ইউজার লগইন

থ্যালাসেমিয়াঃ ভয় নয়, প্রয়োজন সচেতনতা, পর্যাপ্ত প্রচারণা। (প্রথম পর্ব)

Thalasemia-1.jpg

এইচআইভি কিংবা হেপাটাইটিস নিয়ে মানুষের মাঝে যতটা সচেতনতা আছে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে তেমনটা এখনও গড়ে ওঠেনি। একমাত্র যারা ভুক্তভোগী তারাই এই রোগ সম্পর্কে জানেন। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হারটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় দেশে আনুমানিক ৫০ হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগী প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ারের সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ এবং বছরে প্রায় ছয় হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার হয়ে জন্মগ্রহণ করছে। থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসার তুলনায় প্রতিরোধই শ্রেয়। আর এই রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজন মানুষের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা।

বেশ কিছুদিন থেকে আমার স্ত্রীর শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না। দীর্ঘদিন ধরেই রাতে জ্বর থাকতো, তাপমাত্রা খুব বেশী রাইজ না হওয়াতে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কুরবানী ঈদের দিনও বেশ অসুস্থ্ই ছিল। ঈদের ছুটির পর আইসিডিডিআরবি’তে রক্তের কিছু টেস্ট করালাম। ভিডাল টেস্টে টাইফয়েড পজিটিভ পাওয়া গেল আর সিবিসি’তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ মাত্র ৬। দেরী না করে সেদিনই একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলাম। তিনি যা বললেন তাতে মোটামোটি মনে ভয় ধরে গেল! সরাসরি এডমিট, হিমোগ্লবিন বাড়াতে হলে ৪ ব্যাগ রক্ত দিতে হবে। তবে রক্ত দেবার আগে আয়রনজনিত সমস্যা রোধে থ্যালাসেমিয়া টেস্ট করাতে বললেন। থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে তেমন জানাশোনা না থাকায় আঁতকে উঠলাম! ক্যান্টনমেন্টে এএফআইপি’তে টেস্টগুলো করতে দিলাম, চারদিন পরে রিপোর্ট। এই চারদিনে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে প্রচুর ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। কিছুটা জানাশোনা হল, যেসব ব্যাপারে আমি ছিলাম একরকম অন্ধকারে! মনে মনে ভাবলাম- হায়রে! আমরা কতকিছুই জানিনা! চারদিন পরে রিপোর্ট হাতে পেলাম। রিপোর্ট মোটেও সন্তোষজনক নয়, জানতে পারলাম আমার স্ত্রী থ্যালাসেমিয়ার বাহক (Hemoglobin E Trait)। কিছুটা মন খারাপ যে হয়নি তা বলব না, তবে প্রাথমিক অবস্থায় মনে যে ভয় ধরেছিল তেমনটি আর নেই। এখন আমি অনেকটাই সাহসী।

আমার স্ত্রীর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি যতই তাকে বোঝাই যে তুমি শুধুমাত্র ক্যারিয়ার। তোমার তুমি কখনও আক্রান্ত হবে না, সে যেন আশ্বস্ত হতে পারে না। আর তার সবচেয়ে বেশী ভয় আমাদের মেয়েটাকে নিয়ে। ও কি এটা পেল? আমি বলি, এখন তো আর কিছু করার নেই। যদি ও ক্যারিয়ার হয়েও থাকে আমরা আগে থেকেই সাবধান হয়ে যাব। ইতিমধ্যে ওর শরীরটা আরও খারাপ হল, দুর্বলতা যেন আরও বেড়ে গেল। আমার মনে হল, কিছুটা হিমোগ্লবিন কমে যাবার কারণে আর কিছুটা রিপোর্ট দেখে। আমি রিপোর্টসহ ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি যথারীতি ভর্তির জন্য লিখে দিলেন। অনেকে সেদিনই ভর্তি হতে বললেন কিন্তু আমি আরও একদিন সময় নিলাম। এই ফাঁকে দু-একজনের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম গ্রীনরোডে গ্রীনলাইফ হাসপাতালে একটি থেলেসেমিয়া সেন্টার আছে, যেখানে এই ধরনের রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা হয়। আমি ফোনে ওদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলাম। পরদিনই আমার স্ত্রীকে ওখানে নিয়ে গেলাম।

বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারনা নতুন নয়, আর এটা যে সম্পুর্ন অমূলক তাও নয়। কিন্তু এখানকার মানুষগুলোকে ঠিক তার বিপরীত মনে হল। মানুষগুলোও বেশ আন্তরিক। হাসপাতালের একটি কক্ষে বেশকিছু বেড পাতা আছে। হরতালের কারণে রোগীর সংখ্যা ছিল বেশ কম, তবুও লক্ষ্য করলাম ছোট ছোট শিশুদের রক্ত দেয়া হচ্ছে। কারো কারো পেট বেশ ফোলা, চেহারা বেশ ফ্যাঁকাসে আর চোয়ালের হাড়গুলো বেশ উঁচু- দেখলেই মনে হয় বাচ্চাগুলো অসুস্থ! কয়েকমাসের বাচ্চা থেকে শুরু করে বিশ-পচিশ বছরের যুবকদেরও রক্ত দিতে দেখা গেল। এখানে রক্ত দেবার চমৎকার ব্যবস্থাও আছে। আমাকে হাসপাতাল থেকে যে খরচের হিসেব দেয়া হয়েছিল এখানে দেখলাম তার চারভাগের একভাগ খরচও না, আর এদের ব্যবস্থাপনাও অনেক বেশী রিলায়েবল। ব্লাড স্ক্রিনিং, ক্রস ম্যাচিং, ওয়াশিং+স্যালাইন+স্যালাইন সেট, ব্লাড ট্রান্সমট ও ট্রান্সমটের সরঞ্জামসহ সর্বসাকুল্যে মোট খরচ ৬৫০ টাকা। দুই ব্যাগ রক্ত দেয়ার পর আমার স্ত্রী এখন অনেকটা সুস্থ্। কয়েকদিন পর আবার টেস্ট করে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে। যাই হোক, এবার থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে মূল আলোচনায় আসা যাক-

থ্যালাসেমিয়া কি?

থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে আলোচনায় প্রথমেই আমরা জানার চেষ্টা করি থ্যালাসেমিয়া কি? এটি একটি বংশগত রক্তের রোগ, এই রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদনে ত্রুটি হয়। পিতা মাতা থেকে সন্তানের মধ্যে জিনের মাধ্যমে এটা প্রবেশ করে। এটা কোন ছোঁয়াচে/সংক্রামক রোগ নয়, একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায় না। কেবলমাত্র যে বংশে এ রোগ আছে সেই বংশের লোকজনই বংশানুক্রমে এটা বহন করে চলে। থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেনস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়াতে ভুগে থাকেন। অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি ঘটতে পারে। উপযুক্ত চিকিৎসা না হলে যার পরিণতি হতে পারে অকাল মৃত্যু!
প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১ লক্ষ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে আর আমাদের দেশে এই সংখ্যা প্রায় আট হাজার। সারাদেশে এ রোগে আক্রান্ত সাড়ে তিন লাখেরও বেশি শিশু। দেশে দেড় কোটিরও বেশি মানুষ এ রোগের জীবাণু বহন করছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৪ দশমিক ১ ভাগ মানুষ ‘বিটা থ্যালাসেমিয়া’র বাহক। তাই এ রোগ প্রতিরোধে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

থ্যালাসেমিয়া কেন হয়?
মানবদেহের রক্তের লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল তিন মাস। অস্থিমজ্জায় অনবরত লোহিত কণিকা তৈরি হচ্ছে এবং প্রতি তিন মাস পর পরই প্লীহা-এ লোহিত কণিকাকে রক্ত থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এই লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল অনেক কমে যায়। তাদের হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি না হওয়ায় লোহিত কণিকাগুলো সহজেই ভেঙে যায় এবং যে হারে কমে যায় অস্থিমজ্জার পক্ষে একই হারে লোহিত কণিকা তৈরি সম্ভব হয়ে ওঠে না, ফলে আয়রন বের হয়ে আসে। যেহেতু এই রোগীকে নিয়মিতভাবে রক্ত গ্রহণ করতে হয়, তাই তাদের রক্তে আয়রনের পরিমাণ ধীরে ধীরে বেড়ে যায়। ফলে একদিকে যেমন রক্তশূন্যতা সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে প্লীহা আয়তনে বড় হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত আয়রণ জমা হওয়ার কারণে মস্তিষ্কও, হৃদপিন্ড, প্যানক্রিয়াস, যকৃত, অন্ডকোষ ইত্যাদি অঙ্গের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য এই রোগীদের রক্ত গ্রহণের পাশাপাশি আয়রন অপসারণকারী (Iron Chelating Agent) ঔষধ সেবন করতে হয়।

থ্যালাসেমিয়ার রকমভেদঃ
থ্যালাসেমিয়া দুইটি প্রধান ধরনের হতে পারে: আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বেটা থ্যালাসেমিয়া। সাধারণভাবে আলফা থ্যালাসেমিয়া বেটা থ্যালাসেমিয়া থেকে কম তীব্র। আলফা থ্যালাসেমিয়াবিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি প্রকৃতির হয়। অন্যদিকে বেটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি। এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমত চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বিশ্বে বেটা থ্যালাসেমিয়ার চেয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। আলফা থ্যালাসেমিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সর্বত্র এবং কখনও কখনও ভূমধ্যসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের লোকদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়।

যারা কেবলমাত্র থ্যালাসেমিয়ার বাহক (ক্যারিয়ার) তারা সারাজীবনই কাটিয়ে দিতে পারেন কোনরকম জটিলতা ছাড়াই। থ্যালাসেমিয়ার বাহকরা অনেকসময় জানতেও পারেন না যে তারা জন্ম থেকেই এই জিনটি বহন করে আসছেন। কারণ তাদের রক্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয়না, তারা সম্পুর্ন স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। জটিলতা দেখা দেয় তখনই যখন একজন বাহক আরেকজন বাহকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ জটিলতা অবশ্য তাদের ক্ষেত্রে হয়না, কিন্তু তারা দু’জনেই বাহক হওয়ার কারণে দুর্বিসহ হয়ে উঠতে পারে তাদের সন্তানদের জীবন। বিশেষজ্ঞদের মতে, মা-বাবা উভয়েই বাহক, এরূপ দম্পতিদের গড়ে চারজনের এক সন্তান মারাত্মক থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। দু'জন বাহক হিসেবে জন্ম নেয় এবং অবশিষ্ট একজন সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে। তবে স্বামী-স্ত্রীর একজন বাহক হলে কোনো সমস্যা নেই।

250px-Xlinkrecessivefather.jpg
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে কোন একজন ক্যারিয়ার

Hb.jpg
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দু'জনই ক্যারিয়ার

চলবে...

পোস্টটি ৭ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

তানবীরা's picture


খুবই কাজের লেখা। আশাকরি অনেকের উপকারে আসবে এই লেখাটা। থ্যালাসেমিয়া নিয়ে অজানা অনেককিছু জানলাম।

আপনার পরিবারের জন্যে শুভকামনা রইলো। আপাকে বলবেন, মনে সাহস রাখতে।

নাজনীন খলিল's picture


টিপ সই

সামছা আকিদা জাহান's picture


খুবই দরকারি পোস্ট। বিষয়টা জানার খুব ইচ্ছা ছিল ভাসা ভাসা জানতাম। জানলাম। সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করবে। টিপ সই

আরাফাত শান্ত's picture


টিপ সই

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture

নিজের সম্পর্কে

খুব সাধারণ মানুষ। ভালবাসি দেশ, দেশের মানুষ। ঘৃণা করি কপটতা, মিথ্যাচার আর অবশ্যই অবশ্যই রাজাকারদের। স্বপ্ন দেখি নতুন দিনের, একটি সন্ত্রাসমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের।