ইউজার লগইন

পেছন পথের ধুলো

http://sphotos-c.ak.fbcdn.net/hphotos-ak-ash3/19008_396880993736580_1577174335_n.jpg

এটি একটি কাল্পনিক গল্প, জীবিত বা মৃত কারো সংগে গল্পের কোন চরিত্রের মিল নেই। মিলে গেলে কাকতাল মাত্র।

মাধবপুর স্কুল মাঠ আজ রঙীন সাজে সেজেছে। মাঠের এক পাশে বড় স্টেজ করা হয়েছে। সারা গ্রাম আজ আনন্দের বন্যায় ভাসছে। চারিদিকে একটা উৎসব উৎসব ভাব। ইমতিয়াজ সাহেব আসবেন, তাই এই বিশাল আয়োজন! গ্রামের সব গন্য মান্য ব্যক্তিবর্গ- চেয়ারম্যান, মেম্বার থেকে শুরু করে তরুন-যুবারা আজ মহা ব্যাস্ত।

ইমতিয়াজ সাহেব এই গ্রামের গর্ব। খুব জ্ঞানী মানুষ। তার অনেকগুলো পরিচয়- তিনি এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা, নাট্যকার এবং লেখক। তার আরও একটা বড় পরিচয় আছে- তিনি আসন্ন সংসদ নির্বাচনের একজন প্রার্থী। তাঁর নিজের গ্রাম থেকেই প্রচারণা শুরু করবেন; তাই আজ এই জনসভার আয়োজন।

গ্রামবাসী অধীর আগ্রহ নিয়ে ইমতিয়াজ সাহেবের জন্যে অপেক্ষা করছে। তাঁর আসার কথা সকাল এগারটায়, তিনি এলেন বিকাল চারটায়। দামী গাড়ি থেকে তিনি যখন নামলেন তাঁকে এক ঝলক দেখার জন্য উৎসাহী জনতা হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কি সুদর্শন দেখতে! যেন দেবদূত! ধবধবে সাদা দামী পাঞ্জাবী আর তার উপড়ে কাশ্মীরী শাল জড়িয়ে তিনি এলেন! তাঁকে ফুলের তোড়া দিয়ে সাদরে গ্রহন করল উৎসাহী জনতা। গ্রামবাসী তাঁকে নিজেদের মাঝে পেয়ে খুব খুশি। ইমতিয়াজ সাহেব বক্তৃতা দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে গেলেন! বললেন- তিনি এ গাঁয়েরই ছেলে, গাঁয়ের ধুলোবালি মেখেই বড় হয়েছেন, আবার ফিরতে চান এখানেই, নিজের গাঁয়ের মানুষের মাঝেই! গাঁয়ের উন্নয়নের জন্য আজীবন কাজ করে যাবেন। এ রকম অনেক আশ্বাস দিয়ে তার ভাষন শেষ করলেন।

ইমতিয়াজর চলে যাচ্ছেন, দুপাশে জনতার ভিড়। গ্রামবাসী তাঁকে বিদায় জানাচ্ছে। তার গাড়ী একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাত তিনি দেখতে পেলেন অনেকটা দূর থেকে এগার-বার বছরের একটা ছেলে দৌড়ে তার গাড়ির কাছে আসার চেষ্টা করছে; হাতে একটি ভাঁজ করা কাগজ। লোকজনের ধাক্কা ধাক্কিতে ছেলেটি পড়ে গেল। ইমতিয়াজ সাহেব দলীয় কর্মীদেরকে বললেন ছেলেটিকে কাছে আসতে দিতে। ছেলেটি ভয়ে ভয়ে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ায়! তাঁর জানালার পাশে এসে তাঁকে কাগজটি এগিয়ে দেয়। ইমতিয়াজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন- কি এটা ?
ছেলেটি উত্তর দেয় – চিঠি
-কার চিঠি ?
-আমার বাবা দিয়েছেন
-কে তোমার বাবা ?
-গফুর মিয়া।
ইমতিয়াজ সাহেব কিছু বললেন না, চিঠিটি খুলে পড়তে লাগলেন।
চিঠি পড়া শেষ হলে তিনি কিছুটা আনমনা হয়ে গেলেন! দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে ছেলেটিকে বললেন- তোমাদের বাড়ি কতদূর ?
ছেলেটি হাত দিয়ে স্কুলের দিকে দেখিয়ে বলে- কাছেই, ঐ দিকে।
চল, বলে ইমতিয়াজ সাহেব ছেলেটিকে নিয়ে উল্টাদিকে হাঁটতে লাগলেন।
দলীয় কর্মীরা তার পিছন পিছন চলল। তিনি কিছুদূর এসে তাদেরকে ওখানেই থামতে বললেন।

ইমতিয়াজ সাহেব ছেলেটির পিছন পিছন চললেন। স্কুলের মাঠের পাশ দিয়ে একটু এগিয়ে একটা একচালা পুরানো ঘরের সামনে থামলেন। ভিতর থেকে ক্রমাগত কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কেউ একজন অনর্গল কাশছে। ছেলেটি ইমতিয়াজ সাহেবকে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসে। বারান্দার এক কোণে একটা পুরনো চৌকির উপর শীর্ণ দেহের একজন মানুষ শুয়ে আছে, গায়ে গেরুয়া রঙের হাফ হাতা গেঞ্জি, চোখ দু’টি বন্ধ। চেহারায় অপুষ্টির ছাপ স্পষ্ট।

ইমতিয়াজ সাহেব গফুরকে দেখে কিছুক্ষণ হতবিহবল হয়ে তাকিয়ে থাকেন। কাকে দেখছে সে! চৌকির উর শুয়ে থাকা লোকটির সাথে সে কিছুতেই গফুরকে মিলাতে পারে না। তার চোখে ভাসে উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের সদা হাস্যময় গফুরের ছবি।

-বাবা, স্যার তোমাকে দেখতে এসেছেন!
ছেলের কণ্ঠ শুনে চোখ মেলে তাকায় গফুর। ইমতিয়াজ সাহেবকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয় সে। গফুর ভাবতে পারেনি যে ইমতিয়াজ তার চিঠি পেয়ে এখানে ছুটে আসবে! উঠে বসার চেষ্টা করতেই ছেলেটি চৌকির উপর উঠে বাবাকে বসিয়ে দেয়।
গফুর ব্যাস্ত হয়ে ওঠে ছেলেকে ইশারা করে সাহেবকে চেয়ারটা এগিয়ে দিতে।
ছেলেটি একটি হাতল ভাঙ্গা কাঠের চেয়ার এগিয়ে দিয়ে ইমতিয়াজকে বসতে অনুরোধ করে।
-বসেন।
-কেমন আছ গফুর ?
-ভাল, আপনি কেন কষ্ট করে আসতে গেলেন! অস্ফুট উচ্চারণে বলে গফুর। কথা বলেতে যেন কষ্ট হচ্ছে তার। কতদিন পরে আপনার সাথে দেখা হল !
-হ্যা তা প্রায় পঁচিশ বছর হবে !
-কেমন আছেন?
-আমি ভাল আছি কিন্তু তোমার এ কি অবস্থা !
হাসার চেষ্টা করে গফুর, এ আর কি, বয়স হইছে না ! এহন তো যাইবার সময় হইছে, বলতে বলতে আবার কাশতে থাকে। আমার কথা থাক, আপনি কেমন আছেন ? আমার খুব ইচ্ছা ছিল আপনার সভায় গিয়ে ভাষন শুনব, কিন্তু কি করব শরীরটা আজ বেশী খারাপ হইয়া গেল! তাই ওকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাইলাম।

ইমতিয়াজ যেন কোন ভাষা খুঁজে পায় না। দারিদ্রের ভারে নুয়ে পড়া মৃত্যুপথযাত্রী গফুরের সামনে সে আজ যেন ম্লান হয়ে যায়! ইমতিয়াজ ফিরে যায় বহু বছর পিছনে; যেখানে তার চোখে শুধুই ভেসে ওঠে একজন নিঃস্বার্থ গফুরের মুখচ্ছবি! সেই হাসি, চেহারার ঔজ্জ্বল্য যদিও আজ অনেকটাই ম্লান তবুও চোখদুটোতে অদ্ভুত এক দীপ্তি এখনো খেলা করে! ইমতিয়াজ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, একটা অপরাধবোধ তাকে গ্রাস করে। কিছুক্ষণ পর উঠে পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে গফুরের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
-এটা রাখ, তোমার চিকিৎসায় কিছুটা সাহায্য হবে।

গফুর কোন কথা বলে না, কেবল নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে !

ইমতিয়াজ বুঝতে পারে আবারও ভুল করেছে সে। আজ এত বছর পরে নতুন করে উপলব্দি করে কঠিন দারিদ্রতাও পঁচিশ বছর আগের সেই নিঃস্বার্থ গফুরকে একটুও টলাতে পারেনি! সেদিনের ত্যাগের বিনিময়ে আজও কোন প্রতিদান সে দাবী করে না! মনে মনে ভাবে- গফুর তেমনই একজন যার ঋণ হয়ত আর কখনোই শোধ হবে না! অপরাধীর মত ইমতিয়াজ গফুরের হাত ধরে বলে
-বন্ধু, আমি আবার আসব; এবার শুধু তোমার কাছেই আসব।

ইমতিয়াজ গফুরের ঘর থেকে বেড়িয়ে আস্তে আস্তে গাড়ীর দিকে হাঁটতে থাকে, পিছনে পড়ে থাকে ফেলে আসা দিনগুলোর ধুলোজমা ইতিহাস!

পোস্টটি ৮ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

আরাফাত শান্ত's picture


অসাধারন গল্প!

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


ধইন্যা পাতা

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


খুব খুব ভাল হয়েছে গল্প।

নিয়মিত লিখুন। ভাল থাকুন।

ছবিটা কি আপনার তোলা?

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


থেঙ্কু থেঙ্কু !
ছবিটা নেট মারিং, কিঞ্চিৎ এডিটেড। Laughing out loud

রায়েহাত শুভ's picture


ফ্রাংক্লি বলি, কিছু মনে কইরেন না

একেবারেই স্টেরিওটাইপ গল্প, নাথিং স্পেশাল। এই থীমে প্রচুর গল্প পড়া হয়েছে...

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


এটি আসলেই সাদামাটা জীবনের গল্প, নাথিং স্পেশাল!
এনিওয়ে, মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। Smile

তানবীরা's picture


ভাল লেগেছে, বেশ। নিয়মিত লেখা আশাকরছি

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


ধইন্না Smile

শাপলা's picture


ছোট গল্পে একটু চমক না থাকলে মনে হয় কি যেন নেই কি যেন নেই!!!!!

গল্পটা খুব ঝরঝরে এবং সাবলীলভাবে শুরু হয়েছিল, একটানে পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম, এই বুঝি চমক এসে গেল----
একটু হতাশ হয়েছি কিন্তু লেখার হাত আপনার ভালো।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture

নিজের সম্পর্কে

খুব সাধারণ মানুষ। ভালবাসি দেশ, দেশের মানুষ। ঘৃণা করি কপটতা, মিথ্যাচার আর অবশ্যই অবশ্যই রাজাকারদের। স্বপ্ন দেখি নতুন দিনের, একটি সন্ত্রাসমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের।