স্মৃতির পহেলা বৈশাখ (১)........সীমানা পেরিয়ে / তানবীরা
অনেকদিন থেকেই ব্লগে প্রকাশ হওয়া ইবুকের লেখাগুলি ক্রমান্বয়ে সবার সামনে উপস্থাপনের অনুরোধ ছিলো। আলোচনা সমালোচনার খরগ তলে আনাটা হয়তো লেখকেরো কাম্য। অনেক দেরীতে হলেও আজ থেকে ই বুকের লেখাগুলি ব্লগে প্রকাশ করা শুরু হলো। প্রথমেই ই বুক "স্মৃতির পহেলা বৈশাখ" এর লেখাগুলি দিয়ে শুরু করছি।
সীমানা পেরিয়ে
- তানবীরা
দেশের নতুন বছর উদযাপন আর প্রবাসের নতুন বছরের উদযাপনের মধ্যে আকাশ আর সমুদ্রের দূরত্ব খেলা করে। দৃষ্টিসীমানার শেষ প্রান্তটুকুতে যেমন মনে হয় আকাশ আর সমুদ্র একসাথে মিশে গেছে। ভিন্নভাবে, ভিন্নদেশে নতুন বছর উদযাপন হলেও আমাদের সবার মনের মধ্যে একই অনুভূতি খেলা করে। বেশিরভাগ সময়ই চৌদ্দই এপ্রিলের ঠিক পরে যে শনিবারটা পরে সেদিন প্রবাসী আমরা নতুন বছরকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখানে বরণ করি। সপ্তাহান্ত ছাড়া বৈশাখকে বরণ করার সুযোগ এই বিভূঁইয়ে নেই। নেই মুড়ি মুড়কি, নেই চারুকলার র্যালি, নেই নাগরদোলা কিংবা কাঠ ফাটানো রোদ। এই নেইয়ের মধ্যেই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে নেয়ার মতো করে নিজেরাই নিজেদের মতো করে মিষ্টি বানিয়ে, ফুচকা বানিয়ে, লাল সাদা শাড়ি পড়ে ইউরোপের ফাল্গুনী আবহাওয়ায় বৈশাখকে বরণ করি।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, তারা নিজেদেরকে গুহা সভ্যতা থেকে উন্নত করে সমাজ সভ্যতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে বলে চতুর্থ শ্রেণীর পরিবেশ পরিচিতি বইয়ে লেখা থাকে। বাস্তবে দেখা যায় মানুষ বিভিন্ন ঠুনকো ঠুনকো কারণ নিয়ে ঝগড়া করে করে সমাজকে বিভিন্ন শ্রেনীতে ভাগ করে আবার গুহা বানিয়ে ফেলছে। নেদারল্যান্ডস দেশটি খুব ছোট, আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে তিনভাগের একভাগ। খুব ঘনবসতির এই দেশটিতে টার্কিস, সুরিনামী, মরোক্কান, ইন্দোনেশিয়ান আর অবধারিতভাবে চায়নীজ অভিবাসীদের আধিক্য। ভারতীয় আছেন কিছু কিন্তু বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা নেহাত হাতে গোনা যায়। বাংলাদেশিদের সংখ্যাতো আরোই নগন্য। সেই হাতে গোনা দুই দেশের বাংলাভাষীরা মিলে উনিশশো পচাত্তর সালে “প্রবাসী” নামে একটি সংগঠন তৈরী করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে পশ্চিম বাংলার বাঙালির আধিক্য ছিল। তাই তাদের পর্ব-পুজার প্রাধান্যও ছিল সবসময়।
কালে কালে গঙ্গার সাথে সাথে পদ্মা মেঘনায়ও পানি কম গড়ায়নি। এখন বাংলাদেশিরাও এ্যমেরিকার বাইরে আর কোন দেশ আছে নাকি সেদিকে মন দিলেন। ফলে নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশির সংখ্যা বাড়লো। “প্রবাসী”তে এক সময়ে বাংলাদেশি অংশগ্রহনকারীদের অনুপাত ছিল বিশ আর পশ্চিম বঙ্গের আশি। সেই ভারসাম্য দিনে দিনে প্রায় চল্লিশ আর ষাটে চলে এলে বাংলাদেশিরাও বললেন, বছরে তিনটা পুজো হলে একটা ঈদ উৎসব কেনো হতে পারবে না? প্রতিবারের বৈশাখী স্মরণিকায় হাওড়া ব্রিজের ছবি থাকে, তারপাশে কেনো একবার যমুনা ব্রিজ স্থান পেতে পারে না? যদিও বেশির ভাগ কাজ বাংলাদেশিরাই করছেন তাহলে পরিচালনা কমিটিতে কেনো তারা থাকতে পারবেন না? ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কথা ও মনোমালিন্যের পরে “প্রবাসী” ঘোষনা দিলেন, তারা আর “প্রবাসী” থাকবেন না। তারা এখন হবেন “ইন্ডিয়ান বেঙ্গলি এসোশিয়েশয়ন ইন নেদারল্যান্ডস”। যার মানে হলো না রহেগি বাংলাদেশি না থাকেগি ঝুট ঝামেলা।
গরীবের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের বাস্তব ফলাফল হয় দেবশ্রী রায়ের সিনেমা “শতাব্দীর গল্প” এর মতো। আমরা বাংলাদেশিরা প্রায় বিতারিত হয়ে মুষড়ে পড়ে আছি ঘরে। কারো কোন সাড়া শব্দ নেই। তখন আমি ভাবলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে কেমন হয়? যদিও আমদের সামর্থ্য কম, লোকবল কম, কোলকাতার লোকের ভাষায় আমাদের শিা, সাংস্কৃতিক জ্ঞান সব কম। তাতে কি? কম থাকলে কম খাবো কিন্তু মরে যাবো কেনো? যারা প্রবাসে থাকেন তারা জানেন এধরনের সাহস রাখাও সবসময় চাট্টিখানি কথা নয়। বাংলাদেশি সংগঠন যা বিদেশে তৈরী হয় তার বেশির ভাগই রাজনীতির আর্দশ থেকে তৈরী হয়। বড় বড় দল ভিত্তিক। তাদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম থাকে না বললেই চলে।
আমি যা ভাবি তার থেকে ফিরতে পারি খুব কম। ঘরের লোকের দ্বিধা দন্দ্ব অমান্য করে লিখলাম ইমেইল বাঙালি সব বন্ধুদেরকে চলো নতুন বছরকে সবাই বরণ করি একসাথে। এবার যেহেতু আমরা আমরা তাই খাবারের আয়োজন হলো সম্পূর্ন বাংলাদেশি। পান্তা ইলিশ, ফুচকা চটপটি, মিষ্টি দই, নানা রকমের ভর্তা। ড্রেসকোড রইলো জামদানী আর পাঞ্জাবী। অনেক সময় অনেকে এধরনের অনুষ্ঠান এড়িয়ে যান খরচের ভয়ে, আবার বাংলাদেশি অনেকেই রেষ্টুরেন্টে কাজ করেন তাদের শনিবারে কাজ থাকে বলে। সমস্ত বাস্তবতা মেনে নিয়ে আমি তারপরেও ভাবলাম হল নিলে খরচের ঝামেলা আসে, লোকজন আসা না আসার টেনশনের মধ্যে পরি কিন্তু বাড়িতে হলেতো সেই টেনশন নেই। তাহলে হোক বাড়িতেই, আমার বাড়িতে। প্রথমে পনের থেকে বিশটা পরিবার মাথায় রেখে পরিকল্পনা শুরু করলেও দেখা গেলো তিন সপ্তাহের মধ্যে আমাকে আবার ফিরে মেইল করতে হলো, এবার বাড়িতে হচ্ছে তাই সবাইকে নিতে পারছি না পরের বার সবাই আমন্ত্রিত।
বর্ষবরণ যা ভাবি নাই তার চেয়েও অনেক আনন্দের ছিলো। গান, নাচ, কৌতুক, খাবার আড্ডায় কখন যে আমাদের বেলা তিনটা রাত একটায় গড়িয়ে গেছে আমরা অনুভব করতে পারিনি। বর্ষবরণের সাফল্য আমাদেরকে অন্য প্রেরণা দিল।
সবাই আমরা সাহসী হয়ে গেলাম এই প্রয়াস থেকে। সবাই মিলে ভোট দিয়ে আমাদের সংগঠনের নাম ঠিক করলাম, “সীমানা পেরিয়ে”। নামেই বলে দিলাম আমরা নিজেদেরকে সবার থেকে আলাদা করে ব্র্যকেটে বন্দী করবো না। আমাদের দ্বার হোক সব জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষার জন্য উন্মুক্ত। প্রত্যেকে আমন্ত্রিত, প্রত্যেকে এক সমান। এরপর চললো বারবিকিউ, ঈদ, পুজার শারদীয় সম্মেলন। আর এর মাঝে মাঝে ঘরোয়া পিঠা পুলি, ভর্তা, চায়নীজ উৎসবতো আছেই, থাকবেই।
আজ “সীমানা পেরিয়ে”র একবছর হতে যাচ্ছে। আবার এলো যে বৈশাখ। প্রায় একশজন মানুষের রিজার্ভেশন নিয়ে সতেরই এপ্রিল আমরা যাচ্ছি বড় হলে নতুন বছরকে বরণ করতে। আমাদের সাংস্কৃতিক সংগঠনটি প্রায় দেড়মাস ধরে অনুশীলন করে বেশ কটি দলীয় সংগীত, বাচ্চাদেরকে বৈশাখের গান, নাচ, নাটক সব তৈরী করেছেন বৈশাখী অনুষ্ঠানের জন্য। সবাই নিরন্তর নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে ভাবছেন কী করে অনুষ্ঠানটিকে আরো আর্কষনীয় করে তোলা যায়। এবারের ড্রেসকোডে রয়েছে কাঁথা স্টিচের শাড়ি আর ফতুয়া। অনেকেই দেশ থেকে ডাকে শাড়ি আনিয়েছেন বৈশাখে পরবেন বলে। অনেকেই ধন্যবাদ দিয়ে মেইল করেছেন নেদারল্যান্ডসে এমন একটি সার্বজনীন বর্ষবরণ উৎসব পালন করা হচ্ছে বলে।
সবাই মিলে আবার আমরা প্রমাণ করলাম, পাঁচ আঙ্গুলে যখন মুঠি তৈরী হয় তখন আর কিছুই অসম্ভব নয়। জাগো হে বাঙালি জাগো, সময় এসেছে আজ জেগে ওঠার, রাত পোহালো।
সবাইকে নতুন বছরের আন্তরিক শুভেচ্ছা, শুভ নববর্ষ ১৪১৭।
ব্লগাদের উদ্যোগে বৈশাখ নিয়ে স্মৃতি সংকলন "স্মৃতির পহেলা বৈশাখ" প্রকাশ করা হয় ১লা বৈশাখ ১৪১৭ বঙ্গাব্দ
প্রকাশক: www.amrabondhu.com
সম্পাদনা পরিষদ: লোকেন বোস ও নজরুল ইসলাম
প্রচ্ছদ: নজরুল ইসলাম
আগেই পড়েছিলাম। ভালো লাগাটুকু এখানে জানিয়ে রাখলাম। এধরনের উদ্যোগের খবর শুনলে মনটা ভরে যায়।
মন ভালো লাগলে একটু সাহায্য করেন। দু / একটা নাটক লিখে দেন, পার্ফম করি। তেজ দেখাইয়া যে বের হয়ে আসলাম এখন কোলকাতার নাটক করলে ইজ্জত থাকবে?
স্যালুট
আগেই পড়েছিলাম, আবার পড়লাম। দারুণ লিখেছেন তাতাপু। আর লেখাগুলি পোষ্ট আকারে দেওয়ার উদ্যোগটা খুব ভালো লাগলো।
অতীব চমৎকার! আফসোস সময়াভাবে এই ইবুকে লেখা দিতে পারি নাই। দেখবেন একদিন আমার লেখাও ইবুকে ছাপা হবে
তাতাপু লেখাটা জটিল হয়ছে।।আগে পড়ি নাই আজ পড়লাম।
এবারের পহেলা বৈশাখ আমার জীবনের স্মরনীয় দিন।সারাদিন আম্মার দেয়া একটা ফতুয়া পড়ে ঘুরে বেড়ায়ছি এই ভীনদেশে।ইউনির অন্য বাংলাদেশি ছাত্ররা হাসাহাসি করেছে আমি ফতুয়া পড়ছি বলে।তাদের মতো গ্লোবিস হতে পারি নাই বলে। না খায়ছি পান্তা না খায়ছি ইলিশ মাছ।
বিদেশে থেকেও এমন উদ্যোগ নেবার জন্য আপনাকে সাধুবাদ !
(কবে যেনো আপনি দেশে এসে আমাদের সাথে আড্ডাইবেন আর খাওয়াইবেন ?)
আড্ডাবো আমি খাওয়াইবেন আপ্নে। আপনার বিলের টাকায় চটপটি খাইতে আমি দিনরাত অপেক্ষা করছি। জুলাই - আগষ্টে কাউরে কিছু খাওয়াতে আমার ওস্তাদের নিষেধ আছে
বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই
বাহ ! বাহ। সাধু সাধু
গুরু গুরু আমাকে দিয়েই শুরু
সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ
ভালো লাগলো আপনাদের এই চেষ্টাটা।
আমরাও এইবার করেছি একটা কম্যুনিটি সেন্টারে, ১৪ তারিখেই, তবে রাতে। হেভি মজা হয়েছে।
জুলাই আর আগস্টের অপেক্ষায় থাকলাম।
আমার প্রথম বিদেশ যাত্রা ছিল, সাত সাগর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে সুদূর আমেরিকা। আমেরিকার প্রবাস জীবনের প্রথম তিনটি দিন বড্ড একাকীত্বে কাটলেও চতুর্থ দিনেই পেয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশীদের ঠিকানা। এরপর থেকে একাকীত্ব কখনও আমার লাগাম টেনে ধরতে পারে নি। ২০০৯ সালে দেশের সীমানা পেরিয়ে দ্বিতীয়বারের মত প্রবাসে এলাম, পা রাখলাম নেদারল্যান্ডে। আগষ্ট'০৯ থেকে এপ্রিল'১০ পর্যন্ত পথে ঘাটে বাঙালী খুজে বেরিয়েছি, কিন্তু পাই নি। অবশেষে খোজ পেলাম "সীমানা পেরিয়ে"-র, হাজির হলাম এপ্রিলের ১৭-র "সীমানা পেরিয়ে"-র বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। যদিও মানের মাঝে চাপা শঙ্কা ছিল, এরা সবাই প্রবাসী বাঙালী, এদের বর্ষবরণটা না জানি কেমন হয়। মনের মাঝে চাপা শঙ্কাটাকে উচ্ছাস হিসাবে টেনে বের করে আনল "সীমানা পেরিয়ে"-র মানুষগুলো। প্রাণ উজাড় করা আন্তরিকতা দিয়ে আপন করে নিল মুহুতেই; একবারের জন্যও মনে হয় নি, এদের সাথে আজকেই আমার প্রথম দেখা। বৈশাখী অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আমি বাংলাদেশে বসেই পহেলা বৈশাখ পালন করছি। আরো অবাক হয়েছিলাম, বাঙালী ছাড়াও নানা বর্ণের, নানা জাতির, নানা ধর্মের মানুষও এসে জড়ো হয়েছে "সীমানা পেরিয়ে"-র সাথে। দেখে মনে হচ্ছিল, "সীমানা পেরিয়ে" শুধু নামেই না, কাজেও প্রমাণ দিল, "সীমানা পেরিয়ে"-র দ্বার সব জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষাভাষীর মানুষের জন্য উন্মুক্ত।
মন্তব্য করুন