"শহিদ" শব্দটি শহিদ হচ্ছে আজকাল
প্রথমেই বলে নিই শহিদের ধারনাটি ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্ম থেকে এসেছে। মার্টায়ার কথাটার অর্থ ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের গোড়ার দিকে ছিল সাক্ষী। নিজের ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করার বদলে যে নিজের মৃত্যু অথবা হত্যা প্রত্যক্ষ করে অর্থাৎ তার সাক্ষী হয়, সে হলো মার্টায়ার। ইসলামে শহিদ কথাটা এসেছে এই ধারণা থেকেই। এবং প্রথমে এর অর্থ ছিলো সাক্ষী। নিজের বিশ্বাসের জন্যে যে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে মেনে নেয়। অপর পক্ষে, হাদিসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার আদেশে ধর্মযুদ্ধে যে নিহত হয়, সে-ই হল শহিদ। বৌদ্ধধর্মে বোধিসত্ত্ব কথাটার সঙ্গেও শহিদের ধারণা খানিকটা যোগ হয়েছে। তবে হিন্দু ধর্মে শহিদের ধারণা নেই। বাঙলা ভাষাতেও নেই
বাঙলায় শহিদ শব্দটার প্রথম বারের মতো ঢুকে পড়ে পুঁথি সাহিত্যের মাধ্যমে। একটি পুঁথির নামই আছে; শহিদের কারাবালা। ১৯০৫ সালে বেগম রোকেয়া, তারপর কাজী নজরুল শহিদ শব্দটির ব্যবহার করেন। উইকিপিডিয়াতে শহিদ শব্দটি নিয়ে লেখা আছে-যারা ধর্ম ও দেশের জন্য জীবন দেয় তাদের শহিদ বলা হয়। কথাটি আংশিক সত্য। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে ধর্মযুদ্ধে যারা আত্মত্যাগ করে তারাই শহিদের উপাধী পাবে। মুসলিমদের বাহিরে প্রথম শহিদের উপাধী পান- ক্ষুদিরাম। ১৯২২ সালের অগাস্ট মাসে ধূমকেতা পত্রিকায় কাজী নজরুল ইসলাম ক্ষুদিরামের একটি ছবির নিচে লেখেন- “বাঙলার প্রথম শহিদ ক্ষুদিরাম।” নজরুল দেশের জন্য জীবন দেওয়ায় ক্ষুদিরামকে শহিদের মর্যাদায় ভূষিত করেন। পরবর্তীতে নজরুলের হাত ধরেই দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া বিপ্লবীদের শহিদের উপাধীতে ভূষিত করার রীতি শুরু হয়। বাংলাদেশে শহিদ শব্দটি জনপ্রিয়তা পায় ১৯৫২ সাল থেকে। ভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে যারা নিহত হন তাদেরকে শহিদের মর্যাদা দেওয়া হয়। শহিদ যেহেতু ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে সর্বোচ্চত্যাগ ও খুব সম্মানিত উপাধী সুতরাং শহিদ শব্দটি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ত্রিশ লাখ নিহত হওয়ার মানুষকেও শহিদ বলা হয়। তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত হল;বর্তমানে ন্যায়ের পক্ষে সাহসের সাথে মৃত্যু বরণ করলে শহিদ উপাধী দিয়ে নিহতকে সম্মান জানানো হয়। এর বাহিরে শহিদ শব্দটার অন্য কোন অর্থ ভাবা হয় না।
তবে ৭১-এর পর শহিদ শব্দটি রাজনৈতিক কারণে যেখানে সেখানে ব্যবহৃত হতে থাকে। ৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পরিবারের সদস্যসহ নিহত হয়। তার পরিবারের কেউ শহিদের উপাধীতে ভূষিত না হলেও রাজনৈতিক কারণে অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমান মৃত্যুর কয়েক বছর পর শহিদের উপাধীতে ভূষিত হোন। ধর্মযুদ্ধ অথবা দেশের জন্য যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ না করে প্রথম শহিদের উপাধী পান মৃত জিয়াউর রহমান। মূলত তার রাজনৈতিক দল বিএনপি রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য শহিদ শব্দটি তার নামের আগে জুড়ে দেয়। সেনা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধের কারণে মৃত জিয়াউর রহমানও শহিদের মর্যাদা লাভ করেন। যুদ্ধাপরাধীর বিচারে যেসব রাজাকার ফাঁসিতে ঝুলছে জামাত- শিবির তাদেরকেও শহিদের মর্যাদায় ভূষিত করছে! ৭১-এ ইসলামকে বাঁচানোর নাম করে ধর্মীয় লেবাসে তারা হত্যা-যজ্ঞ চালায় এবং পাকিস্তানীদের সহায়তা করে। কারণ পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর হাতে অস্ত্র থাকলেও মুক্তিবাহিনী সর্ম্পকে তথ্য ও বাঙলার পথ ঘাট চিনিয়ে দেবার জন্য দালালের দরকার ছিল। জাতাম-শিবির ও ধর্মীয় লেবাসে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো সে সময় পাকিস্তানীতের খেতমত করেছে। অদ্ভুত বিষয় হল ধর্ষণ, হত্যা, লুটের আসামীও আজকাল শহিদ হচ্ছে। কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা শহিদ হচ্ছে; ধর্ম রক্ষা করতে না পেরে ফাঁসিতে ঝুলতে হল তাই? নাকি পাকিস্তান রক্ষা করতে না পেরে ফাঁসিতে ঝুলতে হল তাই তারা শহিদের খেতাবে ভূষিত হচ্ছে?
প্রতিটি যুদ্ধাপরাধীদের গায়ে জামাত-শিবির শহিদের তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে। খুন ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পর শহিদের মর্যাদায় ভূষিত করে তাদের সম্মানিত করতে চাচ্ছে। এভাবে বীর, নিহত যোদ্ধা, কাপুরুষ, খুনী ধর্ষণ সবার পেছনে শহিদ শব্দটি যুক্ত করে শহিদ শব্দটির মর্যাদা ম্লান করে দিচ্ছে।
প্রথমত এটি ধর্মকেন্দ্রিক থাকলেও বর্তমানে শব্দটি আর ধর্ম কেন্দ্রিক নয়। কারণ ত্রিশ লাখের মধ্যে নিহত হওয়া ভিন্ন ধর্মালম্বীদেরও শহিদের সম্মানে ভূষিত করা হয়। আর ৭১ ধর্মযুদ্ধ ছিল না। কিন্তু ধর্মবর্ণ নির্বিশেষ সবাইকে শহিদ বলে সম্মান জানানো হয়। ভিন্নধর্মালম্বীদের কেন শহিদ বলা হচ্ছে তা নিয়েও কেউ প্রশ্ন তোলেনি। শহিদ শব্দটি সেমেটিক ধর্মগুলো থেকে উৎপত্তি ঘটলেও এটি এখন বাংলা শব্দের সাথে মিশে গেছে। কারণ শহিদ শব্দে যে স্যাকুলার একটি আবেদন ও গুরুত্ব এখানে জন্মলাভ করেছে তা অন্যকোন শব্দতে হয়নি।
তথ্যসূত্র ও কিছু বক্তব্যের জন্য গোলাম মুরশিদের “নারী ধর্ম ইত্যাদি’’ বইটির প্রতি কৃতজ্ঞ।
পড়েছি
শহীদ উপাধির অপমান!
জামাত-শিবিরতো তাদের কেউ মরলেই কয়-শহীদ
মন্তব্য করুন