কোরবানী
ছোট বেলায় খুশির জোয়ার নিয়ে আসতো দুই ঈদ, এর মধ্যে এক ঈদে শহুরে জীবনে দিন কতকের জন্য মায়াকাড়া একটি গরু এসে কদিনের জন্য আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রে রীতিমত হুলুস্থুল ফেলে দিত। গরুটাকে নাওয়ানো, খাওয়ানো, রাস্তায় রাস্তায় নিয়ে বেড়ানো, অন্যদের গরুর সাথে তুলনা করায় আমাদের উচ্ছাস সীমা ছাড়িয়ে যেত। আব্বা সবসময় শহরের উপকন্ঠের গ্রাম থেকে লোক মারফত গৃহস্তের পালা পোষা বকনা গরু কিনতেন। কিন্তু কাজি আর গাজি বাড়িতে তো বটেই, শেখ সৈয়দেও অলোক্ষ্য একটা প্রচ্ছন্ন কম্পিটাসান থাকতো, যেটা আমরা ছোটরাও বুঝতে পারতাম। জমে ওঠা হাটের থেকে চড়া দাম দিয়ে তাঁরা কিনতেন বিশাল বিশাল ষাঁড়। রাস্তা দিয়ে হেটে যাবার সময় সবচেয়ে দামি ষাঁড়ের পিছনে মালিকের খান্দানি আভিজাত্যও সগৌরবে হেটে যেত।
ঘরে ঘরে এমনিতেই ঐ সময়ে সব্বারই ব্যাস্ততা থাকতো তুঙ্গে। ছুড়ি, চাকু, দা বটি ধারানো, কশাই ঠিক করা, চ্যালা কাঠের ব্যাবস্থা, মসলা গূড়ো করা, উঠোনে গর্ত করে ইটের চিক দেয়া সাময়িক চুলো বানানো, তোলা বড় বড় ডেকচি গুলো ধুয়ে তার নীচে আঠালো কাঁদা ল্যাপা। এই ঈদে অবশ্য নুতন কাপড় মিলতো না, গেল ঈদের কাপড়ই ধুয়ে ইস্ত্রি করা থাকতো।
বাসার কাছেই ছিল ঈদগাহ। দূর দুরান্ত থেকে মানুষ সাফ সুতোরো কাপড় পড়ে টুপি মাথায় দিয়ে পাটি নিয়ে এসে লাইন দিয়ে বসতো। প্রথম কাতারে অবশ্য চৌধুরি, কাজি, সৈয়দ, গাজি, আর শেখদের, আর সেই সময় ছিল মৌলিক গনতন্ত্রের যুগ, চেয়ারম্যান সাহেব থাকতেন মধ্যমনি। মাত্রই তার বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন বিশাল ধুমধামের সাথে। স্বপ্নের মত সেই সব অনুষ্ঠান এখনও এলাকার মানুষজন মনে রেখেছে। এই যেমন ধরেন বরযাত্রির নিখুত সাজানো গাড়ির বহরের আগে বারো জনের ব্যান্ডপার্টি তাদের জৌলুসের পোষাক পরে কুচকাওয়াজের তালে তালে বিদেশি বাদ্যযন্ত্রে সুর তুলেছে ‘চল, চল, চল মেরা সাথি, ও মেরা হাতি… … …। সবকিছু ফেলে ছেলে পিলেরা তো বটেই, যোয়ান এমনকি বুড়োর দলও উৎসুক নয়নে রাস্তার পাশে এসে দাড়িয়েছে। রাস্তার আশে পাশের অন্দর মহলের জানালার পর্দা সরিয়ে বৌ ঝিরাও অভুতপুর্ব এই দৃশ্য হুমরি খেয়ে দেখেছে। বউ বরনেও নুতন ধামায় করে ফুলের পাঁপড়ির বদলে চকচকে এক টাকার কাগজের নোট বৃস্টির মত ছিটিয়ে নুতন বউকে ঘরে তুলেছেন চেয়ারম্যান গিন্নি।
বারোয়ারি মানুষে ঈদগাহের পিছন ভরে গেলেও সামনের সারির খান্দানি লোকজন হেলে দুলে ধীমে তালে আসতেন। ঈদগাহের ঠিক পিছনেই ছিলো মস্ত বড় ময়দান, যেখানে পদ মর্যদা অনুযায়ি, কোরবানীর বাহারি গরুগুলি লাইন দেয়া থাকতো। কশাইরাও তাদের কেরামতি দেখাতে চাইতো ঐ সব খান্দানি গরু কোরবানীতেই। অস্ত্রের ঝনাৎকার, পশুগুলির অন্তিম চিৎকার, ফিনকি দেয়া রক্তারক্তি কারবার থেকে আমাদের দূরেই রাখা হোত। আমরা বরং বারান্দার সিড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে বসে উঠোনের চুলোয় বিরাট বড় ডেকচিতে টগবগ করে ফুটতে থাকা পোলাও বা ভুনা খিচুরির রান্না দেখতাম, আর অপেক্ষা করতাম মগজ ভুনা, কলিজা ভুনা, আর ঝালে ঝোলের সেই মজাদার মাংশ দিয়ে খিচুরি পোলাও। সারা দিনের মানুষের আনাগোনা, উৎসবের এ আনন্দ কে ভোলে?
বছর ঘুরে সেবার ঈদ এলো আষাঢ় মাসে। মুয়াজ্জিন সাহেব আগের দিন রিকসায় করে ‘একটি বিশেষ ঘোষনায় ঈদের নামাজ সকাল আটটায় ধার্য করা হইয়াছে, মাইকে বলে গেলেন। ঈদের দিনের সকালের মেঘলা আকাশ যে কোন সময় ঢেলে দেবে, এর মধ্যেও লোকজন ঠিক সময়মত এসে বসে আছে, সময় বয়ে যায়, তারা অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বিরক্ত হতে শুরু করে। ইমাম সাহেব বুঝতে পারছেন সেটা… … কিন্ত ঠিক তার পিছনেই প্রথম সারির এই বিশেষ যায়গাটা এখনো খালি। ধৈর্য্যর সীমায় বসা মানুষ……, ক্রুদ্ধ হয়ে চিৎকারের আগেই, নীতিবান আলেম তিনি…… উপস্থিত সবার অনুরোধে, ঘড়ির কাঁটা যখন সাড়ে নয়টার ঘরে……, তিনি কোরবানীর তাৎপর্য ও ফজিলত সন্মদ্ধে সংক্ষিপ্ত খোতবা দিয়ে নামায শুরু করলেন… … … …
সালাম ফিরিয়েই সবাই দেখলেন। ঈদগাহের ঠিক সামনেই ধব ধবে সাদা আদ্দির পাঞ্জাবী পড়া বিশাল বপুর চেয়ারম্যান সাহেব তার পোষা মুনিষ নুরু দেলুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে, সর্ব অবয়বে গনগনে ক্রোধ ঠিকরোচ্ছে, তীব্র হিস হিসে গলায় গর্জন করে উঠলেন ‘বা বা বাহ, বেশ বেশ, আমাকে বাদ দিয়েই ঈদের নামাজ শেষ হয়ে গেল? এই এই নুরু…উ, দেলু…উ…উ যা, যা ঐ হা**জাদা হুজুরের ঘাড় ধরে টাইনে ছেঁচরায়ে আমার সামনে নিয়ে আয় এক্ষুনি, এক্ষুনি!
হতভম্ব, নির্বাক জনতা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো চেয়ারম্যান সাহেবের পায়ের জুতো উনার
মারমুখী হাতে উঠে এসেছে!
স্মৃতির উৎসব ফিরে ফিরে আসে।
প্রচলিত প্রথায়, মানুষের বিশ্বাসে,
শান্ত সমাজে, সাম্যর কারুকাজে,
ত্যাগে ভোগে জীবনের ভাজে ভাজে।
অকস্মাৎ অশুভ ক্ষমতার ক্রোধ……
বিপন্ন বিবেক… অসহায় বোধ…
এ যুগেও মন গুহাবাসি হয়।
আসমা খান।
হুম বাংলাদেশ পাল্টাবেনা মনে হয়!
লেখাটি পড়া ও মন্তব্যর জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
ছোটবেলার সেই ঈদের খুশি ছোটবেলার মতোই হারিয়ে গেছে
খুশির স্মৃতি আছে অম্লান!!
ঈদ মোবারক!!!
ঈদ আনন্দ ছেলেবেলাতে শেষ!
মন্তব্য করুন