স্মরণের প্রান্তরে আহমদ ছফা!
আজ আহমদ ছফার জন্মদিন। বড় করে সুন্দর করে একটা লেখার দরকার। শরীরও ভালো লাগছে না, তাই জোশ পাচ্ছি না। যদিও কাল থেকে ভালো মন্দ খাচ্ছি। ছফা নিয়ে আমার কম লেখা নাই। ব্লগে ফেসবুকে বিভিন্ন দৈনিকে। নতুন করে আর কোন কথাটা বলার আছে। বান্ধবীকে ছফার একটা উপন্যাস পড়তে বলেছিলাম, সে পড়ে আনন্দিত। এত বিজি জীবনে যে পড়েছে বাংলা তাই অনেক। এটা আমি সব সময় দেখেছি। কাউকে ছফা পড়তে দিলে যদি পড়ে হতাশ হয় না। এটাই হয়তো আহমদ ছফার চার্ম। ছফা যে মানুষের মুখে মুখে সত্য অসত্য গল্পে কাল্ট হয়েছে এসবই হয়তো ছফাকে প্রাসঙ্গিক রাখবে। আপনি বাংলাদেশের যেকোনো পাবলিক ভার্সিটির দিকে তাকান, খবরগুলো দেখান, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের কাজ কারবার, ভিসি ও প্রভাবশালী শিক্ষকদের দৌরাত্ম এসব নিয়ে ভাবলেই তো বারবার প্রাসঙ্গিক হয়, গাভী বৃত্তান্ত। এটা এখন এত বেশী সেলিব্রেটেড উপন্যাস, মাঝেমধ্যে মনে হয় এ উপন্যাসকে ফলো করাই ভিসিদের ডিউটি। তারা খালি গাভীর জায়গায় মানুষ পালে। সেদিন দেখলাম একটা গ্রুপের নাম, পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরান। যদিও বিহঙ্গ ও পুরাণ বানান ভুল করেছে। আমার ছফার উপন্যাস গুলোর ভেতরে পছন্দসই নাম হলো, মরণ বিলাস। মনে হয় এই নামেই তো সবাই জীবন পার করছি। একটা উদযাপন করার মতো মৃত্যু যেন আসে সেইজন্যই এত কাজ করার প্রচেষ্টা সবার।
মাঝখানে আমি অনেক ইউটিউব দেখলাম। বিশেষ করে যারা জ্ঞানের বাতেলা ঝাঁরে। এনায়েত চৌধুরীর এক ভিডিও আছে, কেন জামিলুর রেজা চৌধুরীকে চেনা জানা দরকার। আমি ভাবলাম আমি ইউটিউবার হলে কি কখনো বানাতাম? কেন আহমদ ছফাকে পড়া দরকার। কারন ইউটিউবে এসব পোস্ট আপনাকে ভাসা ভাসা কিছু জ্ঞান দিবে। কারো লেখা পড়তে ও বুঝতে দরকার আপনার সময় ও মনোযোগ। যেটা এখন দুর্লভ। তাই আহমদ ছফা সবাই সমানে পড়বে এই স্বপ্ন আমি দেখি না। তবুও অনেক লোক আহমদ ছফা পড়ে। যতদিন যাচ্ছে পাঠক বাড়ছে। হাওলাদার, খান, সন্দেশ, স্টূডেন্ট ওয়েজ সব প্রকাশনীতেই তাঁর বই বলার মতো কেনা বেচা হয়। এইটার আরেক কারণ কাল্ট ফলোয়িং। সলিমুল্লাহ খানের টকশো প্রতিভায় আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই পড়তে চায়। সলিমুল্লাহ খান প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ছফাকে আনেন। অনেক অল্প শিক্ষিত সাংবাদিকেরাও, সাহিত্যিক বলতে শুধু ছফাকেই চেনেন। আবার একটা লোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল যিনি সন্তানের নাম রেখেছেন আহমদ ছফা। আমি তাকে চামে দিয়ে বলেছিলাম, আরেকজন হলে নাম রাইখেন, আহমদ ছবি। নুরুল আনোয়ারের বাবা। যিনি বিশ্বাস করতেন, 'ছফা একদিন দেশসেরা মনীষী হবে।' অল্পবয়সেই মারা যান।
ছফা আমেরিকাতেও গিয়েছিলেন নব্বই দশকে। বাঙ্গালীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে টিকেট ও ভিসা খরচ পাঠিয়ে অনেককেই নিয়ে যেত। মার্কিন মুল্লুক তার ভালোই লেগেছিল। ভালো লাগেনি সফর সঙ্গী বুদ্ধিজীবিদের। গাফফার চৌধুরী, মুনতাসীর মামুনরা তাঁকে খুব একটা লাইক করতো না। দেখা গেল তারা চলে গেছে ভেন্যু শহরে, ছফা এখনো পৌঁছান নাই। আবার ছফা সেই শহরেই আছেন, তারা দলবেঁধে অন্য কোথাও চলে গেছে। এতে সুবিধা হয়েছে ছফা বিভিন্ন প্রবাসীর বাসায় ছিলেন। কত বড় মনের মানুষ বলেই তিনি যাদের বাসায় ছিলেন তারা অনেক জিনিস ছফাকে দিয়ে পাঠিয়েছেন, ছফা সুন্দর মতো তা ঢাকা চিটাগাং নানা জায়গায় ঠিকঠাক মতো পৌঁছে দিয়েছেন। তার সাথে ছিল দুর্বোধ্য হাতের লেখার চিঠি, জবাব দিলে আবার চিঠি লিখতেন, খোঁজ নিতেন। আবার দেশে এসে সেইসব প্রবাসীদের টেলিফোন করতেন। এরকম এক ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন, তার বাবা চিঠিগুলো খুব যত্নে রেখেছেন। যেদিন ছফা মারা যায়, তিনি নাকি হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন, সেই প্রবাসী ভদ্রলোক খুবই অবাক হয়েছিলেন, তার দাদার মৃত্যুর সময় ছাড়া তার বাবাকে এরকম ফোন করে কাঁদতে দেখেন নি।
আহমদ ছফা একানব্বইতে ফ্রেন্ডের বাসায় ছিলেন জার্মানিতে। দীর্ঘ বিমান ভ্রমন ও ঠান্ডায় গিয়েই অসুস্থ তখন। দিকে দিকে রটে গেল ছফা এক হিন্দু মহিলাকে মোসলমান করে নিকাহ করেছেন। লোকজন এত উৎসুক যে, ঢাকা থেকে গাটের পয়সা খরচ করে আইএসডি কল করে, প্রবাসীরা কেউ কেউ দূরের শহর থেকে দেখতে আসে। দেখে শ্বাসকষ্টে ছফা দিশেহারা, ছফার সেই বান্ধবী আর তার বয়স্ক মা ছফাকে নিয়ে চিন্তিত। মোরাল অফ দ্যা স্টোরী অন্যের জীবন নিয়া বাঙ্গালীর তুমুল আগ্রহ চিরকালীন। জার্মানির সেই দিনগুলো নিয়ে ছফার একটা বই আছে, জার্মান প্রসপেক্টিভ। বার্লিন দেয়াল ভাঙ্গা শেষ, জার্মানীর সেই অস্থির সময় নিয়ে এক বাঙ্গালী লেখকের চোখে দেখা সেখানের অনুভব, আর কোথাও পাবেন না।
এবার আহসান হাবীবের ভাষ্যে শুনি, "বিখ্যাত লেখক আহমদ ছফা ছিলেন বড় ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। মাঝেমধ্যে থাকতেনও। একদিন তিনি আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে একটা ঘড়ি দিলেন। সবুজ ডায়ালের ঘড়ি। আমি অবাক! তিনি বললেন, ‘নে, তোর জন্য একটা ঘড়ি!’ আমার জীবনে পাওয়া প্রথম ঘড়ি। ওই ঘড়ি হাতে পরে যেন হঠাত্ বড় হয়ে গেলাম। (তখন স্কুলে এইট কি নাইনে পড়ি)। কিন্তু কী আশ্চর্য! কদিন পর ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেল। এরপর যখন ছফা ভাই আবার এলেন, আমি তাঁকে জানালাম, ঘড়ি বন্ধ। তিনি আবার আমাকে আড়ালে নিয়ে ৫০ টাকা দিলেন। বললেন দোকানে নিয়ে ঠিক করে ফেলতে। ৫০ টাকা পেয়ে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। তখন ৫০ টাকা অনেক! কে ঘড়ি ঠিক করে, ওই টাকায় নাজ সিনেমা হলে (তখন গুলিস্তান হলের পাশে ‘নাজ’ নামে খুব সুন্দর ছোট্ট একটা সিনেমা হল ছিল) গিয়ে ওয়েস্টার্ন সিনেমা দেখি বন্ধুদের সঙ্গে, এটা-সেটা খাই কিন্তু ঘড়ি আর ঠিক করি না। ঘড়ি তো হাতেই আছে, সমস্যা কী? ঘড়ি নষ্ট না ঠিক, কে দেখতে যাচ্ছে। ছফা ভাই একদিন ধরলেন, ‘কিরে, ঘড়ি ঠিক করেছিস?’ আমি মাথা ঝাঁকাই। দেখাই তাকে। ওই সবুজ ডায়ালের ঘড়িটার সেকেন্ডের কাঁটা ছিল না বলে বোঝার উপায় নেই ঘড়ি বন্ধ, না সচল। তবে তখনই জেনেছিলাম, একটা নষ্ট ঘড়িও দিনে দুবার অন্তত সঠিক সময় দেয় (পরে অবশ্য ঘড়িটা ঠিক করেছিলাম)।"
এসব নিয়েই আহমদ ছফা। তিনি অল্পতে রেগে যান, আবার পরের দিন ভুলে যান। অন্যের সমালোচনা করেন, নিজের সমালোচনা কেউ করলে ক্ষিপ্ত হন। আবার পরে সব ঠিক। তিনি যাদের খুব বেশী পছন্দ করতেন না যেমন ধরুন আবদুল মান্নান সৈয়দ, তাদের ব্যাপারেও প্রচ্ছন্ন সমর্থন রাখতেন। বাংলাদেশে প্রথম যে লেখক শিবির থেকে দেয়া পুরষ্কার তা ছিল তার স্বাক্ষরিত, মান্নান সৈয়দ ও হুমায়ুন আহমেদকে দেয়া। আবদুল হককে তিনি বুদ্ধি দিতেন জাপানের লোকজনের সাথে ব্যবসা করতে। নিজে আবার বসে বসে লিখতেন সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস। প্রেম পরাজয়, অভাবে টালমাটাল সময় তিনি করছেন ফাউস্ট এর অনুবাদ। শরীফের ক্যান্টিনে চা সিঙ্গারা খেয়ে অন্যের জন্য ব্যবস্থা করছেন ৫০০ টাকা। উনার বইয়ের উৎসর্গ গুলোও কি চমৎকার, কখনো আল মাহমুদ কখনো হাসান হাফিজুর রহমান কখনোবা বন্ধুর অকাল প্রয়াত শিক্ষক বাবা, যিনি আবার ছফাকে দেখতে পারতো না। আহমদ ছফার জন্য আমার মনে পড়ে, দ্যা স্মিথসের একটা গান, দিস চার্মিং ম্যান। যিনি বেচে থাকলে এরকম বিপন্ন সময়ে দেশকে সাহায্য করার জন্য পাগলের মতো হয়ে যেতেন। তাঁর একটাই ভিডিও ইউটিউবে পাওয়া যায়, বন্যার্ত শিশুদের জন্য স্কুল চালাচ্ছেন, হোসেন জিল্লুরকে সাথে নিয়ে।
মন্তব্য করুন