আমি আগের ঠিকানায় আছি
“আমি আগের ঠিকানায় আছি
সময় করে এসো একদিন"
অনেক পুরনো একটা গান। পুরনো বন্ধু, পুরনো প্রেম, বিগত ভালবাসা কে দেখার আকুতি ঠিকানা না জানার অনিশ্চয়তায় সমাপ্ত হয়। কয়েক পুরুষ এক ই ঠিকানায় বসবাস করার যে প্রথা তা পাড় করে এসেছি আরও ও দুই পুরুষ পূর্বে। মানুষের ভিতর যে যাযাবর বাউল মন তাই মানুষ কে নামিয়ে আনত পথে। অচেনা কে চিনার ক্ষুধা ও দুঃসাহসী করেছে অনেক মানুষকে। মানুষ ছু্টে গিয়েছে অজানার পানে। তাই বলে কি পথিকের ঘর থাকে না, থাকে না কোন ঠিকানা? বাউল মনের ও থিতু হবার সাধ হয়, পথে ই তৈরি করে ঘর, রেখে যায় পদচিহ্ন, খড়ি পুরানো ছাই, একটা ভাঙ্গা থালা বা ঘটি। কেউ কেউ ঠিকানার খুঁজে পূর্বপুরুষের ভিটায় ফিরে আসে। বাবা পথিক ছিলেন না। নতুন জীবিকার টানে ভিটে মাটি ছেড়ে নতুন ঠিকানা গড়ে। আমৃত্যু সেটা তার কর্ম ক্ষেত্র ই ছিল। স্থায়ি ঠিকানা হয়ে উঠেনি। জন্ম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল ধরনের ছুটিতে আমরা গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে ও আমার স্থায়ি ঠিকানা ছিল গ্রামের বাড়ীর ঠিকানা। বছরে ২-৩ মাস গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো আমার কাছে আমার জন্ম স্থান বা যে শহরে আমি বেড়ে উঠেছি, যে বাড়ীতে আমি জন্ম নিয়েছি তা কখন ও স্থায়ি ঠিকানার মর্যাদা পায়নি।
সেই ছোট শহর অনেক বেশি আপন লাগতে লাগলো যখন ঢাকায় আসলাম। গায়ে গায়ে ঘেসা ভাড়া বাসা। সব তোমার কিন্তু তোমার না। সেই যাযাবর জীবন এর শুরু। বাসায় উঠান নেই, কোন গাছ নেই, নেই বাড়ীর সামনে কোন মেঘনা নদী। মেঘনা পাড়ের মেয়ে আমি, দেয়ালের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে ঢাকায় চলি। প্রতিনিয়ত বর্তমান ঠিকানা বদলের আসংকা। নিজের অজান্তে ই ছোট সেই শহর আরও আপন হয়ে গেল। স্থায়ি ঠিকানা য় লিখা শুরু করলাম সেই ছোট শহরের ছোট সেই বাড়ীর ঠিকানা। বাসা থেকে সে বাড়ীতে উন্নিত হল। প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাওয়া, শহরের কাছাকাছি চলে আসলে ই কেমন এক ভাব চলে আসতো। পুরো শহর তখন আমার বাড়ি মনে হতো। যেদিন উঠোন এর মাঝের জন্মাবদি দেখা আম গাছটা কেটে ফেল্ল, কি যে অসহায় লাগছিল। এই গাছে চড়ে বসে থাকার জন্য আসে পাশের মানুষের কত কথা শুনেছি। তখন ও তেমন ৪-৫ তলা বাড়ি ছিল না শহর জুড়ে। সব টিন শেড বা এক তলা বাড়ি। সেখানে আমার আম গাছ ৫ তলা ছুই ছুই। সেই গাছের মাথায় বসে শহর দেখা। গাছের মাথায় তিনটা ডাল এক জায়গায় এসে মিশেছে। অনায়াসে সেখানে শুয়ে থাকা যেত। সেই গাছ কেটে ফেলেছে, আমার আশ্রয় কেড়ে নিয়েছে। এই শুন্যতা পুরন হবার নয়। সেই সময় অনেক দিন আমি বাড়ি যাইনি। এই শুন্যতার মুখো মুখি সবার ভয়ে। দুই বছরের মতো হল এ ছিলাম। ঠিকানা লিখতে পারিনি। হলের বারান্দায় কতজন কত যত্ন করে গাছ লাগাত। আমার ও ইচ্ছে হতো। কিন্তু মায়া বাড়াতে হতো। মায়া অনেক জিবন্ত এক অবাস্থবতা।
সেই ঠিকানা ও বদলে গেল। আমি দেশের সীমানা পেড়িয়ে হাজার মেইল দূরে গিয়ে পরলাম। আবার বদল হল ঠিকানা। ৬ বছরে ৪ বার ঠিকানা বদল হল। অদ্ভুত ও আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগলে ও সত্য, বহু দিন আমি একা পথ হেটে গিয়েছে, কোন বিকালে, বা রাতে। কেউ নেই সাথে, নিজের সাথে পথ চলা। চলতে চলতে মনে হতো চার পাশে ধান খেত, কখন ও বা সর্ষে খেত। আইল ধরে আমি হাঁটছি। ধানের গন্ধ বা সেই সর্ষের গন্ধ আমাকে পথে সঙ দিত। আমি বার বার ফিরে যেতাম আমার প্রথম ঠিকানায়। জিবনের প্রথম ২১ বছর যাকে আমি আমার স্থায়ি ঠিকানা বলে লিখে গিয়েছি।
এখন নিজ দেশে, অন্যের ঘরে। এখন আমার কোন স্থায়ি ঠিকানা নেই, নেই কোন বর্তমান ঠিকানা। শিক্ষা, সভ্যতা আর জীবনের মোহ আমার শিকড় উপড়ে ফেলেছে। আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশে আমি ডিজিটাল বাউল।
বারবার ঠিকানা বদল হলে তো মন্দ হয় না। জীবনটা যদি এক যায়গায় থিতু হয়ে গেলো তবে আর কি হল?
ভালো লাগলো লেখাটা!
কথকতা ভালো লাগলো বেশ..নিয়মিত লিখুন, ভালো থাকুন।
মন্তব্য করুন