মেঘবন্দী (১৪) ... মৌমিতার সুখ-দুঃখ / রশিদা আফরোজ
মৌমিতার সুখ-দুঃখ
রশিদা আফরোজ
(১)
‘এইখানে বৃষ্টি পড়ে ভিজে যায় নদী
মন বলে আজ তুমি ফিরে আসো যদি...’
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। খবরের কাগজ হাতে বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছে মৌমিতা। এককাপ চা খেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু বুয়াকে ডেকে সেটা বলতে ইচ্ছা করছে না। রাতুলের কথা মনে পড়ছে। এরকমই এক বৃষ্টির দিনে মৌমিতা তুমুল আনন্দে আলোড়িত হতে হতে রাতুলকে ফোন করে বলে, শোনো, আজ একটা মজা হবে?
‘যেমন?’ রাতুল বলে।
‘আজ তো বৃষ্টি হচ্ছে, আমরা ছাতা নিয়ে বের হবো, রিকশায় ঘুরবো, তারপর হঠাৎ ছাতা উড়িয়ে দেবো...কী মজা হবে, তাই না? ভীষণ উত্তেজিত মৌমিতা।
‘এখানে মজার কী আছে? এসব স্রেফ পাগলামি, ফোন রাখো, একটু পর তো দেখা হবেই।’ রাতুল ফোন রেখে দেয়। মৌমিতার মুখ জুড়ে অন্ধকার নেমে আসে।
পরিচয়ের শুরুতে রাতুলকে মনে হয়েছে ভীষণ রোমান্টিক, রবীঠাকুরের কবিতা আওড়াতো, মৌমিতার পছন্দের জায়গাগুলি ছুঁয়ে দিতো, কী দারুণ মিল ছিল দুজনের চাওয়ায়, অথচ তারপর ধীরে ধীরে দেখা গেল রাতুলের ভেতর আবেগের জায়গা খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
বিয়ের পর সুজনকে নিয়ে একটুও সুখী হতে পারেনি মৌমিতা, দিনরাত ব্যস্ত একজন মানুষ। অফিস আর ল্যাপটপ নিয়েই তার জগৎ, মৌমিতা নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। কবিতার বইগুলির ওপর ধূলা জমতে থাকে, টিএসসিতে যাওয়া হয় না, গান শুনতে ইচ্ছা করে না, মোবাইলে বন্ধুদের সময় দেয়া হয় না, একরকমের ভালো লাগে না বোধ মৌমিতাকে আঁকড়ে ধরে। খোলা জানালায় কিংবা বাড়ির ছাদে ঘণ্টা-ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকাই মৌমিতার একমাত্র সুখ।
(২)
মোবাইল ফোনে রিং হচ্ছে। রিয়ার কল। ‘হ্যালো মৌ, কীরে ফোন করিস না, ফোন ধরিস না, ঐদিন এতো করে বললাম বাবুয়ার বার্থডে পার্টিতে আসতে, এলি না, কী যে তোর হয়েছে বুঝি না।’ এক নিঃশ্বাসে এতোগুলি কথা বলে দম নেবার জন্যই বুঝি থামে রিয়া। ‘স্যরি রি, আসলে ঐদিন সুজনের অফিসে জরুরি কাজ পড়ে গেল...’ ‘হয়েছে হয়েছে তোকে আর অজুহাত দাঁড় করাতে হবে না, শোন আজ বিকালে আমার বাসায় চলে আয়, সিমি, রুবি, মোনা আসবে, আমরা সবাই মিলে আড্ডা দেবো। নো স্বামী, নো বাচ্চা-কাচ্চা, আমরা আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনারঙা দিনগুলিতে হারিয়ে যাবো। মৌ, লক্ষ্মীময়না আসিস। ‘মোনাকে কোথায় পেলি, ও না সুইজারল্যান্ড?’ মৌমিতা অবাক গলায় জানতে চায়। ‘আলাদিনের চেরাগ পেয়েছি, ঘষা দিতেই দৈত্য এসে হাজির, ঐ শালাকে আদেশ করলাম মোনাকে ধরে আনতে...হি হি হি’ হাসতে হাসতে কুটি কুটি হয়ে যায় রিয়া কথাগুলি বলতে বলতে। ‘ওরে ডিয়ারি, তুই যে আন্দামানবাসী হয়ে গেছিস, খবর-টবর রাখিস না, মোনা এসেছে সপ্তাহখানেক হলো। তোকে নাকি অনেকবার মেইল দিয়েছে, রিপ্লাই পায়নি, তাই রাগ করে তোর সাথে যোগাযোগ করছে না। এ্যাই শোন, বিকালে তাহলে দেখা হচ্ছে, এখন রাখছি, বাই।
(৩)
‘ও আল্লাহ,তুই এতো স্লিম হলি কীভাবে রে মোনা?’ ‘রুবি যে দেখি শাড়ি পড়েছিস, জিন্স ছাড়া তোকে তো কল্পনাই করাই যায় না ’ ‘মৌটা এখনো এলো না’...রিয়া এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে আর গৃহকর্মীদের এটা-ওটা নির্দেশ দিচ্ছে ‘ওহহো বুয়া, প্লেটগুলি সাবধানে রাখো’ ‘রোকেয়া, তুই এখানে কি করছিস, যা কিচেনে যা’...‘এমা ৫টা বেজে গেল, এখনো মৌ এসে পৌছালো না’...। ক্রিম কালারের ওপর গোল্ডেন কনট্রাস্টের শাড়ি পড়েছে রিয়া, দুই ঘণ্টা ধরে সেজেছে, অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা হবে, রিয়া খুশির জোয়ারে ভাসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রিয়াকে বন্ধুরা ‘সাজুনি’ বলে ক্ষেপাতো, রিয়া কিছুই মনে করতো না, বরং খুশি হতো। সাজগোজ ছাড়া রিয়াকে দেখা গেছে এমনটা কেউ বলতে পারবে না। ‘মৌ, এত দেরি করলি’ বলতে বলতে রিয়া ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো মৌমিতাকে। ‘আরে ছাড় ছাড়, দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে যে, মুখে বললেও মৌ নিজেও শক্ত করে ধরে আছে প্রিয় বন্ধুটিকে।
‘এই যে কী হচ্ছে, ঘটনা কী?’ পারফিউমের সুরভি ছড়িয়ে সিমি এসে ঢুকলো।
ছাদে চা পর্ব চলছে। সবাই তুমুল আড্ডায় মেতে উঠেছে। একজন একটা কথা শেষ করার আগে আরেকজন আরেক প্রসঙ্গে নিয়ে আসছে, কারণে-অকারণে চলছে হাহাহা হিহিহি। ‘মৌ, তুই বড্ড শুকিয়ে গেছিস, চোখের নিচে কালি লেপ্টে আছে, তুই কেমন আছিস রে মৌ?’ আচমকা প্রশ্ন করে সিমি। মৌ চুপসে যায়। তারপর বলে, ‘আমার কিছু ভালো লাগে না রে। ‘সুজনের সাথে কি তোর ঠিকঠাক বনিবনা হচ্ছে না?’ মোনা জানতে চায়। ‘তা ঠিক নয়, সুজন বেশ দায়িত্ববান একজন মানুষ, সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকলেও আমার সুবিধা-অসুবিধার দিকে সবসময় খেয়াল রাখে। আসলে আসলে...’ কথাটা শেষ না করে দু’হাতে মুখ ঢাকে মৌমিতা। হঠাৎ পরিবেশটা বিষন্ন হয়ে ওঠে।
(৪)
রাতে খাওয়ার পর মৌমিতা ল্যাপটপ নিয়ে বসে। বিয়ের পর পর সুজন এই ল্যাপটপটা ওকে দিয়েছে কিন্তু এই তিনমাসে একবারের জন্যও ছুঁয়ে দেখেনি সে। ব্লগে ঢুকলো, পরিচিত-অপরিচিত অনেকের লেখায় চোখ বুলালো। লিখতে মন টানলো, লিখে ফেললো আজ বিকালের গেট টুগেদারের গল্পটা। আধাঘণ্টার মধ্যে বেশ কয়েকটা মন্তব্য এসে গেল, চেনারা অনুযোগ জানালো কেন মৌমিতা এতদিন চুপ করে আছে, আর অচেনারা প্রশংসা করলো। নিজের ব্লগে ঢুকে নিজের লেখা কবিতাগুলিতে চোখ রাখলো, ভালোলাগায় মৌমিতার মন ভরে গেল, কমেন্টগুলি পড়তে পড়তে ফেলে আসা দিনগুলির কথা ভেবে হাসছিল মৌমিতা। আজ বিকালে বন্ধুরা সবাই মৌমিতাকে নিয়ে রীতিমত কাউন্সিলিঙে বসেছিলো। রাতুলের মত হারামী ভণ্ডের জন্য মৌমিতা নিজেকে এবং সুজনকে ঠকাচ্ছে এটাই ওদের বক্তব্য। সবার কথা শুনতে শুনতে মৌমিতার তখন মনে হচ্ছিল তার মনের ভেতরের মেঘগুলি সরে গিয়ে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। তারপর ৫ বন্ধু মিলে খেলো, গাইলো, নাচলো, বেশ জমে উঠেছিল ওদের পঞ্চসখীর আড্ডা।
‘মিতা, এখনো শোওনি দেখছি’ ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকা মৌমিতাকে দেখে বেশ অবাক হলেও সুজন সেটা ঠিক প্রকাশ করলো না। মৌমিতা লাজুক হেসে বললো, ‘এই ব্লগ খুলে বসলাম।’ ‘কেমন হল তোমাদের পার্টি?’ সুজন জানতে চায়। ‘দারুণ, জানো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যেভাবে আড্ডা দিতাম, ঠিক সেরকম জমাটি আড্ডা হলো আজ’। হড়বড় করে এতোগুলি কথা বলে ফেলে মৌমিতা আচমকা লজ্জায় মাথা নিচু করলো। সুজন পরম মমতায় মৌমিতার মাথায় হাত রাখলো।
(৫)
সকাল থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। জানালায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে মৌমিতা। এই ক’দিনে বদলে গেছে মৌমিতার জীবন। সুজনের সাথে সম্পর্কটা বেশ সহজ এখন। এতোদিন মৌমিতা বুঝতেই পারেনি ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত এই মানুষটির ভেতর এতো রোমান্টিক একটা মন আছে। রাতে খেতে বসে সুজন জানতে চায় সারাদিন মৌমিতা কী কী করলো, নূতন কোনো কবিতা লিখেছে কী না, নিজের ব্যবসার বিভিন্ন বিষয়ও শেয়ার করে মৌমিতার সাথে। রাতুলের কথা ভেবে আর কষ্ট পায় না মৌমিতা। রাতুল কোনোদিন মৌমিতাকে সম্মান দেয়নি, বরং নিজের কেরিয়াারের চিন্তায় মৌমিতার স্বপ্নকে মাড়িয়ে চলে গেছে।
‘মিতা, মিতা, মিতা ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢোকে সুজন, মৌমিতা অবাক, কী ব্যাপার, অফিসের দরকারি কোনো ফাইল রেখে যায়নি তো? কিন্তু সেজন্য তো আর কাউকে পাঠানো যেতো। সুজন মৌমিতার হাত ধরে বলে, ‘চলো ছাদে যাই, বর্ষাবরণ করা যাক, তারপর দুইটা ছাতা বের করে একটা মৌমিতাকে ধরিয়ে দেয়, অবাক মৌমিতা দম দেয়া পুতুলের মতো চলতে শুরু করে।
সুজন ছাতা খুলতে খুলতে বলে, ‘আমরা এখন ছাতা মাথায় সুরে-অসুরে গান গাইবো, তারপর ছাতা উড়িয়ে দিয়ে ভিজবো, কেমন মজা হবে বলো তো?’ মৌমিতা কথা বলতে পারে না, কেবল তাকিয়ে থাকে। সুজন ততক্ষণে গান ধরেছে,
এসো নীপবনে, ছায়া বীথিতলে
করো গোপন স্নান নবধারা জলে...
কী দারুণ গলা, মৌমিতা আচমকা ছাতা ছুঁড়ে ফেলে দু’হাতে সুজনকে জড়িয়ে ধরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে।
লেখিকার নামের বানানটা যদি খেয়াল করতেন পুস্তক সাহেব/সাহেবা
তাতাপু, দোষটা লেখকের। লেখক নিজেই তার নাম নিয়ে দ্বিধান্বিত।
লেখাটা কি অতি-অতি বদ লেখা? পড়ার অযোগ্য? মনটা খারাপ হলো। তবে ব্যাপার না!!!!!!!!!!!!!!
ছোট্ট একটা গল্প। যতটুকু দরকার ততটাই লেখা হয়েছে। মেদহীন। ভাল লেগেছে।
মন্তব্য করুন