ভাড়া, তেলের দাম, মোহাম্মদপুর-শ্যামলী এলাকার বাসের টিকিট সিস্টেম তুইলা দেওয়া, বড়লোকদের ট্যাক্স ফাকি দেওয়ার অভ্যাস ব্লা ব্লা ব্লা। লোকটার দাবী অনুযায়ী তার বয়স ৬২। যদিও আধো অন্ধকারে তার গলার ত্বকে রিংকেল খুঁজতে অপারগ হইলাম আমি। আলোতে গেলে কিছু দেখা যাইতো হয়তো। তার পরনের ব্লেজারটা শাব্দিক অর্থেই ব্লেজার। পুরানা স্যুটের কোট না পইরা এই বয়সেও তার স্টাইল সচেতনতা ইন্টারেস্টিং; চশমার বাইফোকালবাহী অক্সিডাইজ্ড ফ্রেইমটা হয়তো বাজারের সবচে দামী উদাহরণ নয় কিন্তু রুচিশীলতায় এই বয়সের মানে মুক্তিযুদ্ধের সময় ২২ বছরের যুবকের জন্য বেশ আইডেন্টিফাইড। শুদ্ধ প্রমিত উচ্চারনের শব্দচয়নে রাজশাহীর হালকা টানটারে আমার চাঁদের কলঙ্কের মতোন লাগলো।
এমন একজন আধুনিক মানুষের সাথে আমার তর্ক শুরু হইলো তার বিলা খাওয়া খ্যাপাটে ভাষণ শেষ করার সাথে সাথেই। যখন সে দেশের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ আর আমলাদের চরিত্র বিশ্লেষণ কইরা সে কনক্লুশান টানলো এই দেশে দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে ৭০ সাল থেইকা, যার ভয়াবহ শিকড় স্বাধীনতার পরপরই তৈরী হইছে। এই বয়ানের পর আমি তারে একটা প্রশ্ন কইরা তর্ক শুরু করলাম, "আচ্ছা আপনি স্বাধীনতার আগে একজন বাঙালি ইনভেস্টরের নাম বলেন যে পাকিস্তান শাসনামলে পাঞ্জাবীগো সাথে পাল্লা দিতো।" খানিক নীরবতার পর এর সাথে জুইড়া দিলাম, শর্ত প্রযোজ্য: পশ্চিমবঙ্গের সম্পত্তি বদলানো মুসলিম বাঙালিদের এই তালিকায় রাখা যাইবো না। এতোক্ষণের বাকপটু ক্ষুব্ধ মানুষটা এক প্রশ্নেই নীরব। সেকেন্ড ত্রিশেক পর সে জহিরুল ইসলামের নাম উল্লেখ করলো বেশ ইনকনফিডেন্ট গলায়। তবে বয়ষ্ক লোক, আমার মতোন আন্ধারে ৩৪/৩৫ লাগা মধ্যবয়ষ্কের সাথে তো আর তর্কে হারতে পারেন না। শুরু করলেন আবার তার ইনকাম ট্যাক্স ইন্সপেক্টার বাবার সততা নিয়া। পাকিস্তানী শাসনামলে ইনকাম ট্যাক্স দারোগারাও সৎ ছিলো এই হইলো তার বক্তব্য। আমার পূর্বতন বক্তব্যই বহাল থাকলো। তবে দারোগা সম্বন্ধিত মীথ মনে করাইয়া দিলাম তারে। এই জাতি দারোগা মানে পুলিশের দারোগার উপরি আয় নিয়া সারাজীবন ঈর্ষান্বিত ছিলো। দেশী পুঁজিপতিই যদি সেইভাবে না থাইকা থাকে ইনকাম ট্যাক্স দারোগারা ঘুষ খাইবো কার কাছ থেইকা। কিন্তু যেইখানে দুর্নীতি করা সম্ভব সেই ১৯৫১ সনের ভূমি সম্পর্কীত প্রজাতন্ত্র আইনে যে তখনো দুর্নীতি জায়েজ ছিলো সেই কথা তারে মনে করাইয়া দিলাম। তৎকালে এসএসসি পাস যোগ্যতার চাকরী সাব-রেজিস্ট্রার হইতে যে কাড়াকাড়ি লাগতো সেই ইতিহাসে সায় দিতে এই প্রায় প্রগতিশীল বৃদ্ধের সময় লাগলো না।
তারে দেখতে যেহেতু ৬২ বছর লাগে নাই, সেই সুযোগে নিজের বয়সটা বছর চারেক বাড়াইয়া দিলাম। ভাগ্যিস আজকে সকালে শেইভ করা হয় নাই তাই পাকা দাড়ির ছটায় সে হয়তো বিশ্বাসও কইরা ফেললো। তারপর শুরু করলো প্রজন্মের সমালোচনা। এই নতুন প্রজন্ম যে দায়িত্বশীল না একেবারেই সেই বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নাই জানতে পারলাম। নতুন পরিচয়ে আমিও স্বাধীনতা পূর্ববর্তী প্রজন্ম হিসাবে তার নৈকট্য পাইয়া গেলাম। কিন্তু আমি নিজেতো এই মুহুর্তে বর্তমান প্রজন্ম বিষয়ে এই বৃদ্ধের মতোন বিদ্বেষ পোষণ করি না। তাই তারে যখন কইলাম এই প্রবণতা তো এখন বৈশ্বিক ট্রেডমার্ক। সমাজের রথী-মহারথী কিম্বা নবযূগের ডেল কার্নেগীরা তো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্ধের মতোন এই প্রতিযোগিতার তত্ত্ব ঢুকাইয়া দিছে। এমনকি আল্লাহ'র পথে লড়াইরত জাওয়াহিরিও যে লাদেনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রণয়নে ব্যস্ত ছিলো!
তার পাকিস্তানী আমলে আগ্রহে আমি ভাবছিলাম ধর্মের কোনো খোদকারী আছে তার বিশ্বাসের স্থবিরতায়। কিন্তু সে উল্টা আমারে শুনাইতে শুরু করলো তার মধ্যপ্রাচ্যের অভিজ্ঞতা। ওয়ান্স আ ডক্টর এই ভদ্রলোক কোনো এক শেখ পরিবারের হাউস ফিজিশিয়ানের চাকরী করতে গিয়া তাদের পাশ্চাত্য প্রেম দেখছে একেবারে ইঞ্চি দূরত্ব থেইকা। ধর্মের নামে যে পৃথিবীতে পুঁজিরই দাপট চলে! পুঁজির নিয়মে সুযোগের অভাবে সৎ পিতার ভাগ্যান্বেষী পূত্রের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানী কিভাবে বড় পুঁজির আহারে পরিণত হইছে সেই বৃত্তান্ত শুনলাম বাকীটা পথ। আহারে আহারে করা ছাড়া আমার আর কিইবা করার থাকে?
এমন আবিষ্কারের পরে যখন বাস শ্যামলীর প্রান্তে আইসা দাঁড়ায়। বহুদিনের অনভ্যাসে আমার একজন মানুষের বয়স, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, ব্যর্থ ব্যবসায়িক বিনিয়োগের তথ্য জানা হইলেও নাম কিম্বা বর্তমান পেশা সম্পর্কে কিছু জানা হয় না। সে পকেট থেইকা হ্যান্ডগ্লোভ্স বের করতে করতে বাস থেইকা নামে। আর তখনি আমার মনে হয় আমিও আসলে এই সময়েরই প্রতিনিধি। পূর্ব প্রজন্মের অভিযোগের সাথে হয়তো কিয়দংশ মিল থাকে, কিন্তু যোগাযোগের বেলায় আমার ব্যক্তিকেন্দ্রীকতা আছে...আছে একজন নব্য পরিচিত লোকের সাথে দ্বিতীয় দিন কথা না বলার অভ্যাস। আগামীকাল হয়তো এই ৬২ বছরের তরুণের সাথে দেখা হবে কিন্তু কোনো কথা হবে না, যতোক্ষণ না সে আমার অহমিকায় আঘাত হানে।
বেচারা বয়স্ক মানুষটা। পড়বি তো পড় মালির ঘাড়েই!!!
বয়স্ক লোকটারে আমার কিন্তু বেশ পছন্দ হইছে।
পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনামল আর স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনামল নিয়া তুলনাটারে আমার স্বাভাবিক ক্ষোভের প্রকাশ বইলাই মনে হইছে। আমাদের স্বরাজরা যে পাঞ্জাবীদের মতোই দেশের সম্পদ লুটপাটে ব্যস্ত আছে এইটা তো ক্রুঢ় বাস্তবতা।
সেইটাই কথা। সুযোগ পাইলে কয়জন ছাড়ে!!
প্রতিযোগিতামূলক সমাজে একজন অন্যজনের চাইতে ভালো থাকার প্রতিযোগিতায় নামলে কারে দোষ দেওন যায় ক'ন তো?
আমি অবশ্য অপরিচিত কারো সঙ্গে কখনোই আলাপ শুরু করতে পারি না।
মাসখানেক আগে এক প্রৌঢ় সিএনজি ড্রাইভার সাহেব ভালোই জ্ঞান দিয়েছিল আমাকে। ঢাকা শহর-সরকার-বর্তমান প্রজন্ম সবকিছুর উপর বীতশ্রদ্ধ এই ভদ্রলোক অপেক্ষায় আছেন ছোট ছেলের পরীক্ষা পাসের। তারপর সব ছেড়েছুড়ে ফিরে যাবেন গ্রামের বাড়িতে, গ্রামে জীবন কাটাতে আসলে তত বেশি টাকার দরকার হয়না। আপনার মতই তাঁর নামটা জানা হয়নি আমার।
বেচারা বয়স্ক মানুষটা। পড়বি তো পড় মালির ঘাড়েই!!!
২ নাম্বার মন্তব্য দ্রষ্টব্য...
আপ্নে বেশ ভালোই মুডি আছেন।
গালি দিলেন?
মন্তব্য করুন