দেশ-দেশান্তর (সবজি কাহিনী)
বাংগালীদের সন্মন্ধে প্রচলিত আছে তারা ভোজন রসিক, তাই প্রথমেই বলি রসনা আর রসুই ঘরের কথা। সেই ৯৬ সালের শীতে মুশকিল হচ্ছিলো আমাদের প্রযন্মের, ছেলে মেয়েদের নয়। খাবার মানে তো শুধু ক্ষুধা নিবৃতি নয়, আজন্ম লালিত রসনারও পরিতৃপ্তি। দেশি খাবারের প্রতি লোভ হোত, দেশে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, যা এখনও দেশের গ্রামের বুড়ো বুড়িরা বিলাতি বা চুঁয়া বাইগুন বলে, সীম নুতন আলু এই সব শীত কালিন তরকারি গুলিকে মোটামুটি কুলিন হিসেবেই বিবেচনা করা হোত, আসলে লাউ, কুমড়ো, উচ্ছে, ঝিঙ্গে, পটোল, কত রকমের বেগুন, কচু, লতি, বরবটি, কাকরোল, ঢেরস, সজনে, মুলো, লালশাক, আহা লালশাক!! কত রকমের শাক!!! গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে এই সব রকমারি বারোয়ারি তরকারির অভাব বিদেশে এসে যেন তীব্র ভাবে অনুভব করতে লাগলাম।
প্রচন্ড শীতে টাটকা মাছ, সব্জি, বিশেষ করে কাঁচা মরিচের কস্টটা আমাকে খুব বেশি ভোগাতো। তাই শীতের শেষেই শুরু করি সব্জি চাষের তোড়জোর। শুকনো মরিচের বিচি থেকে চারা তুললাম, গার্ডেন সেন্টার থেকে এদেশি বিভিন্ন বিচি কিনলাম, যুকিনি যা সামান্য ধৈর্য্য ধরে বড় করলে দেশের কাঁচা মিস্টি কুমরোর মতন লাগে। ইতালিয়ান যুকিনি যা আসলে চার পাঁচ হাত লম্বা চিকন লাউ, সালাদ ও সব্জির শষা, টমেটো, চাইনিজ দোকানের পুঁইশাকের ডাটা লাগিয়ে পুঁই গাছ গুলির লকলকে ডগা, সতেজ পাতা দেখে মনে অন্য রকম আনন্দ হোল। সারা সামার সব্জি বাগানটাকে সন্তান স্নেহে যত্ন করে তাক লাগানোর মত ফসল তুললাম, বন্ধু বান্ধবদের বিলোলাম, শীতের দুর্দিনের জন্য ফ্রজেন করলাম।
এ শতকের শুরুতে দলে দলে পুবের মানুষ পশ্চিমে আসতে শুরু করলো, টরেন্টো, মন্ট্রিয়েল তো বটেই, অটোয়াতেও প্রচুর এশিয়ান বসত গাড়লো। সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন হতে থাকলো ধীরে ধীরে। কেমন করে যেন দেশ থেকে লাউ, কুমড়ো, উচ্ছে, ঝিঙ্গে, ধুন্দল, লাল শাকের বিচি এলো, পাড়া-প্রতিবেশি, সহ-কর্মিদের সাথে বিচি, চারা গাছের আদান প্রদানে ব্যাক-ইয়ার্ডের সব্জি বাগান অনেক বৈচিত্রময় হোল। কোন চাইনিজের বাড়িতে বাংলাদেশের করোলা, আর ঈজিপ্টসিয়ান পাটশাক(মুলখিয়া) দেখলে অবাক হবার কিছু নেই। বাঙ্গালির বাড়িতে চাইনিজ চালকুমড়ো(লাউ এর মতনি দেখতে, স্বাদে চালকুমড়ো, নাম ফাজি, গায়ে বেশ রোঁয়া, উচ্চ ফলন শীল) দেখতেই পারেন। যারা বাগান করতে পারছেন না, তারা এশিয়ান গ্রসারি দোকানেই (আগে যার অভাব ছিল) কাংখিত দেশি ফ্রেস সবজি পাচ্ছেন কিনতে। চাইনিজ গ্রসারিতে আপনি কি পাবেন তার চাইতে কি পাবেন না জানতে সুবিধা হবে।
ওয়ালমার্ট সন্মন্ধে বলা হয় ‘বাই দি এশিয়ান, ফর দি এশিয়ান, প্রফিট ইজ ফর আমেরিকান’, আমি দেখি দিনের যেকোন সময়েই বাংগালীদের মিলন মেলা (ক্রেতা বিক্রেতার) হচ্ছে ওয়ালমার্ট, অনেক বাংগালীর কর্মসংস্থান দিচ্ছে, সাথে সাথে এও শোনা যায় ওয়ালমার্টের থেকে সস্তা জিনিস অন্য কোথাও পাওয়া যায় না ফলে ক্রেতার দলও গম গম করছে সারাদিন। তো হটাৎ করেই শোনা গেল ওয়ালমার্ট গ্রসারী সেকশন খুলছে। সেদিন দোকানে গিয়ে মনে হোল একেই চাহিদা আর যোগানের ব্যাবসা বলে! ভেজিটেবল আইলে গিয়ে দেখি বাংলাদেশের গ্রাম্য হাটের মত ক্ষেত থেকে সদ্য তোলা, টাটকা তিতে করোলা, পটোল, ঢেড়শ, ঝিঙ্গে, ধুন্দল, লাউ, কুমড়ো, কত রঙের আকারের বেগুন, সুগন্ধি ধনে পাতা, কাঁচা মরিচ, বম্বে মরিচ থরে থরে সাজানো। দামে বেশ সস্তা এই সব সব্জির চাষ আবাদ হচ্ছে মেক্সিকো, পোর্টেরিকা বা ডোমেনিয়ান রিপাব্লিকে। ওয়ালমার্টের দেখাদেখি অন্যান্য কানাডিয়ান সুপার মার্কেটেও আমাদের দেশি সবজি জাতে উঠে গেল।
পরিচয়ের পোষাকি নামটাও না বললেই নয়, যেমন পুঁই এর নাম ‘মালাবার স্পিনিচ’ ঝিঙ্গের নাম ‘চাইনিজ ওকরা’ লাউ এর নাম ‘ওপো’ মুখী কচুর নাম ‘এডো’ ঢেড়সের নাম ওকরা। সবচেয়ে মজার নাম দেখলাম ফার্মবয়ের দোকানে। আপেল সাইজের হালকা বেগুনি রঙ্গের ছোট ছোট বেগুনের উপরে লেখা ‘হিন্দু এগপ্লান্ট’ আর বাংলাদেশের ইসৎ লম্বা ফোলা ফোলা বেগুনি শিরদাড়া শীমের উপরে লেখা ‘বাংলা বীনস। পরে হিন্দু এগপ্লান্ট নাম বদলে হোল ইন্ডিয়ান এগপ্লান্ট। করোলার নাম ইন্ডিয়ান কেরালা। আরো অবাক ব্যাপার মাঝে মাঝে কানাডিয়ান গিন্নিরাও এশিয়ানদের কাছে জানতে চায় করোলার ভেষজ গুন বা রান্নার রেসিপি। এবার আমার লাউ গাছ বেড়া ডিঙ্গিয়ে পাশের বাড়ির চেরি আর আপেল গাছে বাড়তে লাগলো। আমার পড়শী আলসালভোদরের, তার চেরি গাছের মগ ডাল থেকে লাউ পেড়ে, তাকে চিংড়ি দিয়ে তা রান্না করে এক বাটি চাঁখতে দিয়েছিলাম। তার এত মজা লেগেছে যে সে এখন মাঝে মাঝে লাউ চিংড়ি রাঁধে।
পাড়াতো খালাম্মা যিনি এসেছেন সেই পঞ্চাসের দশকে, যখন কারি পাওডার আর গোলমরিচই সম্বল, তাই দিয়ে খালু পি এইচ ডির পড়াশোনার ফাঁকে ফার্মের মুরগির চামরাসহ আস্ত ঠ্যাং এর ঝোল আর আংকেল বেন এর ভাত রান্না করে ভ্রমন ক্লান্ত খালাম্মাকে খেতে দিয়েছিলেন। খাবারের ঐ বোঁটকা গন্ধে খালাম্মা ফিরতি প্লেনেই দেশে ফিরবার দাবি করেছিলেন। ‘ঠেলার নাম বাবাজী’ তো ঠেলায় পড়ে চোখের পানি নাকের পানি এক করে পঞ্চাশ বছর পরে, বাড়ির কাছের সদ্য খোলা শ্রীলংকান দোকান থেকে কিনে দেশি সব্জির আঝালা আতেলা আলুনি তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েই আমাকে ফোন দিয়েছেন। ‘আসমা বলো পঞ্চাশ বছর কি কম সময়? এত দীর্ঘ সময়েও কেন আমার জিব(জিহবা) ভুললোনা ঐ দেশি তরকারির স্বাদ? মুখে দেয়ার সাথে সাথে কেন তা চিনতে পারলো? দ্বিধাগ্রস্থ বৃদ্ধাকে আমি ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করি ‘বাংলা ভাষাটাকে কি ভুলেছেন খালাম্মা?’
‘জননী, জন্মভুমি!! নিছক কিছু সুখ দুঃখের স্মৃতির সমাহার নয়, এটা একটি মানুষের অস্তিত্ত্বের পরিচয়, তার দেহ, মন সেটা ভোলে না, ভোলা উচিৎ না!!!
চোখের আলোয় দেখি আমি, স্মৃতির মায়ায় ছুঁই,
ও আমার বিদেশ বাড়ির মাঁচায় শোয়া পুঁই।
থোকা থোকায় ফুটছে কত হলুদ ঝিঙ্গের ফুল।
উচ্ছের সাথে হাওয়ায় দোলে নধর ধুন্দুল।
চেরি গাছের মগ ডালেতে ঝুলছে লাউ এর লতা,
শরৎ হাওয়ায় পুব পশ্চিমে কয় কি মায়ার কথা?
বৃক্ষ-লতায়, পাতায় পাতায় হীম কুয়াষার ভীড়ে
ভোরের আলো ঝল মলালো শিশির কনার হীরে।
কোন সুদূরে হারিয়ে ছিলাম, এই তো পেলাম নাম ঠিকানা
ফসল মাঠের ভূগোল পাঠে পুবের কিছু শষ্য-দানা।
রসুই ঘরে ছড়ায় কিছু পুরোন সেই আনাজ ঘ্রান,
রসনাতে তৃপ্তি ফোটে, হোক না কিছু স্মৃতির বয়ান!!
আসমা খান
আপনার লেখাটা পড়ে একই সাথে তিনটা জিনিস পেলাম।
দেশের প্রতি টান, আপনার সাবলীল লেখার হাতের পরিচয় এবং সুক্ষ্ম হিউমার সেন্স। সাথে বোনাস হিসেবে পেলাম কবিতাটা
অনেক সুন্দর লাগলো...
অসংখ্য ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যর জন্য।শুভেচ্ছা জানাই। ভালো থাকবেন।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
উফ্ কি যে চমৎকার একটা লেখা। দুইটা লাইক দিলাম। তাতেও মন ভরলো না।
লেখাটি পছন্দ করেছেন জেনে খুব ভালো লাগছে। সুন্দর মন্তব্যটির জন্য অস্নগখ্য ধন্যবাদ।
কবিতাটাতো অসাধারণ এর ওপরে।
একটা কথা অনেকে বলেন, বাংলাদেশি আর কলকাতার বাংগালী আলাদা করবেন কিভাবে? বাগান দিয়ে। বাংলাদেশি মানে সবজি বাগান লাউ - কুমড়া - শাক আর কলকাতা মানে নানারকম ফুল
চমৎকার মন্তব্যর জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
আমি আসলে ফুল খুব পছন্দ করি, প্রতি বছরই নুতন নুতন জাতের ফুল লাগাই ফ্রন্ট ইয়ার্ডে। মন ভালো করতে ফুলের কোন বিকল্প নেই। সবজি বাগানও আমাকে অনেক আনন্দ যোগায়, মনে হয় আমার আঙ্গিনাতে এক টুকরো বাংলাদেশ!!!
আমার জানা অনেক বাংলাদেশিই কোন বাগানই করেন না।
আমার সাথে কি আপনার জানাশোনা আছে নাকি?

জানা শোনা হতে কতক্ষন লাগে? কেমন আছেন তানবীরা? অনেক শুভ কামনা রইলো।
দারুণ একটা লেখা।
খুব ভাল লাগলো কবিতাটা !
অনেক অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যর জন্য। শুভেচ্ছা জানাই।
একটা প্রশ্ন ছিল- ওখানে দেশীয় শাকসবজি এতো টাটকা পান কীভাবে? দেশ থেকে অনেক শাকসবজি বা মাছ বিদেশে যায় শুনেছি, সেগুলো যেতে যেতে তো অন্তত দিন পনের সময় চলে যায়- সেগুলো কেমন লাগে খেতে? কিংবা দেখতে?
আমি বাংলাদেশি মাছ ফ্রজেন হিসেবেই দেখেছি এখানে। বরফ দেয়া টাটকা মাছ যেটা মদ্ধ্যপ্রাচ্য বা ইংল্যান্ডে দেখেছি, সেরকম অটোয়াতে দেখি নি।
আমার লেখাতে উল্লেখ করেছি, অনেক সবজি মেক্সিকো, পোর্টরিকা, ডোমিনিয়ান রিপাব্লিকে চাষবাস হয়, সরাসরি প্লেনের কার্গোতে চলে আসে। বিশেষ করে পটোল আর করোলা দেখলে মন হয় এই মাত্র বাগান থেকে তোলা, দেশের মত পানিতেও চোঁবানো নয়।
অনেক ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য।
চমৎকার লেখা,
চমৎকার কবিতা।
সুন্দর মন্তব্য।শুভেচ্ছা জানবেন।
যারা প্রবাসে থাকেন তাদের সাথে কথা বললে একটা ব্যাপার উপলদ্ধি করি,তাদের প্রতিটা নিঃশ্বাসে থাকে দেশের জন্য মায়া,দেশের জন্য ভালোবাসা,দেশের মানুষদের জন্য হৃদয় নিংড়ানো আবেগ।আপনার লেখাটা পড়ে সেকথাই মনে হলো আরেকবার।বিশেষ করে কবিতাটা।কী আবেগী কথা!!
চোখের আলোয় দেখি আমি, স্মৃতির মায়ায় ছুঁই,
ও আমার বিদেশ বাড়ির মাঁচায় শোয়া পুঁই।
থোকা থোকায় ফুটছে কত হলুদ ঝিঙ্গের ফুল।
উচ্ছের সাথে হাওয়ায় দোলে নধর ধুন্দুল।
প্রবাসিদের দেশের জন্য, প্রিয় জনের জন্য মায়া থাকে।
সুন্দর মন্তব্যর জন্য ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা জানবেন।
আমি যে শহরে থাকি সেখানে থাই/চায়নিজ/ভিয়েতনামিজরা না থাকলে দেশী অনেক সবজিই পাওয়া হতো না। এখানে লাউকে বলে লং মেলন, চালকুমড়োকে হেয়ারী মেলন, কড়ল্লাকে বিটার মেলন ,ধুন্দলকে বলে লুফা, ঝিংগাকে কি জানি বলে, জানি না
। লাল শাক পাওয়া যায় না, দেশ থেকে ফ্রোজেন আসে তবে খেতে রাবারের মতো
। পুঁই শাক, ডাটা শাক, কুমড়ো শাক, কলমি শাক, শর্ষে শাক পাওয়া যায়, পাট শাক একবার পেয়েছিলাম। পটল পাওয়া যায় না, অন্য সব পাওয়া যায়। দেশী শীম পাওয়া যায় না।
সুন্দর মন্তব্যর জন্য ধন্যবাদ। কানাডার বড় শহর গুলিতে অনেক সুপার মার্কেটেই দেশি অনেক সবজি পাওয়া যাচ্ছে। আপনার শহরেও দেশি লোকজন বেশি হলে হয়তো সবই পাওয়া যাবে, সময়ের ব্যাপার।
টোরন্টো-তে টাটকা শাক-সব্জি পাচ্ছি আজকাল। আমার আত্মীয় স্বজনরা ব্যাক-ইয়ার্ডে চাষ করছেন। ছোটবোন তার কন্ডো-তে টবে করেছিলো। এখন নতুন বাড়ীতে করলো এই গ্রীষ্মে। আমারও ইচ্ছে, এক টুকরা জমিতে চাষাবাদ করার।
পটল, কাকরোল যে মেক্সিকো, পোর্টেরিকা বা ডোমেনিয়ান রিপাব্লিক থেকে আসছে, তা একদম জানা ছিল না। আশ্চর্য হলাম।
সতেজ থাকুন।
মন্তব্যর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আমার বাসা থেকে বাংলাদেশি দোকান বেশ দূরে, তাই খুবই কম যাওয়া হয়, গেলে কাকরোল পাই।খুব প্রিয় একটি তরকারি।
ওয়ালমার্টে যখন প্রথম গ্রোসারি সেকশন খুলেছিল, তখন্ দেখেছিলাম করোলা, পটোল, কাঁচা খোঁসা সহ তেতুলের উপরের ডিসপ্লেতে লেখা প্রোডিউস অফ ডোমিনিয়ান রিপাব্লিক, পোট্রেরিকা, বা মেক্সিকো। লিচুর উপর লেখা থাইল্যান্ড ইদানিং দেখা যাচ্ছে ব্রাজিল। সেখানে কর্মরত একজন ইন্ডিয়ান হাসি মুখে উপরের ট্যাগ দেখিয়ে আমাদের বলেন ' এ মলুককো নেহি, দেখিয়ে এ মেক্সিকো থে আয়া '
আমরা এখন টাটকা দেশি সবজি খেতে পারছি এটাই বড় কথা!
মন্তব্য করুন