গান গুলো মোর
আমার বাবা ছিলেন পল্লী গীতির স্রোতা, আর শুনতেন পুরুনো দিনের হিন্দি বা উর্দু ছবির গান (সাদা কালো যুগের)। কবি গান, বাউলদের গান, যাত্রা, নাটক, সিনেমার প্রতি ছিল তার দুর্নিবার আকর্ষণ।।।। অন্য দিকে আমার ছোট মামা ছিল পশ্চিম বাংলার নতুন- পুরনো আধুনিক গানের । ভক্ত। বাংলাদেশের আব্দুল জব্বার ছিল তার প্রিয় শিল্পী। আমার মামা র ও যে মামা ছিল একজন, যে প্রায় তার বয়সী বা তার চেয়ে কিছু বড়, সে ও ছিল গানের পোকা। তাদের মাথায় উঠলো তারা গান শিখবে। গ্রামে তো আর ওস্তাদ নেই। কোথা থেকে যেন একটা হারমনিয়াম কিনে নিয়ে এলো। এখন এই হারমোনিয়াম নিয়ে তারা কোথায় রাখবে? আমার মামার নানারা হলেন মোল্লা বাড়ির মানুষ। মোল্লা বাড়ির ছেলে গান বাজনা করে বেড়াবে। তার সাথে আবার ভাগনাকে নষ্ট করবে।! আমার বড় মামা মুসুল্লি না, কিন্তু বেশ নিয়ম কানুন মেনে চলেন। সকাল সন্ধ্যা বাড়িতে প্যা প্যা চলতে থাকবে, কখন ও না। তা সেই মামা ভাগ্নের জায়গা হল কলই খেত, কান্দা (খেতের মাঝে উঁচু জায়গা যেখানে সহজে পানি উঠে না), রাতের স্কুল ঘর। তারা বিশাল যতনে গানের চর্চা চালিয়ে যান। বড় মামা কিছু দিন পর পর ই ছোট মামার বিছানা পাতি তন্ন তন্ন করে খুজে আনেন কয়েকটি গানের বই। নিউজ প্রিন্ট কাগজে ২ টাকা করে পাওয়া যেত এই সব বই।এই সব বইয়ে বাংলা সিনেমার গান, নজরুলগীতি, পল্লিগীতি র লিরিক ছাপানো থাকতো।।।
সেই বড় মামার যখন বিয়ে হয়, আমরা নৌকায় করে বরযাত্রী যাচ্ছি।।এক নৌকায় বর, আরেক নৌকায় আমার ছোট মামা, তার মামা আর বন্ধুর, আর আমি (আমি তাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলাম - বিশ্ব বিদ্যালয়ের শেষ বর্ষ পর্যন্ত)। সারা রাস্তা বাংলা সিনেমার গান, আব্দুল জব্বার এর গান।। আমার মামা বাড়ি থেকে দাদা বাড়িতে নৌকা করে যেতে হয়।প্রতি ঈদের পরের দিন বা তার পরের দিন, মামা তার বন্ধুদের নিয়ে আমার দাদা বাড়ি যেত আমাদের আনতে। আসা যাওয়ার পুরো সময় চলতো গান আর কার্ড। এর অনেকটা ই জুড়ে থাকতো বাংলা সিনেমার গান।মামা যখন আমাদের বাড়িতে চলে আসলো, তখন আমাদের বাড়িতে একটা শনের ঘর ছিল।আমার বাবা ইহর আর শন দিয়ে এই ঘরটা বানাতো। নিজে ই এর সব কাজ করতো।এই ঘর হয়ে উঠলো পাড়ার মামার বয়সী সবার আখড়া।। ।প্রেমানন্দ মামা তার তবলা নিয়ে, মামার হারমোনিয়াম, বাদল মামা......বিশাল আড্ডা। প্রতিদিন। মামা মহা উদ্যমে গান শিখে। মামার অবশ্য রেয়াজ করার চেয়ে গান গাওয়ার প্রতি ই বেশি আগ্রহ ছিল।। রবীন্দ্র সঙ্গীত তেমন শুনতো না। ।।হঠাৎ মামা রবীন্দ্রসঙ্গীত ধরল। সারা দিন ঘরে বসে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে, আর। বাইরে বের হয় না।।। তখন একটু বড় হচ্ছি । আমরা। বুঝতে পারলাম, ঘটনা শুবিধার না।।। মামার রবীন্দ্র সঙ্গীত মানে ই হল, কোথাও গণ্ডগোল হচ্ছে। বাবা গান না গাইলে ও বাসায় গান বাজনা করছে হৈ হুল্লোড় করছে, কখন ও সে কোন অভিযোগ করে নি ।সে পছন্দ ই করতো।। তাদের গান শুনতে শুনতে ই আমরা গান শুনতে শিখলাম। ।মামা আরও পছন্দ করতো গজল । কেউ ইন্ডিয়া গেলে সে সবসময় খালি ক্যাসেট আনাতো। টিডিকে......সে তার পছন্দের গান রেকর্ড করাতো পাটুয়াটুলী থেকে। তার হাজার তিনেকের মতো বানানো ক্যাসেট ছিল।।।
তখন পর্যন্ত আমাদের গান শুনা নজরুল, রাবীন্দ্র, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, পল্লিগীতি, লালন, বাংলা সিনেমার গান, গজল, পুরনো হিন্দি গান,কবি গান। হিন্দু পাড়ায় বড় হবার কারনে ই সকাল সন্ধ্যা কীর্তন শুনতাম। আমার এক ধরনের নেশা হয়ে গিয়েছিল এই কীর্তনের প্রতি। এখন ও আমি কাঁসা বাজিয়ে কীর্তন শুনতে খুব পছন্দ করি। যদিও খালি গলায় তো র শুনা যায় না এখন।আর খুব মিস করি মানিক কাকা র তানপুরা। সকাল এর তানপুরা......তখন ও ব্যান্ড বা ইংলিশ গান শুনা হয়নি কোন। তখন ও আমার প্রিয় শিল্পী ভুপেন হাজারিকা। তখন ও কৈশোর এর পাদ ধুলি দেয়ার সময়ে, কল্পিত মন খারাপে, বা বিদ্যুৎহীন চাঁদনী রাতে, ঘরের জানলা্র গ্রিলে পা তুলে দিয়ে বিছানায় শুয়ে, চাঁদের আলোয় মামার গানের ডাইরি নিয়ে প্রথম পাতা থেকে গাইতে থাকতাম.........মাঝে মাঝে চোখের জলে বুক ভাসাতাম। কেন যে চোখে পানি আসতো তা ও জানতাম না।
আমরা যখন ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীতে, তখন শুভ্রদেব আসলো, তপন চৌধুরী আসলো। গানের লিরিক আর কম্পোজিশনে একটু ভিন্নতা আসলো। এল আর বি আসলো, ডিফেরেন্ট টাচ আসলো। মামা ই সব ক্যাসেটের যোগান দিত। একবার ডিফেরেন্ট টাচ মিতালী সিনেমা হল এ গাইতে আসবে। আমি তখন [ভুপেন হাযারিকার সাথে, হাল জমানার রাজনীতি ভাই শুনছি, শুনছি শ্রাবণের মেঘ গুলো।} সেই প্রথম কনসার্ট দেখা।সেই সময়ে আমার ছোট ভাই কষ্ট করে টাকা জামায়ে জেমস এর একটা বিশাল সাইজ পোস্টার নিয়ে আসলো বাসায়। আম্মা তো এই চুল ওয়ালা পাগল ছেলের পোস্টার কোথাও লাগাতে দিবে না। আমার ভাই শেষ পর্যন্ত বাথরুমে লাগানোর চিন্তা করলো। অনেক পড়ে আমি ইংলিশ গান শুনা শুরু করেছি। মেটাল এখন ও ঠিক নিতে পারি না, যদিনা খুব অস্থির থাকি।
এখন ও সেই দিন গুলো ফিরে পাই, আবার যখন ঐ গান গুলো শুনি। দিন গুলো সোনার খাঁচায় আতকে রাখতে না পরলে ও গান গুলো র্য়ে গিয়েছে......যখন ই শুনি তখন ই দিন গুলো ফিরে আসে
বিষয়বস্তু দারুণ, কিন্তু পড়তে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। আর একটু যত্ন করে লিখলে লেখাটা সার্থক হোতো।
মন্তব্য করুন