সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো
এই শহরের ফুটপাতেই বেড়ে ওঠা তার। বয়সে হয়তো আমার বড়ো বা আমার ছোট, যেহেতু সঠিক জানি না তাই বয়সের হিসেবটায় যাচ্ছিনা। ছেলেটার নাম অভি। তাকে নিয়ে আমার অনেক কৌতুহল। তার মধ্য থেকে সবচেয়ে বড় কৌতুহল হলো তার নাম। আমার মাঝে মধ্যে প্রশ্ন জাগতো তার নাম কে রেখেছিলো? প্রশ্ন জাগার কারণ হলো তার তো কোন মা-বাবা নাই, সে তো জানে না তার কোন পরিচয়, সে কেনো কেউ-ই জানে না, ছোটবেলা থেকেই ভেসে ভেসে বড় হয়েছে সে! তবে তার নামটা রাখলো কে?। আমার প্রশ্ন আমার কাছেই থাকলো, আমি কখনও তাকে জিজ্ঞেস করিনি। সে আঘাত পাবে এই ভেবে।
অভি খুব নম্ন-ভদ্র ছিলো। চুপচাপ থাকতো। কেউ কিছু বললে উত্তর দিতো নয়তো সে কোন কথাই বলতো না। তার জীবন যাপনের মধ্যে এক নদী বয়ে যেতো সে নদীতে পাল তুলতো সহস্র কষ্টের নৌকা। আমার যতোদূর মনে হয়, আমি সব সময় তাকে ঝিম মেরে কিছু একটাতে মগ্ন থাকতে দেখতাম। সেই ঝিম ধরা অভি হঠৎ করে হয়ে গেলো এই পাড়ার পাগলা অভি। কবির সুমনের ভাষায় তার সাথে সাপলুডু খেলছে বিধাতা। চুলে উঁকুনের নিরাপদ ঘরবাড়ি। দিন রাতের কোন হিসেব নেই তার, কোন নেতা ভোটের আগে তার কাছে ভোট চাইতে আসনে না।
আগেই বলেছি তাকে নিয়ে আমার অনেক কৌতুহল এর মধ্যে আরেকটি হলো তার ধর্ম নিয়ে। যেমন তার নাম নিয়ে আমার প্রশ্ন জাগতো তেমনি তার ধর্ম নিয়েও প্রশ্ন জাগে। প্রশ্নটা হলো, অভির ধর্ম কি? সে যখন পাগল ছিলো না তখনও আমি কখনও তাকে কোন ধর্ম পালন করতে দেখিনি, কেউ তাকে ধর্ম পালন করতে বলতেও দেখিনি বরং তাকে ধার্মিকরা অবজ্ঞা করতে দেখেছি। দূর্গাপুজা বা ঈদ জাতীয় কোন উৎসবের বাতাস তাকে কখনও ছুঁয়ে যেতে দেখিনি, সে তো কখনও জানতো না সে কোন ধর্মের, তবে তার হিসেব হবে কি করে কেয়ামতে? তার জন্ম যদি ভুল হয়ে তাকে সেটার দায়ভার কি তার বহন করতে হবে? তার জন্যে বিধাতার নিয়ম তালিকায় কি নিয়ম রাখা আছে?
পাগল অভিকে নিয়ে আমি অনেক ভাবতাম, কেনো ভাবতাম জানি না, জানার চেষ্টাও করিনি। একদিন কোন এক গৌধুরিবেলায় আমি অভির গল্প গৌরবের সাথে করেছিলাম। গৌরব হলো আমার বন্ধু। যে জীবনের মাঝে খুঁজে, বেঁচে থাকাটাকে অর্থময় করে তুরতে চায়, আরো অনেক স্বপ্ন তার। তার স্বপ্ন বা ইচ্ছেগুলোকে আমার কাছে আকাশ ছোঁয়া মনে হতো কিন্তু তার কাছে সেগুলো অনেক সহজ এবং আমি দেখেছি তার স্বপ্নকে সে পেয়েছে অনেক সহজেই কারণ তার আত্মবিশ্বাসটা এতোই স্বচ্চ যে, সে যা চায় সেটা খুব সহজেই পেয়ে যায় বা পাওয়ার আগ পর্যন্ত সে চেষ্টা চালিয়ে যায়। তার জীবন দেখে আমার তাকে ঈর্ষা করার কথা থাকলেও আমি তাকে পছন্দ করতাম। তাই আমি আমার প্রশ্নের হয়রানিগুলো বলেছিলাম গৌরবকে। অভিকে নিয়ে আমার প্রশ্নগুলো একদিন গৌরব নমিতাকে জিজ্ঞেস করলে বারবারই ব্যর্থ হয়েছে গৌরব, নমিতার কোন উত্তর ছিলো না। নমিতা গৌরবকে বারণ করে দিলো এসব তাকে না বলতে। এরকম অনেক দেখেছি ধর্মের বিষয়ে কোন উত্তর না দিতে পারলে তারা অন্যদিকে মোড় নেয় বা নাস্তিক বলে উপেক্ষা করে কিন্তু আমার কাছে বা গৌরবের কাছে কেনো জানি মনে হয় এইটা তাদের পরাজয়। সে যাই হোক শেষ পর্যন্ত গৌরবের প্রশ্নগুলো তার ভেতরই থাকলো। গৌরব নিজেই এর উত্তর খুঁজে চলছে এবং গৌরব ভেবে দেখলো অনেক কিছুতেই শেষ পর্যন্ত নিজেই করতে হয়। নমিতাকে বলেছিলো কথাগুলো, নমিতা একটু রাগ করে বললো ‘আমি তো তোমার কেউ না, সেটা আমি জানি, আমার সাথে তোমার সব ‘শেয়ার’ করবে কেনো?। গৌরবের মনে হলো আসলেই কি নমিতা তার? কতটুকু সত্যি সে যে নমিতা তার? এই দ্বিধার উত্তর গৌরব পায় না এই জন্যে যে, নমিতার আচরণ মাঝে মধ্যে একটা সন্দেহের প্রচীর তৈরি করে তাদের সম্পর্কের মধ্যে সেই প্রাচীরে গৌরবের বিশ্বাস ধাক্কা খেয়ে ফের তার কাছেই চলে আসে তাই গৌরব নমিতার কাছে সব বলতে পারেনা, নমিতাও যে গৌরবকে তার সব বলেনা তাও গৌরব বুঝে বা জানে। সকলের মধ্যেই না-বলার অনেককিছু আছে, এমন কিছু যা দুজনের কেউ কাউকে কখনই বলতে পারেনা। পারে না তো বটেই, সব সময় শুধু পরস্পরের কাছে কতো ভালোভাবে গোপন করে রাখা যায়, তারই চেষ্টা করে। আর যাই হোক এইটার নাম তো ভালোবাসা হতে পারে না। অন্তত গৌরবের কাছে না। নমিতার কাছে হয়তো ভালোবাসার মানে চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া, চুমু খাওয়া, হাতে হাত রাখা আর সিমেনার নায়ক নায়িকাদের নিয়ে গল্প করা কিন্তু গৌরবের কাছে সেটা না আর এই জন্যেই নমিতার প্রতি ডুবেও গৌরব ডুবতে পারেনা কারণ গৌরবের কাছে মাঝে মধ্যে নমিতার থাকার পরও যে শূন্যতা বিরাজ করে, আচানক মাথা নাড়া দিয়ে ওঠে যে শূন্যতা, তাতে গৌরব বুঝে যে নমিতা তার হতে পারেনি বা গৌরব নমিতার হতে পারেনি। নমিতা যদি পুরোপুরি গৌরবকে তার ভালোবাসায় দখল করতে পারতো তবে গৌরবের মনে হতো না, এমন কেউ যদি থাকতো, যাকে সম্পূর্ণভাবে তারই বলা যেতো, যে সেজে থাকলেও তার, সেজে না থাকলেও তার, দিনে, রাতে, মাসে, বছরে সারা জীবনে শুধু গৌরবের।
মানুষের আসলে কেউ থাকে না। কেউ কারো হতে পারেনা। কেউ যদি হয়ও সেটা হয় ক্ষণিকের জন্যে। আমি দেখেছি, আয়নায় নিজের মুখ ছাড়া আর কেউ নাই নিজের। মানুষ সব শেষ করে নিজের কাছেই ফিরতে হয়। ফিরে। নমিতার সাথে যে কয়দিন উষ্ণ সময় কেটেছে তা আনন্দের ছিলো অস্বীকার করার কোন উপায় নেই গৌরবের তবে সেই আনন্দটা ছিলো ক্ষণিকের। সকল আনন্দই ক্ষণিকের জন্যে হয় ।
বিচ্ছেদ কখনও সুখের হয়না। নমিতাকে ত্যাগ করার পর নমিতার সাথে ছোট ছোট স্মৃতিগুলো বড় হয়ে দৃশ্যমান হতো তাতে বুকের গভীরে অচেনা ব্যথা ছুঁয়ে যেতো সে ব্যথা সামাল দিতে পারতো গৌরব কারণ তার অনেককিছু সামাল দিতে হয় এই জীবনে, জীবনের সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করার মধ্যে যে বেঁচে থাকার সাধ পেতো। সহজ ভাবে তো সবাই বাঁচে, একটু কঠিন করে বেঁচে থাকাটাই তো বাহাদুরী, নয় কি? কথাগুলো বলেছিলো গৌরব। তার বাহাদুরী শুধু মুখেই ছিলো না, তার জীবন যাপনেও ছিলো। মাঝে মধ্যে গৌরব ভাবতো নমিতা যেমন স্বভাব বা চরিত্রের হোক তাকে ভালোবেসেছিলো গৌরব আর ভালোবাসার জন্যে নমিতা অনেক ভুল সে ক্ষমা করেছে। ক্ষমা করার মধ্যেও আনন্দ আছে। শেষবার কেনো তবে ক্ষমা করে দিলো না নমিতাকে? এরকম প্রশ্নটি আমি তাকে করেছিলাম উত্তরে সে আমাকে বললো, যার জায়গা যেখানে তাকে সেখানেই রাখা উচিত। আমি আর কোন কথা বলার কিছু পেলাম না, শুধু এতোটুকু বুঝেছি গৌরবের কথায় যুক্তি আছে।
পথে ঘাটে নমিতার সাথে দেখা হয়, হয় কি হয়ে যায়, দেখা হয়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ পাগল অভির সাথেও। অভির তো কেউ নেই, কেউ নেই না আছে সেটা তার কিছু যায় আসে না, তাতে তার কোন কষ্টও নেই, সুখও নেই তবে নমিতার আরেক সঙ্গী হয়েছে বা গৌরবের সাথে যখন ছিলো তখনও সে সঙ্গী ছিলো বলে গৌরব জানতো। থাকাটাই স্বাভাবিক, কারণ নমিতা তো ভালোবাসা কি সেটাই জানে না, সে শুধু জানে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে প্রেম করে, ব্যস, এইটুকু। তখন আমার মনে হয়েছিলো যে মানুষ ভালোবাসা কি জানে না, ভালোবাসার সুখ জানে না সে অনেকবারই অনেকের সঙ্গে সম্পর্কে যেতে পারে। তবে সেটার নাম ভালোবাসা হবে না, সেটা হবে নিছক কাম। কিন্তু নমিতা যেখানেই থাকুক, যার হয়েই থাকুক, যেদিন সে ভালোবাসা কি বুঝবে সেদিন নমিতা বুঝবে গৌরব তাকে যে ভালোবাসা দিয়েছিলো সেই ভালোবাসা সে আর কারো কাছ থেকেই পায়নি এবং নমিতার বাকি জীবনে কখনও গৌরবকে সে অস্বীকার করতে পারবেনা, কারণে অকারণে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় গৌরব তার মধ্যে বেঁচে থাকবে, আর গৌরবের বিজয় বুঝি সেখানেই। কিন্তু আমার মনে হওয়া পাল্টে গেলো তার কয়েদিন বা কয়েক মাস পর। যখন দেখলাম গৌরব অভিকে খুঁজছে সারা শহরে কিন্তু অভিকে পাচ্ছে না, এভাবে একদিন, দুইদিন করে প্রায় এক সপ্তাহ গৌরব খুঁজেছে অভিকে। অশ্চর্য তখন অভিকে পাওয়া যাচ্ছিলো না কোথাও তারচে’ আশ্চর্য হলো এভাবে হন্য হয়ে গৌরব কেনো খুঁজছে একটি পাগলকে! কি কাজ বা দরকার তার পাগল অভির সাথে? অবশেষে সপ্তাহ এক বা দুই বা তারও বেশি সময় পর গৌরব অভিকে পেলো শহরের কোন এক ফুটপাতে তার মতো করে শুয়ে থাকতে। সেদিন রাতেই বা এরপর পরে কোন এক রাতে অভি সমেত গৌরব যখন নমিতার সঙ্গে দেখা করলো সে রাতে বিশাল একটা চাঁদ উঠেছিলো আকাশে, সে চাঁদ জ্যোৎস্না দিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে দিগবিদিক। অভি তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে তার উঁকুন ভরা মাথা চুলকাতে ব্যস্ত, মাথা চুলকাতে চুলকাতে যখন তাকালো তখন দেখলো তার পায়ের কাছে শুয়ে আছে নমিতা আর তার চারপাশ ভেসে যাচ্ছে রক্তে, সে রক্তে জ্যোৎস্ন এসে পড়ছে! অভি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো ভূমিকাহীন। গৌরব কখন চলে গেছে আকাশের বিশাল চাঁদ ছাড়া আর কেউ দেখলো না।
গল্পের মধ্যে ধুকে পড়েছিলাম তবে শেষটুকু একদমই অকল্পনীয় ছিল!
পাঠ ও মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
পড়লাম।
গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম তবে শেষটুকু একদমই অকল্পনীয় ছিল!
টাইপোগুলো দেখে নিও
পাঠ ও মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
শেষটা মারাত্মক।
আপনের লেখা দিনকে দিন আরও ভাল হচ্ছে।
অনেক দিন পরে আসলেন। ভাল আছেন তো?
এই তো আছি বেঁচে। আপনি কেমন? মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ।
হারাইয়া যান ক্যান?
পড়লাম
পড়লাম
মন্তব্য করুন