দেশ-দেশান্তর (দুর্যোগ, উৎসব)
ঝড়
৩১ শে অক্টোবর। আজ সকাল সাড়ে সাতটায় ঘর থেকে বেড় হয়ে দেখি শোঁ শোঁ বাতাশ, মুষল বৃস্টি, মধ্য রাতের অন্ধকার। স্যান্ডি তার ঝড়ের মেজাজ নিয়েই আছে, ধার কিছুটা কমেছে এই যা। হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ির লাইন, মানুষ প্রকৃতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজেদের কাজে বেরিয়েছ। গতকাল সাড়াদিন আবহাওয়া চ্যানেলে তাকিয়ে ছিলাম, মেজ কন্যার জন্য দোয়ায় ছিলাম, তারা থাকে ম্যানহাটনে, স্যান্ডির তান্দব্ লীলার ঠিক মধ্যখানে। সকালে জানলাম না তাদের খুব বেশি কিছু হয়নি, তারা ভালোই আছে। আজ সকালে টিভিতে দেখছি নিউ ইয়র্কে ফুঁসে ওঠা সমুদ্রের ঢেউ এর মাঝে সার্ফিং করছে বেপরোওয়া কজনা!! লন্ডভন্ড পথঘাট, ভাঙ্গাচোড়া গাছপালা, ঝিমিয়ে পড়া ম্যানহাটন থেকে উন্মত্ত ফনাতোলা পাহাড়সম ঢেউএর সাথে পাঞ্জালড়া মানুষগুলো আমাদের মুগ্ধ করলো।
গতবছর ৩০ শে আগস্ট ঈদের ঠিক আগের দিন প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে আইরিন এসেছিল আমেরিকায়। মেজ কন্যার অটোয়াতে ঈদ করার কথা সব্বার সাথে, কিন্ত ঝড়ে তার ফ্লাইট ক্যান্সেল। শুধু তাই না, ম্যানহাটন ছেড়ে জীবন নিয়ে নিরাপদ এলাকায় যেতে হবে। কন্যা ইন্টারনেটে গিয়ে আইরিনের যাত্রাপথ অনুসরন করে সিদ্ধান্ত নিল সকাল নয়টার মধ্য যদি ম্যানহাটন ছেড়ে চলে যাওয়া যায়, তাহলে ড্রাইভ করে ঈদের আগেই অটোয়াতে পৌছে সবার সাথে ঈদের আনন্দে ভাগ বসানো যায়, এমনিতেই দুপুর বারোটার মধ্য বাড়ি ছাড়তেই হবে জান বাঁচানোর জন্য। দুজনে ননস্টপ গাড়ি চালিয়ে বিকেল পাঁচটায় অটোয়াতে আলগোছে বাসার দরজা খুলে তারা নিঃশব্দে ফ্যামিলি রুমে এসে দেখে, পুরো পরিবার শুকনো মুখে টিভিতে দেখছে আইরিনের ধ্বংশলীলা। প্রযুক্তির যাদুতে যখন ঘাড়ের কাছে শন শন বাতাশ লাগছে, কানে ঝড়ের হুংকার শুনছি, পিলে চমকে উঠছে বিদ্যুতের আলোয়, একাগ্র মনে দোয়া করছি, তখন কে যেন কে যেন মাথার পিছনে দাঁড়িয়ে চুলে আঙ্গুল দিয়ে চিরুনির মত বিলি কাটছে। টিভি থেকে চোখ সরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি মেজ মেয়ে জামাই!! সেই উথাল পাতাল চিন্তা শেষে ঈদ কেমন হোল বলুনতো???
হালুঈন
পুরো অক্টোবর মাসের আবহাওয়া আশাতিরিক্ত ভালো ছিল। প্রায় প্রতিদিন নেবারহুডে হাটতে গিয়েছি। আর আসন্ন কানাডিয়ান উৎসব হালুঈনের প্রস্তুতি দেখেছি। এরা পারেও বটে! এক একটি উৎসব তার চেহারার অনন্যতা, বিশেষত্ব, আমেজ, সাজগোজে সব্বাইকে মাতিয়ে দিয়ে যায়। নিজে সাজে, মনকে সাজায়, ঘর বাড়ি সাজায়, ব্যাবসায়িরা পন্য সম্ভারে, বিভিন্ন রকমের চকলেট, বাচ্চাদের বিভিন্ন ভয় জাগানো পোষাকে দোকানপাট সাজায়, পুরো নগর এমন ভাবে মাতে, যে চাইলে আপনি চোখ দিয়ে দেখতে পাবেন, জিব দিয়ে চাখতে পারবেন, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে পারবেন, উৎসবের ছন্দে নাচতে পারবেন! প্রস্ততি চলে বহুদিন ধরে, বহুমাত্রায়। যেমন বাড়ির বাইরে হালুঈনের সাজ কিছুটা ভৌতিক। নর মুন্ডু, কংকাল, ভৌতিক মুখোস, মাকড়সা, কালো বিড়াল, গ্যালো, গিলোটিন, এপিটাফ। ঢাউস সাইজের কুমড়ো কার্ভ করে ভয়ার্ত মুর্তির অবয়ব বানিয়ে ভিতরে মোমবাতি জ্বালিয়ে গা ছমছমে পরিবেশ।
সন্ধ্যার সাথে সাথে দল বেঁধে ছেলে পিলেরা বিভিন্ন চরিত্রের মুখোশে, পোষাকে যেমন ভূত, পেত্নি, দৈত্য, দানো, স্পাইডার ম্যান, এমনকি টেরোরিস্টের সাজে এসে কলিং বেল টিপে, গৃহকর্তাকে কচিকন্ঠে সমবেত কোরাসে বলবে ‘ট্রিক অর ট্রিট’, খুশি মনে গৃহস্বামি চকলেটই দেন, কে আর নিজের দরজায় ছুড়ে মারা পঁচা ডিম বা ময়লা আবর্জনা পেতে চায়! প্রাগৈতিহাসিক আমলের প্যাগানদের উৎসব এখন বানিজ্যিক পন্য হয়ে গিয়েছে, ভ্যালেন্টাইন ডে বা মাদার’স ডে বা খ্রীস্টমাসের মত। আমাদের দেশের নববর্ষের উৎসবও কি এমন ধারা বানিজ্যিক পন্য হয়ে যাবে?
হেমন্ত
শীত কড়া নাড়ছে দরজায়, হেমন্ত নিরবেই চলে যাচ্ছে। রঙ্গিন পাতারা ঝর ঝর করে ঝরে যাচ্ছে। দু সপ্তাহ আগেই গাছ গুলি এত রঙ্গিন এত জীবন্ত ছিল! ন্যাড়া গাছ গুলি একাকি দাড়িয়ে। ভুট্টা, স্ট্রবেরি, সয়াবিন, গম, ক্যানলা বা অন্যান্য ফসল কাটা বিরান মাঠ, শুধু কুমড়ো ক্ষেতে এখনো কমলা রঙের ঢাউশ, মাঝারি, ছোট গাদা গাদা কুমড়ো পড়ে আছে। দেশান্তরি ঝাকে ঝাকে উড়ে যাওয়া হাস, ছোট হয়ে যাওয়া দিনের মায়াময় গোধুলি মনকে রাঙ্গিয়ে বিদায় নিচ্ছে। সকালে কুয়াষা, আমার প্রতিদিনের হাটা পথে একটা ন্যাড়া ক্ষেতে এক রাতের বিশ্রাম শেষে ঝাঁকে ঝাঁকে হাস দক্ষিনে উড়াল নেবার প্রস্ততি নিচ্ছে। লেজ ফোলা কাঠবিড়ালির ছোটা ছুটি কি
যে ভালো লাগে দেখতে। তাপমাত্রা এখনো এককের ঘরে, শুন্যর নীচে নামেনি।
চমৎকার আবহাওয়ায় ফের বিয়ের ধুম লেগেছে। গত সপ্তাহে খেলাম বাঙ্গালি ছেলে আর আলজেরিয়ান মেয়ের বিয়ে। মেহেদি অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি ঘরে বানানো মুগপাক্কন পিঠে, হরেক রকমের দেশি মিস্টি, মেয়ের বাড়ি থেকে এসেছে মুচমুচে মধু দেয়া অমৃতের স্বাদের বাকালাওয়া। আরব আর বাঙ্গালি প্রথা মিলে মিশে একাকার। ছেলের মা আলপনায়, রাখিতে, ঘোমটা মাথায় শারি পড়া আরব বৌকে ঘরে তুলেছেন, নিজের গলা থেকে খুলে সোনার হার পরিয়ে দিয়ে, যা তিনি পেয়েছেন নিজের শ্বাশুরীর কাছ থেকে।
দেশে হেমন্তের শেষ রাতে মায়ের পুরোনো শারি দিয়ে বানানো কাঁথা অদ্ভুত মায়াময় গন্ধে, জড়িয়ে ধরতো, আবেশে ঘুম চলে আসতো, সেই সব স্মৃতিময় কাঁথা কাঠের আলমারিতে ভাজে ভাজে ন্যাপথলিনের গন্ধ মেখে প্রতিটি সেলাইএর ফোঁড় মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে আছে এখনো, মায়েরও ছিল তার মায়ের বাড়িতে স্মৃতির খনি, ব্যাক্তিগত বা সামাজিক উৎসবে, দুর্যোগে সেই সব স্মৃতি মনের সামনে চলে আসে, সব্বাইকে মায়ায় কাছে টানে, সামনে চলার পথ দেখায়। প্রথার জন্ম কি ভাবে হয়?
আসমা খান
খুব ভাল লাগল আপনার রোজনামচা।
নিয়মিত পড়তে চাইই
অশেষ ধন্যবাদ। লেখাটি পড়ে মন্তব্যর জন্য।
নিয়মিত পড়তে চাই আপনার লেখা
মন্তব্যর জন্য ধন্যবাদ।
আপনি খুব চমৎকার ভাষায় গুছিয়ে লিখতে পারেন।
নিয়মিত লিখবেন। ভাল থাকুন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার লেখাটি পড়ে সুন্দর মন্তব্যর জন্য।
আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।
মচমচে...লেখা চলুক নিয়মিত
~
অবশ্যই লেখা চলবে, যদি পাঠক চায়
চমৎকার লেখা...
ধন্যবাদ চমৎকার মন্তব্যর জন্য।
অসাধারণ!!!
খুব ভাল লেগেছে লেখা নিয়িমত চাই লেখা।
অনেক ধন্যবাদ, সুন্দর মন্তব্যর জন্য। পড়ছেন, উৎসাহ দিচ্ছেন, লেখাতো উচিৎ তাই না?
আপনার লেখাটা পড়ে মুগ্ধ হলাম আসমা আপু। মনে হলো খুব সুন্দর করে গুছিয়ে এবং আদ্যোপান্ত সাজিয়ে তৈরি করা একটা লেখা। খুব দারুণ!
অ.ট. বাংলাদেশি উৎসবগুলোর সঙ্গে আসলে কোনোকিছুর তুলনা চলে না। নববর্ষ, কুরবানী, বিয়ে- এগুলো বেশি দারুণ! আর উদ্দাম আনন্দ করার জন্য বিজয়া দশমী বেস্ট। এইবার আমরা গেছিলাম সদরঘাটে। ট্রাকের উপর ছিলো প্রতিমা আর ছেলেপিলে আর আন্টি-আংকেলরা। পিছনে ১০০টা হুন্ডার বিশাল বহর। জেন্ডার সমতা আনার জন্য প্রত্যেক সাইকেলে চালকের সঙ্গে একটি করে মেয়ে দেয়া হলো। থিমটাই ছিলো ওইরকম। খুব মজা হইসে এবং আমি পানিতে পড়ে গেছিলাম।
মার লেখাটি আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।

আপনার লেখা যখনই পড়ি তখনি ভালো লাগে। লিখে যান অবিরত। ভালো থাকেন শুভকামনা!
সুন্দর মন্তব্যর জন্য অশেষ ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা জানবেন।
সুন্দর মন্তব্যর জন্য অশেষ ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা জানবেন।
জী... জী এবং অবশ্যই জী ... দিদি ... আপনি শেষে যে উক্তিটি করেছে, " প্রথার জন্ম কি ভাবে হয় ? "
হ্যাঁ দিদি ঠিক বলেছেন এ ভাবেই হয়.... .... একটা কাপড়ের বুনন যেমন একটি সাথে আরেকটির আলিঙ্গনে হয়, তা না হলে কাপড়টাই আর বুনা হতো না । প্রথার বহতা যেন সেভাবেই.... ....
খুব ভালো লাগলো আপনার সাবলীল এবং ঝরঝড়ে লেখনী... প্রেরনা দেবে...
চালিয়ে যান ভেঙ্গেচুরে....
মন্তব্য করুন