ভয় দেখালে কামড়ে দেবো
গুরুর একটা জনপ্রিয় গান দিয়ে শুরু হয়েছিল আগের লেখাটা। এবারও মনে পড়ছে একটা গানের কথা।
লিখতে পারি না কোনো গান আজ তুমি ছাড়া...
এই গানটা কি প্রথম ইত্যাদি অনুষ্ঠান থেকে একই সাথে দেখেছিলাম আর শুনেছিলাম আমি? খুব সম্ভবত। তখন আমি বগুড়ার সুত্রাপুরের দোতলা বাসাটায় থাকি। সময়কাল বয়স যখন ১৩ থেকে ১৭। বয়ঃসন্ধির মধ্যকালটা। সেই সময় কোনোকিছু মাথায় কিংবা মনের ভেতর একটা কিছু ঢুকলে সেটাকে আর বের করা সম্ভব হতো না। গানটা একবার শুনেই মাথায় ঢুকে গেল। এবারে একদম অরিজিনাল ভার্সন। অন্য কারো গলায় গাওয়া না। গানটা যতোবার শুনতাম ততোবার একইরকম গভীর একটা হাহাকার বুকে অনুভব করতাম। অনুভূতি ক্ষমতার প্র্যাকটিস্ যেন!
আমরা বন্ধু ব্লগটা আমার এমন একটা জায়গা যেখানে আমি শুধু আমার জীবনের গতিপথের একটা ছাপ রাখার চেষ্টা করছি। আমি সৌভাগ্যবান কারণ, ওয়েবহোস্টিং একটি সময়, অর্থ ও পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজ এবং সেটা আমাকে করতে হচ্ছে না এই ব্লগের কল্যাণে। তাই ব্লগ কর্তৃপক্ষকে আমার একটা বিশেষ ধন্যবাদ। অবশ্যই প্রতিটি ভাল উদ্যোগ সৃষ্টি করে ভাল উদ্যোগের শেকল। আপনাদের এই উদ্যোগেরও থাকবে গতিশীল ঢেউসদৃশ প্রতিক্রিয়া।
বয়ঃসন্ধির সময়ে বখে যাওয়াটা আমাদের সমাজের অতি-স্বাভাবিক একটি প্রবণতা। এতই স্বাভাবিক যে এটাকেই সমাজের সিংহভাগ টিন-এজার জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে দেখতে পায়। সমাজের তৈরি আরেকটি সুড়ঙ্গ। যার চোখ একবার এই সুড়ঙ্গের ভেতর পড়েছে তার দৃষ্টিক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে একটা টানেল ভিশন-এ। আমি নিজে কি টানেল ভিশনমুক্ত দৃষ্টিশক্তির অধিকারী ছিলাম?
ঈদের দিনগুলির কথা মনে পড়ে। শুধু এই এক উৎসবকে কেন্দ্র করে যতোগুলো রঙিন আঁক জীবনের খাতায় পড়েছে, সেগুলোকে যদি এক মলাটের আওতায় আনা যেতো তাহলে অনেকগুলো ছোটগল্পের একটা সংকলন হতে পারতো। তবে টানেল ভিশনের কঠিন গন্ডি ভেঙ্গে বের হয়ে আসার সাহস কখনোই জোগাতে পারি নি ভেতরে। সময় সময় বরং পটু না হওয়া সত্ত্বেও আঁধার গড্ডালিকায় পা বাড়ানোর চেষ্টা করেছি।
লেখার আসলে তেমন কিছু নেই। ঝিম ধরা চৈত্রের দুপুরের মতো নিস্তরঙ্গ চলছে জীবন। অনেকটা সোহরাওয়ার্দী পার্কের কোনো এক গাছের নিচে, হাত-পা ছড়িয়ে অনন্তকাল ধরে শুয়ে থাকার মতো অবস্থা। আমার যখন সোহরাওয়ার্দী পার্কে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তখন সেখানে এমন লোক ছিল, যারা পেশাদার সেই কাজে। এক বাঁশি গাঁজা খেয়ে নিজেকে কিছু একটা কেউকেটা ভেবে নিয়ে, জগতের আর সব জরুরি ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে সারাটা দিন শুয়ে থাকতে পারতো তারা। আমি পারতাম না। কিছু না কিছু একটা আমাকে করতেই হতো। বেশিরভাগ সময় বন্ধুমহলের ধরা-বাঁধা কর্মসূচী হলেও, মাঝে মাঝে ভয়াবহ অচেনা উৎপাতের উদগীরণ ঘটতো ভেতর থেকে। সেই সময়গুলোতে জখম করেছি নিজেকে, জখম করেছি অন্যদেরকে, আমি জানি।
তারপরও এগিয়ে যাওয়ার এক অনন্ত অবদমন আমাকে সামনে হামাগুড়ি দেয়ার শক্তি জুগিয়েছে। প্রতিটি ভাঙন গলিয়ে-পুড়িয়ে প্রায় শেষ করে দিয়েও যে সামান্যটুকু মুছতে পারে নি, সেখান থেকে প্রত্যেকবার আমি নতুন করে শুরু করেছি। জীবনটা থাকতে পারতো অনেক অন্যরকম একটা চেহারা নিয়ে। সেসব নিয়ে অবশ্য ভাবি না। কল্পনা করে সময় নষ্ট করার চেষ্টা করলে অবদমনের কোনো ঠেলা টের পাই না। ঠেলাটা না থাকলে কোনকিছুতে লেগে থাকতেও পারি না, বরং বিমর্ষ লাগে।
যখন কোনভাবে আমি নিজেকে একটা কাজের মাঝ পর্যন্ত নিয়ে ফেলতে পারি, তারপর কিন্তু সেটা নিয়ে আর চিন্তা করা লাগে না। শুরুটা সবচেয়ে শক্ত, আর শুরুর পর আসে আরেকটা শেষ ধাক্কা, কাজটা থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে, অবশ্যই প্রচণ্ড শক্তি সহকারে। সেই ধাক্কাটা সামলে নিতে পারলেই গিয়ে পরে দেখা মেলে অপূর্ব এক মধুস্বাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতির। যে কাজটাকে যতবেশি পছন্দ করি, সে কাজটাকে আমি অনুভব করতে পারি ততবেশি তীব্রভাবে। যতো তীব্র হয় অনুভূতির মাত্রা, আনন্দের মনে কেটে রেখে যাওয়া দাগটা গভীর হয় ততবেশি।
পিচ্চি ভাগনীটার পা-এ ব্যান্ডজবাঁধা। তারপরও সে সারাদিন লাফালাফি-ঝাপাঝাপি করতেই থাকে। যেন মুহূর্তের বিরতি নেয়ার প্রোগ্রাম তার সিস্টেমে লেখা নেই একেবারেই। মনটা ভাল হয়ে যায় ওর চেহারাটা দেখলেই।
গুরুর গান আমার আজকালকার ব্লগগুলোর মূল প্রেরণা। কোনো একটা গান শুনতে শুনতে লেখার মতো একটা কিছু মাথায় আসলে ব্লগের প্যানেলে লগ-ইন করি। অথচ তারপর যে কি কি সব বিষয় নিয়ে লেখা হয়ে যায়, আসলেই আমার খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ থাকে না। চেষ্টাও থাকে না তেমন।
তাই জীবনটা যেখানে থাকতে পারতো সেখানে নেই বলে এক অবৈজ্ঞানিক ভৌতকাল্পনিক কষ্টের জাবর কাটার কাজে নিজেকে দেখতে পেলেই দুর-ছাই দুর-ছাই বলে তাড়া করি। কোনো একদিন ধরতে পারলে নিজেকে পিটিয়ে লম্বা করবো এমন একটা ইচ্ছেও মনে মনে পোষণ করি। কেননা আমি আসলেই নিজের ওপর অতি-অমানবিক অত্যাচার করি।
যাহোক লেখার সমাপ্তি এখানেই। এবারে কবিতা। ব্লগের নামও এই কবিতার নামে রাখা, কেননা কবিতার জন্মও একই প্রক্রিয়ার অংশ। কবিতার নাম, ভয় দেখালে কামড়ে দেবো।
জেমস্ এর কিছু গানের সাথে কাটছে একটা নিথর দুপুর
ডাকছে গাছের মরা একটা ডালের মতো ঝুলন্ত সুর
বাহিরে কিন্তু কাছেই কোথাও।
ওই ডালটা জীবনটাকে
চায় দেখাতে কোথায় কবে
হারিয়ে গেছে সোনার নূপুর।
সুখের চাবি ধরতে কতো হাত পুড়েছে ভুল আগুনে
তারপরও যে হয় নি শেখা কোন সুতোটা ভাগ্য বুনে।
নিকুচি করি শিল্পসুখের, নিকুচি করি রোদের আলোর
চাই না আরাম হারাও তুমি, পুড়াই তোমার মায়ার ঝালর।
হাত পুড়েছে? বেশ হয়েছে, দাঁতগুলো আছে এখনও ভাল
ভয় দেখালে কামড়ে দেবো, কিভাবে তখন আসবে বলো?
---
অনেকদিন পর মীরের লেখা পড়লাম। ভাল লাগলো।
ধন্যবাদ প্রিয় নিভৃতদা', প্রীত হয়েছি আপনাকে দেখেও
মন্তব্য করুন