বিবিধ স্মৃতি বহন করে দু'বছর পরই ৫০ হবো, সেঞ্চুরির স্বপ্নও দেখি! (পর্ব-১)
বয়স নিয়ে অনেকের লুকোচুরি থাকলেও আমি বেশ বড়াই করি নিজের বয়স নিয়ে। মনে করি, বয়সও আমার অন্যতম সম্পদ। হিসেব করার চেষ্টা করি, কী পেলাম আর পেলাম না। ব্লগ আঙ্গিনায় আমার মত বয়স্ক হয়ত খুব বেশী নেই, কিন্তু আমি চেষ্টা করি চলমান প্রজন্মের মেধাবী মানুষগুলোর চিন্তার সাথে পরিচিত থাকার। দেখি, আমার চিন্তা/উপলব্ধির ব্যাপারে আমরাবন্ধুর ব্লগাররা আগ্রহী হন কি-না।
১. সুন্দরবন সংলগ্ন এক গ্রাম্য জনপদে কিশোরী মায়ের কোলে জন্ম নিয়ে নানাবাড়ীতে পরম আদরে বড় হচ্ছিলাম। আমার হাজী সাহেব দাদু ছিলেন কোমল মনের কিন্তু কর্কশ আচরণের সমাজপতি মানুষ। কি যে ভয় পেতাম তাকে! হিটলারের কর্মচারিদের কিভাবে দিন কাটতো- ঐ বয়সে টের পেয়েছিলাম।
২. ছয় বছর বয়সে ছোট ভাই আর বোনকে নিয়ে করাচি গেলাম বাবার কর্মস্থলে উড়োজাহাজে চড়ে। মধ্য আকাশে জানালা দিয়ে সাদা মেঘের স্তুপে তাকিয়ে তাকিয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমরাতো আকাশে উঠেছি আল্লাহকে দেখছি না কেন? জীবনে গাড়ীতেও না চড়া ভীত-সন্ত্রস্ত্র মা হেসে ফেললেন। সেই হাসিটুকু এখনো চোখে ভাসে।
৩. একাত্তরের যুদ্ধে শক্রর মাঝে বসবাস কী ভয়ঙ্কর ছিল। ভারত যখন বিমান হামলা শুরু করল, করাচির বাসিন্দারা দেখলাম তেলের স্থাপনাগুলো দিনের পর দিন জ্বলছে। রাতে সাইরেনের শব্দ হলেই বাবা সবাইকে নিয়ে সিঁড়িতে বসাতেন। মুখে রুমালের অর্ধেকটা চিবিয়ে ধরে দুই কোনা কানে চেপে ধরতাম। আমাদের বেশী ভয় ছিল ওখানকার অবাঙালিদের। তারা সুযোগ পেলেই হেনস্তা করতো বাঙালিদের। আমাদের পাশের এলাকার একটি ঘটনা শুনেছিলাম। ব্লাক আউটের সময় এক বাঙালি মা তাঁর সন্তানের জন্য হারিকেনের টিমটিমে আলোতে দুধ বানাচ্ছিলেন। উর্দুওয়ালার লোকাল ক্যাডাররা সেই বাসার দরজা ভেঙে শিশুটিকে কেড়ে নিয়ে রাস্তায় আছড়ে মেরে ফেললো।
৪. বাঙালি চাকুরজীবিদের হঠাৎ হঠাৎ আটক করে কোথায় যেন নিয়ে যেত। আমরা বাবাকে নিয়ে ভয় পেলাম। চাকরি-টাকরি ছেড়ে খুব গোপনে দূরের এক এলাকায় চলে গেলাম। সেখানে যে বাড়ীতে ভাড়ায় উঠলাম, পরে জানা গেল সেই বাড়ীওয়ালার জামাই আর্মির অফিসার হিসেবে বাংলাদেশে যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। আমরা পড়লাম টেনশনে। বাড়ীওয়ালার প্রতিবেশীরা তাঁকে উস্কানি দিল আমাদের উপর প্রতিশোধ নিতে। সদয় বাড়ীওয়ালার উত্তর ছিল, এরাতো আর জামাইকে হত্যা করেনি। এদের কী দোষ? বরং ভাড়াটিয়া হিসেবে এরা এখন আমানত, এদের কোনো ক্ষতি করা যাবে না।
৫. বাড়ীওয়ালার ৫/৬টি ছেলে আর দুইটি মেয়ে। তাদের বড় আকারের যে মুদি দোকান, সেখানে আমার চেয়ে কিছু বড় যারা ছিল তারা কিভাবে টাকা চুরি করতো! আমাকে ব্যবহার করে যে পদ্ধতিতে টাকা সরাতো, তা হচ্ছে: সওদা আনতে গিয়ে আমি হয়ত দিতাম ১ রুপিয়ার নোট, কিন্তু ক্যাশে বসা সেই ছেলে (আমার পাড়াতো সিনিয়র ভাই) ঘোষণা দিত আমি ৫ রুপিয়া দিয়েছি। সেভাবে বেশী টাকা ফেরত দিয়ে পরে আমার কাছ থেকে বুঝে নিত।
৬. মোটামুটি পুরনো হওয়ার পর একদিন ওপরতলায় বাড়ীওয়ালাদের বাসায় গেলাম। হঠাৎ সাদা বর্ণের এক কিশোরী মেয়েকে দেখলাম ঘরদোর গোছাচ্ছে। জানা গেল সে বাড়ীওয়ালার ছোট মেয়ে। কখনো দেখাতো দূরের কথা তার কণ্ঠও শোনা যায়নি। তার অবরুদ্ধ জীবন-যাপন ঐ বয়সে আমাকে ব্যথিত করেছিল। মনে হচ্ছিল, কাঠের নিচে আটকে থাকা কোনো আরশোলা আলোর অভাবে সাদা হয়ে আছে। পাকিস্তান এখনো ঐ অবস্থানে আছে বলেই দেশটি শেষ হয়ে যাচ্ছে।
ভালো লাগলো আপনার অভিজ্ঞতার শেয়ার নিতে পেরে। পরের পর্ব শীঘ্র আসুক।
আপনাদের সেই বাড়িওয়ালি ই প্রমাণ করেন, সব কালে সব দেশেই ভালো মানুষ ও থাকেন। হয়তো তারা চাপা পড়ে যান অনেক বড় বড় অমানবিকতার কাছে !
হ্যা, এরকম মানসিকতার মানুষ সব যুগে সব জনপদে থাকেন বলেই সভ্যতা মানবতা শম্ভুকগতিতে হলেও এগোচ্ছে। তবে নষ্টদের দাপটে তাঁরা চাপা পড়ে থাকেন বলেই আমরা তাঁদের সহজে চিনতে পারি না। ঐ বাড়িওয়ালা যেখানেই থাকুন, প্রার্থনা করি তিনি ভালো থাকুন।
উৎসাহ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। পরবর্তী পর্বগুলো দ্রুত লেখার চেষ্টা করবো।
স্মৃতিচারণ পড়তে সবসময়ই ভালো লাগে। আপনি যে খালি ঘটনা না বইলা তারসাথে নিজের অবজারভেশনও লিখতেছেন এই ধরণটা ভালো লাগলো...
ধন্যবাদ।
রিটায়ার্ড চাকরিজীবীদের পাল্লায় পড়লে বোঝা যায়, স্মৃতিচারণ কী জিনিস। আমি খুব এনজয় করি অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের বকবকানি। তবে উপসংহার টানি, আপনাদের প্রজন্ম আরো ভালো আর দক্ষ হলে দেশটা আরো ভালো থাকতো। ফলাফল, মুখ কালো করা বা ক্ষেপে যাওয়া। আমি তখন মানে মানে কেটে পড়ি।
লেখা পড়ে আরাম পাইলাম, ভালো লাগছে। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
টিনের বাক্সে
ধন্যবাদ। এমন এন্টিক কয়েনের অরিজিনাল রিসিট নিতে ভুলবেন না। কুরিয়ারে পাঠিয়ে দেবো।
লেখা ভালো লাগলো। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
আর আপনার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা থাকলো যেন সেঞ্চুরী করতে পারেন।
এতক্ষণে 'বুড়ো'র জন্য কারো মায়া হলো। দোয়া করার জন্য ধন্যবাদ। আপনিও সেঞ্চুরি করুন। অনেক অনেক বছর পর এই এবি সেঞ্চুরিয়ানে ভরে যাক।
৪ নাম্বারে বর্ণিত পাকিটার সম-মানসিকতার অনেক পাকি সেই সময় ছিলো। কিন্তু সূর্যের আলোয় তারাদের হারিয়ে যাওয়ার মতই পাকিদের ব্যাপক অপকর্মের যজ্ঞে হারিয়ে গেছে তাদের কারো কারো ছিটেফোঁটা মানবিকতার গল্পও।
আপনার ৫০ হবে আর মাত্র দু বছর পর আমার হবে ৭বছর পর। বয়সটা আমাদের নয়। তা দিয়ে পরিমাপ করা হয় দেহের ঋজুতা অথবা দৌর্বল্য।
বয়স মানে নানাবিধ অর্জন। তবে আফসোসের মাত্রা ব্যাপক হলে বয়স মানে হয়ে যায় দুঃখস্মৃতির বোঝা। জীবনে যা-ই হোক না কেন, আফসোস করা যাবে না।
ভালো লাগল স্মৃতিচারণ। লেখা চলুক।
উৎসাহ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
লেখাটা ভালো লেগেছে। স্মৃতিচারনের সিরিজ চলুক।
চলুক স্মৃতিচারণ.।.।.।.।

লেখা ভালো লাগলো। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
মন্তব্য করুন