অদ্ভুত আঁধার এক
তিন মাস হয়ে গেল। মাসের হিসাবে হয়তো এটা শুধুই একটা সংখ্যা। কিন্তু যাদের বুক খালি হলো তাদের কাছে কত সহস্র বছর মনে হচ্ছে তা বোঝার ক্ষমতা কি আমাদের আছে? তনু’র কথা বলছিলাম।সেই তনু। যে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ছিল, যে নাটক করত, আবৃত্তি করত, স্বপ্ন দেখত, প্রাণ খুলে হাসত, এমনকি নিজের হাত খরচ চালাতে গিয়ে বাবার উপর যেন চাপ না পড়ে সেজন্য টিউশনিও করতো।কেমন লক্ষী মেয়েটাই না ছিল বাবা-মায়ের।
তনু থাকত নিরাপদ বেষ্টনীর ভেতর। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের নিরাপদ অভয়ারন্যে ছিল তনুর বসবাস। চতুর্থ শ্রেনীর কর্মকর্তা বাবা ইয়ার আলী, মা, ভাই ,আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে তনুর একটা স্বপ্নের জগত ছিল। সেনাবাহিনীর স্কুলের নাচ–গানের শিক্ষক হওয়ার বাসনা ছিল মেয়েটার।আহা! মানুষের স্বপ্ন গুলো কত ঠুনকো! আমি কি বলছি এসব? স্বপ্ন? যেখানে মানুষের জীবন হয়ে যাচ্ছে কুকুর-বিড়ালের মতো অস্তিত্বহীন সেখানে স্বপ্নের কথা তো অবান্তর।
হঠাৎ একদিন দুঃস্বপ্ন হানা দিল তনুর জীবনে, তনুর বাবার জীবনে, তনুর মায়ের জীবনে, তনুর ভাইয়ের জীবনে, তনুর সহপাঠীদের জীবনে, মঞ্চ নাটকের বন্ধুদের জীবনে।যারা তনুর আপন ছিল তাদের জীবনের সকল আনন্দ কেড়ে নিতে চিলের মতো ছোঁ মেরেছিল কেউ কেউ।
সন্ধ্যা থেকে তনুকে খূঁজে পাওয়া যায় না। অথচ টিউশনি শেষে আরও অনেক আগেই ঘরে ফিরে আসার কথা তনুর।তারপর অনেক রাতে তনুর বাবা তনুকে খূঁজে পায়। তবে যেভাবে তনুর বাবা তনুকে খূঁজে পেয়েছে পৃথিবীর কোনো বাবাই হয়তো এভাবে তার প্রিয় সন্তান ,বুকের মানিককে কখনোই খুঁজে পেতে চাইবে না। সেনানিবাসের ভেতরেই গলা কাটা, এলোমেলো ভাবে চুল কাটা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া,ক্ষত-বিক্ষত তনুকে পাওয়া গেছে। না, না ভুল হচ্ছে, তনুকে নয় তনুর লাশ পাওয়া গেছে।
তারপর অনেক জল গড়িয়েছে।তনুর জন্য জেগেছে তনুর ভাই, তনুর সহপাঠীরা, তনুর বন্ধুরা, জেগেছে সারা দেশের মানুষ, প্রতিবাদের ঝড়ে কেঁপে উঠেছে রাষ্ট্র যন্ত্র।“জাস্টিস ফর তনু” স্লোগানে ঘরে, বাইরে, পত্রিকায়, টিভি চ্যানেলে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবখানে ছিল তনু। তনু ধর্ষন এবং হত্যার বিচার চেয়ে সারা দেশে যে গণ জোয়ারের সৃষ্টি হয়েছিল আমি নিশ্চিত ছিলাম তনু ধর্ষন এবং হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার আমরা পাব। অন্তত সিলেটের ছোট্ট শিশু রাজন হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচারের কারণে সে আশা অনেক খানি পোক্ত হয়েছিল।
কিন্তু না, আমি অজ্ঞ ছিলাম। তাই বুঝতে পারিনি তনু হত্যার বিচার পাওয়া খুব একটা সহজসাধ্য কাজ নয়। কারণ এখানে জড়িয়ে আছে জলপাই রঙের আভ্যন্তরীন রহস্য। তনুর বাবা ইয়ার আলী তো অনেক অস্পষ্ট একটা বিষয়কে খুব সহজ করে, খুব স্পষ্ট করেই তনু হত্যার বিচার চেয়েছেন।গত ১৫ জুন, ২০১৬তারিখের প্রথম আলোতে পড়লাম, তনুর বাবা বলেছে, “কোনো ব্যক্তির অপরাধের দায়ভার কোনো বাহিনীর উপর আমি চাপাতে চাই না। আমরা চাই দোষী ব্যক্তিগুলোকে ধরে বিচারের আওতায় আনা হোক”।সন্তান হারানোর মতো এমন কঠিন সময়েও ভদ্রলোক কত বিনয় করে সন্তান হত্যার বিচার চাইছেন। তারপরও এখন পর্যন্ত অপরাধীই শনাক্ত করা গেল না। অপরাধীর হাত কত উঁচুতে যে এত বড় অপরাধ করার পরও আমাদের চৌকস আইনশৃংখলা বাহিনী তার কিংবা তাদের টিকিটি ধরারও সাহস করতে পারছে না।
“জাস্টিস ফর তনু” নামে সারা দেশব্যাপী যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল আমার কাছে সে গণজোয়ারের দাবী ম্লান হয়ে গেছে সেদিন, যেদিন তনুর মৃত্যুর ১৪ দিন পর তনুর প্রথম ময়না তদন্তের রিপোর্টে বলা হয় তনুর শরীরে ধর্ষনের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। এই ময়না তদন্তের রিপোর্ট যে ডাক্তার লিখেছেন,এই ভয়ংকর মিথ্যাচারের জন্্ এই রিপোর্ট লেখার সময় তার কি একটুও অপরাধ বোধ কাজ করেনি নিজের মধ্যে।হয়তো করেনি। হয়তো করে না।তারা এভাবে মিথ্যা রিপোর্ট লিখতে লিখতে তারা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ভুলে যায়।
কি অদ্ভুত ব্যপার! সিআইডি রিপোর্টে আবার বলা হয়েছে তনুর শরীরে ধর্ষনের আলামত পাওয়া গেছে। তিনজনের স্পার্ম পাওয়া গেছে। সেই তিনজন কারা ? সেটা কি আর জানা যাবে কোনো দিন?
প্রহসন! বিচারের নামে চলছে প্রহসন! এক তনু আমাদের দেখিয়ে দিল তোমরা যারা কেবলই সাধারণ নাগরিক এ রাষ্ট্র তোমাদের জন্য নয়। তা না হলে প্রায় মাস তিনেক পরে দেয়া তনুর দ্বিতীয় ময়না তদন্তের রিপোর্টে অত্যন্ত মার্জিত ভাষায় তনুর শরীরে হত্যার পূর্বে “যৌন-সংসর্গের” আলামতের অস্তিত্ব পান আমাদের বিজ্ঞ ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক দল। তবু স্বস্তি যে অবশেষে তারা যৌন-সংসর্গের আলামত খুঁজে পেয়েছেন।জানি বিক্রি হয়ে গেছেন তারাও। হয়তো নিজেরা শখ করেই বিক্রি হয়েছেন , হয়তো জিম্মি হয়ে নিজেকে বিক্রি করেছেন।
গত ২১জুন,২০১৬ তারিখের প্রথম আলোর প্রথম পাতায় কান্নাসিক্ত তনুর মায়ের একটা ছবি ছাপা হয়। তনু হত্যার তিন মাস উপলক্ষ্যে গণ জাগরণ মঞ্চ, কুমিল্লা জেলা শাখার আয়োজনে প্রতিবাদ সমাবেশে তনুর মা কাঁদতে কাঁদতে জানতে চায়, “গরিব বলে কি বিচার পাব না? এভাবে মেরে ফেলবে?”
তনুর মায়ের জন্য বুকের ভেতরে দানা বাঁধা কষ্ট আকুপাকু করতে থাকে।এই মানুষটার সাহসটাকে সাধুবাদ জানাতে ইচ্ছে করে।এমন নির্মম ভাবে সন্তান হারানোর শোকের মধ্যেও তিনি তার সন্দেহভাজন সেনা সদস্যদের নাম প্রকাশ করেছেন।যিনি সাহস করে এখন পর্যন্ত সত্য কথা বলে যাওয়ার দুর্বার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সন্তান তো ফিরে পাবেন না, কিন্তু তার সন্তানের মতো এমন নির্মমতার শিকার যেন কোনো মায়ের সন্তান না হয়, কোনো মায়ের বুক যেন এভাবে শুণ্য হয়ে না যায় সে জন্য সন্তান হত্যার উপযুক্ত বিচারের আশায় তিনি এখন পর্যন্ত সকল হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করে আর্তনাদ করে যাচ্ছেন। তনুর মা বলেছেন, “সেনাবাহিনী মেয়ের সব স্মৃতি নিয়ে গেছে।ডায়েরি নিয়ে গেছে। ডায়েরির সব পাতা কাইট্টা রাইক্কা দিছে।বাসা থেকে আয়্যলবাম নিয়ে গেছে।একটা ছবিও ফেরত দেয়নি, যা দেখে কাঁদব।”
আহা, তনু ,বোন আমার,তুই মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিস। মরনের পরে কতবার যে তোকে মারা হচ্ছে তুই কি টের পাস?তোর সাথে সাথে বেঁচে থেকে প্রতিদিন মরে যাচ্ছি আমরা, যারা এখনো পুরোপুরি অন্ধ হতে পারিনি, বধির হতে পারিনি, বোবা হতে পারিনি। আবার আমরা যে পুরোপুরি বোধসম্পন্ন মানুষ সেটাও দাবি করি কি করে? আমরা বেঁচে আছি ভান করে। আমরা ভান করছি আমরা অন্ধ, আমরা বধির, আমরা বোবা, আমরা এক একটা জীবন্ত লাশ।
আমি তনু হত্যার সুষ্ঠু বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছি। যেভাবে ছেড়ে দিয়েছি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার বিচার।যেভাবে ছেড়ে দিয়েছি প্রতিদিন দেশের আনাচে কানাচে চাপাতির আঘাতে লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক, ধর্মাযাজক, পাদ্রী, ব্যবসায়ী, পুরোহিত হত্যার বিচার। ক্ষমতা খুব খারাপ জিনিস। ক্ষমতার কাছে মানবিকতার কোনো জায়গা নেই।তনুর মায়ের কান্না ভরা আর্তনাদ রাষ্ট্রযন্ত্রের কানে পৌঁছানোর আগেই ক্ষমতার কাছে সব ম্লান হয়ে যায়। অসহায় তনুর মায়ের আর্তনাদের মেঘে ঢেকে যায় আকাশ।চারদিকে কেবল আঁধার আর আঁধার!মনে হয় এই বুঝি নামবে বৃষ্টি।অথচ কতদিন বৃষ্টি হয় না।
তনু তো প্রকাশ পেয়েছে বন্ধু আর অজান্তে কত তনুর জীবন যে ঝরে যাচ্ছে সেটার হিসেব মিলাবে কিভাবে? অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেও মুখ বুজে থাকতে হচ্ছে অনেক তনুর বাবা-মার।
মন্তব্য করুন