গল্পঃ ভাই
অনেকক্ষণ ধরে মোবাইলে রিং বেজে চলেছে। অপু মনে মনে ভাবে, ‘এত রাতে আবার কে ফোন করলো? এই মোবাইলটা হল আরেক যন্ত্রণা, বাথরুমে গিয়েও শান্তি নেই!’ হাতমুখ ধুয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসে। ফোনটা হাতে নিতেই দেখে তপুর ফোন।
-কি রে তপু, তুই এত রাতে!
-দাদা, তুই কবে বাড়ি আসবি?
-কেন রে? মাত্র তিন মাস আগে বাড়ি থেকে ফিরলাম।
-মা খুব অসহায় হয়ে পড়েছে রে। সারাক্ষণ তোর কথা বলে।
-কেন? মা’র কি হয়েছে?
-মা’র শরীরটা ভাল যাচ্ছে না রে।
-তুই আছিস না, মা’র দিকে খেয়াল রাখতে পারিস না?
-তা তো রাখি, কিন্তু মা তোকে খুব মিস করে। বলে, অপুর চাকরি করার দরকার নাই, ওরে বাড়ি আইতে ক।
-তুই মাকে বুঝা তপু।
-আমারও তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে, দাদা।
-কি রে! তোদের হল কি? তুইও কি মা’র মত অবুঝ হলি?
-দাদা, তুই বুঝবি না। তোকে ছাড়া বাড়িটা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
-তোরা এমন করলে চলবে কেমনে বল তো?
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। অপু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
-মাকে বল, আমি আগামী মাসে আসবো।
-থাক। তোর আসা লাগবে না।
-এমন করছিস কেন রে তপু? এত দূর থেকে চাইলেই যখন তখন আসা যায়?
-হ, আমি অবুঝ। আমি কিচ্ছু জনিনা, তুই কালই বাড়ি আসবি। আমি কাল রাতে তোর জন্য ষ্টেশনে অপেক্ষা করবো।
দু-প্রান্তেই কিছুক্ষণ নীরবতা। তপু আবার বলে,
-কি রে দাদা, আসবি না?
-নতুন চাকরী, ছুটি পাব না যে!
-চাকরী করা লাগবে না। তুই চলে আয়। আমাদের যা আছে, তাতে তোর চলে যাবে।
-তোরা এমন করলে আমি কি করে থাকি বলতো?
-অতসব বুঝিনা, আমি কাল রাতে তোর জন্য ষ্টেশনে অপেক্ষা করবো।
-তোর অপেক্ষা করতে হবে না। আমি একাই আসতে পারবো।
-এহ! আমি বুঝি জানিনা তুই কেমন বীরপুরুষ! কালীবাড়ির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একা আসতে পারবি?
অপু হাসে। -তুই আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবি?
-হুম।
-ঠিক আছে রে পাগলা। আমি আসছি।
-আয়। দাদা, তোকে আমি অনেক মিস করি।
অপু হেসে বলে- পাগল!
ঢাকা থেকে শিমুলপুর ষ্টেশনে দিনে একবারই ট্রেন আসে। তাও রাতে। ট্রেন এসে ভিড়লো রাত দশটায়। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শীতের রাত। অপুর জামার উপরে কেবল একটা হাফ হাতা সোয়েটার। ট্রেনের বাইরে আসতেই তীব্র শীতের ধাক্কাটা অনুভব করে। হাড় কাঁপানো শীতে এ সোয়েটার যেন কিছুই না। মনে মনে ভাবে, বড় ভুল হয়ে গেলো! জ্যাকেটটা সাথে আনা উচিৎ ছিল। গ্রামের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলে তো জমে যাব! এখন আর কিছুই করার নেই। অপু ট্রেন থেকে নামে। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে চারিদিকে একবার চোখ বোলায়। তপুকে কোথাও দেখতে পায় না। ষ্টেশনের বাইরে আসতেই চোখে পড়ে রাস্তার পাশে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তপু। মুখটুকু দেখা যাচ্ছে শুধু। অপুকে দেখেই সেই সহজ সরল হাসি।
-তোর খুব কষ্ট হয়েছে দাদা?
-না রে! মা কেমন আছে?
-ভাল।
-তোর ফোনে কি হয়েছে? আজ সারাদিন ট্রাই করে তোকে পেলাম না।
-তোকে তো বলা হয়নি, আমার ফোনটা পুকুরে পড়ে গেছে। তোর নম্বরটা কোথাও লেখা ছিলনা, তাই তোর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।
দু’ভাই ষ্টেশন ছাড়িয়ে এগিয়ে চলে বাড়ির দিকে। ষ্টেশন থেকে দূর্গাপুর প্রায় তিন মাইল পথ। পুরাটাই কাঁচা রাস্তা। পায়ে হাঁটা ছাড়া কোন গত্যান্তর নেই। ছোট্ট জংশনটা ছাড়িয়ে কাঁচা রাস্তায় নামতেই কুয়াশার দেয়ালটা চোখে পড়ে। হিম শীতল ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগতেই ঠকঠক কর কেঁপে ওঠে অপু।
-কি রে দাদা, তুই তো শীতে কাঁপছিস!
-আমি কি জানতাম এখানে এত ঠাণ্ডা পড়েছে? ঢাকায় তো এখনও তেমন শীত পড়েনি।
-ভয় নাই। আমি তোর জন্য এক্সট্রা চাদর আর কানটুপি নিয়া আসছি।
তপু ওর গা থেকে একটা শাল আর কানটুপি এগিয়ে দেয়। অপু কানটুপিটা মাথায় চাপিয়ে নেয়। চাদরটা গায়ে জড়াতেই অদ্ভুত এক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে সারা গায়ে। একটুও শীত অনুভব করে না। অপু কিছুটা অবাক হয়। এত তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা কেটে গেল!
-কি দাদা, শীত কমেছে?
-হুম।
-আমি এতক্ষণ গায়ে জড়িয়ে ছিলাম তো! তাই চাদর গরম হয়ে ছিল।
সামনে কুয়াসার দেয়ালটা আরও গাঢ় হয়ে আসে। তপু পাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলো ফেলে ফাঁকা রাস্তায়। তাতে সামান্যই আলোকিত হয়। সেই আলোতে অপু দেখে বৃষ্টির মত শিশির পড়ছে। শিশির ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে দু’জনে হাঁটে। ভেজা ঘাস আর ধূলোয় কাদায় মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে দু’জনের জুতো। তপুর পায়ে স্লিপার থাকায় পা কাদায় মাখামাখি। চারিদিকে নিকষ কালো আঁধার। এই নিস্তব্ধ রাত্রিতে ঝিঁঝিঁপোকা আর ব্যাঙের ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। জনমানবহীন প্রান্তরে ওরা দু’ভাই ছাড়া যেন অস্তিত্ব নেই আর কারো।
-তুই এমন পাগলামি করলি কেন রে তপু?
-কি পাগলামি করলাম?
-আমার এখন বাড়ি আসা কি জরুরি ছিল?
-হ্যা, ছিল। দাদা, তোর আর ঢাকা যাওয়ার দরকার নেই।
-তাহলে আমি কি করবো? তুই-আমি, দু’জনই বাড়ি থাকার দরকার কি?
-বাজারে এতবড় দোকান, তিন-তিনটা পুকুরে মাছের চাষ হচ্ছে। এতে কি তোর চলবে না?
-এগুলোর জন্য তো তুই আছিস! আমি চাকরি করলে কিছু বাড়তি আয়ের সংস্থান হয়।
-আমি তো আর পারছি না। এখন তো বারো ভূতে লুটে খাবে।
-এতদিন তো চলছিলো, হঠাৎ এমন কি হল যে তুই অস্থির হয়ে উঠলি?
-দাদা, মা’র এখন তোকে খুব দরকার।
-এটা কোন কথা হল? কত মানুষ শহরে চাকরি করে! তাছাড়া তুই তো মা’র কাছেই আছিস।
-আমার কথা বাদ দে। মা’র কাছে এখন তোর থাকা জরুরি। মা তোর জন্য মেয়ে দেখছে।
-ওহ! এই জন্যই তোমাদের এত তোড়জোড়?
-তোড়জোড়ের কি আছে? মা’র বয়স হয়েছে। এখন তার সেবা দরকার।
-বুঝছি। তোর কথামত আমার বাড়ি আসা ঠিক হয়নি।
-দাদা, এই মুহূর্তে তোর বাড়ি ফেরা ভীষণ জরুরি। মা বড় একা! আজ তোকে তাঁর খুব দরকার।
-আমি বুঝতে পারছি না এতদিন তো ভালই চলছিলো, তুই থাকতে হঠাৎ মায়ের এমন কি হল যে আমাকেও বাড়ি এসে থাকতে হবে?
তপু কোন উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। রাতের অন্ধকারের নির্জন রাস্তায় এই নিরবতা অসহ্য লাগে অপুর।
-দাদা, সামনে কালীবাড়ির জঙ্গল। তুই এই পথে একা আসতে পারতি? তপু হাসতে হাসতে বলে।
-না রে। তুই এসে ভালই করেছিস।
দু’পাশে ঘন জঙ্গলের মাঝের পথ ধরে হেঁটে চলে ওরা। বাগানে বিচিত্র প্রাণির ডাকাডাকি, গাছের ডালের ঘর্ষণের শব্দ অদ্ভুত ভৌতিক আবহের সৃষ্টি করেছে। অপুর গা ছমছম করে।
-দাদা, ভয় লাগছে?
-একলা হলে লাগতো। তুই সাথে থাকায় লাগছে না।
তপু হাসে। -আমি জানতাম, এ পথে তুই একা আসতে পারবি না।
একসময় জঙ্গলটা শেষ হয়ে আসে। আর কিছুটা পথ হাঁটতেই ছোট্ট বাজারটায় চলে আসে ওরা। বাজারের পেছনেই ওদের বাড়ি। এখন প্রায় মধ্য রাত্রি। কোন মানুষজন চোখে পড়ে না; দোকানপাট বন্ধ করে ইতিমধ্যেই বাড়ি ফিরে গেছে সবাই। বাজার জুড়ে সুনসান নিরবতা। কুকুর দু’টো অলসভাবে শুয়ে আছে তপুর বন্ধ দোকানের সামনে। সারাদিন এ দু’টো বাজারেই ঘোরাঘুরি করে। তপু মাঝে মধ্যেই খাবার দেয় ওদের। ওরা দু’জন কাছাকাছি আসতেই ও দু’টো চিঁ-চিঁ উঠলো, যেন ভয় পেয়েছে। তারপর লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেল দুই দোকানের মাঝের করিডোর ধরে। দু’জনে বাজার ছাড়িয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে।
প্রায় তিন একর জায়গা জুড়ে বিশাল বাড়িটিতে মাত্র একঘর বাসিন্দা। অপুকে বাদ দিলে কেবল দু’টি প্রাণির বাস। তপু আর মা। বাড়ির মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করে নারিকেল আর সুপারির সাজানো গোছানো বাগানটির এক পাশে পুকুর; শান বাঁধানো ঘাট। আর বাগানের মাঝখান দিয়ে বাড়িতে ঢোকার পথ। পথের শেষ প্রান্তে ওদের বাংলাঘরটি দাঁড়িয়ে। এ ঘরে কেউ থাকে না। কেবল মেহমান আসলে এখানে বসার ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাঘরটি ছাড়িয়ে একটা লম্বা প্যাসেজ পার হয়ে উঠোনে আসতে হয়।
বাড়িতে ঢুকে পুকুর ঘাটের সোজাসুজি এসে তপু বলে,
-দাদা, তুই ভিতরে যা, আমি পা ধুয়ে আসছি।
-আচ্ছা, তাড়াতাড়ি আয়।
অপু নারিকেল বাগানের মাঝের পথ ধরে এগিয়ে যায়। বাংলাঘরের কাছাকাছি আসতেই বাড়ির ভিতর থেকে লোকজনের মৃদু কথাবার্তা ভেসে আসে কানে। অপু মনে মনে ভাবে, এত রাতে বাড়িতে কারা কথা বলে! এখন তো মা ছাড়া বাড়িতে আর কারো থাকার কথা না! ও বাংলাঘরের পাশ দিয়ে ভিতরের রাস্তায় আসে। হঠাৎ চোখে পড়ে বড়মামা আর মামাতো ভাই হাসান দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে ছুটে আসে হাসান। বড়মামাও এগিয়ে আসেন।
-অপু ভাই, তুমি কখন খবর পাইলা?
-কিসের খবর?
-কেন তুমি কিছু জান না?
-না! কি জানবো? আমাকে তো তপু ফোন করে একরকম জোর করে আসতে বাধ্য করলো। বলল, মা অসুস্থ। রাতে ষ্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আমাকে এগিয়ে আনার জন্য। মা কেমন আছে রে হাসান?
-ভাল। তপু তোমাকে ষ্টেশন থেকে নিয়ে এসেছে?
-হ্যা। পুকুর ঘাটে পা ধুয়ে আসছে।
মামা আর হাসান পরস্পরের দিকে তাকায়।
-তপু কখন ফোন করেছে তোকে? মামা জিজ্ঞেস করেন।
-কাল রাতে। রাত বারোটার দিকে।
-রাত বারোটায়! হাসান বিড়বিড় করে বলে।
-কেন, কি হয়েছে?
-চল, ঘরে চল। হাসান বলে।
অপু উঠোনে প্রবেশ করতেই দেখে আশেপাশের বাড়ির অনেক লোকজন জড়ো হয়েছে। ওকে দেখে এগিয়ে আসে সবাই। হাসান ইশারায় কি যেন বলে তাদের। ঘরের ভিতর থেকে বিলাপ করে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে।
-হাসান, কি হয়েছে রে? অপু অস্থির হয়ে ওঠে।
হাসান কিছু বলে না। অপুকে নিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। বারান্দায় পা রাখতেই আগরবাতির তীব্র গন্ধটা নাকে এসে লাগে। অপু ছুটে যায় ভিতরে। ঘরে ঢুকে নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘরের মধ্যখানে শোয়া তপু। নিথর। তপুর প্রাণহীণ দেহের পাশে বসে মা, নির্বাক।
-গতকাল তোমাদের পুকুর পাড়ের বড় আমগাছটা থেকে পড়ে গিয়েছিলো। মাথায় আঘাত লাগে। কাল সকালেই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। আজ সন্ধ্যায় সব শেষ। পাশে দাঁড়ানো হাসান বলে।
অপুর কোনদিকে খেয়াল নেই। তপুর নিষ্প্রাণ মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু। বহুদূর থেকে কানে ভেসে আসে তপুর কণ্ঠস্বর-
“দাদা, এই মুহূর্তে তোর বাড়ি ফেরা ভীষণ জরুরি। মা বড় একা! আজ তোকে তাঁর খুব দরকার।“
ছবিঃ অন্তর্জাল।
অনেকদিন পর আপনি আসলেন, ভালো লাগলো!
হ্যা, অনেকদিন আসা হয়নি এখানে। গল্পটা পুরনো, তাই শুধু আমার পেজেই দিলাম।
অন্ধকারে স্বপ্ন দেখি
মন্তব্য করুন