ফেরার গল্প (দুইখন্ড একত্রে)
_________( পাঠকের সুবিধার্থে দুই খন্ডকে একসাথে করে দিলাম)___________
এখানে একটা সত্যিকারের পুকুর ছিলো। আর কেউ না মনে রাখলেও আমি সেটা মনে রেখেছি। সেই পুকুর পাড়ে কত শত উদাসী দুপুর যে কাটিয়েছি ভাবলেই এই খড়খড়ে রোদের দুপুরটাও বেশ মায়াময় হয়ে ওঠে। আমি অনেকদিন পরে এই রাস্তায় ফিরছি। ঐ যে ওখানে একটা বিষণ্ণ আতাগাছ দেখছেন, ওটার পাশের গলিটা দিয়ে পঞ্চাশ গজ মত গেলেই আমার বাড়ী। কিংবা বলতে পারেন আমার বাড়ী ছিলো। এখন কেউ আছে কি না, সেটা জানা নেই।
একবিন্দুও বাড়িয়ে বলছিনা, আমি আসলেই ফিরে এসেছি। যদিও চেনা রাস্তাটা আর আগের মতো চেনা নেই। কালাম মামার চা সিগারেটের দোকানটা যেখানে ছিলো, সেখানে একটা কিম্ভুত আকৃতির হাইরাইজ দেখছি। কে জানে, কালাম মামাই এটার মালিক কি না।
এই যে লাল ইটের নোনাধরা বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, এখানে থাকতো রচনা'রা। তবে এই বাড়িটা এরকম ভাঙ্গাচোরা ছিলোনা তখন। এই পাড়ার সবচে' আধুনিক বাড়িটার এমন হতশ্রী দশা দেখে বুক হু হু করে উঠছে। একসময় রচনার সাথে একটু কথা বলতে পারলে তাদের বাসার লনে খানিকক্ষণ খেলাধুলা করতে পারলে পাড়ার কিশোরদের কাছে নিজেকে অনেক বড় লাগতো। কামরুল কিংবা নওশাদের সাথে যদি রচনা বেশী সময় কথা বলতো, তাহলে কিশোর বুকে চিনচিনে ব্যাথা হ'তো। সেই দিনগুলোও কতদুরে ফেলে এসেছি...
একদিন রচনার বিয়েও হয়ে গিয়েছিলো তার বাবার মতই এক ব্যবসায়ীর সাথে। তরুন আমি, কামরুল, নওশাদের জন্য সেদিনটা ছিলো অনেক কষ্টের। গাড়ি চেপে বরের বাড়িতে রচনা চলে যাবার পর আমরা তিন বন্ধু মিলে সারারাত একসাথে হেঁটেছিলাম। কেউ কোনো কথা বলিনি, শুধু একের পর এক সিগারেট পুড়েছিলো আমাদের হাতে।
কামরুলরা এই পাড়া ছেড়েছিলো তার কিছুদিন পরেই। আর কোনো খোঁজ পাইনি ওদের। নওশাদ এখানেই ছিলো। ঐ যে বাঁ পাশে টিনের চাল ওয়ালা ঘরগুলো উঠেছে, ওটা ছিলো নওশাদদের উঠোন। একটা বিশাল আমগাছ ছিলো উঠানে। নওশাদের মা এই আমগাছের আম দিয়েই প্রতি বছর আমসত্ত্ব বানাতেন। আমরা ছিলাম তার রাক্ষস কুল।
সময় অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলো, সাথে নওশাদটাও অনেক যাযাবর হয়ে গিয়েছিলো। আমি চাকরী পাবার অল্প কিছুদিন আগে নওশাদ একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করলো। কোন মেয়ে নাকি ওকে প্রত্যাখান করেছে তাই। সেই যাত্রা বেঁচে ওঠার পর, নওশাদের মা ওকে ধরে বিয়ে করিয়ে দিলো। কেয়া ভাবী দারুণ একজন মানুষ ছিলেন। নওশাদকে একটানে যাযাবর থেকে গৃহস্থ বানিয়ে ফেলেছিলেন। সব পাগলামি ঝেড়ে ফেলে নওশাদ নিজের ব্যবসা শুরু করলো, আর বছর না ঘুরতেই মিষ্টি একটা ছেলের বাবাও হয়ে গেলো।
আহ! আমার ফিরে আসার গল্প বলতে গিয়ে দেখি বিশাল কাহিনী ফেঁদে বসলাম। যাক্, আমিও মোটামুটি দু'-তিন বছর চাকরী করে মা-বাবার চাপে পড়ে লোপাকে বিয়ে করে ফেলি। নিজের স্ত্রী বলে বলছি না, লোপার মত মেয়েকে পাওয়া আমার সাত জনমের ভাগ্য ছিলো। অন্যের বাবা-মা কে কেউ এভাবে আপন করে নিতে পারে, আমার জানা ছিলোনা। আর আমার বাবা-মা? তারাও লোপাকে পেয়ে যেনো নিজের হারানো মেয়েকে খুঁজে পেলো। বলতে বোধহয় ভুলে গেছিলাম, আমার একটা বড় বোন ছিলো। আমার জন্মের পরপরই, মাত্র তিন দিনের জ্বরে ভুগে মারা যায়। যা হোক, লোপার কথা বলছিলাম।
লোপার সাথে আমার বিয়ের মাত্র সপ্তা দুই আগে পরিচয়। মুরুব্বীদের প্রাক বিবাহ কথা বার্তা শেষ হবার পরেই আমি মেয়েটাকে দেখি। দুই সপ্তাহে একটা মানুষকে আর কতটুকু চেনা যায়? সবকিছু ঠিকঠাক বুঝে ওঠার আগেই দেখি সাজগোজ করা একটা শ্যামলা মেয়ে আমার ঘরে বসে আছে। নিতান্ত ছাপোষা আমি আরো বেশী গৃহী হয়ে গেলাম। এরপরের সাতটা বছর কিভাবে চলে গেলো বুঝতেই পারিনি। লোপার সাথে কখনো কথা কাটাকাটি, মন কষাকষি হয়নি সেটা বলবোনা। কিন্তু প্রতিবারই কিভাবে কিভাবে জানি সব কিছু মিটে যেতো।
এই সাত বছরে লোপা আর আমার একটা মেয়ে হয়েছিলো। দুজন মিলে অনেক আলোচনা-ঝগড়াঝাটি করে নাম রেখেছিলাম শ্যামা। মেয়েটার মায়াময় মুখের কথা ভাবতেই চোখে পানি চলে আসলো। আমার শ্যামা যদি বেঁচে থাকে, কেমন দেখতে হয়েছে? কি করছে? কিছুই জানিনা। আর জানবোও বা কিভাবে? কতদিন পর ফিরছি এই রাস্তায়, আমার বাড়ীর রাস্তায়।
এইযে, সুশীল কাকুর সেলুন পার হচ্ছি। আরে! এখানেতো সেলুনই নেই এখন। একসময় বাবার হাত ধরে আসতাম চুল কাটাতে, বড় হয়ে ওঠার পর একা একাই। আবার শ্যামার প্রথম চুল কাটানোর জন্য সুশীল কাকুকেই ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভয় পেতাম, এত নরম চামড়া, যদি কেটে ছড়ে যায়? সুশীল কাকু থাকতেন আরেকটু সামনে গিয়ে ডানের বাড়িটায়। বাবার সাথে উনার ছিলো বন্ধুর মত সম্পর্ক, পুজো পার্বণে উনাদের বাসায় কত নাড়ু সন্দেশ খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।
আমাদের বিয়ের চার বছরের মাথায় বাবা মারা গেলেন হঠাৎ করেই। মা ও শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। সাজানো পৃথিবী অনেকটাই এলোমেলো হয়ে পড়লো। এর ভেতরেই বাবার মৃত্যুর পাঁচ মাসের মাথায় মা ও চলে গেলেন বাবার সান্নিধ্যে। নিজের নাতনীর মুখ দেখে যেতে পেরেছিলেন এটাই স্বান্তনা। আমি মনে হয় একটু বদলেও গিয়েছিলাম তখন। অনেক দিনের ছায়া মাথার উপর থেকে সরে যাওয়ায় অনেকটা অবিন্যস্ত। তবুও সামলে নিচ্ছিলাম নিজেকে আস্তে আস্তে।
এইতো বিষণ্ণ আতা গাছটার কাছে চলে এসেছি। এবার বাঁয়ে মোড়, তিনটা বাড়ী পার হ'লেই আমার বাড়ী। আহা কতদিন আমার মেয়েটাকে দেখিনা, লোপাকেও। মেয়েটা মনেহয় অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। এতদিন পর আমাকে দেখে কি চিনতে পারবে? যে হারে মুখ ভর্তি সাদা সাদা দাঁড়ি-গোঁফ হয়েছে! লোপার চুলেও মনেহয় পাক ধরেছে। কিন্তু আমি ঠিকই চিনতে পারবো ওদেরকে। নিশ্চই চিনতে পারবো আমার হৃদপিণ্ডের ধুক ধুক শব্দগুলোকে।
সেবার, শ্যামার তিন বছরের জন্মদিন সামনে চলে এসেছে। আমি আর লোপা ঠিক করলাম মেয়েটাকে সাগর পাহাড় এগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। লোপা আর শ্যামা'র সে কি উচ্ছাস। মহা উৎসাহে শ্যামাকে নিয়ে লোপা বেড়ানোর প্রস্তুতি নিতে থাকলো, আর আমি ব্যাস্ত থাকলাম ছুটির আগে শেষ মূহুর্তের কাজ গুলো নিয়ে। রওনা দেবার আগের দিন দুপুরে, অফিস থেকে বেরোবো বেরোবো করছি, এমন সময় আমার ফোনটা বেজে উঠেছিলো। জরুরী কোনো একটা খবর ছিলো, যেটা এখন আর মনে নেই, শুনে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম অফিস থেকে।
এইতো আমার বাড়ীতে পৌছে গিয়েছি।
কিন্তু... এরকম ময়লা জমে আছে কেন গেটের সামনে? ঘরের দরজা জানালাগুলো একটাও আস্ত নেই কেন? লোপা শ্যামা ওরা কি আমার উপর রাগ করেছে গত আঠারো বছর ধরে যোগাযোগ নেই বলে?
আহ! সব কথা মনে পড়ায় এত এত কষ্ট লাগে কেনো। সারাবছরই তো ভুলে থাকি, মেয়েটার জন্মদিন কাছিয়ে আসলেই মনে পড়ে কেন সব কিছু...
আমার শ্যামা... আমার লোপা... বাসায় ফিরছিলো টুকিটাকি কিছু জিনিস কিনে। পথে ওদের রিকশাটাকে ধাক্কা দিয়েছিলো একটা কার। মেয়ে কোলে লোপা ছিটকে পড়েছিলো রাস্তায়, আর একটা বাস চলে গিয়েছিলো ওদের কোমল শরীর দু'টোকে পিষে দিয়ে।
সারা বছর পথে পথে ঘুরি আমি। সেই বাসটা আর কারটাকে খুঁজি। অন্য কিছু মনে থাকে না। শুধু শ্যামার জন্মদিনের আগে আগে মনে পড়ে ওদের সাগর আর পাহাড়ে নিয়ে যাবো বলেছিলাম। ফিরে আসি এই রাস্তায়...
দম বন্ধ করে পড়লাম।
প্রথম পর্বের চাইতেও ভাল।
অসম্ভব মন খারাপ করা একটা লেখা। গল্পের গঠন ও বলার ধরন চমত্কার।
এই গল্পটা দুইখন্ড একই সাথে পোষ্ট দিলে আরও ভাল হত।
প্রিয়তে নিলাম। ভবিষ্যতে আপনার কাছে এমন আরো অনেক লেখার প্রত্যাশা থাকবে। ভাল থাকুন।
তাইলে কি দুই খন্ড একসাথেই করে দেবো বলছেন?
তাহলে যারা এখনও পড়েনি বা পড়ে পড়বে তাদের জন্য সুবিধা হবে। আর পড়তে বসে কোন গ্যাপ না দিতে হলে লেখার স্বাদও আরেকটু বেড়ে যাবে বলেই আমার ধারণা।
এখনই দিচ্ছি তাহলে...
ভাবলাম ফাজলামো একটা মন্তব্য করবো। শেষে এসে মনটা চরম খারাপ হয়ে গেলো। বাস্তবে এমন না হোক কারো।
বাস্তবেও ঘটে এরকম ঘটনা। একেবারে এরকম না হলেও কাছাকাছি...
কি বলবো বুঝতে পারছিনা, চোখে পানি চলে আসলো শুধু
যাক একেবারে তাইলে খারাপ লেখিনাই। ধন্যবাদ মনজুর ভাই...
গল্প বলার স্টাইল্টা, শেষ লাইন পর্যন্ত পড়তে বাধ্য করসে! বেশ ভাল লাগসে! তবে এই "আমি" টার গল্পে শেষমেশ ভাল একটা কিছু হবে, এমন্টাই আশা করছিলাম! যাই হউক, লেখকের উপর কুন কথা নাই
আমিও চেয়েছিলাম গল্পের "আমি"টার ভালো কিছু হোক, কিন্তু লেখার ফ্লো নিজেই চলে গেলো ট্রাজিক পথে
গল্প পড়ে মন খারাপ হলেও গল্পটা লিখসেন দারুণ।
খুব চিন্তায় ছিলাম পাঠক কিভাবে নেবে গল্পটাকে। চিন্তা মুক্ত হয়েছি...
সত্যি বলতে গল্পটা পড়ার পর থেকে খুব মনে হচ্ছে এমন একটা গল্প বই আকারে পড়তে পারলে বেশী ভালো লাগতো অথবা কোনো ম্যাগাজিনে
আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক... আপনার আশা পূর্ণ হউক... (কানে কানে বলি, আপনার কথা শুনে কিন্তু বেশ ইয়ে ইয়ে লাগছে নিজেকে )
ছুটির দিনে'তে পড়া আজকের ফিচারটা মাথায় ঘুরছিলো, ভাবছিলাম, হয়তো লোকটা কোথাও ছিলো, দেখা হয়নি বহুদিন পরিবারের সাথে! কিন্তু এমন হবে ঘটনাটা বুঝে উঠিনি .।.।।
গল্প বলার ঢং'টা বেশ হইছে।
প্রথমে মাথায় ছিলো "আমি" স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পার করে দিয়েছে অনেকগুলো বছর। তারপর ফিরে এসে সম্পর্কের টানাপোড়েনে পড়বে। কিন্তু লিখতে লিখতে থিমটা চেঞ্জ হয়ে গেলো...
কোথায় যেন একবার পড়ছিলাম -
'গল্প কখনই লেখকের কথায় চলে না,
গল্প লেখককে দিয়ে নিজেকে লিখিয়ে নেয় মাত্র '!
হ'তে পারে...
(
শুভ ভাই চমৎকার হইসে। অতি চমৎকার। ঘটনাটা যে এইদিকে যাইতেসে সেইটা টেরই পাই নাই। বার বার মনে হইতেসিলো, আপনে বোধহয় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন বিনাবিচারে, এখন ফিরা আসতেছেন স্ত্রী-কন্যার কাছে। অসাম ভাবে পাঠককুলকে ফাঁকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত ঠিকই দূর্দান্ত একটা গল্পের চেহারা দিয়ে দিলেন পুরা লেখাটাকে।
স্যালুট ভাই, আপনের কাছে ইরাম গল্প আরো চাই
মিয়া, আপ্নে ইদানীং গল্প লেখেন না কেন?
আর এত্ত প্রশংসা দেইখা : ... বোঝেনইতো...
বুঝি তো বটেই
গল্পটা দারুন হইসে। আর লেখাত স্টাইল্টাও চমৎকার।
আরে!!! কদ্দিন পর আপনাকে দেখলাম... আছেন কেমন???
ভালো আছি। আপনি ক্যামন আছেন? আমি রেগুলার ব্লকে আসি এবং সব লেখাই পড়ি। কিন্তু আমি এত্তো বেশি অলস যে আমার লগইন করে কমেন্ট করতে পর্যন্ত আলসেমি লাগে।
সবাই একসাথে অলস হয়ে গেলে চলে কিভাবে?
বৃ, তোমার ভেতরকার শক্তি সম্পর্কে আমি জানি। গল্প বলার ধরনটায় তোমারে খুঁজে পাইলাম না। যদিও গল্পটা বেশ স্পর্শ করেছে।
হু, এইটা একেবারে আমার ধাঁচের গল্প না। সোজা সাপ্টা কাহিনী বর্ণনা, কোনো যাদু নাই কয়েনেজ নাই। তয় লিখে শান্তি পাইছি...
শুভ গল্প খুব চমৎকার হয়েছে কথাটা বলতে পারলে ভাল লাগতো। কিন্তু বলতে পারলাম না। কারণ অনেকের জীবনেই এটা নির্মম বাস্তবতা আজ।
কাছাকাছি বাস্তবতা আমার পরিবারের ভিতরেই আছে...
চমৎকার গল্প। আমি কিন্তু প্রথম ধরতে পারিনি এটা গল্প !
এরকম লেখা আরও চাই।
ফার্স্ট পার্সনে বলা হয়েছে বলে কি গল্প বলে ধরতে পারেন নি, না অন্য কোনো কারণ?
মনে হচ্ছিল দীর্ঘ সময় পর প্রিয়জনদের কাছে ফেরার অভিজ্ঞাতার বর্ণনা। শেষটায় এসে চমকে দিলেন !
ভাল লেগেছে।
অনেক ধন্যবাদ...
চোখে পানি ।
কিছু বলার নেই।
ধন্যবাদ বলে আপনার ইমোশনটাকে খাটো করতে চাইতেছি না...
মন্তব্য করুন