মেঘবন্দী (১১) ... তুচ্ছ বর্ষন গল্প / রুমানা বৈশাখী
তুচ্ছ বর্ষন গল্প
রুমানা বৈশাখী
১)
টিপটিপ করে পড়েই চলেছে কাল দুপুর থেকে। সন্ধ্যা পেরিয়ে, রাত পেরিয়ে এখন পরদিন ভোর। তবু বুঝি আকাশের মজুদের শেষ নেই। এতটুকু বিরাম নেই বৃষ্টির ঝরঝরিয়ে পড়ে চলার। গাঢ় অন্ধকার ঘনাচ্ছে ক্রমশ। যে কোনো মুহুর্তে আবার ঝমঝমিয়ে বর্ষনের প্রস্তুতি।
রাস্তায় একটা জনমানব নেই, দোকান গুলো একটু আধটু খুলেছে কেবল। মাথায় কাপড় দিয়ে দুরুদুরু বুকে পথ চলে সুলতানা। টিপটিপ বৃষ্টিতে পরনের কাপড় ভিজে লেপ্টে যাচ্ছে শরীরের সাথে, ভিজছে মাথার ওড়না। ঠান্ডা বৃষ্টি বিন্দু আর হিমশীতল বাতাসে কেমন জ্বালা করছে শরীর। এমন নয় যে বাসায় ছাতা নেই কোনো। আছে,অনেক গুলোই আছে। কিন্তু বেগম সাহেবা ছাতা দেবার কথা একটু খানি বলতেই এমন করে মুখ বাঁকালেন। ঝামটা মেরে বললেন. ‘গরীব মানুষের মেয়ের অতো ঢঙ কিসের রে? জীবনে ছাতা কোনোদিন চোখে দেখছিস? তোদের জন্যে রোদ কি আর বৃষ্টিই কি?’
আসলেই তো, গরীব মানুষের মেয়ের অত ঢঙ থাকতে নেই। ঢঙ থাকলে কি আর পরের বাড়িতে ঝি গিরি করে খাওয়া যায়? বেশিদিন হয়নি এই ছোট জেলা শহরের এ বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসাবে এসেছে সে, এখনও তাই নতুন জীবনটা আপন হয়ে ওঠেনি। গেলো বছরের বর্ষায় বাপজানের ধাণি জমি গুলো সব পানির পেটে গেলো, রাক্ষুসে নদী এতটুকুও রেখে গেলো না কটা চাউলের সংস্থানের জন্যে। শুধু সে একলা নয়, রোকসানাও আজকাল পরের বাড়িতে ঝি গিরি করে খায়। তাও সেই সুদূর ঢাকা শহরে।
রোকসানা... ...
সই রোকসানা। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত সহপাঠী রোকসানা। এরপর রাসেলের স্কুলে যাবার বয়স হলো, সুলতানার তাই পড়া হলো না আর।
স্কুল শব্দটা মনে পড়তে আরও তাড়াতাড়ি পা চালায় মেয়ে। বেগম সাহেবার ভাই ঢাকা রওনা হবেন, উনার জন্যে সকালের নাশতা কিনতে হবে। উনার নাকি হোটেলের পরোটা-ভাজি থেতে ইচ্ছ হচ্ছে, সেই সাথে খাসির পায়া। যে হোটেলেরটা খাবেন, সেটা অবশ্য বেশ অনেক পথ দূরে। কিন্তু কি আর করা, মামা খাবেনই। এই বৃষ্টির দিনে খাসির পায়ার সাথে গরম পরোটা না হলে চলছে না তার কিছুতেই। সাহেব অবশ্য বৃষ্টির মাঝে সুলতানাকে বের হতে দেখে আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু জবাবে বেগম সাহেন এমন চোখ গরম করে তাকালেন যে সাহেব উঠে চলে গেলেন অন্যঘরে। চৌদ্দ-পনেরো বছরের কাজের মেয়ের প্রতি কেন বেশী মমতা দেখাতে পারলেন না মানুষটা, তা অবশ্য বোঝে মেয়ে। এই শহরে এসেই বুঝতে শিখেছে। সাহেব মানুষটা ভালো, কিন্তু বেগম সাহেবাই সংসারের মালিক। চাইলেও তাই সাহেব পারেন না এই ঘোর বাদলার দিনে কাজের মেয়েটার বাইরে যাওয়া রোধ করতে।
মরার বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে তা পড়েই যাচ্ছে। পরনের সস্তা সুতির জামাটা ভিজে চেপে বসেছে শরীরের সাথে। ওড়না দিয়ে যে ঢাকবে, ওড়নারও সেই হাল। পথ চলতি যে দু একজন মানুষ আছে, সকলেই এক নজর হলেও ফিরে তাকাচ্ছে। দোকানদারেরা আধখোলা ঝাঁপির ফাঁক দিয়ে চেয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে।
লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে সুলতানার। কেমন যেন রি রি করে শরীরের মাঝে যখন মনে মনে হয় হোটেলটায় যাবার কথা। কত পদের পুরুষ লোক বসে থাকে ওখানে। আরও বড় কথা হলো, কটা ছেলেপেলে আছে। সারাদিন আড্ডা জমায় হোটেলে, তাস পেটায়। মালিকের ছেলে, কেউ কিছু বলে না। আর কেউ থাকুক বা না থাকুক, ওই ছেলে গুলো তো নিশ্চিত থাকবেই থাকবে। ঝড়-বৃষ্টি-তুফান যাই হোক না কেন।
মনে মনে আল্লাহকে ডাকে মেয়ে। দুরূদ শরীফ পড়ে। আম্মা বলতো, যার কেউ নেই দুনিয়ায় তার আল্লাহ আছে.. .. ..
২)
কটা পরোটা ভেজে দিতে এত সময় লাগে? পরোটার করিগরও বুঝি শত্র“তা করছে আজ, আটটা পরোটা বানাতে আট ঘন্টা সময় নিচ্ছে।
হোটেলে খদ্দের বলতে গেলে নেই, দু একজন ছাড়া ছাড়া। বখাটে গুলো ঠিকই আছে। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে, দৃষ্টি দিয়ে চেটেপুটে খাচ্ছে বৃষ্টিভেজা নারী শরীরটাকে। আশেপাশে অন্য নারীর উপস্থিতি যখন নেই, সুলতানাই তাই একমাত্র দৃষ্টির খোরাক এ মুহুর্তে।
খাবার গুলো পলিথিনে ভরে শক্ত করে মুখ বেঁধে নিতে হবে যাতে বৃষ্টি ভেজাতে না পারে। ম্যানেজারকে টাকা দেবার সময় বলে দিলে ভালো হতো। এখনও বলা যায়, কিন্তু ভেতরে যাওয়ার মন করছে না একটুকু। টাকা নেবার জায়গাটার পাশেই বসে আছে হারামী গুলো, কি দরকার গিয়ে? পরোটার করিগরের উত্তপ্ত তাওয়ার পাশেই তাই জড়োসড়ো দাঁড়িয়ে থাকে মেয়ে।
আচ্ছা, এই ছেলে গুলো যদি এখন তার পিছু নেয়? আগেও একবার নিয়েছিলো, একদিন ভর দুপুরে। সুলতানা তখন বুদ্ধি করে বড় রাস্তায় ঢুকে পড়াতেই না রক্ষা, মানুষজনের ভীড়ে এরা আর কিচ্ছু বলা-কওয়ার সাহস পায়নি।
কিন্তু আজ.. ..
আজ তো পথে-ঘাটে একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। হোটেল থেকে বাড়িন ফিরতি পথে সরু একটা নির্জন রাস্তা পার হতে হয়। রাস্তার এক পাশে আবার গোরস্থান। আসবার পথেই যেমন ভয় ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো কেউ।
অবশ্য সকল ভূত-প্রেতের ভয় ছাপিয়ে মনের মাঝে এখন মানুষের ভয়টাই সবচাইতে বড় হয়ে ওঠে সুলতানার মাঝে। এবং কিছুক্ষণের মাঝে সত্যিও হয়ে ওঠে সেই ভয়টা, যখন বখাটে গুলো পিছু নেয়। ঢিলেঢালা ভঙ্গিতে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব রক্ষা করে আসে পেছন পেছন। বৃষ্টির বেড় একটু বেড়েছে, তাতে কোনো বিকার নেই তাদের। কেবল দৃষ্টি গুলো নিবদ্ধ নারী শরীরটার উপর, না তকিয়েও বুঝতে পারে মেয়ে।
তাড়াতাড়ি পা চালায় সুলতানা। রিতীমতন দৌড়ে চলে। চারপাশ ক্রমশ আরও অন্ধকার হয়ে উঠছে, মনটার মাঝে অস্থির অস্থির লাগছে খুব। লোকগুলো অনেকটা দূরে এখনও,তবে মন বলছে যে এই দূরত্ব কমতে শুরু করবে। আর তারপর কমতে থাকবে আর কমতেই থাকবে কেবল!!
পেছন থেকে ভেসে আসছে শিষ মারার আওয়াজ আসছে এখন। বাতাস বহন করে নিয়ে আসছে লোকগুলোর ছুঁড়ে দেয়া কুৎসিত কুৎসিত বাক্য।
‘.. ..ওরে ছেমড়ি,আমরা কি তোরে কিছু করছি নাকি?.. ..’
‘করুম রে.. ..অনেক কিছু করুম। এত তাড়াহুড়া কিসের?’
‘হায় হায় মেরি জান! উড়নাডা খুলো না ক্যান?.. ..খুলো খুলো! আমরা তোমার স্বোয়ামী, আমাগো লগে শরম নাই।’
‘.. ..ওরে মাগী,একটু পরে তো তিনজনের লগেই শুইতে হইবো। আয় না,কাছে আয়.. ..’
‘ভালো মতন আয় রে,তোরে খুশি কইরা দিবো আমরা। সালোয়ারটা খোল.. .. ..’
‘তিনজনই আমরা মরদের বাচ্চা,আরাম পাইবি অনেক। কাছে আয়!’
‘মনে হইতেছে তিনজনে হইবো না তোর.. .. ..আর কয়জন ডাকুম?’
কুৎসিত হাসির আওয়াজগুলো শরীরের সাথে লেপ্টে যেতে থাকে সুলতানার। ঘৃণায় রি রি করে ওঠে মন, কান্না আসে চোখ ফেটে। কাঁদতে কাঁদতেই এবার দৌড়ে চলে সে। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে কেবল, কসম কাটে আল্লাহ নবীর নামে। আজকের এই বিপদ ে কে রক্ষা পেলে কাল সকাল হওয়া মাত্র বাড়ি চলে যাবে সে, গ্রামে চলে যাবে আম্মার কাছে। দরকার নেই তার শহরে কাজ করে খাওয়ার। না খেয়ে পড়ে থাকবে, তবু বাপজানের পায়ে ধরবে যেন এত দূরে কাজে না পাঠায়।
সুলতানার তখনও জানা ছিল না যে খুব নিকটেই সেই দিন, যখন আর শহরে ঝি গিরি করতে হবে না তাকে পেটের দায়ে। খুব নিকটেই সেই দিন, যখন বাড়ি ফেরা হবে চিরকালের মতন। পার্থক্য শুধু এই যে, সুলতানা বাড়ি ফিরবে না। বাড়ি ফিরবে কেবল তার শরীরটা।
কেননা.. .. ..
পেছনে বাড়তে শুরু করেছে শ্বাপড় দলের পায়ের শব্দ। কমছে ক্রমশ শিকার আর শিকারীর মধ্যবর্তী ব্যবধান!!
পরিশিষ্ট :-
পলিথিনের প্যাকেটের শরীরে মোড়ানো ছিল খাবার গুলো। গরম গরম পরোটা-ভাজি-খাসি পায়া। মামার পরম কাঙ্খিত খাদ্য বস্তু।
এবং লাশ হয়ে যাবার পরও পলিথনের ব্যাগটা শক্ত করে মুঠোর মাঝে ধরাই ছিল সুলতানার। ধর্ষিত হবার সময়েও বেগম সাহেবার হুকুমের তালিম করেছে সে, হাতছাড়া করেনি মূল্যবান পলিথিনটা। কিংবা কে জানে, হয়তো আর কিছু না পেয়েই ব্যগটাকে অবলম্বন হিসাবে আঁকড়ে ধরেছিল তার অসহায় হাতটি।
কারা যেন ধর্ষণ করার পর সুলতানার ক্ষতবিক্ষত শরীরটাকে ফেলে গেছিল সেই কবরস্থানের মাঝেই। বিবস্ত্র, নগ্ন শরীরটাকে। নির্যাতিত, প্রাণহীন শরীরটাকে। মুখ বাঁধা, হাত-পা বাঁধা। শরীরময় ছড়িয়ে থাকা সিগারেটের ছ্যাকার চিহ্ন- বুকে, মুখে আর সেই গোপন অঙ্গেও যার কারণে মেয়ে হয়ে জন্মানোটা অভিশাপ হয়ে গেছে। তের-চৌদ্দ বছরের দেহটা তার সহ্য করতে পারেনি একদল পিশাচের লালসার বাষ্প.. .. ..
মরে গেছে। স্রেফ মরে গেছে!
কখন? কিভাবে?
যখন তাকে ফেলে দেয়া হয়েছিল কবরস্থানের খা খা নীরবতার মাঝে, তখনও কি বেঁচে ছিল মেয়েটা? বেঁচে থাকার প্রাণপন প্রচেষ্টায় চিৎকার করছিল কি তার রোধ করা কন্ঠ?
কাদাজলে মাখামাখি হয়ে কতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছে সে?
নোনা পানিতে জ্বলুনি ধরেছে শরীরের আঁচড়-কামড়ের ক্ষতগুলোতে.. ..নিঃস্বাসের সাথে সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করেছে হিম শীতল জল কণা.. . আর একসময়.. ..
একসময় নিষ্ঠুরতম পৃথিবীটার প্রতি একরাশ ঘৃনা আর অভিমান নিয়ে চলে গেছে সে মৃত্যুলোকের ওপারে। কেউ দেখেনি,কেউ শোনেনি। একদল হিংস্র প্রাণী একটি সদ্য কিশোরিকে ছিঁড়ে-খুড়ে খেয়েছে পরম আনন্দে, আর তারপর পৌছে দিয়ে গেছে মৃত্যুর দোরগোড়ায়-- চাপা দিতে নিজেদের পাপ, চাপা দিতে নিজেদের পরিচয়।
এমনই তো হয়, তাই না?
অহরহ হয়, ভীষণ অবলীলায় হয়। কারও বোধহয় আজকাল কিছু যায়-আসেও না এইসব তুচ্ছ গল্পে। আমাদের সয়ে গেছে চোখ.. ..সয়ে গেছে মন!!
অনেক দিন পর এমন একটা গল্প পড়লাম । পড়ে নিজেকে খুব অসহায় মনে হল । আসলে আমাদের সব সয়ে গেছে , না হলে সেই সব নরপিশাচ রা কিভাবে সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় সুলতানার মত নিরীহ মেয়েদের ধর্ষণ এবং হত্যার পর । সেটা এই সমাজের কাছে আমার প্রশ্ন। চমৎকার গল্পের জন্য বিশেষ ধন্যবাদ আর অনেক শুভকামনা রইল ।
অসাধারণ লেগেছে। আমি দেখেছি আমি বাদে সকলেই দারুন সব লেখা দিয়েছে বই এ
অসাধারন একটা লেখা....
আগেই পড়ছিলাম .... ভালো লাগছে
চমৎকার লেখা।
দারুন লিখছেন! .।।। ভালো লাগছে।
মন্তব্য করুন