ইউজার লগইন

জেলবন্দী মানুষ কিংবা দেয়ালবন্দী আমি

১))
প্রায় চৌদ্দ বছর পর জেল থেকে মুক্তি পেয়ে হাঁফ ছেড়ে নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে খেয়াল করলাম, উজ্জ্বল আলোতে চোখ জ্বালা করছে। হাঁফ ছাড়ার কথা ভুলে গিয়ে, আমি চোখের দুর্দশা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। অথচ প্রথমেই আমার ছেলের কথা মনে হওয়া উচিত ছিল কিংবা আমার বৃদ্ধ মা কিভাবে সংসারের ঘানি টানছে সেই বিষয়ে উদগ্রীব হয়ে বাসায় ছুটে যাওয়া উচিত ছিল। ছেলের কথা মনে হলো, অনেক পড়ে। এর মাঝে মুক্ত বাতাসে,মুক্ত মানুষ হয়ে চা খেলাম আয়েশ করে।
তখন খেয়াল হলো- আমার জন্য জেলগেটের বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। দাঁড়ানোর কথা ছিল না,আমি প্রত্যাশাও করি নি। মা ছাড়া গত চৌদ্দ বছরে কেউ যোগাযোগ করে নি খুব একটা। তাই ফুলের মালা নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে এটা ভাবার মতো বোকা আমি না। তবু হয়ত অবচেতন মন কিছু একটা চাইছিল।
পুরোন ঢাকার ঘিঞ্জি রাস্তাগুলো যে আরো ঘিঞ্জি হয়েছে সেটা বুঝতে না বুঝতেই পেছন থেকে শুনতে পেলাম-
আব্বা, বাসায় চলেন। অনেক রোদ উঠছে আজকে।
চমকে উঠি। তাকিয়ে দেখি আমার থেকেও লম্বা এক ছেলে। ঘন কালো চুল, শ্যামলা মায়া মায়া চেহারা, সাদা কালারের শার্ট পড়নে। এই ছেলে আমাকে আব্বা ডাকছে কেন? বিভ্রান্তজনিত জটিলতায় কয়েক মুহূর্ত পার হয়ে যায়, এরপর চোখের আদ্রতার কারণে আর কিছু দেখতে পারি না। অথচ দেখা দরকার ছিল, বুকে নিয়ে জাপটে ধরা দরকার ছিল,চোখে পানি আসা দরকার ছিল। এমন কিছুই হলো না।
ছেলেটিকে বললাম- অনেক রোদ। চোখ কচকচ করতেসে। পানি দেয়া দরকার।

...........................
আজকে হোস্টেলে ফিস্ট। বিকেল থেকে না খেয়ে অপেক্ষা করছি। এই মুহূর্তে গল্পের নায়কের চোখ সংক্রান্ত জটিলতার সমাধান করতে ইচ্ছে করছে না। পেটে খিদার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। আবার মাথার ভেতর গল্পের ঘটনা প্রবাহ আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। ছেলে যদি আসবেই এতদিন এলো না কেন দেখতে? আর আমার গল্পের নায়ক তো আরো আজব চিড়িয়া। দুনিয়া সম্পর্কে উদাসীন মনে হচ্ছে। এমন উদাসীন লোকের জীবন সুখের হয় না। জেলে যাওয়ার ব্যাপারটাও স্পষ্ট ধরতে পারছি না।
রুমুকে ফোন দিলাম। রুমু- আমার সকল গল্পের প্রথম পাঠক। তাকে বিষয়টা খুলে বললাম। সে খুব সহজ গলায় বলল, মাত্র তো শুরু করলে, দেখো কী হয়!
আমিও ভাবলাম দেখি কী হয়! আচ্ছা, আমি কী মুক্ত হয়ে শ্বাস নিতে পারি? জেল ফেরত আসামী নাই পারতে পারে, আমি কী পারি?
রিশাদ তুই কই? আর কত ল্যাপটপ গুতাবি?
আমার রুমমেট ডাকছে। হতচ্ছাড়া বেরসিক পাবলিক,মুডটাই নষ্ট করে দিল।

.................................

২))
বাসায় আসার পথে রকিবের সাথে টুকটাক কথা হয়েছে। সামনের বার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিবে। রকিব আমার ছেলের নাম, যে আমাকে গত চৌদ্দ বছর দেখতে আসেনি। কতদিন আমি অপেক্ষায় থেকেছি তার হিসেব রাখি নি। আমি বরাবর-ই হিসেবি ছিলাম। আজ আমি অপেক্ষায় ছিলাম না। মনে মনে একা একা বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। কে জানে, হয়ত বাড়ি ফিরতাম না। এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতাম, কতটা বদলে গেছে রাস্তাঘাট মেপে নিতাম নতুন করে আলো দেখা চৌদ্দ বছরের চোখের আলোয়।
এখন বাড়ি ফিরে এতটুকু বুঝতে পারি, বাড়ির মানুষ বদলে গেছে। তাদের চেহারা বদলে গেছে, তাদের হাসি বদলে গেছে। ঘরের ডেকোরেশন রক্ষা পায় নি, বদলে যাওয়া থেকে।
রকিবের যখন চার বয়স, তখন আমাকে জেলে যেতে হলো। এখন ভাবি, কী দরকার ছিল! এখন মনে হয় দরকার ছিল অবশ্যই। রকিবের মা’র মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছি, ভুল কী করেছি?
মানলাম, রকিবের মা আত্মহত্যা করেছিল তাই বলে হুজুর জানাজা পড়বে না? বরাবর-ই কত ধার্মিক ছিল আমার বউ। ছিল অভিমানী। অফিসের বস যখন তাকে রাতের বেলা ডেকে পাঠালো, সরল বিশ্বাসে সে সব কিছু হারিয়ে ফিরে এল, সে কিছু করবে না? নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাড়ির বউ কি-ইবা করতে পারত?
ইচ্ছেমতো কুপিয়েছি বস হারামজাদাকে। ব্যাপারটার ভেতর বিশাল স্যাটিকফেকসন কাজ করেছিল।

আজ ফিরে এসে দেখি সব দূরে সরে গেছে। আমার মা’র বয়স বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। কেমন যেন নিস্পৃহ হয়ে গেছে। আমাকে দেখে বাড়তি কোনো উচ্ছ্বাস নেই, যেন ই বাড়িতে আমি সবসময় থাকি, আমার এই হঠাৎ আসায় কারো মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ভাই এর সাথে দেখা হয় নি এখনো। শুনেছি, খুনীর ভাই বলে তার নাকি বিয়ে হয় নি। সে জন্য-ই কী আমার সামনে আসছে না।
মা’কে ডাক দিয়ে কথা বলতে গিয়েও পারলাম না। রকিব বাসায় আসার পর কোথায় জানি চলে গেছে। আমার মাত্র চৌদ্দ বছরের অনুপস্থিতি আমাকে যেন মুছে ফেলেছে। আর যদি মরে যেতাম! শিরদাঁড়া বেয়ে এক অদ্ভূত শীতল অনুভূতি বয়ে গেল। স্পষ্ট বুঝতে পারি বিশাল এক পাহাড় দাঁড়িয়ে গেছে, আমার আর পরিবারের মাঝে। অনেকগুলো পাথরের স্তুপ পড়ে আছে। জেল থেকে ফিরে আবার কী জেলেই চলে এলাম?
উত্তর পেয়ে যাই, জেল থেকে জেলে এসেছি। তখন আশা ছিল, এখন কিছুই নেই। একা একা ঘরের কোণে পরম মমতা দিয়ে দেয়ালের পর দেয়াল তুলতে থাকি। নিজেও ঢুকতে থাকি ভেতর থেকে ভেতরে। সামনে পুরোনো ছাল ওঠা পাথর দেখে থমকে যেতে হয়? কেউ কী তবে এসেছিল এখানে আগে? আমার মতো অদৃশ্য কেউ? কেউ কী আটকা পড়ে আছে, এখানে?
ভাই কেউ আছেন? আছেন নাকি কেউ? থাকলে আওয়াজ দেন।ক্রিকেট খেলি। আপনি ব্যাট কইরেন।ক্লান্ত লাগতেসে ভাই,কেউ আসেন না কেন?
একটা একটা করে পাথর সরিয়ে দেখি পাহাড় জমে আছে, বরফের মতো সাদা পাহাড় । ঠান্ডা,হাত দেয়া যায় না,পায়ে হাঁটা যায় না। আমার পর্যাপ্ত পরিমাণ শীতের কাপড় নেই। আমি একটি ভাঙা পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি স্থির। আমি ঘুর পথে পাহাড়ের পথ অতিক্রম করতে গিয়ে দেখি একটা কুকুর মরে পড়ে আছে, তার একটু দূরে কালো রঙ এর বেড়ালের গা জড়াজড়ি করে পড়ে আছে একটি ইঁদুর। সেখানে কোনো মানুষের লাশ থাকতে পারে এই ভেবে চারপাশটা চক্কর দিয়ে ফেলি। সেই এক-ই একঘেয়ে পরিবেশ, যেন গোলকধাধা- শুরু আছে শেষ নেই। অথবা শেষ আছে কিন্তু আপাতত এক-ই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছি, যা আমি সারাজীবন ধরে করেই আসছি।

...........................................................................।
রুমু মন ভালো নেই।
কেন?
দেয়ালের ভেতর হারিয়ে গেছি।
রুমু ভাবল, আমার পাগলামি।
রুমু, নায়ক খুব একলা হয়ে আছে। আমাকে যেতে হবে।
রুমু বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দেয়।
রেখেই তো দিবে,তাকে তো রেখে দিতেই হবে। আমি একা, সেও একা। আমার দেয়াল আলাদা, তার দেয়ালো আলাদা। বাকিসব ভোগলামি। এসবের ভেতর আমি নাই।

আমি নায়কের খোঁজে দেয়ালের ভেতর ঢুকতে থাকি।

পোস্টটি ১০ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

রায়েহাত শুভ's picture


হুমমম...

আরিশ ময়ূখ রিশাদ's picture


হুম, মানুষ বৃত্ততেও বন্দী হতে পারে

শর্মি's picture


নোটস ফ্রম আনডারগ্রাউন্ড...
চালায়ে যান।

আরিশ ময়ূখ রিশাদ's picture


গল্পের তো চাকা নেই। পাঠে কৃতজ্ঞতা

তানবীরা's picture


আপনার লেখার স্টাইলটা দারুন।

সুন্দর গল্প, অতি সুন্দর।

আরিশ ময়ূখ রিশাদ's picture


আপনি মন্তব্যে উদার। নিয়মিত পাঠে কৃতজ্ঞতা

লীনা দিলরুবা's picture


রেখেই তো দিবে,তাকে তো রেখে দিতেই হবে। আমি একা, সেও একা। আমার দেয়াল আলাদা, তার দেয়ালো আলাদা। বাকিসব ভোগলামি। এসবের ভেতর আমি নাই।

গল্প লেখক, গল্পের গল্প লেখক এবং গল্পের নায়ক একই ভাবনার লালন করছেন দেখে সেই পুরনো কথাটাই মনে পড়ে যায়, আসলে মানুষ মূলত একা। ফর্মেট টা অন্যরকম। গল্প লেখা চলুক।

ভোগলামির মানে কি! কোন চলতি শব্দ সম্ভবত।

আরিশ ময়ূখ রিশাদ's picture


আমরা বন্ধুরা নিজেদের ভেতর ধোঁকাবাজি বোঝাতে শব্দটা ব্যবহার করি!

অনেক ধন্যবাদ, আপু। গল্প ছাড়া কিছু লিখতে পারি না। তাই আপনাদের মতো সুন্দর পোস্ট দেয়া হয় না। অবশ্য গত দু'দিনে আপনার দু'টো গল্প পড়েছি

নাজ's picture


আমার মাত্র চৌদ্দ বছরের অনুপস্থিতি আমাকে যেন মুছে ফেলেছে। আর যদি মরে যেতাম!

জানিনা কেন, তবে আজ-কাল এই মৃত্যু সম্পর্কিত যে কোন কথাতে আমার চোখ আটকে যায় Sad

লেখাটা বেশ ভালো লাগলো। চলুক Smile

১০

আরিশ ময়ূখ রিশাদ's picture


্লেখাটার ফরম্যাটে একটু ভিন্নতা আনতে চেয়েছিলাম। পাঠে কৃতজ্ঞতা

১১

জ্যোতি's picture


গল্পটা ভালো লাগলো। গল্প বলার স্টাইলটাও। গল্প শেষ করে কেমন একা লাগছে, অদ্ভুত এক শূণ্যতা।

১২

আরিশ ময়ূখ রিশাদ's picture


আমরা তো শূন্যতার ভেতরেই থাকি

১৩

মীর's picture


চমৎকার লিখেছেন। Smile

১৪

আরিশ ময়ূখ রিশাদ's picture


পাঠে কৃতজ্ঞতা।

১৫

জেবীন's picture


গল্প বলার স্টাইলটা ভালো লাগছে... 
চলুক গল্পটা...

১৬

আরিশ ময়ূখ রিশাদ's picture


এই গল্প চলবে কী করে? এই গল্প তো শেষ।।পাঠে কৃতজ্ঞতা আপু

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

আরিশ ময়ূখ রিশাদ's picture

নিজের সম্পর্কে

বলার মতো কিছু নেই।বলার মতো কিছু তৈরী করতে চাই