অঞ্জন বলছে - 'টিভি দেখো না!"
অঞ্জন দত্তের অতি বিখ্যাত গান, কবীর সুমনের এক সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম তিনি বলছেন-- এই গানটা ছাড়া বাচ্চাদের জন্য কোনো সিমপ্লিস্টিক গান আর তিনি শুনেন নাই বাংলায়। বাচ্চারাও অঞ্জনের কথা শুনে নাই, আমিও শুনি নাই। শয়তানের বোকা বাক্সটা দেখেই চলছি। আর এবার টিভির পর্দাতেই ধরা দিলো অঞ্জন দত্ত। অনুষ্ঠানটা দেশ টিভির পর্দাতে দেখতে যে কি কষ্ট হলো তাই একটু ভাবি। বাড়ীর সবাই ঘুমাচ্ছে, শিয়ালের ডাক চারিপাশ থেকে, একদম গ্রামীন নিঝুম নিস্তব্ধতা। এর ভেতরে টিভি দেখা বিশাল ঝামেলার। কানে হেডফোন রাখতে রাখতে আমি অল্প সাউন্ড শুনি না আবার। তাই আমার সাউন্ডে হয়তো সবার ঘুমে সমস্যা হয়েছিল, তবে কেউ কিছু বলে নাই, খালি আব্বু এসে বকা দিয়ে ছিল- তাও টিভি অফ করি নাই। বিজ্ঞাপন বিরতির জ্বালায় যদিও খুবই অতিষ্ঠ ছিলাম তবুও পুরো অনুষ্ঠানটাই দেখলাম মুগ্ধ হয়ে। অঞ্জন দত্তের সব পুরোনো গানই তো প্রায় মুখস্থ তাই আমার কাছে নিজেই নিজের এক্সাম নিই। নতুন গানের অপেক্ষায় ছিলাম কয়েকটা শুনলাম। সেই আগের মতোই ভালো লাগা। এই বছরের অন্যতম সুখের দিন ছিল সেদিন। সতেরো বছর পরে অঞ্জন দত্ত ঢাকায় গান গাইলো তাও টিভির পর্দায়, তাও মনে হয় ইনি তো আমাদেরই লোক। পরমাত্মীয় বন্ধু । ভালো লাগছে আমার মতো অনেক ফ্যানের কথা শুনে। যারা মুগ্ধ আমার মতোই অঞ্জনে, অনেকদিন ধরে। আমি দুর্ভাগ্য মানুষ, তাই ফোনে অনেক চেষ্টা করে পাইনি। টেক্সটের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই আমার ভালো লাগার গল্প আমার কাছেই থেকে গেল। তবে এ বছরের সব চেয়ে সেরা টিভি অনুষ্ঠান আমার কাছে সেটাই।
আমার টিভি দেখা নিয়ে বন্ধুরা সবাই খুব বিরক্ত হয়। সবাই বলে এই জিনিস ছাড়। নতুন কিছু কর। নয়তো পড় আর ঘুমা। রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা টিভি খুলে দেখার মানে কি? মানে নাই তাও দেখে চলি। আবার টিভি ছাড়াও দিন কাটাতে পারি। আসল কথা হলো, টিভি দেখার প্রতি এখনো আমার একটা ফ্যাসিনেসন আছে। তেমন ভালো কিছু দেখা হয় না বা পাই না, তাও সমানে রিমোট টিপে চলি। এবারের ঈদেও সেরকম উচ্ছাস নিয়ে টিভি না দেখলেও একদম বন্ধ ছিল না। তবে আমার মামা দারুন একটা কথা বলে, ‘যে ৩০০ টাকা ডিশের বিল দেই, উসুল করার মতো মাসে একটা বা দুইটা ভালো নাটক কিংবা সিনেমা হয় না কোনো চ্যানেলে, শুধুই চ্যানেল ঘুরে পাল্টে দেখার জন্যই এখন টিভি দেখা।‘ আমি অবশ্য এত হতাশ হই না, চেষ্টা তদবির করলে ঈদে এত এত নাটক সিনেমার ভেতরে একটা দুইটা ভালো হবেই। কিন্তু সেই ভালো জিনিসটা আপনি দেখতে পারবেন না, এত চ্যানেলের গন্ডায় গন্ডায় গোবর গনেশ মার্কা অনুষ্ঠানের ভীড়ে । আগে বিটিভি যখন ছিল তখন তাঁদের একটা গাইড পাওয়া যেত, কি কি অনুষ্ঠান সামনের মাসে হবে, কি নাটক সিনেমা-তার কি গল্প সব কিছুর ধারনা দেয়া থাকতো। আমার মনে হয় টিভি চ্যানেল গুলো এত এত অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের পেছনে টাকা না শ্রাদ্ধ করে, সিলেক্টিভ অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিক সেই অনুষ্ঠান কিংবা নাটকেই তাঁরা বেশী বাজেট দিক, দর্শক যেন ভালো কিছু দেখতে পারে। নয়তো প্রতি ঈদে চারশো নাটক, দেড়শো টেলিফিল্ম, ও গোটা বিশেক পর্বের নাটক, একশো সেলিব্রেটি টকশো কিংবা গেমশো চালানোর কোনো মানে হয় না। কেউ দেখে না, সবাই শুধু রিমোট টিপেই চলে। টেলিভিশনের যারা নির্মাতা কিংবা শিল্পী তারাও দেখে কিনা আমার জানা নাই। এখনকার স্টাররা তো কি কি নাটক যাচ্ছে বা হচ্ছে টিভিতে তাই বলতে পারে না। অনুমান ভিত্তিক ছেড়ে দেয় যে অমুক অমুকের সাথে কাজ করেছি। তাই যাদের রুটি রুজি এইসব করে চলে তারাই এত কেয়ারলেস কিংবা নিজেদের কাজ দেখে ইউটিউবে, তাহলে মাইনষের কিসের ঠ্যাকা এইসব গারবেজ হজম করার!
টিভিতে অনেক কিছুই দেখছি, পদে পদে নিম্নরুচি আর নিম্নমানের অনুষ্ঠান। সেসব নাটক বা টেলিফিল্ম নিয়ে বলার কিছু নাই। সেইসব নিয়ে লিখে অযথা সময় নষ্টের মানে নাই। তবে টিভিতে যা দেখায় তা আপনি না দেখেও বলে দিতে পারবেন, কি কি হয় আর কি কি হতে পারে। ঈদের প্রথম দিনই এখনো কেকা আন্টির গেম শো থাকবে রাতে ইভা রহমানেত গানের অনুষ্ঠান থাকবে। সকালের দিকে প্রায় সব চ্যানেলেই শাকিব খানের সিনেমা হবে। সেইসব সিনেমায় দেখা যাবে শাকিব খান গ্যারেজে কাজ করে কিন্তু রেডিসনে খায়, মালোশিয়াতে নাচ গান করে। কিংবা জলিলের সিনেমা কেউ কেউ দেখাতে পারেন। জলিলের পুরানো সিনেমাগুলো আরেক জিনিস বটে। চ্যানেল আইতে সেই সময় শুধু টেলিফিল্ম পাবেন, হুমায়ূন আহমেদ মরে গিয়েও শান্তিতে নাই তার মতো করে অনেকে নাটক বানিয়ে হাসানোর ধান্দা করে। কিন্তু কিছুই হয় না, হুমায়ূন আহমেদের আর যাই থাকুক না থাকুক ভাঁড়ামির মাত্রা জ্ঞান ছিল। এদের তা নাই। এরা শুধু পারে নকল চরিত্র ও কাহিনীর নাটক বানাতে। এরপর আসবে টেলিফিল্ম দেখানো সময় দুপুরে, ৬০ মিনিটের একটা টেলিফিল্ম দেখতে সময় লাগবে আপনার ২ ঘন্টা চল্লিশ মিনিট। এত বিজ্ঞাপন আর সংবাদ বিরতি, আপনে ভুলেই যাবেন যে কি দেখছিলেন কোথায়। সন্ধ্যায় শুরু হবে পর্বের নাটক ২৮ মিনিটের নাটক দেখতে চলে যাবে আপনার ৬৫ মিনিট সময়। তারপর সংবাদ দীর্ঘ সময় নিয়ে। তারপর একটা নাটক। সেটা বিরতিহীন চাঙ্কে যদি পান তাহলে আপনার কপাল ভালো। নয়তো চল্লিশ মিনিটের একটা নাটক দেখতে বসলে চ্যানেলভেদে আপনার চলে যাবে ১২০-১৪০ মিনিট। তারপর রাতে লাইভ, সেখানে দুটো গান শুনবেন ও উপস্থাপকের বলদামী দেখবেন আর ছোট্ট ব্রেকের নামে সময় নিবে ২০ মিনিট করে আর সংবাদ তো আছেই ৪০ মিনিটের। তাই আমি বাদে কেউ এত বেকায়দায় নাই যে, এত সময় নষ্ট ধৈর্য সংযম নিয়ে টিভিতে বালছাল নাটক হজম করবে। তাই এত এত শিট নাটক টেলিফিলমের ভেতরে আমি শুধু ভালো লাগছে কিংবা দেখার উপযোগী এমন দু চারটা জিনিসের কথাই বলবো।
এনটিভিতে ঈদের নাটক ‘কাগজের ক্যামেরা’ নাটকটা আমার ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে হানিফ সংকেতের নাটকটাও। কিন্তু হানিফ সংকেতের সমস্যা হলো সব জায়গাতেই শুধু ম্যাসেজ আর ম্যাসেজে ভারাক্রান্ত। এত শিক্ষা মানুষের ভালো লাগে না সব সময়। কিছুক্ষণ বিরতিহীন চাঙ্কে এনটিভির ‘টুপুর টাপুর অপেরা’ ভালোই লাগলো। কাজিনদের সাথে তাহসানের নাটক দেখলাম, তাঁদের খুব ভালো লাগে উনাকে। আমার তাহসানের একটা নাটকও ভালো লাগে নাই। তবে ভালো লাগে তাহসানের নাটকের নায়িকাদের। মাঞ্জা মারা অল্পবয়সী নায়িকাদের দেখলে মনে হয় আহা কি করলাম জীবনে! তবে তাহসানের একটা নাটক আমার ভালো লাগছে, তার নাম ভুলে গেছি, নাটকটার নাম মনে নাই। তবে তাহসান রানওয়ে ব্রাইড নিয়ে ঘুরে বেড়ায় নানান জায়গায়, একটূ হলিউডের রোমান্টিক কমেডি গন্ধ আমরা পাই। আলি ফিদা একরাম তেজোর একটা নাটক ‘পারিবারিক জীব’ খুব ভালো লাগছে। আমি মুগ্ধ এই নাটকের গল্পের খুব সাধারন ভাবনার অসাধারণ ঊপস্থাপনা দেখে। এই জঘন্য একটা শহরে এরকম গল্প ভাবতেও সুখ। এস এ টিভিতে হরর নাটক 'আলো' ভালো লাগছে সবার মতোই। কোন চ্যানেলে হয়েছে জানি হলো ‘দ্বিধা’ সেটাও মন্দ নয়। এনটিভিতে নিপুনের দারুন অভিনীত নাটক ‘সুপারস্টার’ দেখে আমি মুগ্ধ হইছি। তবে নাটকটা আরো ভালো হতে পারতো। পার্থ বড়ুয়ার একটা নাটক নাম ‘আয়না’ সেটা দেখছি ভালোই। শাওনের বানানো নাটক বাংলাভিশনে নাটক ‘জরী কিংবা মিনুর গল্প’ সুন্দর ছিল। অনেকদিন পর এই নাটকে রওনক হাসানের অভিনয় আমার ভালো লাগলো। মৌটুসি তো সব জায়গাতেই সাবলীল। সবাই ‘ভিটামিন টি’ দেখে খুব হাসছে। আমার ওতো হাসি আসে নাই কিংবা ভালো লাগে নাই। শুধু বিজ্ঞাপন কম বলে খুব ঝামেলাহীন ভাবে নাটকটা গিলছি। মাঝে মধ্যেই যমুনা টিভিতে কনসার্ট দেখলাম। ভালোই লাগে এত রাতে এত আয়োজন দেখে। ঢাকায় থাকলে অবশ্যই যেতাম। হুমায়ূন আহমেদ টিভি পর্দায় কান্নাকাটি আমার ভালো লাগে না। আমার আম্মুর খুব ভালো লাগে। তাই বাংলাভিশনে অনুষ্ঠানটা আম্মুর কারনে দেখলাম। বাংলাভিশনে মিলনের অভিনীত ‘প্রেম ও খুন’ নাটকটা মোটামুটি আছে। মিলনের ভালো অভিনয় দেখে খুশী হলাম, এটলিষ্ট চেষ্টা করছে। নিশোর একটা নাটক দেখেছিলাম, মোটামুটি, নাম মনে নাই। দেশটিভি তাঁদের মতো করেই অনুষ্ঠান সাজিয়েছে। সাতজন নতুন পরিচালকের নাটক। কয়েকটা নাটকের কিছু সিন দেখলাম, প্রোডাকশন হিসেবে খারাপ না। সাগর জাহানের 'সেকান্দর বক্স' দেখি নাই। কারন চাইলেই ইউটিউবে দেখা যাবে। এতদিন ধরে প্যারা খাওয়ার মানে নাই। তবে মাসুদ সেজানের বানানো, জাহিদ হাসানের পর্বের নাটক ‘ফরমাল-ইন’ মজার হইছে। জাহিদ হাসান যে এখনো কত ভালো অভিনেতা তার প্রমান। জাহিদ হাসানের আরো অনেক নাটক নানান চ্যানেল হলো কিন্তু দেখা হয় নাই। সৈয়দ আওলাদের বানানো ‘পেইন্টার’ নাটকটাও মোটামুটি দেখা যায়। এনটিভিতে একটা টেলিফিল্ম হলো নওশীনের, ‘আমারও যে একলা লাগে’ পুরোটা দেখি নাই। তবে কিছু কিছু অংশ ভালোই লাগলো। দেখতে হবে। গাজী টিভিতে চিটাগাং অঞ্চলের ভাষার নাটক আগের মতোই দেখা যায়, খারাপ লাগে না। আর আমার জন্য কোনো সাব টাইটেল লাগে না, নিজে বলতে না পারলেও যে ভাবেই বলুক আমি বুঝবো। এইতো আর কোনো নাটক কিংবা টেলিফিল্মে র নাম বলার মত খুঁজে পাচ্ছি না। চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের মা নিয়ে আয়োজনটা ভালো ছিল। তবে সব চাইতে ইন্টারেস্টিং ছিল টাকা কিভাবে ছাপায়, টাকশালের সিকিউরিটিজ সিস্টেম কি ও কেমন এইসব নিয়ে সিরিজ রিপোর্ট। এইতো, অনেক কথাই লিখে ফেললাম। টিভি দেখার অবসর ছিল বলেই এত দেখা আর এত লেখা। সামনে থেকে আর এত টিভি দেখার ইচ্ছে নাই। আজকাল মন মেজাজ খুব খারাপ থাকে- আমার!
টিভি দেখি নাই, তবে আপনার পোষ্ট জব্বর হইছে!
থ্যাঙ্কস পাভেল!
মন্তব্য করুন