ইউজার লগইন

সান্ত্বনা পুরস্কার যেখানে সবকিছুতেই

সাধারণত আমার মন মেজাজ যেদিন ভালো থাকে না সেইদিনই ব্লগে লিখতে বসি। আজ অবশ্য তেমন না। মন মেজাজ ফুরফুরেই বলা চলে, কিন্তু আমার পিসির মনিটরের অবস্থা ভালো না। চি চি শব্দ করে সমানে। জানি না প্রবলেম কোথায়, তবে ইরিটেটিং সাউন্ড। সামনেই হয়তো বড় কোনো সমস্যা হলেও হতে পারে। তাই মন ভালোটা শেষমেশ থাকছেই না- এই শব্দ বিভ্রাটের কারনে। অন্যদিকে নোটবুকেরও মাদারবোর্ড ঠিক করতে হবে, সেই ফিনান্সিয়াল কন্ডিশনও এই মাসের শেষে নাই। এখন আপনি যদি সান্ত্বনা খুঁজে অনেকের মতন ভাবেন- শব্দ করলে করুক বিরক্তিকর, পিসির কাজ তো চলে, দেশের কত মানুষের পিসি নাই তা আপনি জানেন? আমি হয়তো সামনা সামনি মেনে নিবো। মনে মনে বলবো এরকম বিরক্তিকর সাউন্ডের পিসি চালানোর চেয়ে, পিসি না থাকা ভালো, আর কত মানুষের কত হাই কনফিগারেশনের পিসি, আমি কি তা নিয়ে কিছু বলছি! অযথা সান্ত্বনার মুখোশ কেন গায়ে মাখাতে হবে?

ছোটবেলায় নেভীর পিকনিকে যেতে হতো। স্প্রিন্টে আমার অবস্থা বরাবরই খারাপ। তাই দৌড়ে দশজনের ভেতরে পঞ্চম হয়ে পেতাম সান্ত্বনা পুরস্কার। সেই প্রাইজটাও হতো হেভভী, যে বিস্কুট সবাই দোড়ঝাপ দিয়ে খেয়েছে তার আস্ত এক প্যাকেট। তার সাথে বোনাসও ছিল যে বিস্কিটের সুতা ছিল সারি করা তা দিয়ে দেওয়া। সেখানো আরো গোটা দশেক বিস্কিট পাওয়া যেত। পিকনিকের খাবার যা হয় একটু দেরীতে, আমি বিস্কুটটা তখনই আয়েশ করে খেয়ে ফেলতাম একা। মনে হতো এত আমার অর্জন। কিন্তু সমবয়সীদের অর্জন চোখে পড়ার মতো, তারা পেতো ডিনার প্লেট, দেয়াল ঘড়ি আরো কত কি! তখন মনে হতো এই এক বিস্কুট আমার জন্য সান্ত্বনা তো দূরে থাক, গলায় আটকে যায়। সবাই পারে আমি আমি পারি না। সেই পিচ্চিকালেই আমি বুঝে গেছি, সব কিছু সবার জন্য নয়। তাই কথায় কথায় সান্ত্বনা খুঁজেও লাভ নেই।

তবে এই জাতি সান্ত্বনাবাদী, সব কিছুতেই সান্ত্বনা খুঁজে মনকে শান্ত রাখতে ভালোবাসে। কয়েক বছর আগের কথা- ওয়াসার পানি কয়দিন ধরে কম আসছিল ট্যাপে, বাড়ীওয়ালার ওয়াইফকে বললাম, তিনি জানালেন 'আমার নিজের বাড়ী তো পুরান ঢাকায় সেখানে তো অবস্থা আরো খারাপ। আপনারা তো পানি পান ভালোই, সেখানে পানিতে যে বিশ্রী গন্ধ নাক উল্টিয়ে বমি আসে'। আমি ভদ্রমহিলাকে বলে বুঝাতে পারলাম না, আমি পুরান ঢাকায় থাকি না যে সেই পানির কথা মনে এসে বর্তমানে কাজ চালাতে হবে। তার কিছুদিন আগের কথা, হাউজিং সোসাইটিতে কারেন্ট থাকে না, তা নিয়ে এলাকার মুরুব্বী ও লীগ নেতারা গিয়েছে ডক্টর আবুল বারাকাতের অফিসে, তখনও তিনি জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান না, তবে তাঁর অফিস ও বিল্ডিং যেহেতু এখানে তাই তাঁকে অনুরোধ করা হলো যেন কারেন্ট কম যায় তার একটা বিহীত করতে। তিনি জানালেন, 'কারেন্ট যায় এটা বড় ব্যাপার না, কারেন্ট যে আসে সেটাই বড় ব্যাপার'। কালকে তার বই বের হবে কার্ডে দাওয়াত পেয়েছি। নাম- গনমানুষের অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত, এই উনার গন মানুষ গিরির নমুনা!

এরকম শত সহস্র উদহরণ দেয়া সম্ভব। রাস্তায় জ্যাম, বাসে ঘেমে ঘেমে গোসল দিচ্ছেন, চরম বিরক্ত, কেউ কেউ মিষ্টি গলায় আপনার সাথে আলাপ জুড়ে দিয়ে বলবে, আজ তো কম ছয়দিন আগে আমার মতিঝিল যেতে ৬ ঘন্টা লেগেছিল। শুনে মনে হবে এ যেন জাতীয় গর্বের কথা। কিংবা দেশের নির্বাচনহীন গনতন্ত্রহীন ইনডিসিপ্লিন্ড অবস্থা নিয়ে আপনি এমনিতেই কিছু একটা বলছেন কাউকে, তখনই কেউ সান্ত্বনা বানী বর্ষণ করে বলবে 'আরে ভাই অনেক ভালো আছি, পাকিস্তানের অবস্থা দেখছেন কত খারাপ।' আমি তখন বলে ফেলি, ৪৪ বছর আগে আমাদের আগের প্রজন্ম কি পাকিদের সাথে তুলনা দেয়ার জন্য দেশ স্বাধীন করেছিল? যদি করে থাকে তবে আমার কিছু বলার নাই। মানুষ সমন্ধে তো এই ধারনা আরো বেশী। ওমুকে আমার সাথে এমন করছে, এই শুনে আপনাকে লোকজন বলবে, 'ওমুক তো তাও ভালো। আমার ওমুক যা করছে তা আরো ভয়াবহ, আপনি বেঁচে গেছেন'। যেন মানুষ একটা জানোয়ার তাই তাঁর সমন্ধে জানতে হলে জানোয়ারদের সাথেই মিশতে হবে আপনাকে। সব চেয়ে মজা পেয়েছিলাম, পুলকের মা একবার পা পিছলে পড়ে গেছে রাস্তায়, খুবই খারাপ অবস্থা। পুরো ফ্যামিলী খুব বেকায়দায় ছিল। এখনো আন্টি অসুস্থ, তখন পুলককে অনেকে সান্ত্বনা বানী দিয়ে বলতো- বেঁচে তো আছে, মরে তো নাই।' যেন উনার মরার জন্য সবাই বসে আছে। কি দুর্বিষহ অবস্থা। দেশের টিভিতে দেখার মতো কিছুই হয় না, তা নিয়ে যখন বলি তখন বলে সবাই, তাও দেশের টিভিতো ভালো, ভারতের চ্যানেল তো ফ্যামিলী নিয়ে দেখাই যায় না। আমি পাল্টা প্রশ্ন করে ফেলি- তাহলে ফ্যামিলী নিয়ে কি দেখেন? উত্তর আসে জী বাংলা, আমি মনে মনে বলি- জয় বাংলা। কল্যান নামে আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা সেদিন, সে একটা কফি শপে আমাকে ঢূকালো, জঘন্য কফি। ও খুব তৃপ্তি নিয়ে খেতে খেতে বললো, এরচেয়েও পচা কফি বান্ধবীর সাথে বসে গিলতে হয়- হাসি হাসি মুখ নিয়ে। আমি বলেই ফেললাম, তুই গিল, আমার এরকম টাকার মায়া করে জঘন্য জিনিস গেলার ইচ্ছা নাই। এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। সব দিলাম না।

কথা হলো, এরচেয়েও খারাপ হতে পারতো এইটা মনে করে সান্ত্বনা পাওয়ার সাইডে আমি নাই। কথা হলো খারাপ খারাপই, সেখানে সান্ত্বনা খুঁজার মানে কি? ভালো যখন পাই তখন তো আমরা খারাপ চাই না, তাহলে খারাপ পাবার সময় কেন আরো খারাপ পেলাম না তা ভেবে আত্মপ্রসাদে ভুগবো। যে জিনিসে আমি বিরক্ত হচ্ছি, আমার সাথে চলছে না- তা জোর করে চালানোর মানে কি? তাই আমি সান্ত্বনা পুরষ্কারের এই সমাজে এত ডাউন টু আর্থ হতে চাই না। সবাই পাবে ভালো ভালো, আমি পাবো মন্দ, তাতেও সান্ত্বনা খুঁজবো , সেই আত্মতুষ্টির আমার কোনো দরকার নেই। যাদের দরকার তারা নিয়ে সুখে থাকুক! শেষ করবো গোলাম আজমের কথা ধরেই, কত বিচার চাইলো আমাদের উত্তর প্রজন্ম, আমরাও চিল্লাচিল্লি করলাম কত, সেই কবে থেকে কত গন আদালত- কত সংগ্রাম-কত নাগরিকত্ব বাতিল হলো, এক বায়তুল মোকারমের সামনে জুতা মারা ছাড়া তাঁর একটা পশমও আমরা ছিড়তে পারি নাই। উল্টো বিচারের নামে দেয়া হয়েছে আরাম দন্ড, খাওয়ানো হয়েছে ইমপ্রোভ ডায়েট, করা হয়েছে দেশের সেরা চিকিৎসা। ন্যাচারালী তিনি মরলেন, আমিও সান্তনা খুঁজে বলবো যাক শাস্তি হয়েছে, মরেছে মীর জাফরটা!

পোস্টটি ১৪ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


ভাল্লাগতাছে না.. Stare

আরাফাত শান্ত's picture


Sad

প্রিয়'s picture


আমাদের অবস্থা হইসে নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার মতোন।

আরাফাত শান্ত's picture


ঠিক বলছো!

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


সান্ত্বনা খুঁজতে না যাওয়াই উত্তম।
ছেলেবেলায় আমার ভাগ্যেও কখনও পুরষ্কার জোটেনি! সান্ত্বনা পুরস্কারও না। Sad

আরাফাত শান্ত's picture


সমবেদনা ভাইয়া Laughing out loud

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

আরাফাত শান্ত's picture

নিজের সম্পর্কে

দুই কলমের বিদ্যা লইয়া শরীরে আমার গরম নাই!