প্রেম থেকে অপ্রেমে(শেষাংশ)
মুখবন্ধ
সাধারণ মানুষ,ছাপোষা জীবনযাপনকারী ন'টা-পাঁচটার বৃত্তেবন্দী লোভকামমোহমাৎসর্যে আকণ্ঠ ডুবে থাকা জীবনেও প্রেম আসে। প্রেম ছককাটা জীবনটাকে উল্টেপাল্টে দেয়, নতুন করে বাঁচতে শেখায়। কিন্তু রোম্যান্সের চটজলদি আকুলতা কমলে যেটা পড়ে থাকে, সেটাকে প্রেমের ছাইভস্ম বলাটাই কি বেশি সঙ্গত? মানবিক টানাপোড়েন দানবিক হয়ে উঠলে প্রেম তো অপ্রেমেও পর্যবসিত হতে পারে দ্রুত, তাই না? ক'দিন আগে লেখা একটা সহজিয়া রোম্যান্সের পরিণতি নিয়ে ভাবছিলাম। বেশ কিছুটা লিখে ফেলেছিলাম- শেষটা এখনো চেষ্টা করছি মেলানোর। যদিও জীবনের হিসেব মেলানো খুব কঠিন।
৪
তিন বছর আগে-
“প্লিজ না, প্লিজ প্লিজ...” ভয়ে শুকিয়ে গেছে কুশির মুখ।
সামিনের পুরো শরীর তার শরীরের ওপর, গলার কাছে ওড়না টান দিয়ে সরিয়ে ফেলে- এতো জোরে যে নরম চামড়ায় লাল দাগ বসে যায় শিফনের কাপড় কেটে। হলদে রঙের একটা জামা পরেছে সে, পাজামাও সে রঙের। আজ পহেলা ফাল্গুনের উৎসবে বাড়িতে আবীর খেলা হয়েছে তার ছিটেফোঁটা এখনো তার কানে, গলায়।জামার বুকের কাছেও লেগে আছে কিছুটা।
সামিন তার প্লিজ এর থোড়াই কেয়ার করে! আরো জোরে কুশিকে চেপে ধরে বুকের বোতাম খোলে। ছটফটিয়ে ওঠে কুশি- আতঙ্কে, লজ্জায়।
“সমুদা, আপনার পায়ে পড়ি। প্লিজ...” কান্নায় জড়িয়ে গেছে কণ্ঠ...”মা চলে আসবে...আমাকে মেরে ফেলবে, প্লিজ...না... প্লিজ না...”
সামিন তখন প্রবল পুরুষ। দুনিয়ার কিছুই তাকে রুখতে পারবেনা। গত তিনটে বছর এই মেয়েটার জন্য সে অস্থির হয়ে ছিলো। শরীরেও, মনেও।
আমেরিকা থেকে ছুটে চলে এসেছে শুধু এই মেয়েটার মুখটা মনে করে!
বারবার ছ’মাস পেরুলেই ছটফটিয়ে প্লেনে ওঠে, পড়ালেখা শিকেয় উঠছে তার। কিছুতেই ভেবে পায়না কেন এই লজ্জা, কেন এই আড়ষ্টতা মেয়ের।
কুশি কি তাকে ভালোবাসেনা? কুশি কি তাকে চায়না??
তার চাই। কুশিকে চাই।
আজই চাই, এক্ষুণি চাই।
তিন বছরের সংযম এক লহমায় ভেঙে পড়েছিলো আজ কুশিকে ভিজে গায়ে দেখে।
আবীরের থালা থেকে অর্ণবের কুশির গালে রঙ মাখিয়ে দেওয়া তার মেজাজ ধাঁ করে চড়িয়ে দিয়েছিলো, কিন্তু তৃণা আর এমি যখন এক বালতি পানি ঢেলে দিলো আর ভিজে কাপড় গায়ের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে কাঁপছিলো কুশি, তখন শরীর জ্বলে ওঠে তার।
নিজের মনে নিজে দাঁতে দাঁত চেপে বলে - এই মেয়েটা আমার। শুধু আমার। ওকে কেউ দেখবেনা।
কেউ না!
প্রথম সুযোগেই বাবামা খালাখালু আর অন্যান্য মুরব্বীদের চোখ এড়িয়ে কুশিকে হাত ধরে প্রায় টেনে হিঁচড়ে বেডরুমের দিকে নিয়ে যায়। পথে অর্ণবের সাথে একবার মুখোমুখি হয়। অর্ণব কুশিকে হাত টেনে অন্যদিকে কিছুটা নেয়ার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু হিংস্র শ্বাপদের মতো সামিন সে হাত সরিয়ে দেয়- “কুশির সাথে আমার জরুরি কথা আছে। এক্ষুণি, এই মুহূর্তে। ও কোত্থাও যাবেনা এখন।” যৌন উত্তেজনা আর রাগের মিশেলে ফোঁসফোঁস করে ওঠে তার কণ্ঠ, “ খবরদার কুশি, অবাধ্যতা আমি একটুও পছন্দ করিনা”...
ভদ্র আর সদ্য কৈশোর পেরুনো অর্ণবকে কাটাতে তার দু’মিনিটও লাগেনি। যদিও অর্ণব ব্যাপারটা পছন্দ করেনি মোটেও। বাঁক ঘুরতেই অর্ণব চোখের আড়াল হয় আর ত্বরিত গতিতে পাঁজাকোলা করে কুশিকে কোলে তুলে নেয় সামিন। কুশি নীল হয়ে গেছে। সমুদা কি আজ তাকে মেরেই ফেলবে! কী করেছে সে! মুখচোখ শুকিয়ে যায়, বুকের ভেতর হৃদপিণ্ড গলার কাছে উঠে আসতে চায়।
“একটু পানি...”শুধু এটুকু বলতে পারে সে।
“চুপ! একদম চুপ! পানি ঘরে বেডসাইড টেব্লে আছে না? গিয়ে পাবি।”
জোরে জোরে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে সে।কুশিকে কোলে নিয়ে হাঁপাচ্ছে রীতিমতো!“সমুদা, আমার জামাটা ভিজে...” আস্তে করে বলে কুশি। একটু সহানুভূতির আশায় তাকায় সাতাশ বছরের সুদেহী পুরুষটির দিকে।
“বলেছি না চুপ্? না থামলে কি করে থামাতে হয় আমি জানি!”
ঘর এসে গ্যাছে, টপ্ করে কুশিকে নামিয়ে চট্ করে দরজা বন্ধ করে। কুশির হাত পা কাঁপছে। “দরজা... বন্ধ করছেন কেন সমুদা?” ফোঁপানির সাথে কণ্ঠের কাঁপুনি মিলেমিশে যায়।
“তৃতীয়বারের মতো বললাম না চুপ? এরপরেও কথা??”
চোখ জ্বলছে তার। হায়েনার দৃষ্টি। শক্ত করে একহাতে চিকণ বেতসলতা শরীর জড়িয়ে ধরে, আরেক হাতে মাথার চুল মুঠি করে মুখটাকে নিজের ঠোঁটের কাছে টেনে আনে। চুলে টান লেগেছে, কুশি চিৎকার করবে- কিন্তু সে সুযোগ সে পায় কোথায়! জোর করে মুখ হাঁ করে সামিন তার তপ্ত জিভ ঢুকিয়ে দিয়েছে তার মুখে। পাগলের মতো শক্তিতে জাপ্টে ধরে তাকে বিছানায় ফেলে, তার দুর্বল প্রতিবাদ শোনার সময় কোথায় এই পাশবিক পুরুষের!!
শেষ অব্দি সে যখন মায়ের এসে পড়ার কথা বলে তখন সামিন খুব ধারালোভাবে হেসে ওঠে। “ও! শুধু মা এসে পড়বে, মেরে ফেলবে এই ভয়?” তাচ্ছিল্য তার কণ্ঠে - অন্তর্বাস পর্যন্ত পৌঁছে গেছে হাত, নরম সিল্কের মতো মসৃণ আর মাখনরঙা ত্বকের সাথে মেলানো সেই কাপড়ের রঙ।
“না, না মা’র জন্য না, সমুদা প্লিজ...”
“আমি চাইনা, এভাবে না, সমুদা প্লিজ...প্লিজ...”কান্নায় বুঁজে আসে তার গলা, শরীর উৎসুক হয়না, কেবল কুমারীত্ব হারানোর ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। পুরুষ তখন মগ্ন পদ্মকোরকের মতো স্তন দু’টির ফুটে ওঠা সদ্য কুঁড়িগুলোকে নিয়ে। বাচ্চাদের মতো খুশিতে ডগমগ- “কুশি, পায়রার বুকের ওম তোর বুকে।” বলেই মুখ গুঁজে দেয়।
“সমুদা প্লিজ না...পায়ে পড়ি আপনার... না... আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ... এভাবে না............”কুশির সমস্ত ইচ্ছে, স্বপ্ন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে পড়ছে... এভাবে না, এভাবে হয় না...
এভাবে তো সে দুঃস্বপ্নেও চায়নি।
সমুদা প্রথম তার চোখে চোখ রাখবে... অনেকক্ষণ।
হাতে হাত ধরে তারা দিনের পর দিন বসে থাকবে... এটা সে অনেক রাতে স্বপ্নে দেখেছে।
আলতো করে হাতের পাতায় হয়তো একটা কি দুটো চুমু খাবে সারা দিনমানে।
কখনো হঠাৎ আলতো করে বুকে চেপে ধরবে তাকে, ল-ম্বা সময় নিয়ে। ব্যাস্। এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবলে তার ভয় লাগে, অস্বঃস্তি হয়, বুকে ব্যথা করে। মনে হয় খুব খারাপ কিছু করে ফেলছে। তার বয়সী মেয়েদের তুলনায় সে এখনো অনেক সাদাসিধে। সিনেমায় আলিঙ্গন বা চুমুর দৃশ্য আসলে নিজের অজান্তেই সে মুখ ফিরিয়ে নেয়, চোখ বুঁজে ফেলে। প্রেম ব্যাপারটা তার কাছে খুব পবিত্র ঐশ্বরিক দীপ্তিময় কিছু বলে মনে হয়। শরীর সেখানে থাকলেও কোনোভাবেই মুখ্য ভূমিকা নিয়ে নেই।
সতেরোর প্রেম নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়... ...
তার এই সফট, সিল্কি, স্মুথ, ইম্যাকুলেট, সারল্যভরা দুধের গন্ধমাখা স্বপ্ন সাতাশের শরীরী লিপ্সার কাছে হেরে যায়।বর্ধিষ্ণু পুরুষালি আগ্রাসন তাকে বিবস্ত্র করেই ক্ষান্ত হয়না, নিরস্ত্রও করে।
সেদিনও, ড্রেসিংরুমে সমুদা... কেন?
আজো....না...না... প্লিজ না...
যৌন অনুভূতির চেয়েও প্রবলতর হয় ব্যথা আর কষ্টের ক্লেদাক্ত অনুভূতি।
যে পুরুষটির স্বপ্নে তার নারীত্বের উন্মেষ, যার কথা ভেবে যৌবনের উদগমের সাথে তার প্রথম হৃদয়দৌর্বল্যের সূচনা তার চাপে পিষ্ট হতে হতে পৃথিবীর ওপর বিশ্বাস লুপ্ত হতে থাকে তার। সামিন জোর করে কুমারীর শরীরে নিজেকে প্রবিষ্ট করে বটে, কিন্তু সূচীমুখভেদী তীব্র যন্ত্রণায় কুশি যখন আর্তনাদ করে ওঠে তখন ফুলপাখিলতাপাতা নরম কোমল সমস্ত অনুভূতি তার বাহ্যজ্ঞান থেকে লুপ্ত হয়। কুশির মুখ চেপে ধরে নিজের অজান্তেই। মেয়েটা এতো চেঁচাচ্ছে কেন?
পুরুষত্বের ছটফটানি আর কষ্টের মাঝে সে অনুভব করে পুরুষাঙ্গে পিচ্ছিল কিছুর অনুভূতি। গোঙানিকে শীৎকার ভেবে কুশিকে আরো জোরে আঁকড়ে ধরে সে, আর বিস্ময়াভিভূত হয় শরীরের নিচে রক্তের ধারা দেখে।
বিছানার চাদর লাল হয়ে গেছে।
ভেসে গেছে জবাফুল- কাতরাচ্ছে মেয়ে তার হাতের মুঠোয়, শীৎকার নয়, গোঙানি। ব্যথার, যন্ত্রনার।
সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো কুশি কুমারী।
কুশির বয়স মাত্র সতেরো।
শরীর এখনো তৈরী হয়নি পুরুষস্পর্শের প্রাবল্য যুঝতে।
কুশির মন এখনো কুঁড়ি ফুটে কুসুম হয়নি।
সামিনের চেতনা ফিরে আসে, কিন্তু চৈতন্যদোয় ঘটেনা। মানুষের আগে সে পুরুষ এই আদিম বোধ তাকে চালিত করে। কুশির শরীর তার শরীরের চাপে দলিত, শ্বাস তার হাতের তালুর চাপে ক্ষীয়মান, আওয়াজ ব্যথার তীব্রতায় অপসৃয়মান।
ক্রমশঃ নিস্তেজ দেহে একটা সময়ে কুশি অস্ফুটে শুধু বলেছিলো, “খুব...ব্যথা...প্লিজ...আর না...”
সামিনের মাথা তখন পুরো খারাপ ! সে জানেনা কেন, এই মেয়েটির প্রতি তার অধিকারবোধ ভীষণ। অধিকারের ষোলআনা উসুল করাটা তার কাছে সে মুহূর্তে অনেক বড় ব্যাপার।
পুরো জানোয়ার হয়ে গেছে তার ভেতরটা!
“শ্ শ্ শ্... চুপ্ সোনা...একটু ব্যথা লাগবে।। তারপর ভালো লাগবে দেখবি... লক্ষ্মীসোনা আমার...হরিণছানা...” নিজের মনে আউড়ে চলে সে। ঘোরে, বেঘোরে।
কুশির ভালো লাগছেনা। একফোঁটাও না।
ব্যথার পর আরো তীব্রতর ব্যথার ঢেউ, যোনীমুখের যন্ত্রণা ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। হায়! ঈশ্বর বলে কি কেউ আছেন? তিনি কি শুনতে পাচ্ছেন না এই কাতরোক্তি? কুশি বারেবারে প্রার্থনা করে শেষ হোক এই নারকীয়তা। কেন, কেন এখনো সে মরে যাচ্ছেনা? আর পারছেনা সে। সামিনের হাত তার মুখ চেপে ধরে আছে–মনে হয় অনন্তকাল-চিৎকার চাপা গোঙানি হয়েছে-অনন্তকাল- তারপরেও সে বেঁচে আছে কেন? উহ্, মা, বাবা, অর্ণব, তৃনাপি, চুনি খালা- কেউ এসো, কেউ একটা। আমি আর পারছিনা, মা। প্লিজ মা, প্লিজ মা, প্লিজ মা......
“শ্ শ্ শ্ - লক্ষীসোনা, এই তো এক্টুকু, একটু ব্যথা সহ্য কর..." কামোত্তেজিত পুরুষের অনতিউচ্চ ফিসফিস তার চেতনায় বাহ্যত কোনো প্রভাব ফেলেনা। কিন্তু ভাগ্যদেবী এবারে তার সহায় হন। সামিনের ভালোবাসার তোড় এতক্ষণে যা পারেনি, শরীরী তোড় ক’মিনিটের মধ্যেই তা সাধন করে ফেলে। চোখ উলটে, মুখের ভেতরে শ্বাস আটকে সাড়ম্বরে জ্ঞান হারায় সে!
অথচ, প্রেমিকপুরুষটির সংক্ষুব্ধ ঝাঁকুনি তারো প্রায় পাঁচ মিনিট পর!
তাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বার বার সামিন ফিসফিস করে, উচ্চস্বরে, রাগত স্বরে, ভেঙে পড়া স্বরে ডাকে
“কুশি?
কুশি...?
কুশি... কুশি কুশি...তাকা একবার সোনা, লক্ষী... মানিক .... সোনা বাচ্চা... তাকা ... কুশি।। কুশি...
কুশি!!!!!!!”
কুশি তাকায় না। কুশি তাকানোর অবস্থায় নেই।
বেসামাল সামিন উঠে বসে চেতনাহীন দেহটিকে দ্যাখে। ঠোঁট বেঁকে গেছে, ভ্রুকুঞ্চিত, যন্ত্রণায় মুখ নীল। অক্সিজেনের অভাবে সাদাটে চামড়া। আর- রক্ত!
অতো রক্ত হয় না’কি কারো গায়ে? তার শরীরে লেগে গ্যাছে রক্ত, কুশির শরীরে চটচটে রক্ত,বিচ্ছিরি একটা গন্ধ,দুপায়ের ফাঁকে ঠাণ্ডা মেরে যাওয়া নারীদেহ।
নারীদেহ? না’কি শুধুই একটা দেহ!
মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে তার। আস্তে ধীরে সম্বিত ফিরছে।
ধোঁয়াটে অন্ধকারের ভেতর, কামক্লেদবীর্যস্খলিত জয়ী পুরুষ।
নিচে বিধ্বস্ত, পরাস্ত পরাজিত পুষ্প।
তার খুব খারাপ লাগছে। বমি পাচ্ছে।
পরিতৃপ্তি নেই, শুধু স্খলনের গ্লানিটুকু আছে।
আর আছে অন্ধকার। প্রগাঢ়, দুর্ভেদ্য, কালান্তক জুগুপ্সার অন্ধকার।
সারা পৃথিবী ঘিরে।
৫
তিন বছর দু’সপ্তাহ আগে-
কুশি মগ্ন হয়ে গাইছে-
“অবেলায় যদি এসেছ আমার বনে দিনের বিদায়ক্ষণে
গেয়ো না, গেয়ো না চঞ্চল গান ক্লান্ত এ সমীরণে
ঘন বকুলের ম্লান বীথিকায়, শীর্ণ যে ফুল ঝ'রে ঝ'রে যায়
তাই দিয়ে হার কেন গাঁথ হায়, লাজ বাসি তায় মনে।
চেয়ো না, চেয়ো না মোর দীনতায় হেলায় নয়ন-কোণে॥”
ক্লাসটা ছোট। গোটা দশ পনেরো ছাত্রছাত্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাঁয়া, তবলা, তানপুরা, এস্রাজ, হারমোনিয়াম একদিকে সারবেঁধে রাখা। কিন্তু খালি গলাতেই রেওয়াজ সবচে’ বেশী সময় ধরে হয়। সুচরিতাদি, যিনি গান শেখান সবসময় ওদের উৎসাহ দেন খালি গলায় গাইতে। ক’দিন পর একটা অনুষ্ঠান, তাতে সৌভাগ্যবশঃত কুশির একটা একক গান মনোনীত হয়েছে। গত দু’বছরে পিয়ানো টিচারের উৎসাহে গানটাকে নতুন করে শিখছে। আর বিশেষভাবে বাবা ভীষণ রকমের রবীন্দ্রনাথের গানের ভক্ত। তাই বাস্কেটবল খেলা ছাড়া মাত্র একটা কাজ পড়াশোনার বাইরে করতে পারবে-এমন শর্তে ও গানটাকেই বেছে নেয়।
অর্ণব একেবারে পেছনের সারিতে বসা। কুশিকে দেখে দেখে তার আশ মেটেনা। কখনো ভাবেনি এই মুখচোরা, লাজুক মেয়েটা এতো সুন্দর গাইতে পারবে। কুশির মগ্নতা তাকে ছুঁয়ে যায়। চিকণ, রিনরিনে একটা সুরের আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ঘরে। তার ঠিক মধ্যেখানে রাজেন্দ্রাণীর মতো তার স্বপ্নের মেয়েটি, চোখ মুদে গাইছে- সারা পৃথিবী ভুলে গিয়ে- এই দৃশ্য তার ভেতরটা টলিয়ে দেয়। সে ঠিক করে,খুব ছেলেমানুষের মতো ঠিক করে-বিয়ের পর সে আর কুশি মিলে একটা গানের দল খুলবে। একেকটা দিন শুধু তারা দু’জন দিনভর এরকম গান গাইবে। আর কিচ্ছুনা।
সে জানে, প্রেমিক হিসেবে সে খুব আহামরি কিছু নয়। কুশি তাকে দেখে একটু লজ্জা পায় আজকাল, সেটা গতবছর জন্মদিনে ওকে ফুল দেবার পরপরই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো। কুশিকে সে চায়। কুশির সাথে সে বেড়ে উঠেছে, বন্ধু হিসেবে, ছোটবেলার সাথী হিসেবে, ক্লাসমেইট হিসেবে সহজ সম্পর্ক সবসময় তাদের ছিলো। আছেও। সে প্রেমের কথা তেমন গুছিয়ে বলতে পারেনা। ভালোবাসা দেখানোটা একটা আর্ট। সেই আর্টে সে দক্ষ নয়। কিন্তু কুশির কষ্ট, দুঃখ, দ্বিধান্বিত মুহূর্তে সে পাশে থাকে। ঘিরে ছিলো সামিন ভাইয়ের চলে যাবার সময়টাতেও। সে জানে, কুশি লোকটাকে খুব ভয় পায়। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে কুশি তার জীবনের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মনে করে ওই সামিন লোকটাকে।
ভাইয়া খুব মেধাবী, দুর্দান্ত ক্যারিয়ারিস্ট আর খুব মজার ঠাট্টা করতে পারে- এটুকু সে জানে। মা ইনফ্যাক্ট বেশ কয়েকবার ঠেলেছে তাকে কুশির সাথে পড়তে যাবার জন্য। সেটা হয়ে ওঠেনি মূলতঃ কুশির অনাগ্রহেই। কেন যেন তার মনে হয়, কুশি নিজের জীবনের এই দিকটা খুব ঢেকে রাখতে চায়। কুশি কষ্ট পায়, ক্ষতে মলমের প্রলেপ দিতে বন্ধু হিসেবে তাকে আঁকড়েও ধরে, কিন্তু কখনো নিজেকে মেলে ধরেনা। সেখানে তার যত গোপনীয়তা। মেয়েটা এতো চাপা!
কিন্নর কণ্ঠের রেশ গান শেষ হবার পরও খানিকক্ষণ সবাইকে আবিষ্ট করে রাখে। সুচরিতাদি উঠে এসে ওর মাথাটা ধরে আশীর্বাদ করে দেন। তার মানে গানটা আজকে সে সত্যিই ভালো গেয়েছে। অর্ণবের দিকে তাকাতে সে মাথা ঝাঁকিয়ে আশ্বস্ত করে, নিষ্পাপ বন্ধুত্বের হাসিতে বুঝিয়ে দেয় আজ দিনটা কুশির।
ফুরফুরে মেজাজে দু’জন হেঁটে ক্লাসরুম থেকে করিডোরে। ড্রেসিংরুমে রয়েছে কুশির বাস্কেটবলের সরঞ্জাম।কুশি বলে “অর্ণব ভাইয়া, তুমি থাকো, আমি উপর থেকে নিয়ে আসি, প্র্যাক্টিস শুরু হয়ে যাবে। গাড়ি এসেছে তোমাদের? তাহলে আমি তোমার গাড়িতেই আজ যাবো। মা’র মিটিং আছে কলেজে, গাড়ি আসবেনা।” অর্ণবও ঘড়ি দ্যাখে, হ্যাঁ আধঘণ্টা মাত্র বাকী-“ যাও, তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু!”
ড্রেসিংরুম পুরো খালি। তড়িঘড়ি জুতো্মোজা গলিয়ে শর্টস পরে, জার্সি, হেডব্যান্ড, হাতে হাঁটুতে রক্ষাকবচ- হঠাৎ কার যেন ছায়া সামনে।
হাঁটুগাড়া অবস্থাতেই মাথা উঁচু করে, আর করেই হাঁ!
সমুদা!
এখানে!
কেন?
এখন কেন??
ধারালো ঠোঁটের পাতলা হাসি বুক চিরে দেয় তার।
“কীরে কুশ্, তড়বড় করে রেডি হচ্ছিস, দেরী করিয়ে দিলাম?”
“আ...আ...আপনি! ক্...ক্...কবে এসেছেন?” ভয়ে, উত্তেজনায় তোতলাতে শুরু করে সে। বুক ধ্বকধ্বক করছে!
সামিন খুব তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে তার ঘাবড়ে যাওয়া। বাচ্চাটার(হেই ম্যান, মেয়েটার! মেয়েটার! দ্যাখো, আরো লম্বা হয়েছে, শরীর হাতপা সুডৌল, কী টানাটানা চোখদু’টো, কোমরের কাছটায় অদ্ভুত সুন্দর বাঁক!বুক ওঠানামা করছে ঘন নিঃশ্বাসে। এই মেয়েটা শুধু তোমার!)
আচমকা থম্কে যাওয়া তাকে আরো টানে। দু’পা এগিয়ে এসে কুশিকে হাত ধরে ওঠায় সে। অনুভব করে আঙ্গুলের ডগা কাঁপছে মেয়ের- “কাল বিকেলের ফ্লাইটে এসেছি। আজ তোদের বাড়ি গিয়ে শুনলাম আইভী খালা গাড়ি পাঠাবেন না, তাই গাড়ি নিয়ে এসেছি, চল্ পৌঁছে দেবো।”
“আ...আ...আমি তো অর্ণব ভাইয়াদের গাড়িতে...” এখনো তোতলাচ্ছে কুশি।
ভ্রু কুঁচকে দু’মিনিট ভাবে সামিন-“ওহ্, অর্ণব মানে রীতাখালার সেই পুঁচকে ছেলেটা না? আনিকার ভাই? আচ্ছা, ওদের গাড়িতে যাবি? বেশ!”
“আমি এত্তোদিন পর এলাম, আমার সাথে টাইম স্পেন্ড না করতে চাইলে কী আর করা!” -ছদ্ম দীর্ঘনিশ্বাসে পেছন ফিরে যাবার জন্য উদ্যত হয় সে। “আ...আ...আমি...মানে মা জানে...আমি...ওদের গাড়িতে...মানে...” এতো ভয়! এতো দ্বিধা! এই লোকটা তার জবান বন্ধ করে দেয় কেন? বারবার?
সামিন উলটো ঘোরে- দু’পা, তিন’পা এগোয় কুশির বলয়ে- কুশি ঠিক দু’পা, তিন’পা পেছোয়–
আরো কাছে এসে কুশির গালের ধারে ঠিক কানের পাশে মুখ নিয়ে আস্তে করে থেমে থেমে বলেঃ “ওর...গাড়িতে...আমারটাতে নয়?”
কুশি থরথর করে কাঁপছে। নিজের কাছে নিজেরই বোকার মতো লাগছে। সে বড় হয়েছে, তার পছন্দ–অপছন্দ এখন অনেক পরিশীলিত। এই লোকটা শুধু তাকে বলেছে তাকে পছন্দ করে- একে এতোটা ভয় পাবার কিছু নেই- এই লোকটা তাকে কিচ্ছু করবেনা- এটা সমুদা- তার টিচার-
আচমকা তার দুকাঁধের পাশে বাহুবেষ্টন! ঠেলে ড্রেসিংরুমের লকারের গায়ে সেঁটে দিলো লোকটা!!
তার মুখ সমুদার কাঁধের কাছে, মুখটা নামিয়ে আনে সমুদা-না! এটা কি? কি হচ্ছে তার সাথে??
না!
না!!
না !!!
তার প্রতিবাদ করা উচিত, হাত ছুঁড়তে পারছেনা, সামিন ঘিরে রেখেছে, পা আটকানো ওর দুপায়ের বৃত্তে –
মুখ দিয়ে আতঙ্কের শব্দ বেরুতে গিয়ে বাধা পায়, কারণ হঠাৎ, এক্কেবারে হঠাৎ, সামিন তার ওষ্ঠাধর চেপে ধরেছে নিজের ঠোঁট দিয়ে!!
জোর করে মুখ হাঁ করায়, কুশলী খেলোয়াড় তার জিভ ঢুকিয়ে দেয় অনাঘ্রাতা কিশোরীর সুঘ্রাণ জিভে।
কুশি ঢোঁক গিলছে, সে পাগল হয়ে যাচ্ছে কি? এরকম লাগছে কেন তার? “না, প্লিজ না...”
সামিন তার গলা আঁকড়ে ধরে কানের লতিতে জিভ ডুবিয়ে সঘন কণ্ঠে ফিসফিস –“সুইট সেভেনটিন, ইয়েট আনকিস্ড, ইয়েট আনটাচ্ড, ইয়েট আনপলিউটেড...” মদির হাসিতে পেপারমিন্ট চুইংগামের সুবাস, একটা ফরাসি কোলনের পুরুষালি গন্ধ অবশ করে দিচ্ছে তার হাত পা- “তুই আগে কখনো, কাউকে চুমু খেয়েছিস, কুশ্?” ঘন গলা।
টলটলে চোখ, অপাপবিদ্ধা কিশোরী তাকায় পূর্ণ তরুণের দিকে। মাথা এদিক ওদিক নাড়ে। সে? চুমু খাবে? কাকে???
তাকে এরকম উতল অস্থির বেসামাল করে দেয় পৃথিবীতে আর কেউ আছে? খুব ক্ষীণভাবে অর্ণবের মুখটা মনে আসে কিন্তু এই দাপুটে পুরুষ ঠোঁট কামড়ে ধরেছে তার- ব্যাথা পাচ্ছে, জিভ দিয়ে ঠেলছে তাকে, লেহন করছে ওষ্ঠপুট- জীবনে প্রথমবারের মতো- চুম্বন কাকে বলে সে অনুভব করছে-সেখানে অর্ণবের কৈশোরিক আবেগ বিপুল স্রোতে ভেসে যায়।
মিনিটখানেক পর।
সামিন চিবুক ধরে আছে তার- তার পা তখনো অবশ, দুই উরুর মাঝখানে ঝিমঝিম করছে, মাথা পুরো ফাঁকা।
কী সুন্দর সামিনকে দেখতে! ঘোরলাগা দৃষ্টি আবিষ্ট হয়ে আছে সেই ধারালো চোয়ালে আর পাতলা ঠোঁটে। ঠোঁট চিরে হাসি সুদর্শনের-“তোকে তোর জীবনের প্রথম চুমুটা আমি খাবো, এটা ঠিক করেছিলাম চার্লস নদীর পারে বসে। দুপুরের খাবারের পর তোকে নিয়ে খুব ভাবতাম...”
না...এটা ঠিক না... সমুদাকে এরকমভাবে সে কল্পনা করেনি! তার স্বপ্নে ছিলো অন্যরকম কিছু। অনেক নরম, কোমল, সূক্ষ্ম ছোঁয়া! তার বদলে এই!
“একী রে, তোর ঠোঁট ফুলে তো ঢোল! এত বাচ্চা, এতো নরম আমার হরিণছানা”– তৃপ্তির হাসি পুরুষের গালজুড়ে-“ ইস্স্- দ্যাখ ওপরের ঠোঁটে রক্ত জমাট বেঁধে ফুলে গ্যাছে- না না জিভ দিস্নি, ব্যথা পাবি”- নিজের পকেট থেকে ওয়েট টিস্যু বের করে আল্তো করে মুছে দিচ্ছে-চুলকোচ্ছে, জ্বলছে- সে উঁউঁ করে শব্দ করে ওঠে।
কৌতুকের হাসি সামিনের চোখেমুখে ঝিকমিক করে –“মা’কে কি বলবি? ইয়াব্বড়ো ফোলা ঠোঁটের হিস্ট্রি? হুম্ম্?” নিজের মনেই হাসছে সে কুশির জবাবের তোয়াক্কা না করে। তারপর হঠাৎ বলে-“ইয়েট আনটাচ্ড, ইয়েট আনপলিউটেড...” জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁটটা বুলিয়ে নিয়ে-“আমার একটু পলিউট করার ইচ্ছে হলো তোকে...”হাসছে চোখের মণি-“আরো অনেক অনেক বেশি পলিউটের জন্য অস্থির হয়ে আছি গত তিনটে বছর!কবে বড় হবি তুই?”
কুশির মুখ লাল হয়ে গেছে। কানের পাশ দিয়ে গরম ভাপ বেরুচ্ছে। শরীরী এই সংসর্গ আর সামিনের উল্টোপাল্টা কথা তাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে ভীষণ। কিন্তু তার শরীর বশ মানছে না কেন? এখানে এখন কেউ এসে পড়লে কী হবে ভেবে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে তার। একই সাথে জীবনের প্রথম চুম্বনের সিক্ততা আর ক্ষত তাকে অস্বঃস্তিতে ফেলেছে। কিন্তু বুকের ধ্বকধ্বকানি তাতে একটুও কমছে না!
সামিন তাকে অবশেষে ছেড়ে দেয়, গাড়িতে করে বাড়ির গেট অব্দি লিফটও দেয়। পুরোটা সময় সে মুখ নিচু করে ঘাড়গুঁজে বসে থাকে, আর সামিন এন্তার ফাজলামি করে যায় তার ইনেক্সপেরিয়েন্স, ইম্যাকুলেটনেস, ইনোসেন্স নিয়ে। কিন্তু একবারের জন্যও সে বলতে পারেনা সে চেয়েছিলো অন্যকিছু, অন্যরকম ভাবে। অনেক প্রতীক্ষার, প্রার্থনার ফসল হিসেবে। এভাবে দস্যুর মতো লুণ্ঠন তার স্বপ্নের মোড় আচমকা ঘুরিয়ে দিয়েছে।
সে চিরকালের মুখচোরা।
আইভী রহমান যখন আঁতকে উঠেছেন ঠোঁটের কাটা দেখে, সেই মুখচোরা মেয়ে মা’কে জীবনের প্রথম মিথ্যে কথাটা বলে-“ বলটা ছুটে এসে মুখের ঠিক ওপরে লেগেছিলো মা। দেখতে পাইনি” বলেই মুখ নিচু করে। ভয়ে, লজ্জায়, ধরা পড়ে যাবার আড়ষ্টতায়। মা অবশ্য কিছু ধরতে পারেন না। বরং অষুধ অয়েন্টমেন্ট লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
সেদিন রাতে, গভীর অন্ধকারে, একা বিছানায় শুয়ে তার প্রথমবারের মতো প্রশ্ন জাগে, স্বপ্নের সামিনের সাথে বাস্তবের সমুদার যে বিশাল ফারাক সেটা কি সে পছন্দ করছে? নাকি না?
৬
আবার ফিরে বর্তমানে-
সামিনের একটা ঝটকা লেগেছে। বিষম ঝটকা। কুশির কাছ থেকে আর যাই হোক এই আহ্বান সে আশা করেনি!
“তুই...ঠিক আছিস্ তো কুশ্?” সতর্ক গলা, আকর্ষণের ছিটেফোঁটা নেই তাতে।
ম্লান হাসে কুশি-“সমুদা, তুমি তো কক্ষনো জিজ্ঞেস করতেনা আমি ঠিক আছি কী’না। আজ কেন করছো?” পরিষ্কার টলটলে চোখ, তাকিয়ে আছে সোজা।
“আমাকে যেদিন রাজন চাচা তোমাদের বাড়িতে সেক্সুয়ালি অ্যাবিউস করার চেষ্টা করলো সেদিনও না...হাঃ হাঃ... বরং তুমি খালুর সাথে বাধ্য ছেলের মতো তোমার রেকমেন্ডেশন লেটার আনতে গ্যালে...ওই লোকটা তারপরও দু’দিন তোমাদের বাড়িতেই আমাকে টাচ করেছে, আমি কেঁদে উঠলেই বলতো সবাইকে ডেকে আমার বয়ফ্রেণ্ডের সাথে জড়াজড়ির কথা বলে দেবে- জড়াজড়ি? বয়ফ্রেণ্ড?...তুমি? হাহ্!...”বিকৃত হয়ে যায় কুশির মুখ... “আমি যে কী পরিমাণ ভয় পেতাম তোমাকে সেটা কারুর অজানা ছিলোনা। তারপরেও আমাকে আর তোমাকে জড়িয়ে ওই কথাটা বলতে লোকটার বাধেনি।”
“তুমি ওনাকে কি বলেছিলে তা জানিনা সমুদা, তবে ওনার কথা শুনে বারবার মনে হতো তুমি সব জানো, সব কিছু জেনে বুঝেও তুমি ওই লোকটার হাতে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে...”
সামিনের গায়ে কেউ ছুরি দিয়ে কাটছে...নুন মাখাচ্ছে...আহত গোঙানিতে সে বলে....“কুশ্, আমি কিচ্ছু জানতাম না...কাউকে কিচ্ছু বলিনি... ওই শুয়োরটা...তুই কেন, আমিন খালু, আইভী খালামণি...আমার মা্... কাউকে...”
“কাউকে কি বলবো? চিৎকার আমি করতে পারিনা, সিনক্রিয়েট করা আমার আসেনা, জানোই তো...তাহলে তো ওইদিন রাতটাও অন্যরকম হতো, তাইনা?” কুশির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে মোছার কোন চেষ্টা করেনা, শুধু বলে যায়।
“অর্ণবকে তুমি সহ্য করতে পারোনা, আমার গানের টিচার আমার দিকে তাকালে তোমার মুখ ভার হয়ে যায়, জীবনে যে একবার বা দু’বার তোমার সাথে ফাস্টফুড কোর্টে গেছি সেখানেও ছেলেরা আমার দিকে তাকালে তুমি আমাকে ধম্কে কাপড়চোপড় ঠিক করাতে। কিন্তু কি জানো সমুদা, তোমার চোখের সামনে ওই লোকটা বারেবারে আমাকে কতো অপমান করলো...এত কিছু থেকে বাঁচাতে তৎপর হলে, কিন্তু যখন দরকার পড়লো, ছুট্টে দশহাজার মাইল দূরের দেশে পালিয়ে চলে গেলে...” হাল্কা একটা শ্বাস ফেলে কুশি।
“কুশ্, আমি...তুই জানিস্ না আমি কতোদিন...কতোরাত...শুধু তোর কথা ভেবে...তোকে কত কষ্ট দিয়েছি সেটা ভেবে...” গলায় শ্লেষ্মা জড়িয়েছে সামিনের? নইলে গলা দিয়ে কথাগুলো উঠে আসতে এতো বাধা পায় কেন?
কুশি তাকিয়ে আছে। নিরাবেগ, নিরুত্তাপ।
“সমুদা, আমি তো ছোট ছিলাম। আমি তো তোমাকে পছন্দ করতাম। আমি তো তুমি ছাড়া কখনো কাউকে...” সহসাই চোখ নামিয়ে নেয় সে। নিজের মনের দুর্বলতাটুকু সামিনকে জানাতে তার বড় দ্বিধা।
কিন্তু আজ একটা বোঝাপড়া চাই তার। কিছু স্পষ্ট উত্তর চাই।
ষোল থেকে বিশের বিষময় যাত্রাপথের কথা স্মরণ করে সে বারেবারে শিউরে ওঠে।
সে জানে, আজ হেরে গেলে কোনোদিনই আর মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই তার।
সামনে গহীন তুষারে ছাওয়া প্রান্তর। গাড়ির ভেতর আধো অন্ধকার, উল্টোদিকের সুগন্ধী সুবেশী পুরুষটি তার ক্ষণিকের দেবতা থেকে অনুক্ষণের দানবে পরিণত হয়েছে গত তিন বছরে- আজ তার ভয় থাকলে চলবে কেন?
ফের চোখ তোলে,“তুমি আমাকে বলো একটা কথা...” গলা গম্ভীর তার।
সামিন সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছে।
“আমি বারেবারে নিজেকে বুঝিয়েছি, এত সমস্ত কিছু ঘটার পরেও বুঝিয়েছি, হয়তো আমার “কিছু” ভুল ছিলো...হয়তো তুমি আমার কাছ থেকে কিছু পাবার জন্যই বারেবারে ছুটে আসতে। হয়তো...হয়তো...তুমি আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারোনি... তাই হয়তো তুমিও ভুল করে ফেলেছো।
তুমি...আমাকে স্পষ্ট করে বলবে সমুদা, তুমি কেন...কেন... ওইদিন ওই কাজটা করেছিলে?”
কুশির মুখ কুঁচকে গেছে, ভ্রু আর চোখ তীক্ষ্ণ করে সে তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। সে আজ স্পষ্ট একটা কিছু শুনতে চায়।
“কুশি...আমি...তোকে...কী বলি...আমার ভেতরটা তোকে দেখলে পাগল হয়ে যেতো,সবসময়। সেটা প্রথম তোকে পড়াতে বসে যেদিন স্কেলের বাড়িতে তোর হাত ফাটিয়ে ফেলেছিলাম, সেদিন থেকেই। আমি... ... ... কি করে... ... তিন তিনটে বছর... ... তোর জন্য অপেক্ষা করেছি, তুই জানিস্নি। বা জানলেও, আমার মনে হয়েছে... ... তুই... ... বুঝিসনি। তুই অনেক ছোট, কুশ্। তোর সাথে আমার বয়সের অনেক ডিফারেন্স। আমি যখন একলা থাকতাম, দিনেরাতে অনেক সময় পাগলের মতো তোকে ফোন করতাম, তোকে ইমেইল করতাম। তোর গলা, তোর শরীরের... ... একটু স্পর্শ পাবার জন্য... ... আমি উন্মুখ হয়ে থাকতাম। তোকে আমি কী পরিমাণ মিস্ করতাম সেটা বুঝতে পারতাম, যখন দেশে যেতাম আর অর্ণব নামের ওই ছোট্ট ছেলেটার সাথে তোর নির্দোষ বন্ধুত্বও আমার গায়ে জলবিছুটির জ্বালা ধরিয়ে দিতো। তোর মনে আছে কুশি, একদিন আইভী খালার ডাকেও তোকে আমি জোর করে চেপে ধরে রেখেছিলাম। তুই কাঁদছিলি, তোর বাবার ওষুধের স্ট্রিপ তোর কাঁধের ব্যাগে-সরবিট্রেট বোধ হয়- আমি তোকে আটকে ধরে রাখলাম আর বড়িতে আমিন খালুর জন্য এম্বুলেন্স এলো শেষ অব্দি- আমি ভেবেছি কুশি। স—ব ভেবেছি।
একবার না, দু’বার না- বহুবার।
আজ এতো বছর হয়ে গেলো, আমি ঘুমাতে পারিনা, মাঝরাতে থেকে থেকে জেগে উঠি... ... স-ব ছবির মতো চোখের সামনে ভাসে... ...
কিন্তু কুশ্, বিশ্বাস কর্ আমার কাছে এটার কোনো উত্তর নেই।
আমি, বোধহয় জানোয়ার হয়ে গিয়েছিলাম, ওটুকুই।” পরিশ্রান্ত গলার স্বর সামিনের।
“ন্যাটালি আমাকে ফোন করেছিলো”- নিরুত্তাপ গলায় সামিনের এতোক্ষণের ফিরিস্তি উপেক্ষা করে কুশি বলে।
“মেয়েটা বোধ করি আমার থেকে বেশি ম্যাচিওর্ড, কিন্তু তোমাকে পছন্দও করেছিলো বেশ।“ তীর্যক স্বর সামিনকে বেঁধে কিন্তু সে স্টিয়ারিংয়ে মাথা নিচু করে শোনে শুধু।
“মেয়েটার ফোন পেয়ে আমি রাগ যতোটা না অবাক হয়েছি তার চেয়েও বেশী। ও আমাকে বলেছিলো তাড়াতাড়ি চলে আসতে। এসে তোমাকে সামলাতে। হাহ্!!” বিদ্রূপের হাসি ঠোঁটের ফাঁকে। সরল মুখটা কুটিল হয়ে ওঠে মুহূর্তেই- “কি খাওয়াও বলোতো তোমার প্রেমিকাদের সমুদা? সবাই একেবারে তোমার বুনো আদিম সেক্স অ্যাপিলের ঠেলায় মুগ্ধ?”
কুশির প্রতি তার আকর্ষণ নেই আর, কিন্তু অপরাধবোধটা আছে। পুরোমাত্রায়।
বিঁধছে তাকে। শব্দগুলো। কিন্তু তার জবাব দেবার মুখ নেই।
“ন্যাটালি আসলে- মার্থা, জুলিয়া, শ্যানন আর চার নম্বরটার নাম ভুলে গেছি- প্রতি মাসে কিভাবে ক্যালেন্ডারের পাতা পাল্টানোর মতো তুমি শয্যাসঙ্গী পালটাচ্ছো সেটা ভেবে জেরবার হচ্ছিলো। মজার কথা হ’লো, এই আধুনিক মার্কিন মেয়েটির পান্না খালার সাথে কথা বলে ধারণা হয়েছে তোমার আমার বিয়ে ঠিকঠাক, ইনফ্যাক্ট, আমি তোমার আনঅফিশিয়াল বউ!!”
“আজকে বলতে দ্বিধা নেই সমুদা, আমাকে রেইপ করার পর...... ... ...” দীর্ঘ একটা শ্বাস নেয় সে, আবার জ্বলন্ত স্মৃতি দগদগে ঘা নিয়ে হাজির হয় সামনে।
“আমি নিজেকে যখন পোকামাকড় বা কুৎসিত প্রাণীর চেয়েও নোংরা কিছু ভাবছি, ভাবছি “আমার” ভুলেই সবকিছু হয়েছে, মানে তুমি নও “আমি” ই তোমাকে লিড করেছি “খারাপ” হ’তে- এরকম সময়ে বহুরাত আমিও নিজেকে তোমার “বউ” ভেবে ওই কুৎসিত, জোর জবরদস্তি শরীর চটকানো- অজ্ঞান করে মুখ চেপে ধরাটাকে জায়েজ করতে চেয়েছি। আমাকে অসহ্য ব্যথা দিয়ে মেরে ফেলার মতো যন্ত্রণাটা যখনি মাথায় এসেছে- নিজেকে এই বলে বুঝিয়েছি, নিশ্চয়ই “আমারো” কোন দোষ ছিলো। আর তুমি আমাকে বউ ভেবেই করেছো। কিন্তু শামীম আন্টি প্রথম আমার চোখ খুলে দেন এই বলে যে বউয়ের সাথেও এটা করা কোনোভাবেই হালাল পর্যায়ে পড়েনা।
আ রেইপ ইজ আ রেইপ ইজ আ রেইপ!!!!” কুশি হাঁপাচ্ছে। অনেকদিন পর, তার গলা অস্বাভাবিক উঁচু, কথাগুলো চাবুকের মতো বাড়ি মারছে সামিনকে।
আহত একটা পশুর মতো সে গুঙিয়ে ওঠে। বোবা চোখ চেয়ে আছে কুশির দিকে। সে চোখে কোনো ভাষা নেই, বাঙ্ময়তা হারিয়ে গ্যাছে।
“শামীম আন্টি কে কুশি? কতোটুকু জানে সে তোকে? আমাকে? কী জানে সে তোর আমার সম্পর্কের?” আহত পশুর ঘড়ঘড়ে গলা সামিনের।
“সমুদা, স্টপ ইট। জাস্ট স্টপ অ্যান্ড লিসেন।“ হিসহিসে গলার স্বর কুশির। সেই হিসহিসানি, যা দিয়ে সামিন ভয় দেখাতো তাকে। সামিন চম্কে উঠেছে।
“শামীম আন্টি কে এটার থেকে অনেক বেশী জরুরী তুমি আমাকে ভুল কী শিখিয়েছিলে। সেটার জন্য আমার গত তিনটে বছর, ইনফ্যাক্ট আমার সারা জীবনটা ক-তোখানি...। ক------তো-----খা---নি পালটে গেছে!
তুমি আমাকে শিখিয়েছিলে তুমি আমাকে ভালোবাসতে।
মিথ্যা কথা।
তুমি শিখিয়েছিলে আমি তোমার জীবনে একমাত্র নারী।
মিথ্যে কথা।
তুমি শিখিয়েছিলে ভালোবাসার মানুষকে যখন তখন যেরকমভাবে তার ইচ্ছে অনিচ্ছের তোয়াক্কা না করে চাওয়া যায়, তাকে হাসিলও করে নেয়া যায়।
মিথ্যে কথা।
এতোগুলো ডাহা মিথ্যে কথা বলেও তুমি আমাকে বোঝাতে চাইছো তুমি “আসলেই” আমাকে ভালবাসতে? পছন্দ করতে?? রিয়েলি???
চোখ জ্বলছে কুশির। গনগনে রাগের আঁচে সে বলতে থাকে, “আজ কেন তোমাকে আদর করতে বললাম জানো সমুদা? আমি দেখতে চাইছিলাম সত্যি সত্যি তুমি কাউকে আদর করতে পারো কিনা। ছিঁড়ে খুঁড়ে লণ্ডভণ্ড করে দোমড়ানো মোচড়ানো একটা মানুষকে তোমার আদর করার সামর্থ্য আছে কিনা। ভালোবাসা, শুধু শরীরে নয়, মনেও। শারীরিক সংসর্গ তো শুধু শরীরেরই নয়, মনেরও, তাই না সমুদা? তাহলে শরীর দিয়ে যে ঋণ কামিয়েছিলে ভালোবাসা দিয়ে আজ সেটা শোধ করতে পারো??”
সামিনের মুখে তেতো উঠে আসে, বমিবমি ভাব হয়। দুঃসহ নিষ্ক্রিয়তায় সে জানলা নামিয়ে মুখ বিকৃত করে বাইরে ঠাণ্ডা হাওয়ায় শ্বাস নেবার চেষ্টা করে।
বাইরের অন্ধকার ঘোলাটে হয়ে উঠছে, তুষার ঝড়ের পূর্বাভাস ছিলো আজ- হঠাৎ মনে পড়ে। সেই ঠাণ্ডা হিম, চোখের ঘোলাটে দৃষ্টিতে ও পরিবাহিত হয়- সে তাকায়।
প্রথমবারের মতো, অপরিচিত একটা মুখ। লালচে আভা, স্ফীত নাসারন্ধ্র, হাঁপাচ্ছে। ঘেন্না আর বিতৃষ্ণা ওই টলটলে চোখজোড়ায়। চেনে না। এই নারী তার অচেনা!
তার দম আটকে আসে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। প্রথমবারের মতো কুশির সামনে তার গলা আটকে যায়, পেটের মধ্যে বমি পাক খেতে থাকে। ভালো লাগছে না। অসহনীয় এই কথাগুলো, এই মেয়েটা তার সামনে থেকে দূরে চলে যাক্, পারছে না সে এর মুখোমুখি হতে। শরীরের ঋণ চুকেবুকে গেছে, জীবনের ঋণ শোধবার দায় বড় দায়। কাটা কইমাছের মত ছটফট করে সে সত্যের সামনে, নিষ্পাপতার সামনে।
বুঁজে আসা স্বরে কোনোমতে সে বলে “কুশ্, ব্লিজার্ড আসছে- বাড়ি যাই চল্।”
ঠিক সেই সময়ে তীব্র ঘূর্ণিপাকের বৃত্ত দেখা দেয় সুদূর দক্ষিণে। কেবলি এগিয়ে আসে ঠাণ্ডা হাওয়া, সূঁচ বেঁধানো যন্ত্রণায় স্পর্শ করে তাকে। চমকে উঠে গাড়ির জানালা বন্ধ করে- উইন্ডস্ক্রিনে তুষার স্তরে স্তরে জমা হচ্ছে।
হাত বাড়িয়ে কুশির হাত স্পর্শ করে, কিন্তু তপ্ত লৌহশলাকা স্পৃষ্ট হবার মতো আচম্বিতে হাত সরিয়ে নেয় সামিন। কুশির হাত অস্বাভাবিক গরম। তার চোখ অস্বাভাবিক তীব্র, এই কামড় দেয়া ঠাণ্ডাতেও অস্বাভাবিক হল্কা তার সারা শরীর জুড়ে।
এতো তাপ, এতো আগুন!
এতো ঘৃণা!
এতো বিবমিষা!
ঝোড়ো হাওয়া শাঁইশাঁই শব্দে ধেয়ে আসে। চারিদিক গাঢ় আঁধারে ঢেকে যায়। বাতাসের তীব্রতা গাড়িটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে বুঝি! ভীষণ ভারী তুষারের চাঁই আকাশ ভেঙে নেমে আসছে- চারিদিকে প্রলয়শঙ্খ বাজার ডাক। স্খলিত, ক্লিষ্ট পুরুষ ক্লেদের আগুনে পোড়ে, ছাই হয়- কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেনা তার জীবনের দু:সহতার গল্প।
বলতে পারেনা ওই একটি রাত তার জীবনকেও পালটে দিয়েছে।
সময় লেগেছে, অনেক বেশি সময়, কিন্তু জীবন তার ওপরও প্রতিশোধ নিয়েছে।
যেই পুরুষত্বের সক্ষমতায় একসময় আনন্দের শিহরণ জাগতো শিরদাঁড়াতে, নিজেকে মনে হতো পৃথিবীর সবচাইতে ক্ষমতাবান, সেটি আকস্মিক বিদায় নিয়েছে তার জীবনকে শূন্য করে।
নপুংসক হাত ধর্ষিত আঙুলের কাছাকাছি পৌঁছুতে চায়,এই প্রথম বুঝি অক্ষম পুরুষের গোঙানি গলা মেলায় ধর্ষিতার কাতরোক্তির সাথে।
কিন্তু তুষার ঝড় তাকে ছিন্নভিন্ন করে।
মুহুর্মুহু, নিরন্তর।
মন্তব্য করুন