আমরা এমনি এসে ভেসে যাই!
বাসায় মোটামুটি গত এক সপ্তাহ মেহমানে ঠাসা ছিল। আজ বাসা ফাকা, সামনেও কদিন থাকবে ফাকা। কেউ আমার সাথে রুম শেয়ার করছে আমি তার সামনে গোটা গোটা করে ফেসবুকে ব্লগে লিখছি ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন জানি লাগে। এই জন্য মেহমান থাকলে আমি ঘুম না আসলেও শুয়ে পড়ি, বাইরে বাইরে থাকি, বসে বই পড়ি। অবশ্য আমার এখন মেহমান দারী করার সময়, যারা বাসায় আসে তারা দুরের কেউ না, তাও আমার সব সময় ওউন করা লাগে। যেমন বন্ধু বান্ধব মামা মামী ভাই ভাবী বাবা মাকে আমার আপন লাগে। এরবাইরে সবাইকে পর, অনেকে চাচাদের খুব ভালো পায়, আমি চাচাদের সাথে দুই কথার বেশী কথা খুজে পাই না। এরপর মানুষ বিয়ে করে, শ্বশুর শ্বাশুরী শালা শালী কত জনের সাথে কত মধুর আলাপ করে, ফোনে গুটুর গুটুর করে আলাপ করে, আমি ক্লোজ রক্তের আত্মীয়ের সাথেই কথা বলার কিছু খুঁজে পাইনা। এরচেয়ে অপরিচিত মানুষের সাথে অনেক কথা বলতে পারি, হেঁটে হেঁটে যে ব্যক্তি দই বিক্রি করে কিংবা রেন্টে কার চালক অথবা ইউনিভার্সিটির উঠতি ছাত্র বা স্কুল পড়ুয়া কিশোর এদের সবার সাথেও আমি রাজ্যের আলাপ জমাতে পারি। আবার যেখানে আলাপ জমালে সুবিধা প্রাপ্তির কিঞ্চিত সম্ভাবনা আছে সেখানে গিয়ে চুপচাপ থাকি। আমার এই ডিলেমা গুলো আমি আজো বুঝলাম না। এই জীবন কেটে যাবে এইসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই।
পত্রিকায় দেখি আদনান নামের এক ছেলের খুন নিয়ে সবাই খুব চিন্তিত। কিশোরদের গ্যাংবাজি নিয়ে সবাই খুব উদ্বিগ্ন। ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভাবছিলাম। প্রতিটা ভাবনার মতো এটাও একটা কনক্লুশনে আসলো যে- এইসব হবারই ছিল। কারন প্রথমত কিশোর গ্যাংবাজী নতুন কিছু না। আগে হতো ওমুক এলাকার ছেলেরা তমুক এলাকার ছেলেদের পেটাতো, কিন্তু সমস্যা হয়েছে এখন খালি পেটানোতেই সীমাবদ্ধ না, এখন তা খুনের মাধ্যমে চলে গেছে। সেদিন এক কিশোর ছেলের সাথে পরিচয় হলো, যার পকেটে আছে হাজার দশেক টাকা। আমি জিগ্যেস করলাম এতটাকা নিয়ে ঘুরো কেন? তার জবাব- ভাইয়া আমার বাবার অনেক টাকা। প্রতিদিন নাকি লাখের উপর আনে। আমি বললাম ব্যবসা করে, জবাব আসলো-না ভাইয়া। সচিবালয়ে আছে। ঘুষ না ভাইয়া এমনিতেই আমার বাবাকে দেয় সরকার, খুব ভালো কাজ করে দেখে। বোকা কিশোরের বোকা জবাবে তাজ্জব হলাম। আমার কিশোর বেলায় আমার বাবাও কোনোদিন অযথা ১০০০০টাকা পকেটে নিয়ে ঘুরে নাই। এখন এই ছেলে যদি বোকা থেকে চালাক হয়ে দুনিয়া বোঝা শুরু করে, খারাপ হতে তার সময় লাগবে একদিন। আর এখনকার জন্মের পর থেকে ট্যাবে অভ্যস্ত ছেলেমেয়েরা সব বুঝে, নিজেদের বিশাল কিছু ভাবে। কিন্তু সমাজ তাকে বুঝে না। সমাজ থাকে ভাবে শিশু কিশোর। নিজেদের 'ম্যান' প্রমান করতে গিয়েই এত কাহিনী। আবার সাধারন শ্রমজীবি কিশোরদের সাথেও আমার পরিচয় আছে, যারা কেউ কেউ খুব ভালো, বাবা মায়ের কষ্ট বুঝে, অল্প কটা টাকার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে। আবার কেউ কেউ সিমল্পী নষ্ট হয়ে গেছে, ইয়াবা গাজা বেচে স্মার্টফোন চালায়, চিপা জিন্স পড়ে নিজেদের কিছু একটা ভাবে। সমস্যার শুরু আসলে আমরা কিশোরদের কিশোর জীবন দিতে পারি নাই, যেমন শিশুদের দিতে পারি নাই আদর্শ শিশুকাল। মাঠে খেলাধুলা, বন্ধুদের সাথে বেড়ে উঠা, ভালো বই, ভালো সিনেমা, ভালো বিনোদন দিয়ে তাদের বোঝাতে পারি নি তোমরা কতটা প্রেশাস! কেউ পেয়েছে ভোগের সমুদ্রে ডুবে থাকা কেউ পেয়েছে তাচ্ছিল্যময় একটা যন্ত্রনাময় জীবন। ক্লাস সেভেন এইটের অনেক ছেলেদের কাছেই এখন সব চেয়ে মুল্যবান জিনিস হলো ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড পেয়ে মনের খুশীমতো ফেসবুক চালানো, দল বেধে সেলফি তোলা,কার একাউন্টে কয়টা মেয়ে আছে তা নিয়ে ঝগড়া করা। যেমন বারেক সাহেবের সন্তান জুয়েলের জেলাসি হলো তার এক বন্ধুর ১৪৫৫ বন্ধু আছে যার বেশীর ভাগই মেয়ে। আমার মনে হয় মাদ্রাসার ছেলেপেলেরা এদের চেয়ে অনেক ভালো, বিকেলে তারা নিজ গরজে ক্রিকেট ফুটবল খেলে, অন্তত মোহাম্মদপুরে বেশীরভাগ মাঠ বিকালে সকালে মাদ্রাসা আর ক্যাম্পের ছেলেদের কলতানে মুখরিত। এই শুক্রবার এক ছোট ছেলেকে দেখলাম যাকে নিয়ে গেছে কোরআন খতম দিতে, সে তা বাদ দিয়ে তাকিয়ে আছে রাস্তায় যারা খেলছে তাদের দিকে। আমার বাসার নীচে মেয়েরা ব্যাডমিন্টন খেলে রাস্তায়, তাদের দেখি আলাপের বেশী অংশই ফেসবুক আর বলিউড। এই যে আমরা জেনারেশন শেষ করে দিচ্ছি এর কুফল আরো নানা মাত্রায় পাবো সামনে। আগে একটা সময় আমাদের নামে কেউ বিচার দিলে বাবা মা আমাদের ধরতো, এখন বিচার দিলে উল্টো বাবা মা বলে আপনার সন্তান ঠিক করেন। এই ব্ল্যাংচেক পেয়ে শিশু কিশোররা নিজেদের ইয়াংস্টার ভাবতে শুরু করেন। সন্তান তখন নিজেদেরকে ডন নাম্বার ওয়ান ভাবা শুরু করে।
কিশোরদের নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আমার শিহাবের কথা মনে পড়ে। শিহাবকে আমি চিনি না। হয়তো দেখেও থাকতে পারি। আমার ক্লোজ ছোটোভাই অনিকের কাছের ভাই। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র। প্রথমে খবর পেলাম সে সুইসাইড করেছে আদাবরে। পরে শুনি তাকে খুন করা হয়েছে। পুলিশ যাদের সন্দেহ করছে তারা সবাই তার বন্ধু। নেশার সহযাত্রী। জানি না আর বিস্তারিত। তবে খুন কেন হবে সে? অনিকের মতে শিহাব খুবই ভদ্র ছেলে। খালি নেশাই করতো তাও বাপের অঢেল টাকা পয়সা ছিল বলেই। কিন্তু খুন হবার মতো ছেলে সে কখনোই না। খুন হবার আগের দিনও নাকি সে তার বান্ধবীকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে, কতটা কেয়ার করে তা বারবার জানিয়েছে। শিহাবের জন্য আমার মাঝে মধ্যে এক প্রস্থ বেদনা ভর করে। এমনিতেই আমাদের জীবন খুবই ঠুনকো, অনিশ্চিত, এক্সিডেন্টময়। তার ভেতরে যদি কেউ আপনাকে মেরেই ফেলে তাহলে থাকলে কি? অনিক বলছিলো বিলাপ করে করে কাঁদে তার মা বোন। এই অন্তবিহীন দুঃখের ক্ষত শুকাবে কিসে?
শিরোনামটা নিয়েছিলাম ডিএল রায়ের এক গান থেকে। গানটা আমার খুব প্রিয়।স্কুলে আমাদের কমার্সের তিনটা সাবজেক্টের টিচার ছিল গফুর স্যার, ভালো মানুষ। উনাকে সবাই ডাকতো গফরা বলে। আমিও ঝোকের মাথায় ডাকছিলাম গফরা, আমার যে বন্ধু সে কোনোকারনে আমার উপর ক্সিপ্ত ছিল সে দিল বিচার। আমাকে স্যার জিগ্যেস করে, জাকারিয়া আমাকে ওই নামে কেন ডাকোস? আমি তোর দোস্ত বন্ধু লাগিরে? আমি তো স্যারকে বলতে পারিনা মহেশ গল্পের কথা। ভুলে বলে ফেলি- এমনি। স্যার দিয়েছিলো বেদম মার। এই বয়সে এসে বুঝেছি সব কিছুই এমনিতেই। আমাদের জীবন এইভাবেই কেটে যাবে, এমনি এমনি দিন গুলো যাবে চলে, কাজের কাজ কিছু হবে না খালি বয়ানে দিয়ে যাবো। এমনি এমনি এই দেশটা দোযখ হবে, এমনি এমনি আমরা দেখে যাবো শুধু। বাসে উঠেছিলাম এক লোক সকাল সকাল বসার জায়গা নিয়ে খুব চিন্তিত। সকাল সকাল বাসের সিট ঝাড়ছে, মুখে মাস্ক বাধা, দেখলাম তিনি হুট করে উঠেই একজন মহিলার গায়ের উপর প্রায় বসে পড়লো। ভদ্র মহিলা কিছুই বললেন না, শুধু সরে গিয়ে তাকিয়ে দেখলেন। দু ঘা তিনি লাগিয়ে দিলেও কেউ কিছু বলতো না, তিনিও এমনি এমনি সব সহ্য করে নিলেন। আমার কেন জানি মনে হয় আমরা সবাই যারা লজিক্যাল চিন্তাভাবনা করি, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হই, তারা সেই মহিলার মতো ফেসে গেছি। কেউ কেউ আমার মতো না দেখার ভান করে ভেসে গেছি।
আমাদের দেশের মানুষদের জীবন যাত্রার পার্থক্য এতো বেশি যে বাচ্চারা অনেক হীনমন্যতায় ভোগে ছোটবেলা থেকেই -- আর পরিবেশ থেকে ভাল কিছু তো পায় না ফলে যা হবার তাই হয়
আসলেই তাই
মন্তব্য করুন