ঘুম ভাঙা সকাল!
চারটায় মোবাইলে কর্কশ এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম খেলা দেখবো বলে। দু ঘন্টা দেখলামও। যেভাবে উইকেট পড়ে গেল হুড়মুড় করে তাতে মন উঠে গেল খেলা থেকে। মামাও জেগে ছিল। মামাও হতাশা নিয়ে শুতে চলে গেল। আমার আর ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে ইচ্ছে করলো না। রুমে আসলাম ভাবলাম কি করা যায়। কিছু সময় পত্রিকা পড়লাম ভালো লাগে না। দিনটার কথা ভাবলে মনটাই খারাপ হয়ে যায়। একটা বছর শেষ হয়ে গেল। দিন খালি চলেই গেল। কাল শুরু হওয়া জানুয়ারী মাসটাও চলে যাবে, ফেব্রুয়ারীও চলে যাবে বইমেলা করে করে, দেখতে দেখতে মার্চের শেষে মনে হবে নতুন বছরেরও তিন মাস শেষ। আমার আম্মু সব সময় বলতো যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। আমি বলি যায় দিন খারাপ, আসে দিন জঘন্য। সময়কে একটা কারনে আমার ভালো লাগে তা হলো সময় পুরোনো হলে কিছু মুহূর্তের কথা মনে পড়ে। এছাড়া সময় আর কি, কিছু সংখ্যা, যা আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছে আপনার দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে, আপনি বুড়িয়ে যাচ্ছেন, আপনার অনেক কাজ পেন্ডিং-- এতটুকুই তো।
অনেক দিন পর ঢাকায় মিষ্টার কালাম সাহেব আসছে। ভাবছিলাম কালাম সাহেবকে নিয়ে কেন লিখি নাই কোনো ব্লগ, অবাক লাগছে। অথচ কালাম সাহেবকে নিয়ে আমার সিনেমা বানানোর কথা। কারন সিনেমার মতোই উনার জীবনে খালি টুইস্ট। প্রথমেই বলি, আমি অনেককেই সাহেব বলে ডাকি, যাদেরকে হয়তো কেউ সাহেব বলে না। অনেকেই টিটকারী মেরে বলে, ওমুক আবার সাহেব হলো কবে? আমি অবাক হই সাহেব মানে কি খালি শার্ট স্যুট পড়া লোকজন। সাধারন নিম্নবিত্ত মানুষ, সততার সাথে কাজ করে তারাও আমার কাছে সাহেব। সাহেব নাম শুনলে আমার আরেক জিনিস মনে পড়ে, নায়ক ফারুকের সিনেমা। আমি সাহেব নামের এক গোলাম/শুধু হুজুর হুজুর করে গেলাম। আর যা মনে পড়ুক তা আর লিখছি না, যে প্রসঙ্গে বলছিলাম- কালাম সাহেবের বয়স ৭০, প্রেজেন্টলি তিনি ভোলায় থাকেন। সনদ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। আগে মোহাম্মদপুরে ছিলেন। যখন পুরো সোসাইটির খাল দখল করে বস্তি ছিল। উনার মতো মানুষ আমি খুব একটা দেখি নাই, এত লজিক্যাল চিন্তা ভাবনা করে কথা বলতো, অথচ তিনি একজন রাজমিস্ত্রী। উনার সন্তান পাচজন, পাচজনকেই তিনি পড়াশুনা করানোর চেষ্টা করেছেন, যখন দেখলেন হয় না তখন কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কেউ ড্রাইভার, কেউ রাজের কাজ করে, কেউ বা উনার মতো লোয়ার লেভেলের কন্ট্রাক্টর। অভাবে তিনি ছিলেন না কখনোই, একবার এক বিল্ডিংয়ে কাজের সময় হয়রানিমূলক ডাকাতি মামলাই উনাকে শেষ করে দিয়েছে। উনার পুজি সঞ্চয় যা ছিল সব শেষ হয়ে গেল, মামলা মোকাদ্দমা থেকে রক্ষা পেলেও ঢাকাতে উনি থাকতে পারেন নি, চারটা কর্মজীবী সন্তান থাকার পরেও। ভোলায় থাকেন, গ্রামের বাড়িতে, সেখানেও জায়গা জমি নাই, খালে মাছ মারেন, টুকটাক তা বেচেন, সব্জী কিনতে হয় না এতটুকুতেই চলে যাচ্ছেন। এত অভাব অভিযোগের ভেতরেও কালাম সাহেবের হাসি আগের মতোই উজ্জল। এখনো নেভী সিগারেট অফার করলে উনি বলে উঠেন, শান্ত আপনি নিজে খান না কিন্তু আমাকে যে পরিমান চা সিগারেট খাইয়েছেন তাতে আমি সিগারেট খাওয়ার যে গুনাহ তা সব পেয়ে গেছেন। তিন বছর পরে ঢাকায় এসেই উনি সোজা খুজেছেন আমাকে। কিন্তু আমি তো এখন রাত ছাড়া যাই না দোকানে তা উনি জানেন না। পুলককে পেয়েছিল। আমাকে পুলক ফোন দিলো, শান্ত ভাই আপনার মুরীদ কালাম সাহেব তো ঢাকায়। আমি বললাম উলটা বলেন কেন, আমি কালাম সাহেবের মুরীদ। কারন কালাম সাহেব শুধু মাত্র একাত্তরে চিড়া খেয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে, বরিশালে রাত জেগে রেকি করেছে, গ্রেনেড নিয়ে ছুটে চলেছে মাইলের পর মাইল। আমি যেমন খুবই হতাশায় থাকি, উনি শত বিপদেও কখনও হতাশ হন না, উনার ডায়লগ একটাই-- মরে তো যাইতাম সেই একাত্তরেই, এখন যাই বাঁচি তাই বোনাস, কোটি কোটি টাকা দিয়ে বাড়ী গাড়ী করতে পারে মানুষ, দেশের জন্য যুদ্ধ তো আর করতে পারেনা।' কালাম সাহেবে ঢাকায় আসছে একটা কাজে। দেখলাম উনার চশমার অবস্থা ভালো নয়, উনাকে একটা চশমা বানিয়ে দিলাম গত সপ্তাহে। উনি যে অবাক, আশাই করে নাই। কারন উনার কাছে আমি পুলক পোলাপান মানুষ।
বছরের আজ শেষ দিন। সবার মতো রেজ্যুলেশন ছিল না, তবে প্ল্যান মাফিকও কিছু হয় নাই। কোথাও ঘুরতে যাই নি। কাছের বন্ধুদের বিয়ে হলো অনেকের সেখানেও যাই নি। নিজের মতো ছিলাম, নানান কাজে ব্যস্ত ছিলাম, দিন চলে গেছে। শরীরটা মাঝে মাঝে টুকটাক খারাপ গিয়েছে এছাড়া সুস্থই ছিলাম। জামালপুরে কম গেছি, প্রিয় শহর চিটাগাংয়ে যাই নি। মনে সব সময়ের মতো অস্থিরতা ছিল, সামনেও থাকবে। কিছু কিছু মানুষকে চিনছি যারা প্যাথেটিক। কেউ কেউ আবার আমাকে চিনছে যে আমি আজাইরা। সিনেমা বলিঊডের খুবই কম দেখছি। হলিউড আর সাউথের সিনেমা নিয়ে পড়েছিলাম। থ্রিলার, ড্রামা থেকে শুরু করে কমেডি অসংখ্য সিনেমা দেখলাম। বলিঊড না দেখা জাতে উঠা না, আড্ডায় বসলেই ছোটভাইদের মুখে সিনেমার গল্প শোনা হয়ে যায়। তা নিয়ে পাচ মিনিট ভাবলেই সিনেমা দেখার ফিলিংস পেয়ে যাই। বই পড়েছি সমানে। আগে পড়া বইও পড়েছি, দেখি অনেক কিছুই মনে থাকেনা এখন আর। আগে যে ভালো স্মরণ শক্তি তাই মার খেয়ে গেছে। স্মরণ শক্তি জিনিসটাকে আমরা অবহেলা করি, কিন্তু এই জিনিসটা খুব কাজের। আপনি এত কিছু পড়ছেন তা সামান্যও যদি মনে রাখতে না পারেন তবে তা কাজের কিছু হলো না। নিজেকে শাণিত করার জন্য মনে রাখার চেষ্টা করাটা জরুরী। আমার এক বন্ধু সব সময় আমাকে বলতো দাগিয়ে পড়তে, এখন বুঝি সেই কথা বলার মর্ম। আমার আরেক বন্ধু বলতো সিনেমা যা দেখি তা লিখে রাখতে পারলে প্লট পয়েন্ট সহ। আমি হেসে বলেছিলাম, ফেসবুকে পুতুপুতু সিনেমা নিয়ে রিভিউ তো লিখবো না যে লিখে রাখতে হবে। এখন মনে হয় লিখলেও মন্দ হতো না, কত সিনেমা দেখলাম তা নিয়ে একটা ধারনা হতো। আগামী বছর বেচে থাকলে আমি ক্লাসিকে আবার ফেরত যাবো। ক্লাসিক বই, ক্লাসিক সিনেমা, ফেসবুকে কম স্ট্যাটাস, চায়ের দোকান আরো কমিয়ে দিয়ে নিজের যা ভালো লাগে সেইসবে আরো ফোকাস হবো। অবশ্য জানি অনেক কিছুই হবে না, যেমন এ বছরেও হয় নি। আর আমি বিশ্বাস করি না যে নতুন একটা বছর আসলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সংখ্যালঘু হামলা, জঙ্গি হামলা। নারী নির্যাতন, মানুষ খুন, রাষ্ট্রের আরো অন্ধকারে যাওয়া, পাবলিক হয়রানি, মধ্যয্যগীয় অসভ্যতা, নিম্নমানের ইস্যুভিত্তিক সব আলোচনা সমালোচনা চলবে, রেখে যাবে তার দগদগে ক্ষত। বছরের শেষ সকালটা স্মৃতিতে রাখলাম এই পোষ্টটা লিখে!
ভাই অনেক দিন পর আপনার ব্লগ পড়লাম। খেলা দেখার অনুভূতি আপনার সাথে আমারো একই। টিভি নাই, তাই মোবাইলে নেট কিনে ঘুম থেকে উঠে যা খেলা দেখলাম তাতে পুরাই হতাশ। আর আমার অবস্থা এখনো আগের দুই বছরের মতই, তাই নতুন বছর পুরান বছর নিয়া এত আগ্রহ নাই। তবু আশা রাখতে ইচ্ছা হয়। আর আপনি লিখতে থাকেন ভাই, ভালো লাগে পড়তে।
স্মরণ শক্তি, চোখের জ্যোতি, শরীরের বল সবই বয়সে টের পাওয়া যায়। আগে হলে হয়ত এসব হেসে উড়িয়ে দিতাম কিন্তু এখন আস্তে আস্তে টের পেতে শুরু করেছি
মন্তব্য করুন