বুনো ব্ল্যাকবেরী পেড়ে খাবো পাহাড়ে ওঠার পথের পাশে বেড়ে ওঠা জঙ্গল থেকে
ঠান্ডা হয়ে আছে চারিদিক। ভীষণ ঠান্ডা। বৃষ্টির তীক্ষ্ণ ছাঁট ঠান্ডাটা বাড়িয়ে দেয় আরো বেশি। যেন ডীপ আর নরমাল ফ্রীজের মাঝামাঝি কোন একটা লেভেলে বানানো আইসক্রীম। সর্বোচ্চ ঠান্ডায় ট্যাপের পানি হাতের ওপর ছেড়ে রাখলে একটু পর থেকেই হাত অসাড় ও রক্তশূন্য হয়ে আসতে শুরু করে। তাড়াতাড়ি নবটা গরম পানির দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে হাত যে সচল আছে তা নিশ্চিত হতে হয়।
আইসক্রীম খাই না অনেক দিন। ইলমিনাউ স্কুলে পড়াশুনা করার সময় মাঝে মাঝে স্থানীয় আইসক্রীম কোম্পানি, যেগুলো প্রায় পারিবারিক ক্ষুদ্র কিংবা মাঝারি ব্যবসাই আসলে, নিজেদের আইসক্রীম ভ্যান নিয়ে হাজির হতো। বাচ্চাদেরকে ঠান্ডার ভেতর আইসক্রীমের লোভ দেখানোর জন্য। আমি ছিলাম সেই বাচ্চাদেরকে তালিকায় প্রথম। আইসক্রীমের ভ্যান হাজির হলেই আমি গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়তাম। ভ্যানওয়ালা হেসে বলতো, আরে, ভ্যানটা সেট করার সময় তো দেবে!
প্রথমে নিতাম লাল রাস্পবেরীর একটা স্কুপ। এক চামচ মুখে দিতেই ঠান্ডায় শিরশির করে উঠতো নাক। বাইরের তাপমাত্রা তখন মাইনাস দুই কিংবা তিন ডিগ্রী। বাতাস নেই। আরামদায়ক সূর্য্যের আলো ঠিকরে পড়ছে সানগ্লাসে। এরকম সময় পেনি বোর্ডে (ছোট আকারের স্কেট-বোর্ড) চড়ে আইসক্রীম খেতে খেতে গন্তব্যহীন ঘোরাঘুরি খুব আকর্ষণীয় মনে হতো সেই সব দিনগুলোতে। লাল রাস্পবেরীটা শেষ হলে আমার প্রিয় ফ্লেভারের দুইটা স্কুপ ওই কাপটাতে নিয়ে তিন কিংবা সাড়ে তিন ইউরো দাম দিয়ে সত্যি বের হয়ে পড়তাম গন্তব্যহীন ঘুরাঘুরিতে।
গন্তব্য যে একেবারেই থাকতো না, তা হয়তো পুরোপুরি ঠিক নয়। মনে মনে তো প্রকৃতির ভেতর হারিয়ে যাওয়ার একটা ইচ্ছা থাকতোই। পাহাড়ে কিংবা জঙ্গলে। ঘনজঙ্গলের ভেতর, যেখানে নৈঃশব্দ্যও এক নতুন সুরে ধরা দেয়। ছোট ছোট প্রতিটা শব্দ আলাদা আলাদা করে ধরা পড়ে কর্ণকুহরে। অথবা বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে উঠে যেতে ইচ্ছে করে কোন একটা নিরব চূড়ার ওপরে, যেখান থেকে দুই চোখ যতদূর যায় ততদূর শুধু সবুজের পর সবুজ ধরা পড়ে।
কিন্তু কোথাও আসলে হারিয়ে গিয়ে তেমন শান্তি নেই। হয়তো কোন জঙ্গলে ঢুকেছি। অনেকক্ষণ ধরে ভেতরে ঢোকার পর যখন মনে হবে বনের গহীনে পৌঁছেছি, তখনই দেখা যাবে একটু পরই জঙ্গল শেষ হয়ে চাষের জমি কিংবা নদীর পাড় শুরু হয়ে গেছে, যার অপরপাশে গ্রামীণ কিংবা আধাশহুরে জনবসতি।
আর পাহাড় বলতে কিকেলহান। ইলমিনাউয়ের অবিসংবাদিত চূড়া। প্রথম দিকে পাহাডের চূডায় উঠতে ছয়-সাত ঘন্টাও লেগেছে। শেষে ৪৫ মিনিটেও উঠে যেতাম কোন কোন দিন। জিয়াদ-এর সঙ্গে দৌড়েই উঠে যেতাম অর্ধেক পাহাড়। কিন্তু পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা পর্যন্ত আইসক্রীম সাথে থাকতো না। দুই বোতল পোর্টার ঠান্ডা বিয়ার সাথে নিয়ে নিলে হেঁটে হেঁটে পাহাড়ে ওঠার মজাটা তাড়িয়ে উপভোগের সুযোগ মিলতো। একা একা ওরকম থেরাপিউটিক পাহাড় বাওয়া আজকাল হয় না বহু বছর!
থেরাপিউটিক কথাটা প্রথম বোধহয় আমাকে বলেছিল টোসিন। যখন ইলমিনাউ থেকে ল্যাঙ্গেভিজেন নামের একটা গ্রামে দুই মাসের জন্য উঠেছিলাম। ইলমিনাউ থেকে ল্যাঙ্গেভিজেন গ্রামে যাওয়ার পথটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছোট্ট একটা জলাধারের পাশ দিয়ে দিয়ে। জলাধারে নানান নাম না জানা মাছ। কুল কুল ধ্বনি। জঙ্গলের ভেতর পাখির ডাক, ঝিঝির ডাক। মাঝে মাঝে দূরে হরিণের সচকিত চাহনী। চোখে চোখ পড়লেই চোখ সরিয়ে নেয় ওরা। আর সাবধান হয়ে যেতে চায়।
আরেকটা প্রাণী খুব চোখে পড়ে, আর দু'টো আসলে; কাঠবিড়ালী আর খরগোশ। আমাদের দেশের বিড়ালের মতো মুক্ত মনে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় খরগোশদের জঙ্গলের ভেতর। কাঠবিড়ালী দেখা যায় গাছের পানে ঠাহর করলেই। কোন না কোন গাছের কান্ড বেয়ে উঠছেন বা নামছেন তাদের কেউ একজন- এমন দৃশ্য মিস্ হবার নয়। আর সঙ্গে পুরোটা পথ জুড়ে জল বয়ে চলার কুল কুল শব্দ। পাথরে পাথরে ধাক্কা সে জলের শব্দে এমন মূ্র্চ্ছনার সৃষ্টি হয়, যে ভাল করে যদি কান পেতে শোনো তো তোমারও মনে হবে এ যেন এক অতিপ্রাকৃত সৃষ্টি। সেই পথে হেঁটে এসে বন্ধু আমার কমপ্লিমেন্ট দিয়েছিল, এই রাস্তাটা থেরাপিউটিক।
ধরা-ছোঁয়ার বাইরের অমন অনুভূতিগুলো সবসময়ই একটু এলোমেলো। কার যে কেন এ ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তা বোঝা সম্ভব না কারও ক্ষেত্রেই। কিন্তু ব্যক্তি তার নিজের অনুভূতিগুলোর জন্মস্থান চেনে।
আরও একবার ধরা-ছোঁয়ার বাইরের আনন্দের মতো একটা অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল পাহাড়ের গভীরে এক শিক্ষাসফরে গিয়ে। এমন একটা জায়গায় আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম যেটাকে ভাষায় প্রকাশ করে দু:সাধ্য। আর এমন সময় যখন স্টোরি, রিলস্, পোস্ট ইত্যাদির এখনকার মতো রমরমাও না। ছিল, কিন্তু এখন যেমন কোথাও যাওয়ার অবধারিত অর্থ একটাই, তখন সেইটি ছিল না। আমরা এক পাহাড়ের সামনে দুই পাশ থেকে এসে মেলা একটা স্বচ্ছ লেকের সামনে, দুইটি দিন ছোটখাটো একটা হোস্টেল পুরোটা নিয়ে কাটিয়েছিলাম।
লেকের জলে নৌকা বাওয়া, গোসল করা, পাড়ে শুয়ে রোদ পোহানো, পোহাতে পোহাতে লং-আইল্যান্ড-আইস-টী পান, পান করতে করতে আড্ডা আর গায়ের চামড়া যাতে না পুড়ে যায় সেজন্য একে অপরের পিঠে লোশন লাগিয়ে দেয়া- এইসব করেই কেটেছিল দুই-দু'টি দিন। রাতে বারবিকিউ আর ভাল্লুকপান। লেকের পাড়ের বালিতে গোল গোল হয়ে বসে খালি গলায় গিটারের সঙ্গে গান গাওয়ার মতো ছেলেমেয়ে চারিদিকেই। সেসবের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, পাহাড়ের খাজের ভেতর থেকে উপরের আকাশে তাকিয়ে তারার মেলা দেখার মতো আনন্দ কমই আছে আসলে। তবে নেই বললেও হয় না। লেকের জলে ভাসতে ভাসতে রোদ পোহানো, আর গরমের রাতে বাড়ির ছাদে স্লীপিং ব্যাগের ভেতর শুয়ে উল্কাপাত দেখাতেও অনেক মজা।
আবার অনেক মজা পাওয়া যায় গাঢ় সন্ধ্যার নিওন আলোতে প্যারিসের মন্টগোমারি স্ট্রীটে পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতেও। চারপাশে আলো-আধাঁরির খেল, পরিবেশটা একটু গা ছমছমে, যদিও মানুষের সংখ্যা নিতান্ত কম নয় আশেপাশে, কিন্তু সবার মুখেই কেমন একটা চালিয়াত চালিয়াত ভাব। আর এর ভেতরেই প্যারিসের বিখ্যাত সিঁড়ি! ছবির মতো সুন্দর সেসব সিঁড়িগুলো। সেগুলো যখন সামনে এসে হাজিরই হয়ে যায়, তখন তাদের হাতছানি এড়ানো খুব একটা সহজ হয় না কখনোই।
সেইসব সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই একসময় চোখের সামনে হাজির হয় মন্টগোমারি চূড়া, যেখান থেকে চোখে পড়ে প্যারিস শহরের অর্ধেকেরও বেশি। দেখা যায় আইফেল টাওয়ার, আর্ক দে ট্রায়াম্ফ, সিটি স্কাইলাইনসহ অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন উঁচু ভবন, মূর্তি, ভাস্কর্য, বাড়ি-ঘর, রাস্তা, গাছপালা এবং আরও অনেক কিছু। ওখানে উঠে নিরিবিলিতে তোমার হাতটা ধরে খানিকক্ষণ বসে থাকাতেও অপার আনন্দ।
একবার এক ভোরের স্বপ্নে তোমার সঙ্গে বার্লিনের স্প্রী নদীর তীরে হাঁটতে গিয়েছিলাম। হাটঁতে হাঁটতে একটা জায়গায় যেখানে কেউ ছিল না আশেপাশে, সেখানে তুমি কেন যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল। দাড়িঁয়ে আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছিলে। আমি এক মুহূর্তের জন্য তোমার মুখের ওপর সবুজ একটা পাতা হয়ে আসা সূর্যালোকের আভা দেখতে পেয়েছিলাম। কেন যে দেখতে পেয়েছিলাম!
সেই সর্বনেশে আভা এক মুহূর্তের মধ্যে যেন আমার নিজের ওপর থেকে নিজের সকল অধিকার কেড়ে নিলো। হারিয়ে গেল সোনার ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখা আমার প্রিয় উক্তিগুলির সবগুলিই। হারিয়ে গেলো পড়ার টেবিল, বই-খাতা পত্র, লেখার কলম এমনকি হারিয়ে গেলাম আমি নিজেই। প্রলয়ংকরী টনের্ডো ছিল সেটা, আর সেটার ভেতর তীরবেগে ঘুরতে ঘুরতে একসময় এক তীব্র আলোর ঝলকানিতে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল সব।
তারপর থেকে আমার এই এক জ্বালা হয়েছে! উঁচু উঁচু চুড়াগুলোতে তোমায় নিয়ে উঠে বসে থাকতে ইচ্ছা করে। অপার আনন্দও হয়। মন্টগোমারি বাদ। বাড়ির আশেপাশে যতোগুলো চূড়া রয়েছে, সবগুলোতেই তোমাকে নিয়ে উঠে বসে থাকবো। ভিটামিন ডি ভরবো টাংকিতে। আর বুনো ব্ল্যাকবেরী পেড়ে খাবো পাহাড়ে ওঠার পথের পাশে বেড়ে ওঠা জঙ্গল থেকে। কি বলো?
---
মন্তব্য করুন