ইউজার লগইন

চন্দ্রালোকের ছায়া-৩

kintai-bridge-yamaguchi-prefecture-japan.jpg


নদীর উপরে চওড়া সাদা ব্রীজটা আমাদের শহরটাকে যেন মেপে মেপে দুভাগে ভাগ করেছে। নদীর কাছে পৌঁছতে আমার মিনিট বিশেক লাগে। আমি জায়গাটা প্রচন্ড ভালোবাসতাম। কারণ হিতোশি থাকতো নদীর ঐ পারে, আর আমাদের এখানেই দেখা হত।হিতোশি মারা যাবার পরও তাই, জায়গাটাকে আমি এখনও অনেক ভালোবাসি।
ব্রীজটা এখন জনমানবশূন্য এবং নিড়িবিলি। শহরটাকে ভোরের নীলাভ আর ধোঁয়াটে রং এ কেমন যেন ঘোলা ঘোলা দেখাচ্ছে। আমি শূন্য চোখে নদীর ও পারে তাকিয়ে আছি। কে জানে কেন? আমি একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িযে, নদীর কুলকুল শব্দ শুনছি আর ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছি গরম চায়ে, কোন তাড়া নেই আমার। ভোর রাতের সজীব বাতাসে শীতের কাঁপন লাগছে আমার গায়ে। আমার মনে হচ্ছে, আমি মৃত্যুর খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছি। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। এরকম নিস্তব্ধ ভূতুড়ে জাযগায় এরকম চিন্তা আসাটাই স্বাভাবিক মনে হয় আমার কাছে। অথচ সারা রাত নিজের উপর যে অত্যাচার করি রোজ, তার অবসান ঘটে কেবল এখানে এসেই। এই মুক্তিটুকু ছাড়া আমি বোধ হয আমার দিনগুলো কোনভাবেই পার করতে পারতাম। শুধু আমিই জানি, আমার জীবনে এই জায়গাটার কতটা প্রয়োজন ছিল।


আজ সকালেও আমার ঘুম ভাঙ্গলো কোন রকমে ভয়াবহ রাতটা পারি দিয়ে। ঘড়িতে তখন পাঁচটা বেজে ত্রিশ। ভোরের সূর্যটা উঠি উঠি করছে , একটা সুন্দর সকালের আশায়।
আমি কাপড় চোপড় পরে প্রতিদিনের মত বাইরে বেরুলাম।
চারিদেকে এখনও অন্ধকার। কোন জনপ্রাণী নেই রাস্তায়। তীব্র শীতল বাতাস বইছে। রাস্তাটা কুয়াশায় ধোঁয়াটে হয়ে আছে। আকাশ কড়া নীল। শুধু পূর্ব দিকের আকাশে একটু পারিবর্তন দেখা যাচ্ছে। মৃদু লালচে আভা আকাশের কোলে উঁকি দিচ্ছে।
আমি জোর করে দৌঁড়াচ্ছি। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, কেমন হাঁপিয়ে উঠি। এসব আর কিছুই না, আমার শরীর মনের উপর যে দীর্ঘদিনের ধকল যাচ্ছে, তারই ফসল।
আমি সব কিছু তুচ্ছ করি, আমি দৌঁড়াই। দ্বিধাগ্রস্তের মত ভাবি, আমি বাড়ি ফিরে তো ঘুমাতেই পারবো।
রাস্তাটা এত শুনশান আর নিড়িবিলি যে আমি জোর করে, সচেতন থাকার চেষ্টা করি।
নদীর কুলকুল ধ্বনি স্পষ্ট হতে থাকে। চোখের সীমানায় জেগে ওঠে নদীটা। এ মুহুর্তে আকাশটাও তার রং ঘন ঘন বদলাচ্ছে। প্রতিদিনের মত ব্রীজটার কাছে পৌঁছে, রেলিংটায় ঝুঁকে বসি।
এখন আমি অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে আছি রাস্তার দিকে। সারি সারি ইমারত গুলো যেন ঝুলে আছে, শীতের হাল্কা কুয়াশায়। বাড়িগুলোকে মনে হচ্ছে নীল বাতাসের সমুদ্রে নিমগন।
নদী বয়ে চলেছে আপন মনে, সামনে যা পাচ্ছে তাই নিয়ে যাচ্ছে নিজের সাথে; ঢেউয়ের তালে তালে ভেসে যাচ্ছে সাদা ফ্যানাগুলোও।
চারিদিকে শীতল বাতাস। আমার মুখে আর্দ্র বাতাসের ঝাপটা লাগছে। মার্চের আকাশে চাঁদ এখনও দারুণ স্পষ্ট। আমার নিঃশ্বাসে সাদা ধোঁওয়া বেরুচ্ছে।
আমি আমার এ্যালুমেনিয়াম বোতলের ঢাকনাটা খুললাম, তারপর আস্তে করে তাতে ঢাললাম-গরম চা।
আমার দৃষ্টি এখনও নদীর ও পারে। আমি শূন্য চোখে তাকিয়ে আছি।

হঠাৎ ই আমার কানে এল, কেউ যেন বলছে, "এটা কি ধরণের চা? আমি একটু পেতে পারি।"
আমি এতটাই চমকে উঠলাম যে, আমার হাত থেকে এ্যালুমেনিয়ামের বোতলটা ঝুপ করে খসে পড়লো নদীতে। আমার আরেক হাতে এখনও বোতলের মুখটা ধরা। ধোঁওয়া উঠছে গরম চা থেকে।
আল্লাই জানে, কি এটা? দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভয়ে ভয়ে পেছন ঘুরলাম। দেখি, এক অল্প বয়স্ক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে আমার পেছনে।
দেখে মনে হচ্ছে, আমার চেয়ে বড়, কিন্তু কোন একটা বিচিত্র কারণে আমি তার বয়স অনুমান করতে পারছি না। মনে হয় পঁচিশ টচিশ হবে। ছোট ছোট চুল এবং স্বচ্ছ বড় একজোড়া চোখ।পরনে সাদা পাতলা কোট। দেখে মনে হচ্ছে মোটেও শীত লাগছে না মেয়েটার। ন্যূনতম শীতের অনুভূতি নেই মেয়েটার মধ্যে।
মেয়েটা যেন এই মাত্র মাটি ফুঁড়ে উদয় হল। কোন রকম ক্লু ছাড়াই আমার পেছনে এমন করে এল কিভাবে, সেটাই ভাবছি।
হঠাত কোত্থেকে এসে, একটু নাঁকি কিন্তু মিষ্টি সুরে হেসে হেসে আমাকে বললো " তুমি যেভাবে চমকে উঠে তোমার বোতলটা পানিতে ফেল্লে, সেটা দেখে আমার ব্রাদার গ্রিমের কুকুরের গল্পটা মনে পড়ে গেল, অথবা ঈশপরে গল্পও বলতে পারো---" মেয়েটা এখনও হাসছে।
আমি শীতল গলায় বল্লাম, গল্পের কুকুরটা তার নিজের ছায়া পানিতে দেখে মুখের হাড়টা পানিতে ফেলেছিল, কেউ তার পেছনে তোমার মত বিনা নোটিশে উদয় হয়নি।
মেয়েটা হেসে বল্লো, আমি তোমাকে একটা নতুন ফ্ল্যাস্ক কিনে দিতে চাই।
তার হাসিটাকে ফেরত দিয়ে ঠান্ডা গলায় বল্লাম, ধন্যবাদ।
তবে মেয়েটা এমন শান্ত কথা বলার ভঙ্গি দেখে, আমার বিশেষ ভয় লাগছিল না।
আবার তার মধ্যে আগ বাড়িয়ে ভাব করারও কোন লক্ষণ দেখা গেল না। সেটাই স্বস্তির।
না,মেয়েটার মধ্যে কোন পাগলামির লক্ষণ নেই, এমন কি তাকে দেখে মদ্যপও মনে হচ্ছিল না। এখানে অনেকেই আছে এই মেয়েটার মত, যারা সারারাত পান করে, শেষ রাতে বাড়ি ফেরে। মেয়েটাকে তাদের মতও লাগছে না কিছুতেই। চোখ দুটো দেখলেই মনে হয়, মেয়েটা অনেক জানে।
এই চোখ দুটো দেখলে যে কোন পুরুষ প্রেমে পড়ে যাবে। কেমন মাদকতা আছে চোখ দুটোয়।
মুখ দেখে মনে হচ্ছে, পোড় খাওয়া একটি মুখ, অভিজ্ঞতায় ভরপুর।মেয়েটারমধ্যে কি যেন আছে, তার চারপাশের বাতাসেও কেমন একটা গতিময়তা অনুভব করলাম।


আমি চায়ের কাপে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে -কাপটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। এটা পু-আরা চা।
ইশ! পু-আরা চা, আমিও খুব পছন্দ করি, মেয়েটা তার সরু হাতটা এগিয়ে দিয়ে, আমার হাত থেকে কাপটা নিল। মেয়েটা নদীর দিকে তাকিয়ে বল্লো, আমি কিছুক্ষণ হল এখানে এলাম। আমি আসলে এখান থেকে, বেশ খানিকটা দূরে থাকি।
মেয়েটার চোখে আমি পর্যটকের মত মুগ্ধতার ঝলক দেখতে পাই।
সাইটসিয়িং?
আমি বিষ্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করি, আসলে মেয়েটা আমার এই বিশেষ জায়গায় কি এমন দেখতে এল, সেটা ভেবেই আমি বেশ অবাক হচ্ছি।
হুম, আসলে এই জাযগাটায় এমন একটা কিছু দেখা যাবে, যেটা শুধু প্রতি ১০০ বছরে একবারই দেখা যায়।
তুমি কি কিছু শুনেছ? এ ব্যাপারে? মেয়েটা উল্টো আমাকে জিজ্ঞাসা করে।
কিছু একটা দেখা যাবে? আমার বিষ্ময় কাটেনা।
হুম, যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে।
কি সেটা?
আমি এখুনি তোমাকে বলতে পারছি না। কিন্তু কথা দিলাম, আমি তোমাকে বলবো...... ঠিক বলবো, মেয়েটা হাসতে হাসতে বল্লো।
এবং আমি তার শেষ কথাটুকুর আগামাথা কিছুই বুঝলাম না।

চারিদিকে তখন সকাল হয়ে যাচ্ছে। সূর্য়ের আলো নীল আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে। বাতাসের ধোঁয়টে ভাবগুলো কেটে যাচ্ছে সকালের সোনালী আলোয়।
আমার ফিরে যাবার সময় হয়ে এসেছে। তাই আমি বল্লাম, ঠিক আছে, আমার যাবার সময় হল-
ঠিক সে সময মেয়েটা আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে, উজ্জ্বল ভঙ্গিতে বললো, আমার নাম, উরারা।
তোমার?
সাৎসুকি।
উরারা হতে ঢেউ তুলে বিদায় জানাতে জানাতে বললো, ঠিক আছে সাৎসুকি আবার আমাদের দেখা হবে।
আজ চলি।

পোস্টটি ৭ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মীর's picture


প্রথমত লেখাটা খুব সুন্দর। আর দ্বিতীয়ত আপনার অনুবাদ খুব ভালো। সকাল সকাল এমন পোস্ট পড়ে মনটা খুশী হয়ে গেলো। স্পেশাল থ্যংকস্ আপনাকে

নুশেরা's picture


তোমার গদ্য বরাবরই ঝরঝরে, অনুবাদও। শ্রমসাধ্য সময় দিচ্ছো। ছবিটাও দারুণস্য দারুণ! তবে বেশ কিছু টাইপো রয়ে গেছে, দেখো তো। আরেকটা কথা হলো অনুচ্ছেদ ভাগ হলে চোখে আরাম লাগতো Smile

তানবীরা's picture


ছবিটা মারাত্বক। অনুবাদ দারুন হচ্ছে

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

শাপলা's picture

নিজের সম্পর্কে

আমি ভালোবাসি, মা, মাটি, আমার আত্মজা এবং আমার বন্ধুদের যারা আমাকে প্রকৃতই বুঝতে পারেন।