মেয়েটা নদীকে “মা” ডাকতো
_________________________________________________________
অনেকদিন আগে এপু যখন কবিতাটা লেখে, আমি কথা দিয়েছিলাম এটাকে ভিত্তি করে আমি একটা গদ্য লিখব। নানা কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। কালকে ওর কবিতাটা আবার দেখে, দেয়া কথাটা রাখার কথা মনে হ’লো। জানিনা কতটা এক্সেপ্টেবল হবে। তবে এপু যদি বলে গদ্যটা তার কাছে আপ টু দ্য মার্ক হয় নি, তাহলে আমি এটাকে ড্রাফট করে ফেলব।
কারণ, গল্পের ভিত্তি হচ্ছে তার কবিতা।
_________________________________________________________
মেম্বার বাড়ির উঠোন ঘেঁষে ঋজু দাঁড়িয়ে
থাকা শিমুল গাছটা থেকে তুলো বাতাসের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ভেসে যাচ্ছে। ত্বকে পলিমাটির মাধুর্য নিয়ে তুলোর পিছু পিছু ছুটছে মেয়েটা। গেঁয়ো পথটা পার হয়ে একটা
পেঁজা ঘুরে গেল, যেন হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকা কাশবনের ডাক উপেক্ষা করার উপায় জানা নেই তার। কিংবা তার সাথে উচ্ছসিত ছুটে বেড়ানো কিশোরীর মনের সাথে তার অলৌকিক
যোগাযোগ ঘটে গেছে। কিশোরী চোখে জেগেছে অতীতের ঘোর।
কত বয়স হবে মেয়েটার? দশ? নাকি এগার? বয়স যাই হোক, এখনই সারা দুনিয়ার সব দুঃখকে চিনে নিয়েছে সে। ভুল হ’লো। সব দুঃখ কষ্ট না, যেহেতু শরীরের বাঁক গুলো এখনো ভরাট হয়ে ওঠেনি, সেহেতু নারী জন্মটা নিয়ে বিতৃষ্ণা জাগা অভিজ্ঞতা হয়নি তার।
বাবার কথা তার মনে তেমন ভাবে মনে নেই। শুধু মনে আছে; যখন তাদের একটা ঘর ছিলো, একচিলতে দাওয়ায় বসে মা কাঁথার জমিনে সুঁই সুতোয় নকশা ফুটিয়ে তুলতো প্রতি বিকেলের রোদে হেলান দিয়ে, সে সময় একজন এসে দাঁড়াতো মায়ের সামনে। এক হাতে খলুই নিয়ে এঁটেল মাটি রঙের লোকটা যখন নিজের শরীরের দ্বিগুন লম্বা ছায়াটা ফেলত
মায়ের পায়ের উপর, মায়ের মুখে অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠতো কোনো কারণ ছাড়াই। মনে আছে, কোন এক পরবে বাবা নামের লোকটা তার জন্য টুকটুকে লাল জামা কিনে এনেছিলো যা যখের ধনের মত আগলে রেখেছিলো সে। একদিন বিকালে লোকটা তার শরীরের দ্বিগুন ছায়াটা আর মায়ের পায়ের উপর ফেলেনি। আরো কয়েকজন মিলে তার শরীরটাকেই এনে রেখেছিলো তাদের উঠোনে, সেদিন আর তার শরীর এঁটেল মাটির রঙ ধরে রাখতে পারেনি, হয়ে গিয়েছিলো রাতের মত কালো। মায়ের মুখের অদ্ভুত আলোটা মরে গিয়েছিলো সেদিন থেকেই।
মা......মা......মা......
ডাকতে ডাকতে মেয়েটা ছুটে চলেছে নদী তীরের কাশবন ধরে।
মা ই ছিল তার জীবন, আর ছিলো বাবাই। বাবা মারা যাবার কিছুদিনের ভিতরেই বাবাই বের হয়ে এসেছিল তার মায়ের ভিতর থেকে। মা যখন কাজে যেত, বাবাই কে দেখে
রাখার দায়িত্ব দিয়ে যেত তাকে। আস্তে আস্তে সে নিজে হয়ে উঠতে থাকে বাবাইয়ের আরেক মা। তার ছোট্ট জীবন্ত পুতুল ছিলো বাবাই। রাতে মায়ের দু’পাশে ঘুমাতো দু’জন। ঘুমের
ঘোরে মায়ের হলুদ-নুন গন্ধী আঁচলটাকে সে আঁকড়ে ধরত বারেবার। গন্ধটা তাকে নির্ভরতা এনে দিতো। মেম্বারের বাসায় কাজ সেরে মা যখন খাবার নিয়ে ফিরত, সারাদিনের গল্পের খই
ফুটতো তার মুখে। চাহিদা খুব বেশি ছিলো না তার। সকালে নুন-পান্তাতেই মন ভরে যেতো, কখনও মায়ের কাছে আবদার করতো ট্যাংরা মাছের চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খাবার। বিলাসিতা, বলা
যেতে পারে। বাবাইকে কাঁখে নিয়ে সে মাঝে মাঝেই ছুটে যেতো নদীর ধারে। দাঁতে একটা কাশের ফুল কামড়ে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকত। এঁটেল মাটিতে আঁকিবুকি কাটতো পায়ের
বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে। কখনো ফুল, কখনো মাছ, কখনো হিজিবিজি। আকাশে উড়ে বেড়ান পাখিও আঁকার চেষ্টা করেছে অনেকবার। একবার বাবাইয়ের পা বেয়ে উঠে এসেছিলো একটা জোঁক। একটুও ভয় পায়নি সে। হাতে থাকা বড়ই খাবার নুনটা জোঁকের মুখে দিয়ে দিতেই টুপ করে খসে
পড়েছিলো জোঁকটা।
আজকেও গিয়ে বসেছে সে নদীটার ধারে। কাশবন ধরে আসার পথে তার নির্ভরতার গন্ধে মনটা মৌ-মৌ করে উঠছিলো। নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে তার মনে হচ্ছে মায়ের আদর মাখা স্পর্শ তার পা দু’টো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। অনেকদিন আগের মত করে সে নদীর কাছে আবদার করছে তার প্রিয় বিলাসিতার। চোখ বেয়ে নামছে আষাঢ়ের বৃষ্টি।
এমনি এক বৃষ্টির রাতে। ঝুম বৃষ্টি। মায়ের ফিরে আসতে দেরি হচ্ছে দেখে বাবাইকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে চলছিলো মেয়েটা। আকাশের বুক ফেঁড়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো আর বাবাই বারবার কেঁপে উঠছিলো। মেয়েটারও বুকের ভিতর দুরুদুরু করছিলো কি জানি কি আশংকায়। মা ফিরে এসেছিলো অনেক দেরি করে। ভিজে একশা। মেয়েটাকে বলেছিলো “জাইগা থাকিসরে মা, আইজকা রাইতে আকাশ মাডি ভাইঙ্গা বান আইতে পারে”। মেয়েটা জেগেই ছিলো। কিন্তু সারাদিনের ক্লান্তি তার মা কে জেগে থাকতে দেয় নি। বাবাইকে বুকে
জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। অনেক রাতে গুমগুম করে শব্দ শুনে মেয়েটা বিছানার কোনায় বসে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মা কে ডেকে তুলেছিলো ঘুম থেকে। কাঁচা ঘুম থেকে জেগে উঠে মা কোনো দিশে খুঁজে পাচ্ছিলো না। একহাতে বাবাইকে জড়িয়ে আরেক হাতে মেয়ের হাত ধরে দৌড়
দিয়েছিলো নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। মাটিও কাঁপছিলো, যেনো ভয়ে। হঠাৎই পিছল রাস্তায় মায়ের পা হড়কালো। বাবাই ছিটকে পড়েছিলো মায়ের হাত থেকে। মেয়েটাকে মা হিজল গাছটার
কাছে ঠেলে দিয়ে আকাশ চেড়া বিদ্যুতের আলোতে দেখতে পেলো বাবাই একটু দূরে মাটির উপর শুয়ে আছে। দৌড়ে সেখানে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে হিজল গাছটার দিকে পা বাড়াতেই কড়কড় শব্দে কাছে কোথাও বাজ পড়ল, তার আলোতে চারদিক দিনের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আর তার সামনেই হাঁ করে বাবাই আর মা কে গিলে নিলো নদীটা।
মেয়েটা এখন নদীকেই মা বলে ডাকে। কিন্তু মা সাড়া দেয় না।
ভালো লাগলো; শিরোনাম দেখে ভয় পাইছিলাম
ডরাইছিলা কেন?
বাঘ-ভল্লুক ভাবছিলা নিকি?
ভালা হৈছে তৈলে...
ভালো লাগলো। আইডিয়াটা তো বেশ! এখন থিকা আমিও কবিতাকে গদ্যে রুপান্তরের ট্রাই লমু কিনা ভাবতেসি। তয় আমি কারো নাম উল্লেখ কর্মুনা
আমার নাম উল্লেকহ কৈরেন, নৈলে মাইনাস দিমু...
বেশ ভাল হয়েছে। দারুন আইডিয়া। তবে শেষে বাবাইকে না গিলইয়ে লেখা যেতনা?
শেষে বাবাইরে না গিলাইলে এই লিখার কোন আবেদন আসলে থাকে না; লেখকরা মানুষের দুঃখ্-কষ্টের সওদা করে
ঐ আমারে দুষো কেন? এপুরে গিয়া ঝাড়ি দিয়া আসো দেকহি কেরাম পারো???
যেখানে এপুই বাবাই কে মেরে ফেলেছে, সেখানে আমার কি করার আছে বলেন???
হেডিং দেখে ভাবলাম কবিতাটা এখানে এলো কেন।
এপুর অন্য সব কবিতার মধ্যে কেন যেন এই কবিতাটাই মনে থাকে। কবিতার মধ্যে যে গল্পটা ছিল সেই গল্পটার কারনে কিংবা নামটার কারনে। আপনার গদ্যকরন ভালো হয়েছে।
আমি নিজে এই কবিতাটা পড়ে এতটাই আপ্লুত হ'য়েছিলাম যে ওকে বলেছিলাম এটাকে নিয়ে গদ্য লিখবো।
ধন্যবাদ...
বেত্ত, সত্যি সত্যি সুন্দর হইছে লেখাটা
ধৈন্যা ধৈন্যা...
তুমার লেখা কৈলাম নিয়মিত পড়ি, কমেন্টানি হয়না আলসিতে
আই নো ইউ আর এ অলস বিইং, সো মাইন্ড খাই না
স্টাইলটা পছন্দ হৈছে ...
এইবার স্বপ্নের বাংলাদেশ নিয়ে লেখা শুরু করো... সুময় নাই
খাইছে, আমি স্বপ্নের বাংলাদেশ লইয়া লেখমু কেমনে???
আপনার লেখা বরাবরই ভালো লাগে, আজকেও লাগলো।
থ্যাংক্স সাঈদ ভাই...
বাহহহহহহহ, খুব সুন্দর।
গরীবের ঘরে মাসুম্ভাই আইছেন? :
....বাহ, দারুনতো...কবিটার সাথে আপ টু দ্যা মার্ক হৈছে কিনা, সেইডা তো আর আম্রা কৈতে পারুম্না, তয়, ছন্দ ছাড়াও, গদ্যটার মৈধ্যে কাব্য একটা চরম ভাবেই আছে...হাছা কৈতাছি....
ওরে থেংকু থেংকু...
ঐ বালিকার কি হৈছে কিছু জানো???
আচ্ছা এই ব্যাপার ----
ক্লাস থেকে ফিরে কমেন্ট করতেছি । এখন গুডবাই
একলব্যের পুনর্জন্ম | মার্চ ১০, ২০১০ - ৯:৩৯ পূর্বাহ্ন
আচ্ছা এই ব্যাপার ----
ক্লাস থেকে ফিরে কমেন্ট করতেছি । এখন গুডবাই
ভাগ্যিস এপু ড্রাফট করতে বলার আগেই পড়তে পারলাম
কবির হাতে গদ্যও সেরম হয় (ঈর্ষাজর্জর মন্তব্য)
আর কৈয়েন্না আন্টি। হেয় সেইযে গেলো কেলাস করতে অহনও বুজি আসে নাই কেলাস থিকা।
ভালা না হৈলে কৈলেই হয়। ইস্টেরেট ডেরাফটে পাঠাই... তাওতো কয় না
শুভ ভাই লেখা ভালো হইছে কোনো সন্দেহ নাই ।
একটা জিনিস খেয়াল করলাম , দেখেন কবিতায় যে স্পেস রাখা সম্ভব - গদ্যে তা পসিবল না - আপনি সেইখানে বাধা --- আবার কবিতার সেখানে একটা বিশাল সুযোগ ! পাঠক ও সাথে সাথে লিখে নিতে পারে অনেক খানি ।
আপনি জোর দিয়েছেন ঘটনায় , আমি অবশ্য ইলিউশন টায় জোর দিতে চেয়েছিলাম । একটু ভিন্ন ধাচ থেকে পড়তে ভালো লাগল এক ই ঘটনা
লেখা ভালো লাগছে অনেক এবং আই অ্যাম ফিলিং অনারড !
প্রিয়তে থাকলো ।
এটা ঠিক বলছো গদ্যে স্পেস রাখার ব্যাপারটা খুব ভালো গদ্যকার ছাড়া অন্য কেউই আসলে ঠিক মতো আনতে পারে না, আর আমি তো হাতুড়ে গদ্যকার। লেখার সময় আমিও ফিল করতেছিলাম যে তুমি যেভাবে কবিতাটা লিখেছো, গদ্যে আমি সেভাবে আনতে পারতেছি না। সেজন্যই আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম তুমি কিভাবে নাও ব্যাপারটাকে। কারণ তোমার সন্তানকে আমি নিয়ে যদি তোমার মনমত সাজাতে না পারি তাহলে শুধু তোমার কাছেই না, আমার নিজের কাছেও খারাপ লাগবে। যাক অন্ততঃ সেই দুশ্চিন্তা মুক্ত হ'লাম...
মনটা খারাপ হলো, আমাদের কাছে হয়তো এটা নিছক গল্প, কিন্তু বাংলাদেশের উপকূল এলাকার অনেকের কাছে হয়তো এটা নির্মম সত্য।
আসলেই মন খারাপ হয়ে যায়...
মন্তব্য করুন