গল্প: এখন আমাদের সময়টা আসলে ভয়ংকর
মালিবাগ মোড় থেকে যেসব বাস সায়েন্স ল্যাবরেটরী পর্যন্ত যায়, সেসবের যেকোন একটা হলেই যীশুর চলে। বসার সিট না পেলেও কোনো সমস্যা নাই। বাসের সামনের দিকে দাঁড়াতে পারলে বরং মেয়েদের শরীরের হালকা ঘষা জুটে যায় প্রায়ই। সেটা বসে বসে যাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দের। সকালবেলা বাসা থেকে বের হবার সময় এই আশা নিয়েই একটা টিকেট কেটে বাসের জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে যীশু। বেশিরভাগ দিন কপালে কিছু জোটে না, তবে মাঝে মাঝে আশার চেয়ে অনেক বেশি পূরণ হয়ে যায়। সে দিনগুলোকে যীশু বলে বাম্পার।
এমনি এক বাম্পার দিনে, সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে অফিস থেকে বের হয়ে তরঙ্গ বাসের সামনের দরজা ঠেলে-ঠুলে কোনোক্রমে নিজের শরীরটাকে সেটির ভেতর ঢুকিয়ে দিলো যীশু। বাসায় ফেরার খানিকটা তাড়া আছে, কারণ বাড়িওয়ালা নাকি বাসায় এসে বসে আছে। থাকারই কথা। এই রাজধানীর বাজারে তিন মাসের ভাড়া বকেয়া পড়ে আছে। কোন্ বাড়িওয়ালা এটা সহ্য করে? অবশ্য যীশুরও কিছু করার নেই। একটা কম্পিউটার ফার্মে সামান্য সেলসম্যানের চাকরি তার। বাসায় বোন-বোনজামাই, মা আর যীশুর চারজনের সংসার। উপার্জন বলতে বাবার পেনশনের টাকা আর যীশুর বেতন। বাবা মারা যাবার পর টাকাটা পান যীশুর মা। অসুস্থ বোনজামাইয়ের চিকিৎসার ব্যায় আছে। তাদের চারজনের খাওয়ার খরচ আছে। বাড়িভাড়া আছে। কারেন্টের বিল আছে। কতদিক সামাল দেয়া যায়?- ভাবতে ভাবতে, বাসের পাদানিতে ঝুলে পড়লো সে কোনমতে।
পাদানিটার ওপর চাপ ছিলো আরো অনেক ঘরমুখী জনতার। তাই অদৃশ্য কোনো এক বল ধীরে ধীরে যীশুকে বাসের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো। সারাদিনের অফিস সারা ক্লান্তি তখন ওর শরীর বেয়ে নামছে ধীরে ধীরে। নিজেকে সে সমর্পণ করেই দিয়েছিলো ওই অদৃশ্য চাপের কাছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় হয়তো ধাক্কা খেতে একদম বাসের পেছনে পৌঁছে যেতে পারতো। কিন্তু মাঝপথে হুট করে যীশু বাসের ছাত থেকে ঝুলে থাকা একটা হ্যাঙ্গার ধরে শরীরটাকে শক্ত করে ফেলা কারণে তা আর হয়ে উঠলো না।
ঘটনাটা হয়েছিলো কি, যীশুরা যখন সামনের দিকে জনতার চাপে একটু একটু করে পেছাচ্ছিলো তখন ওর ঠিক সামনেই ছিলেন একজন সত্তুরর্ধ বৃদ্ধ। তিনি যীশুর ঠিক পরপরই বাসে উঠেছেন। ওর মতোই ধীরে ধীরে পেছাচ্ছিলেন। মাঝামাঝি আসতেই লাল আর কালোর কনট্রাস্টে সালোয়ার-কামিজ পড়া এক তরুণী উঠে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধকে বসার জায়গা করে দিলে, বৃদ্ধ কৃতজ্ঞচিত্তে মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে সিটটায় বসে পড়লেন। তার পক্ষে আসলেই আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভবপর ছিলো না। ব্যাস্ আর যায় কোথায়। যীশু হুট করে নিজের ভূমির ওপর সটান শক্ত হয়ে গেলো। মেয়েটি ওঠার সময় ঠিক সেভাবে খেয়াল করে ওঠে নি। যে কারণে উল্টোভাবে উঠে দাঁড়িয়েছে। এখন প্রায় যীশুর বুকের ভেতর মুখ-বুক-শরীর নিয়ে অসহায়ভাবে ঢুকে পড়েছে। এরই মধ্যে চারপাশের প্রবল চাপে বেচারী খানিকটা দিশেহারাও হয়ে পড়লো। ততক্ষণে বাইরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে।
দিশেহারা ভাবের প্রথম ধাক্কাটা কেটে যাবার পর মেয়েটি খানিকটা জোর করেই ছেড়ে আসা সিটের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো। তাতে যীশু প্রথমে একটু মনোক্ষূণ্ন হলেও পরমূহুর্তেই মেয়েটির ঠিক পেছনে ঠেলেঠুলে একটা জায়গা বের করে নিলো। তারপর মেয়েটির শরীরে অল্প অল্প করে নিজেকে ঘষতে শুরু করে দিলো। এত অল্প যে সেটাকে অনেকেই নেহায়েত বাসের দুলুনির জন্য মাঝে মাঝে লাগা মৃদু ঘষা ছাড়া আর কিছু বলবে না। মেয়েটি অবশ্য প্রথম থেকেই বুঝতে পারছিলো। কিন্তু ৩৬ সিটের বাসে হেল্পার শ' দেড়েক লোক তুলেছে। এক চুল নড়ার জায়গা নেই কারো। তাই বেচারীর কিছু করার ছিলো না।
এর মধ্যে পুরো রাস্তা জুড়ে লেগে আছে ঝিরিঝিরি জ্যাম। বাসের চাক্কা এক পাক ঘোরে, এক পাক ঘোরার সমপরিমান সময় রেস্ট নেয়; আবার এক পাক ঘোরে, আবার সমপরিমাণ সময় রেস্ট নেয়। মানুষ যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে আছে। সেখানে কে আর একটি মেয়ের সঙ্গে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামাবে?
আর তখনই মেয়েটি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো; যে বৃদ্ধকে সিট ছেড়ে দিয়ে সে নিজে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, সেই বৃদ্ধও মাঝে মাঝে ঢলে পড়ার ভঙ্গি করে এগিয়ে আসছেন তার বুকের দিকে! একবার এমনকি ঠোকর একটা খেয়েও গেলেন। বৃদ্ধকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো। হয়তো সত্যি সত্যি অজ্ঞান হয়ে গিয়ে থাকবে। বোঝার জন্য মেয়েটি একবার বৃদ্ধকে আলতো করে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলো। কিন্তু বৃদ্ধ সেটা টের পেলো না। পেছন থেকে সুযোগ সন্ধানী যীশু এ সুযোগের সদ্ব্যহার করতে ছাড়লো না। 'অজ্ঞান হয়ে গেছে নাকি?' প্রশ্ন করতে করতে সে মেয়েটির পেছন থেকেই একটা হাত ঢুকিয়ে বৃদ্ধের ঘাড় ধরে শক্তভাবে ঝাকিয়ে দিলো। এতে বৃদ্ধ একটু চমকে চোখ খুলে 'ঘুমিয়ে পড়েছিলাম' শব্দ দু'টো উচ্চারণ করে আবার চোখ বুজে ফেললেন। যেন তিনি এ দুনিয়ায় নেই। কোথায় কি ঘটছে, কেন ঘটছে জানেন না। যদিও দু'জনেই বুঝতে পারলো বৃদ্ধ ঘুমাচ্ছিলো না মোটেও। এদিকে সামনের দিকে চালিয়ে দেয়া হাতটাকে পেছনে আনার সময় খানিকটা কায়দা করেই যীশু মেয়েটির কোমর ছুঁয়ে আসলো। মেয়েটি অস্বস্তিতে একটু মোচড় দিয়ে উঠলেও যীশুর কোনো ভাবান্তর হলো না। সে এ ধরনের সিচুয়েশনের পাকা খেলোয়াড়। ঠিক মোচড়ের সময়েই সে নিজের পা দু'টোকে একটু সামনে ঠেসে ধরে এমনভাবে দাঁড়িয়ে গেলো যে, মোচড় শেষ করে মেয়েটি দেখলো সে ছেলেটার শরীরের ভেতরে আরো একটু ঢুকে পড়েছে। এতক্ষণ যে স্পর্শ দুলুনির মতো বার বার লাগছিলো-ছাড়ছিলো সেটা এবার স্থায়ীভাবে শরীরের ওপর বসে গেলো।
এবারে যীশু নিজের একটা হাত ওর কোমরের একপাশে ঝুলিয়ে রাখলো এবং বার বার দুলুনিতে সেটা কোমরে ধাক্কা খাচ্ছিলো। মেয়েটি বেশি সামনের দিকেও ঝুঁকতে পারছিলো না, কারণ বৃদ্ধ তার কান, ঘাড়, মাথার একপাশ টানটান করে রেখেছিলেন মেয়েটির যেকোন রকম স্পর্শ রেকর্ড করে সেটার অনুভূতিকে দ্রুত মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দেবার জন্য। হয়তো মস্তিষ্কে অনুভূতিটা বিশ্লেষণ হয়ে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এক ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ছিলো বৃদ্ধর। স্পর্শের অনুভূতি বৃদ্ধের গালে-কপালে জুটে যাচ্ছিলো মাঝে মাঝেই।
মেয়েটির আশার আলো ছিলো কেবল একটাই। বাসটা ধীরে ধীরে হলেও এগিয়ে যাচ্ছিলো তার গন্তব্য মালিবাগ মোড়ের দিকে। সে কোনরকমের সিটের ওপরকার ঠান্ডা এস এস পাইপের রড ধরে বাকা হয়ে দুই ইতরপুরুষের ছোঁয়াচ থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো।
কাকরাইল মোড়ে এসে বাস বামে মোড় নেয়ার সময়টায় যীশু মোক্ষম সুযোগটা নিয়ে নিলো। মোড় ঘোরার সময় বাস যে স্বাভাবিক নিয়মে সামান্য হেলে পড়ে, সে সময় পড়ো পড়ো ভঙ্গিতে নিজেকে রক্ষার জন্যই যীশু মেয়েটির কোমর এক হাতে চেপে ধরে। মূহুর্তের মধ্যে বাস আবারো সোজা হয়ে যায়। কিন্তু যীশুর হাত মেয়েটির কোমর থেকে সরে না। মেয়েটি দু'তিন মূহুর্ত অপেক্ষা করার পর শরীর মুচড়ে আপত্তি জানানোর চেষ্টা করে। তাতে লাভ হয় না। বরং মোচড় শেষ করার পর সে নিজেকে আরো খানিকটা ছেলেটার ভেতরে ঢুকে পড়া অবস্থায় আবিস্কার করে। যখনই সে নিজের শরীরটা মুচড়াচ্ছিলো তখনই ছেলেটা আরেকটু সামনের দিকে এগিয়ে আসছিলো। কিন্তু মেয়েটি সামনে এগোতে পারছিলো না। যদিও ততক্ষণে বৃদ্ধ তার মুখের একপাশ ও একটি কান মেয়েটির বুকে প্রায় স্থায়ীভাবে স্থাপন করেই ফেলেছেন। আর সামনে ঝুঁকলে এখন নিজেই নিজেকে ঠেসে ধরা হবে বৃদ্ধের মুখে। মানুষ এত লোভী আর জানোয়ার কিভাবে হয়?- ভাবতে ভাবতে ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে মালিবাগ মোড়ের জন্য অপেক্ষা করছিলো মেয়েটি।
আর যীশু ততক্ষণে পুরো হাত বিছিয়ে দিয়েছে ওর কোমরের ওপর। এমনকি একটু একটু বুলাচ্ছেও। পুরো বিষয়টা সে এত আনমনে করে যাচ্ছে যে, অন্য কেউ দেখলে ভাববে বিশাল কোনো ভাবুক ডুবে আছে ভাবনার লাল-নীল রাজ্যে। এরই মধ্যে কোমর থেকে যীশুর হাতটা কামিজের নিচের অংশ ধরে ধরে চলে গেলো ঠিক মেয়েটির পাছার ওপর। সিল্কের সালোয়ারের ওপর দিয়ে ভেতরের অন্তর্বাসের লাইনিঙ স্পষ্ট পড়া যাচ্ছিলো হাত দিয়ে। যীশু ক্রমাগত বেপরোয়া হয়ে উঠছিলো। বাস শান্তিনগর মোড়ের সিগন্যাল আস্তে আস্তে পার হচ্ছে। আর হয়তো দুই কি তিন মিনিট পাওয়া যাবে। তারও যে গন্তব্য মালিবাগ মোড়ই।
অন্তর্বাসের লাইনিঙয়ের রাবারটা হালকা টেনে মেয়েটির প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলো যীশু একবার। সেই পুরোনো মোচড় ছাড়া আর কিছুই করলো না মেয়েটি। সুযোগে যীশু নিজের অন্তর্বাসে এক হাত ঢুকিয়ে টনটন করতে থাকা অঙ্গটাকে উধ্বমুখী করে রেখে আসলো। এবার জমবে ভালো। প্রতি দুলুনিতে পূর্ণ যৌনতার স্বাদ পাওয়া যাবে। উত্তেজনায় এক পর্যায়ে যীশু প্রায় খামচেই ধরলো মেয়েটির শরীরের অনেকটা মাংস। বাসের অন্ধকারে কেউ তাদেরকে দেখলো না। সিটের বৃদ্ধও কিছু একটা টের পেয়ে হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই মেয়েটির আরেকটু কাছে ঘেঁষে বসলেন। মুখটা যতদুর সম্ভব বাঁকা করে চেষ্টা করতে থাকলেন ঠোঁট দিয়ে ওর বুকটাকে স্পর্শ করবার। আর ঠিক এভাবে চল্লিশ সেকেন্ডের মতো চলার পর বাসটা ব্রেক কষলো। ওরা মালিবাগ মোড়ে পৌঁছে গেছে।
যীশু জানে, এখন মেয়েটি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই তাকে হাওয়া হয়ে যেতে হবে। একটু ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বাসের সামনের দিকটায় দ্রুত সরে গেলো যীশু। মিশে গেলো ভীড়ের ভেতরে। মেয়েটিও ডানে-বামে না তাকিয়ে ত্রস্তপায়ে নেমে গেলো বাস থেকে। রাস্তা পার হয়ে চামেলীবাগের গলির ভেতর ঢুকে গেলো। আর সবার চেয়ে খানিক পরে সম্বিত ফিরে পাওয়া বৃদ্ধ ধীরে ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়ালেন। কালো চামড়ার ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে আয়েসী ভঙ্গিতে দরজার দিকে হাঁটা শুরু করলেন। হেল্পার 'চালু নামেন চালু নামেন' বলে তার আয়েসে বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। তিনি ধীরপায়েই বাস থেকে নামলেন। ততক্ষণে এই স্ট্যান্ডের যাত্রীর সব নেমে যে যার দিকে চলে গেছে।
বাস থেকে নেমেই বৃদ্ধের ব্যাংক থেকে তোলা পেনশনের টাকাটার কথা মনে পড়লো। আজকাল প্রায়ই ভয় নামের একটা দৈত্য সুযোগ পেলে গলা টিপে ধরতে চায়। নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন না তখন তিনি কোনোভাবেই। টাকাটার কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একই অনুভূতি শুরু হয়ে গেলো বৃদ্ধের ভেতরে। কেবলই একটা কথা উনার মনে হচ্ছিলো, বুক পকেটে হাত দিয়ে টাকাটা পাবেন না আর। আতংকে হোটেল ম্যানহাটনের সামনের ফুটপাথে একসময় বসেই পড়লেন বৃদ্ধ। মূহুর্তে শুয়েও পড়লেন সেখানেই। কয়েকজন পথচারী দৌঁড়ে এসে ঘিরে ধরলেন বৃদ্ধকে। কিন্তু ততক্ষণে সবশেষ।
ম্যানহাটনের উল্টাদিকে কারিতাসের সামনে তখন চলছে আরেক নাটক। ত্রিশোর্ধ্ব এক লোক দু'হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে এবং যথারীতি ফুটপাথের ওপর। দৃষ্টিতে বিহ্বল শূন্যতা। ১৫ হাজার টাকা বেতনের পুরোটা পকেটে ছিলো তার।
---
মন্তব্য করুন