মেঘবন্দী (৮) ... বৃষ্টিমুখর দিনরাত্রি / আহমাদ মোস্তফা কামাল
বৃষ্টিমুখর দিনরাত্রি
আহমাদ মোস্তফা কামাল
আমার নাকি জন্ম হয়েছিলো বৃষ্টিভেজা শীতের রাতে, মা’র কাছে বহুবার শুনেছি সেই কথা! মায়ের মুখে সেই জন্ম-বর্ণনা, আহা, কী যে মধুর লাগতো শুনতে -
'তোর জন্ম তো শীতের রাতে। বাইরে ফুটফুটে জোৎস্না এমনকি জোৎস্নার দাপটে কুয়াশাও পালিয়েছে' - দারিদ্রপীড়িত সংসারের মধ্যবিত্ত রূপটি ধরে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টায় রত আমার আটপৌরে মায়ের কণ্ঠে যেন কবিতা ঝরে পড়ে - 'ঘরে তখন দুদুর মা (আমার দাই মা) ছাড়া আর কেউ ছিলো না। আঁতুর ঘরে তখন আর কারো থাকার নিয়মও ছিলো না। হঠাৎ, কী কাণ্ড, শুনি, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ! আমি বললাম, ও দুদুর মা, বাইরের সবকিছু মনে হয় ভিজে গ্যালো, দ্যাখো তো! বুঝিস না, মাটির চুলায় রান্না হতো, খড়ি-লাকড়ি সব বাইরেই রাখা। শীতের দিনে কি কেউ বৃষ্টির কথা চিন্তা করে ওসব ঘরে তুলে রাখে নাকি! এখন যদি সব ভিজে যায়, কালকে রান্না করতে অসুবিধা হবে। দুদুর মা বাইরে গেলো, কিন্তু সবকিছু গুছিয়ে টুছিয়ে ফেরার আগেই তোর জন্ম হলো। বুঝলি, তোর জন্মের সময় ঘরে আর কেউ ছিলো না। যেন এই কাণ্ডটি ঘটানোর জন্যই শীতের রাতেই অমন খা খা জোৎস্নার মধ্যেও বৃষ্টি এসেছিলো।'
'কেন মা, শীতের রাতে বুঝি বৃষ্টি হয় না?'
'হতে পারে, তবে সাধারণত হয় না। তাছাড়া ওই রাতে বৃষ্টির কোনো লক্ষণই ছিলো না। বললাম না, ফুটফুটে জোৎস্না ছিলো, মেঘের ছিটেফোঁটাও ছিলো না। আবার দ্যাখ, হঠাৎ যেমন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এসেছিলো, তেমনি হঠাৎই চলে গ্যালো। ওই কয়েক মিনিটের জন্য।'
মায়ের মুখে এই বর্ণনা কতোবার যে শুনেছি তার হিসেব নেই। হয়তো এজন্যই শীতের রাত, জোৎস্না, বৃষ্টি এই বিষয়গুলো আমাকে নানাভাবে উদ্বেলিত করে, এদের মধ্যে সম্পর্কসূত্র খুঁজে বেড়াই। কখনো পাই, বেশিরভাগ সময়েই পাই না। আর হয়তো তাই, আমার প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘দ্বিতীয় মানুষ’-এর উৎসর্গ পাতায় মা’র এই অনবদ্য বর্ণনাকে ধরে রাখি এইভাবে -
'পৌষের কোনো এক বৃষ্টিভেজা মধ্যরাতে এদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম হয়েছিলো আমার, মায়ের কাছে শুনেছি। হঠাৎ বৃষ্টির সেই শীতের রাতে আঁতুর ঘরে মার পাশে দাইমা নামক আমার অ-দেখা এক মহিলা ছাড়া আর কেউ ছিলো না। উঠোনে রেখে দেয়া প্রয়োজনীয় সাংসারিক অনুষঙ্গ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে দাইমা বাইরে গেলে
প্রায়ান্ধকার ঘরে জন্ম হয়েছিলো আমার।
জন্মেই দেখেছিলাম, আমার চারপাশে কেউ নেই- মা ছাড়া।
আজ, এই এতদিন পর- আমার চারপাশে সহস্র মানুষের ভিড়- তবু মার কাছে ফিরতেই ভালো লাগে আমার।'
বলাইবাহুল্য, লেখকদের প্রথম বইটি উৎসর্গিত হয় তাঁর প্রতি, যাঁর কাছে অপার ঋণ জমে আছে, যে ঋণ কোনোকিছু দিয়েই শোধ করা যায় না। আমার প্রথম বইয়ের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। কিন্তু উৎসর্গটি ওভাবে লিখেছিলাম শুধু ঋণ প্রকাশের জন্য নয়, একইসঙ্গে বহু মানুষের ভিড়ে আমার নিঃসঙ্গতা আর বৃষ্টির সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা বলার জন্যও বটে। সেই যে বৃষ্টির রাতে জন্ম, তারপরও জীবনের বহু বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে এমন হঠাৎ-বৃষ্টি জড়িয়ে আছে।
জোৎস্না ও বৃষ্টির এই কম্বিনেশন হয়েছিলো আবার বাবার মৃত্যুর দিনও। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে বাবা মারা গেলেন। সেটিও ছিলো জোৎস্নাপ্লাবিত রাত। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই শুরু হলো বৃষ্টি। প্রায় সারারাত ধরে ঝিরঝির বৃষ্টি হতেই লাগলো, অথচ জোৎস্না ম্লান হলো না, চাঁদ ঢাকা পড়লো না মেঘের আড়ালে!
২.
এইরকম নানারকম বৃষ্টিমুখরিত-জোৎস্নাপ্লাবিত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ভরে আছে আমার জীবন। একদিনের কথা বলি : আমাদের গ্রামের বাড়িটা ছিলো পদ্মার পাড়ে (সেই বাড়ি এখন নেই, পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে)। তো, বাড়িটা যতোদিন ছিলো, ততোদিন আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিলো ওই নদী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটেছে পদ্মার পাড়ে বসে। পদ্মার পাড়ে যেতাম নেশায়। কী যে আকর্ষণীয় ছিলো জায়গাটা! এক অমোঘ টানে প্রতিদিন বিকেলে গিয়ে হাজির হতাম ওখানে, ফিরতাম সন্ধ্যা পার করে। বিরাট সূর্যটা যখন সারা দিগন্তকে লাল রঙে রাঙিয়ে পদ্মায় ডুব দিতো, তখন চোখে ঘোর লাগতো। পদ্মার রূপও একেক ঋতুতে একেক রকম। বর্ষার পদ্মা রাগী, প্রমত্ত; জল তখন ঘোলাটে। আর শীতের পদ্মা শান্ত, অনুপম; জল তখন স্বচ্ছ, মনকাড়া। এই দুই সময়ে স্রোতের শব্দও পাল্টে যেত! বর্ষায় স্রোতের প্রতিকূলে মাঝিদের নৌকা বাইতে হতো প্রায় যুদ্ধ করে, আর শীতে প্রায় অলস ভঙ্গিতে। গতিময়তার মধ্যেও এইরকম পার্থক্য রচনা করতো বিভিন্ন ঋতু। কিন্তু যে সময়ের ঘটনা বলছি, তখন আমি কিশোর ছিলাম, অনির্দিষ্ট সময় ধরে নদীর পাড়ে বসে থাকার স্বাধীনতা ছিলো না। আমাদের বাড়ির কঠোর নিয়ম ছিলো- সন্ধ্যার মধ্যে অবশ্যই বাড়ি ফিরতে হবে। বিশেষ করে ছোটরা সন্ধ্যার পর কোনোভাবেই বাইরে থাকতে পারবে না। তো সেদিন, প্রতিদিনের মতোই, আমি বিকেলে গেছি পদ্মার পাড়ে। সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসার কথা- কিন্তু ফেরা হলো না। সন্ধ্যা হতে না হতেই বিরাট এক চাঁদ উঠলো আকাশে, আর একটু পরই শুরু হলো চাঁদ ও নদীর এক অপরূপ খেলা। নদীর ঢেউয়ে চাঁদের আলো পড়ে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে, আর চিকচিক করে উঠছে এমনভাবে যেন হাজার হাজার হীরকখণ্ড কেউ ছড়িয়ে দিয়েছে পদ্মার জলে। আরো মজা শুরু হলো খানিক পরই। প্রায় বিনা নোটিশে বৃষ্টি নেমে এলো ঝমঝমিয়ে। জোৎস্না রাতে বৃষ্টি হয় না, এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল- আমি আমার জীবনে বহুবার হতে দেখেছি। যাহোক, নদীর নিজস্ব শব্দ, বৃষ্টির শব্দ, আর চাঁদের আলো এই তিন মিলে এমন এক ঘোর তৈরি করলো যে, আমি যে ভিজে একাকার হয়ে গেছি, বাড়িতে গিয়ে বকা শুনতে হবে সেটা ভুলেই গেলাম। যখন বাড়িতে ফিরলাম ততণে দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেছে। একে তো রাত করে বাড়ি ফিরেছি, তার ওপর কাপড়-চোপর ভেজা, কপালে মার আছে বলে মনে হলো। বড়দের পক্ষ থেকে রাগারাগি-বকাবাজি শুরুও হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মা থামালো। আমি অপেক্ষা করে ছিলাম কখন মা বকবে, কিন্তু মা কিছুই বললো না। রাতে যখন শুতে গেছি তখন মা আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলো-
‘ফিরতে এত দেরি করলি যে, কোথায় গিয়েছিলি?’
‘পদ্মার পাড়ে।‘
‘ওখানে তো রোজই যাস, কোনোদিন তো দেরি করিস না, আজকে করলি কেন? বৃষ্টিতেও তো ভিজেছিস!’
আমি নদী-চাঁদ-বৃষ্টির কম্বিনেশনে তৈরি হওয়া পরিস্থিতিটা মাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিল কিছুতেই পরিস্থিতিটা বর্ণনা করতে পারছি না, কী এক ঘোর যে তৈরি হয়েছিল সেটা কিছুতেই বোঝাতে পারছি না। বোঝাতে না পেরে আমি একসময় কাঁদতে শুরু করলাম।
মা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো- ‘কাঁদছিস কেন? আমি তো তোকে বকাবাজি করিনি...’
‘আমি সেজন্য কাঁদছি না মা।‘
‘তাহলে কাঁদছিস কেন?’
‘আমি তোমাকে বোঝাতে পারছি না, বোঝাতে পারছি না...’
‘কি বোঝাতে পারছিস না?’
‘কী যে হয়েছিল, মানে কেন আমি ফিরতে পারলাম না...’
‘তাহলে তোর কাঁদাই উচিত’- মা নির্বিকারভাবে বললো- ‘যা বলতে চাস সেটা না বলতে পারলে কাঁদাই উচিত।‘
তখন কথাটার মানে বুঝিনি। এখন মনে হয়- মা আসলে বলেছিলেন- যে কমিউনিকেট করতে পারে না, তার কাঁদাই উচিত।
সেই থেকে আমি কমিউনিকেট করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিছু একটা বোঝাতে চাইছি। পারছি না। পারছি না বলে কেঁদে চলেছি। কেউ তা দেখতে পায় না। নিঃশব্দ-অন্তর্গত এই কান্না।
৩.
আমাদের বাড়িতে একটা বড়োসড়ো পুকুর ছিলো। সেই পুকুরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ চাষ করার কথা কারো কখনো মনেই আসেনি। গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে মেয়েরা, স্নান করতো ওই পুকুরে এসে। আর তাছাড়া বর্ষায় মাঠ-ঘাট ভেসে যেত বলে নদী থেকেই প্রচুর মাছ এসে বাসা বাঁধতো পুকুরে, চাষ করার দরকারই হতো না। বর্ষা শেষে আর ফিরে যেতে পারতো না ওরা, রয়ে যেত ওখানেই। তো, চৈত্রের এইরকম সময়ে পুকুরের পানি যখন বেশ কমে যেত, তখন বছরের প্রথম দিকের অঝোর বৃষ্টিতে ঝাঁকে ঝাঁকে কৈ মাছ উঠে আসতো পুকুর থেকে - ডাঙায়। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য ছিলো। মাছগুলো কানকো দিয়ে ঠেলে ঠেলে এমনকি বাড়ির উঠোনেও চলে আসতো। বিস্মিত কিশোর এরকম অদ্ভুত দৃশ্য থেকে চোখ ফেরাতে পারতো না। আর কোনো মাছ তো এভাবে পানি থেকে ডাঙায় উঠে আসে না, কৈ মাছ আসে কেন - ফিসফিসিয়ে ভয়ে ভয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলে মায়ের সরল স্বীকারোক্তি - ’জানি না, বাবা। হয়তো কিছু খোঁজে!’ মাছগুলোকে মারতেও দিতো না মা, সবাইকে বলতো- ’ওগুলোকে মারিস না তোরা, কী যে খুঁজতে এসেছে কে জানে! নইলে কি আর জলের প্রাণী এইভাবে ডাঙায় উঠে আসে!’ কি খোঁজে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি বহুদিন, বহুদিন। বড়ো হয়ে, এই সেদিন মাত্র, এক কৃষিবিজ্ঞানীর কাছে শুনলাম সেই ব্যাখ্যা (সত্য মিথ্যা যাচাই করিনি)। কৈ মাছ গভীর পানিতে ডিম ছাড়ে না, ছাড়ে অল্প পানিতে- সাধারণত ফসলের মাঠে। বর্ষায় পানি নেমে গেলেও সেই ডিম মাঠেই রয়ে যায়, বছরখানেক ধরে রোদ-তাপ-আলো-বাতাস সয়ে পুষ্ট হয়, তারপর আরেক বর্ষায় মেঘের গর্জন শুনেই মা-কৈ গুলো চঞ্চল হয়ে ওঠে, বৃষ্টি শুরু হলে উঠে আসে ডিমের খোঁজে।
ওরা যে মা!
৪.
মানুষের সারাটি জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় তার শৈশব-কৈশোর অর্থাৎ বেড়ে ওঠা দিয়ে। আমার নিজের ক্ষেত্রে অন্তত এটি প্রবলভাবে সত্য। আগেই তো বলেছি, যে বাড়িতে আমার জন্ম ও শৈশব-কৈশোর কেটেছে, তার কাছেই ছিলো পদ্মা। বর্ষার সময় পানি বাড়লে নদীর দু-কূল ছাপিয়ে মাঠঘাট ভেসে যেতো। গ্রামের তখন অন্য রূপ- এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যেতে হতো নৌকায় করে। বৃষ্টিতে ভেজা তখন কেবল একবেলার রোমান্টিসিজম নয়, বরং নিত্যদিনের সঙ্গী। বর্ষাকালের এমন একটি দিনও বোধহয় যায়নি, যেদিন আমরা বৃষ্টিতে ভিজে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোসল করিনি। শৈশব-কৈশোরের যে কয়টি জিনিসের সঙ্গে আমার প্রেম, বৃষ্টি তাদের একজন।
যাহোক, অনেক ব্যক্তিগত কথকতায় ভরা এই লেখায় আরেকটি ব্যক্তিগত ঘটনার কথা বলে প্রসঙ্গ শেষ করা যাক। আগেই বলেছি, আমার জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে বৃষ্টির একটা সম্পর্ক আছে। সেসব ঘটনার অধিকাংশই ছিলো আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি যে মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলাম (আমি অবশ্য একাধিকবার প্রেমে পড়েছি, কিন্তু এই একটি মাত্র মেয়ের সঙ্গে সারাজীবন পাশাপাশি থাকতে চেয়েছিলাম! তবে মজার ব্যাপার হলো মেয়েটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে তা জানানোই হয়নি), তার সঙ্গে খুব আকস্মিক এবং অনিচ্ছাকৃত বিচ্ছেদ ঘটে আমার। বাড়ি থেকে খবর আসে যে, তার মা খুব অসুস্থ। সে বাড়িতে মাকে দেখতে গিয়ে আর ফিরে আসতে পারেনি। মৃতু্যপথযাত্রী মায়ের কথা রাখতে সে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। তো যেদিন ও বাড়িতে যায়, আমার সঙ্গে সেদিন তার দীর্ঘ-দীর্ঘ কনভারসেশন হয়। খরাতপ্ত চৈত্রের দুপুর ছিলো সেটি। সম্ভবত কয়েকবছরের মধ্যে সেটিই ছিলো সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী খরা। বৃষ্টির জন্য, একটু মেঘমেদুর আবহাওয়ার জন্য সারাদেশ তখন কাঁদছে। পুড়ে যাচ্ছে গাছপালা, ফসল, আর মানুষের জীবন। তো, যেহেতু পরস্পরকে ভালোবাসা-ভালোলাগার কথাটি তখনও না বলাই থেকে গেছে, আমি ওর মুখ থেকে সেটা শুনতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু ও ছিলো খুব বিষণ্ন হয়ে, জানি না আমাদের আসন্ন বিচ্ছেদের ব্যাপারটা ও আগেই আঁচ করতে পেরেছিলো কী না! কীভাবে ওর মুখ থেকে কথাগুলো শোনা যায় ভাবতে ভাবতে আমি ওকে বললাম-
'এই যে তুমি কিছুই বলছো না, তার কারণ তুমি এই শহরের পরিচিত গণ্ডির মধ্যে থেকে নিজের মনের দরজা খুলতে পারছো না। অথচ, মনে করো, তুমি এই শহরে নও, আছো নির্জন বনভূমির মধ্যে কোনো এক বাংলোয়। একা নও, ধরা যাক আমার সঙ্গেই আছো। তখন যদি তুমুল বৃষ্টি নেমে আসে, আর তোমার ভেতরের কান্নার সঙ্গে যদি বৃষ্টির কান্না মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তখন দেখবে- এমনিতেই সব কথা বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে, অর্গল খুলে যাবে, অবচেতনের দেয়াল দুর্বল হয়ে যাবে... '
ও নিঝুম হয়ে কথাগুলো শুনছিলো। আমার কথা শেষ হতে একটু হেসে বললো- 'সবকিছু রোদে পুড়ে যাচ্ছে আর আপনি বলছেন বৃষ্টির কথা। আপনি যে কী না! '(তখনও সে 'আপনি' থেকে 'তুমি'তে আসেনি।)
আমাদের কথা থামলো না, বরং ডালপালা ছড়িয়ে মোকাররম ভবনের করিডোর ছেড়ে সেই কথাগুলো আকাশে ডানা মেললো। তারও অনেকক্ষণ পর খেয়াল করলাম, আকাশ কালো হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পরই ঝড়ো হাওয়া আর তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। হাওয়ায় ওর চুল আর আঁচল উড়ে এসে আমার চোখে-মুখে পড়ছিলো। কিন্তু ও ছিলো ভ্রুক্ষেপহীন। বিষণ্ন। একা। ওর চোখে ঘনিয়ে এসেছিলো স্বপ্ন। অথবা ঘোর। অথবা মেঘমেদুর বিকেলের ঘন ছায়া। প্রায় শোনা যায় না, এমনভাবে, ফিসফিস করে ও বললো-
'দেখেছো, প্রকৃতি তোমার কথা শুনেছে!' (এই প্রথম সে আমাকে তুমি করে বললো, আমার শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে গেলো।)
'প্রকৃতি তো শুনলো, মানুষটি যে শুনছে না!'
'মানুষটি তো অনেক আগেই শুনেছে, তুমি বোঝোনি?'
'না বোঝালে কি করে বুঝবো?'
'শুধু কি কথা শুনেছে, সে তো তার সর্বস্ব তোমাকে দিয়ে বসে আছে'-- বলতে বলতে ওর ঘোরলাগা চোখ ভরে উঠলো জলে।
জলভরা চোখ নিয়ে ও চলে গেলো।
তার বহুদিন পর, ওর সঙ্গে হঠাৎ যেদিন দেখা হলো, সেদিনটিও ছিলো বর্ষণমুখর আর চোখ ভরে ছিলো জলে।
৫.
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ গল্পে বৃষ্টির এক অসামান্য বর্ণনা দিয়েছিলেন-
''এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তায় রিকশা চলছে ছল ছল করে...আমার জানলায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলি-লগ্ন আমি কতোদিন পাইনি, কতোকাল, কোনোদিন নয়। বৃষ্টি-বুনোট এইসব রাতে আমার ঘুম আসে না, বৃষ্টিকে ভারি অন্যরকম মনে হয়, বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস। এইসব রাতে কিছু পড়তে পারি না আমি, সামনে বই খোলা থাকে, অক্ষরগুলো উদাস বয়ে যায়, যেনো অনন্তকাল কুমারী থাকবার জন্যে একজন রিক্ত রক্তাক্ত জন্মদান করলো এদের। চায়ের পেয়ালায় তিনটে ভাঙা পাতা ঘড়ির কাঁটা হয়ে সময়কে মন্থর কাঁপায়। ষাট পাওয়ারের বাল্বে জ্বলছে ভিজে আলো, আর চিনচিন করে ওঠে হঠাৎ, কতোদিন আগে ভরা বাদলে আশিকের সঙ্গে আজিমপুর থেকে ফিরলাম সাতটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে, 'তুই ফেলে এসেছিস কারে', সেই সোনার শৈশবে ভুল করে দ্যাখা একটি স্বপ্ন, স্বপ্নের মতো টলটল করে। আমার ঘুম আসে না, আলোর মধ্যে একলা জেগে রই।...''
কতোবার যে পড়েছি এই গল্প! যতোবার পড়ি, ততোবারই মন খারাপ হয়ে যায়।
... আর অনেকদিন পর শহরে বৃষ্টি নেমে এলে ভাবি, কতোদিন পর আজ বৃষ্টি হলো! কতোদিন! কতো যে মুখ ভেসে ওঠে চোখে! কতো স্মৃতি! তুমুল বৃষ্টিতে বাড়ির উঠোনে ভাইবোনদের সঙ্গে কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি খেলছে অথবা টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে আর ঘরে থাকতে না পেরে উঠে গিয়ে বৃষ্টির পানি হাতে-মুখে মেখে নিচ্ছে যে কিশোর, বন্ধুর সঙ্গে রিকশায় যেতে যেতে হঠাৎ বৃষ্টি এলে ওর আপত্তি অগ্রাহ্য করে রিকশার হুড না ফেলেই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আর হেড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে চলেছে যে তরুণ, অথবা তপ্ত খরার পর একটানা বৃষ্টির মধ্যে প্রিয়তম মানুষটির সঙ্গে কথা বলে চলেছে ওই যে যুবক তাকে কেন এত চেনা লাগছে? ওইসব জীবন কি কখনো আমার ছিলো?
বাইরে বৃষ্টির শব্দ বাড়ে। অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে একসময় জানালায় গিয়ে দাঁড়াই। নিরবিচ্ছিন্ন বৃষ্টিতে ধুয়ে-মুছে যাচ্ছে চরাচর। এই শহরের সমস্ত ক্লান্তি, জঞ্জাল, পাপ, বেদনা, আর হাহাকার কেন ধুয়ে মুছে যায় না? কী তুমুল, অহংকারী, একরোখা, জেদী বৃষ্টি। বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তা গ্রাহ্যের মধ্যেই আসে না আমার। মনে হয়, আমাদের গ্রামে ঠিক এইরকম বৃষ্টি হতো। বিড়বিড় করে আমি কেবল বলতে থাকি, উদাসপুর - আমি তোমার কাছে যাবো।
কামাল ভাইয়ের সেরা লেখাগুলোর মধ্যে একটি। আমি আগেও একাধিকবার পড়েছি। এবং সমপরিমাণ মুগ্ধ হয়েছি, যতটুকু আজ হলাম।
অ.ট.পুরো লেখায় পুস্তক সাহেবের একটি টাইপো আছে। সাধারণ জনতার টাইপো মেনে নেয়া যায়, পুস্তক সাহেবেরটা তো মানা যায় না :ডি
লেখাটা আগেও পড়েছি, মুগ্ধ হয়েছি এত বেশী যে বলার মতো কিছুই খুঁজে পাই নাই।
আগেই পড়েছিলাম

অসাধারন একটা লেখা। পড়ে এত বেশী ভাল লাগলো যে কমেন্ট করার জন্যই শুধু লগইন হলাম।
অসাধারণ
ভালো লাগল, বেশ ভালো লাগল।
আমার এক নারী বন্ধু বলেছিল, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সহবাস হয়েছে জ্যোৎস্নার সঙ্গে।
আমার জন্ম হয়েছে ফাল্গুন মাসে। বৃষ্টি হয়েছিল, জন্মের ৭ দিনের মাথায় তুমুল শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। আমি বৃষ্টি ভালোবাসতে ভালোবাসতে বড় হয়েছি। বৃষ্টিতে ভিজতে আজো ভালো লাগে।
ভালো লাগল, বেশ ভালো লাগল।
আমার এক নারী বন্ধু বলেছিল, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সহবাস হয়েছে জ্যোৎস্নার সঙ্গে।
আমার জন্ম হয়েছে ফাল্গুন মাসে। বৃষ্টি হয়েছিল, জন্মের ৭ দিনের মাথায় তুমুল শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। আমি বৃষ্টি ভালোবাসতে ভালোবাসতে বড় হয়েছি। বৃষ্টিতে ভিজতে আজো ভালো লাগে।
এক শীতের বিকেলে (বিকেল তিনটা) ঠিক এই ১৪ ডিসেম্বর আমার নিজেরও জন্ম... এই লেখা অন্যত্র পড়েও নস্টালজিক হয়েছিলাম, যতবার পড়বো সবসময় স্মৃতিকাতরতায় ভুগবো। বরং বেশি আর না পড়ি
কামাল ভাই লুকটা কুথায়?
আবারও মুগ্ধ।
মুগ্ধতা রেখা গেলাম বলা যাবে না... তাহলে কামাল ভাইয়ের অন্য লেখায় মুগ্ধ হওয়া যাবে না
... তবে মুগ্ধতায় আছি 
ভালো লাগলো।
মন্তব্য করুন