মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি)
কিছদিন আগে খবর এলো, এবছরের নভেম্বরের পর থেকে এমআরপি (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) ছাড়া সব ম্যানুয়েল পাসপোর্ট বাতিল হয়ে যাবে। এখন আবার হজ্বের মৌসুম, এর উপর এমআরপি করার তাড়া, স্বভাবতই পাসপোর্ট অফিসে ভিড়ভাট্টা থাকারই কথা। ভেবেছিলাম না জানি কি যন্ত্রনা আর সময় লাগে এমআরপি করতে গিয়ে; কিন্তু কারুর সাহায্য ও পরামর্শ ছাড়া নিজেই আবেদনপত্র জমা দিয়ে মাত্র সাত কার্যদিবস মধ্যেই পাসপোর্ট হাতে পেয়ে গেলাম! হ্যাঁ, এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু যত অনিয়ম-অস্বাভাবিক নিয়মতান্ত্রিকতার মাঝে এটুকু স্বাভাবিকত্বে যারপরনাই খুশিই হয়েছি।
ডিপার্টমেন্ট অব ইমিগ্রেশন এন্ড পাসপোর্টের অফিসিয়াল সাইট (www.passport.gov.bd) থেকে "এমআরপি অনলাইন ইন্সট্রাকশন" দেখে জেনে নিন ফর্ম পূরনের নিয়মাবলী। নিয়ম মেনে অনলাইনে ফর্ম পূরন করে সহজেই পেয়ে যাবেন নির্দিষ্ট ডিজিট এবং বারকোড সংবলিত ডাউনলোড যোগ্য আপনার পূরনকৃত একটি ফর্ম; আগে পাসপোর্ট অফিস থেকে এই ফর্মটাই পাওয়া যেত যাতে লিখে জমা দিতে হতো, ফর্মটি এখনো পাওয়া যায়। অনলাইনে ফিলআপ করা এই ফর্মটি ডাউনলোড করে পরবর্তী ১৫দিনের মধ্যে যেকোন দিন পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে যথাযথ স্থানে জমা দিয়ে ছবি তোলা, হাতের আঙ্গুলের ছাপ দেয়া ইত্যাদি আনুসাঙ্গিক কাজ করে সহজেই পেতে পারেন পাসপোর্ট হাতে পাবার তারিখ। অনলাইনে ফর্ম সাবমিট করার ১৫দিনের মধ্যে পরবর্তী কাজ না করা হলে পূরনকৃত তথ্যাদি সিস্টেম থেকে মুছে যায়, পুনরায় ফর্ম পূরন করতে হয়।
অনলাইনে পাওয়া তথ্য দিয়েই যেমন শুরু করেছিলাম কাজ, সেই অনুযায়ী জানতাম, জরুরী পাসপোর্ট ফি ৬০০০ টাকা আর রেগুলার পাসপোর্ট ফি ৩০০০ টাকা। টাকা জমা দিতে গিয়ে সোনালী ব্যাংকের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পরে জানা গেলো ফি বেড়েছে! কিন্তু পাসপোর্ট সংক্রান্ত কোন সাইটে এই তথ্য দেয়া নেই! বর্তমানে জরুরী পাসপোর্ট ফি ৬৯০০ টাকা যাতে পাসপোর্ট হাতে পাবেন ৭দিনের মাঝে, আর রেগুলার ৩৪০০ টাকা সময় লাগবে ২২দিন। জমা রশিদে লেখা হচ্ছে ৬৯০০টাকা কিন্তু বাড়তি ১০টাকা নেয়া হচ্ছে কোন রশিদ ছাড়াই! লোকজন কিছু না জিজ্ঞেস করেই দিয়ে দিচ্ছেন এই বাড়তি ১০টাকা। যেই জানতে চাইলাম, এটা কেন নেয়া হচ্ছে? মহা ব্যস্ত ব্যাংককর্মী অবাক হয়ে আমাকে দেখতে লাগলেন! পরে জানালেন, এটা "প্রসেসিং ফি"; ব্যাংক থেকে পাসপোর্ট অফিসে টাকা-রশিদ পাঠাচ্ছেন, এটা তার খরচ! মূল রশিদে এটার উল্লেখ নেই কেন জিজ্ঞেস করতেই, এবার যেন আকাশ থেকে পড়লেন মুখ করে, জানতে চাইলেন, আমি কি মাত্র(!) ১০টাকার রশিদ চাইছি নাকি? চাইলে উনি দিবেন তবে সময় লাগবে সেই রশিদ বই কোনদিকে যেন আছে! অনেকক্ষন লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, আমার পরেও অনেকে আছেন - এমনি বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে কেবল নিজের রশিদ্গুলো বুঝে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। রশিদ ছাড়াই ব্যাংক এই যে ১০টাকা নিচ্ছেন এটা আদৌ কতটুকু যুক্তিযুক্ত? আর এটা কোন ব্যাংক সুনির্ধারিত মূল্য নয় বুঝাই গিয়েছে, কারন এক গ্রাহক ৮টাকা দেখিয়ে বললেন, ১০টাকার ভাংতি নেই, ব্যাংককর্মী সেই ৮টাকাই নিলেন!
ফর্মপূরনের নিয়মাবলী জেনে হাতে কাছে যেসব তথ্য নিয়ে অনলাইনে ফর্মপূরন শুরু করবেন তা হলো - জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বার (আবশ্যক), জন্মনিবন্ধন নাম্বার (আবশ্যক), টিন নাম্বার (যদি থাকে), পুরনো পাসপোর্ট থাকলে সেই নাম্বার, টাকা জমাদানের রশিদ নাম্বার। নাম ঠিকানা তো নিজেরই জানা।
ডাউনলোডকৃত ফর্মটি, ছবি,প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ফটোকপি, যেমন -জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন পত্র, টিন নাম্বার ইত্যাদি, ফাষ্টক্লাশ গেজেটেড অফিসার দ্বারা সত্যায়িত করে নিতে হবে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের ঝামেলায় নাকি অনেকেই পড়েন; শুনেছি, তাই সতর্কতা হিসেবে পুলিশের চেনা বড়কর্তা দ্বারাই ফর্মটি সত্যায়িত করে নিয়েছিলাম। নানান কাগজপত্রের সাথে যদি আবেদনকারী অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা হয়ে থাকেন তবে এনওসি হিসেবে অবসরের প্রমানাদি জমা দিতে হবে। ( না জানার কারনে বাবার এই কাগজ নিয়ে যাইনি, পাসপোর্ট অফিস থেকে আবার ঘরে ফিরে এসে আর তো খুঁজে পাইনা, দরকারের সময় প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যাবেনা এটাই যেন অমোঘসত্য! পরে হাতের কাছেই 'পেনশনের বই' পেয়ে সেটার ফটোকপি দিয়ে কাজ চালিয়েছি!) সত্যায়িত ফর্মটিতে টাকা জমাদানের রশিদ আঠা দিয়ে লাগিয়ে সাদা রঙ বাদে অন্য যেকোন রঙের কাপড় পরে সাজ দিয়ে এবার চলে যান পাসপোর্ট অফিস।
যত সকালবেলা আগারগাওঁ পাসপোর্ট অফিস যেতে পারবেন ততই কম দীর্ঘ লাইনে পড়বেন। মেইনগেট দিয়ে ঢুকে হাতের বাঁয়ের লাইনে দাঁড়িয়ে যান, এখানে গেটক্লিয়ারেন্স সিল দেয়া হয়। এখানে মেয়েদের লাইন আলাদা এবং আশ্চর্যজনক রকমের ছোট, ছেলেদের লাইনের তুলনায়! তাই চাইলে সাথে করে বোন/বান্ধবি কাউকে নিয়ে যান এই লাইনের দীর্ঘসূত্রতা এড়াতে!মেইনগেট দিয়ে গটগট ঢুকে যাবেন না উপরেরতলার দিকে; কারন জমাদানের তাবৎকর্ম সাধন করে ঠিক ছবি তোলার মূহুর্তে এই গেটক্লিয়ারেন্স সিলটা না থাকার কারনে, আমাকে দৌড়াতে হয়েছিল সেই গেইটের কাছেই! গেইটক্লিয়ারেন্স সিল নিয়ে যেতে হবে তিনতালার ৩০২ নাম্বার রুমে , সেখানে যাবতীয় কাগজ পরীক্ষার পর, অনুমোদনের স্বাক্ষর-সিল পাওয়া যাবে। কারুর যদি এমআরপি রিইস্যূ করতে হয়, তবে প্রয়োজনীয় একপাতার ফর্মটি এখানেই পেয়ে যাবেন। অনলাইন থেকে এই রিইস্যু ফর্ম ডাউনলোড করা গেলেও ফন্টভাঙ্গা হয়ে হাবিজাবি দেখায়। এবার নামুন নীচতালায়, লিফটের কাছে দড়িঘেরা একটা খোলা অংশের নাম্বার দেয়া ১০৫, এখানে এসে ফর্মে এক সিল নিয়ে আবার দে-ছুট চার কিবা পাচঁতলায়। আক্ষরিক অর্থেই ছুট লাগাতে হবে যেহেতু বিশাল লাইনের মানুষদের সবেধন নীলমণি দু'খানা টুনিটেক সাইজের (বড়জোর ৫জনের ক্ষমতাসম্পন্ন) লিফটের একটাই নষ্ট! যখন চালু থাকে সব জায়গায় এক্সেস থাকলেও সে চলে যায় সাততালায়! এর চেয়ে নিজের পদযুগল কাজে লাগানোই শ্রেয়।
চারতলায় নতুন এমআরপি'র ছবি তোলা-আঙ্গুলের ছাপ- সিগনেচার নেয়ার লাইন, আর পাচঁতলায় রিইস্যূ'র। নতুন এমআরপি'র লাইন অপেক্ষাকৃত কম, রিইস্যুর তুলনায়। এতক্ষনের যতকাজ চলেছে সবখানেই লাইনে দাঁড়াতে হলেও তা কম সময়ের জন্যে, যত বেশি সময় এই ছবি তোলার এখানেই লাগে। অনেকক্ষন থেকে ভাবছিলাম, এত যে শুনেছি, পাসপোর্ট অফিস দালালদের আড্ডাখানা, নিজে চাইলে কিবা না চাইলেও যেচে চলে আসে দালালরা, কারুর দেখাই তো পেলাম না। বসে থেকে থেকে একেকজনের সাজপোষাক দেখছি, আহা সেকি সাজের বাহার! ভালই উৎসব আমেজ যেন। এর মাঝে একজনের সাথে কথা বলতে গিয়ে জানলাম কাংক্ষিত দালালের কাজ! মজা করে বলছিলেন, "আজ জমা দিবো কালই পেয়ে যাবো পাসপোর্ট!" অবশ্যই দালালের মাধ্যমে চলছে কাজ, এইক্ষেত্রে প্রতি পাসপোর্টে খরচ ১২০০০টাকা! ৬৯০০টাকা ফি আর বাদবাকি দালাল ফি! এই দালাল লোকটার চেহারা এতোই স্মার্ট যে অবাক হয়ে গেছি! এতক্ষন ভেবেছি মহিলার আত্নীয়! রিইস্যুর জায়গায় প্রতীক্ষার সময় বেশি তাই কত কি দেখতে লাগলাম বেশি বেশি! বিশাল লাইনের চিপা দিয়ে কারুর ঢুকে যাওয়া, আবার যাবার সময়ে ইচ্ছেমতো গালাগাল শুনেও নির্বিকারের সরে যাওয়া; দীর্ঘ লাইনে পেছনে থাকলেও বয়েস্কদের এগিয়ে দেয়া, বাচ্চাদের নানান দুষ্টুমি। এখানে দালাল হিসেবে যাদের দেখলাম আবারও অবাক হয়েছি। একজনের নোটারী পাবলিকের সিল আর এটাচটেড করা দরকার কিছু কাগজ, দরকষাকষি করে ৩৫০০টাকা থেকে ২৫০০টাকায় রফা হয়েছে! এই দালাল কি করে খুঁজে পেলেন জানতে চেয়েই না অবাক হবার পালা। আনসার সদস্য! যাদের আপনি দেখতে পাবেন সহজেই পাসপোর্ট অফিসের গেইট থেকে শুরু করে সবখানেই। তবে সব আনসার সদস্যকে দালাল ভেবে নেয়াটা সঠিক হবে বলে মনে করিনা।
লাইনের শেষে পৌছে যার কাছে ছবি তোলার জন্যে যাবেন, এই ব্যক্তি সিভিলিয়ান; পাসপোর্ট জমাদানের পুরো প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয় আর্মির সদস্যদের দ্বারা, এতে করে শৃঙ্খলা বজায় থাকছে। ছবি তোলা, সিগনেচার করা, হাতের আঙ্গুলের ছাপ দেয়া শেষ করা হলে, পাসপোর্ট ডেলিভারি পাওয়ার তারিখ উল্লেখকৃত স্লিপ পাওয়া যাবে। আজকের মতো কাজ শেষ।
পাসপোর্ট ডেলিভারির তারিখের ২দিন আগে আপনার মোবাইলফোনে এসেমেস আসবে, এবং আপনার আইডিতে মেইল আসবে; দু'টোতেই জানানো হবে আপনার পাসপোর্ট তৈরী হয়ে গেছে। নির্ধারিত দিনে গেইটের বা'দিক দিয়ে গিয়ে দো'তলায় আগেরদিনে পাওয়া স্লিপটা জমা দিতে হবে। এখানেও মেয়েদের লাইন আলাদা এবং তা আশ্চর্যরকমের ছোট্ট! স্লিপ জমাদানের পর শুরু অপেক্ষার পালা। এইদিনও যত সকালবেলা আসা যায় ততই জলদি পাসপোর্ট পাওয়া যাবে। মাইকে নাম ধরে ডেকে নিয়ে যার পাসপোর্ট তার হাতেই দেয়া হয়।
এইমাসের ৯তারিখে ফর্ম জমা দিয়ে ২০তারিখ পেয়েছি পাসপোর্ট; এর মাঝে ৪দিন ছিলো সরকারী ছুটিরদিন। ৩জনের পাসপোর্টের কাজ করতে প্রথমদিন ঘন্টা তিনেক আর শেষদিন ঘন্টা দুয়েক সময় লাগল। পুরো প্রক্রিয়াতে কোথাও কোন সমস্যা হয়নি, লাইনে অপেক্ষা করাতেই যা কিছু বিরক্তিকর ছিলো, কিন্তু এটুকু সহনীয়ই।
তাই কি অন্যের উপর নির্ভর না করে নিজেই করে ফেলতে পারেন এমআরপি অনলাইনেই।
আবার কই যাইবেন আফা?
পাসপোর্ট ঠিক করলাম কেবল, এখনো যাওয়া না যাওয়ার ঠিক নাই।
দরকারি পোস্ট। কাজে লাগবে সবার।
যাদের পুলিশ দুলাভাই নাই তারা কি করবে?
মন্তব্য করুন