পরস্পর
জীবনের এতগুলো পথ পেছনে ফেলে এলেও তাকে মানসিক সঙ্গ দেওয়ার মতো কাউকে পায়নি আজাহার। হতে পারে সে নিজেই ততটা জরুরি মনে করে সন্ধান করেনি বা সেই সময়গুলোতে এগিয়ে আসতে আগ্রহ বোধ করেনি কেউ। মোটকথা প্রেম বলতে যতটা বোঝায় তার ছিঁটেফোঁটাও তার জীবনে নেই বললেও চলে। যদিও একজন ভালো আর দায়ীত্ববান স্বামী হয়ে দুটো সন্তানের যাবতীয় নির্ভরতার স্থল হয়ে উঠতে পেরেছিলো। প্রেম যে একেবারেই নেই তা বলাটাও হয়তো মিথ্যারই নামান্তর হবে। প্রেম বলতে আছে দাম্পত্য প্রেম। আর সে প্রেমও যেই সেই নয়। কখনো কখনো নিদারুণ অশান্তির দ্রোহে জ্বলে ওঠে সেই প্রেমের লকলকে বহ্নি। যে কারণে এক সময় নিজের সঙ্গেই ক্রমশ যুঝতে যুঝতে এক সময় আপস করে নিয়েছিলো। যে আপসের ফল স্বরূপ নিজেকে ভাগ করে নিতে বাধ্য হয়েছিলো দুটো সত্ত্বায়। তখনই আরো ভালো করে সে অনুভব করতে পেরেছিলো যে, প্রতিদিনকার ঔজ্জ্বল্যের ভেতরও আছে আরেকটি আজাহার। যে বড্ড নিঃসঙ্গ। লাজুক। মিতভাষী। আশপাশের যাবতীয় দুখ-যন্ত্রণা যাকে মোটেও স্পর্শ করে না।
তাহলে কি সে নিষ্ঠুর? তাও না। তার একটা শৈল্পীক গুণ আছে। যে কারণে সে নিজেকে মনে করে শিল্পী। সেই শিল্পীটির সন্ধান দীর্ঘকাল কেউ পায়নি। না পেয়েছে স্ত্রী। না পেয়েছে সন্তানরা। বাইরের লোকের কথা বাহুল্য। স্ত্রী-সন্তানের পাশে শুয়ে থেকেও যে, তার সময় কাটছে নিদারুণ নৈঃসঙ্গে তা দিনে দিনে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছিলো। ফলত: ভালো স্বামী আর পিতাটির গেরস্থ মন চলে গেল গৃহ-ধর্মের দিকে। সেই সঙ্গে স্ত্রী-সন্তানের কাছ থেকে চিরতরে আড়াল হয়ে গেল তার শিল্পী মনটি। তারপর থেকেই যেন তার শিল্পী সত্ত্বাটি নিদারুণ তিতিক্ষায় সময় গুণছিলো আরেকজন শিল্পীর প্রতীক্ষায়। যে তাকে সত্যিই বুঝতে পারবে। তার অন্তর্গত নৈঃসঙ্গকে দূর করে দেবে তার প্রজ্ঞার বিভায়। যুগান্তরের পরিক্রমায় যে একাকীত্ব ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠেছিলো ঘন থক থকে কালো মাটির মতই গাঢ় অন্ধকারে। কিন্তু যা তৈরি হতে বা জন্ম নিতে খুব দীর্ঘ একটি সময়ের আবহে কাল কাটায় তার অবসান বা তিরোধান তেমন একটা দ্রুত ঘটে না। সম্ভবও হয়তো নয়। আর তাই হয়তো সম্ভাবনার সিম্ফনীতে শিহরিত হলেও সে সম্ভাবনাটি তার কাছে সন্দেহের কিম্ভূত বিভিষীকা হয়েই ধরা দিয়েছিলো। তার অন্তর্গত শিল্পী সত্ত্বাটি যে ভাবে এতকাল তার চতুশপার্শ্বের মানুষের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলো, সে মানুষটিই আবার শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলো নিজের অস্ত্বিত্ব বিনাশের আতংকে। তবু সে হিমাদ্রির মৌণতা ভেঙেই যেন সরব হয়ে উঠেছিলো প্রথমবারের মতোই। শংকা কাটাতে নিরুপায় হয়ে মুখোমুখি হয়েছিলো বিরূপ পরিস্থিতির।
সেদিন দশটা কি সাড়ে দশটা হবে তার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়েছিলো আজাহারের পাবলিক লাইব্রেরির ছোটদের বিভাগের প্রশস্ত দরজায়। জীবনে যত মানুষ চোখে পড়েছে, তাদের ভেতর কোনো নারী বা পুরুষের দিকে তাকিয়ে অকস্মাৎ চমকে ওঠার মতো অভিজ্ঞতা তার হয়নি। অথচ সকালের প্রায় জন বিরল সেই সময়টিতে যখন, যুবক যুবতীর নানা আকৃতির জোড়ার পদভারে মুখর হয়ে ওঠেনি সবুজ ঘাসের চত্বর কিংবা অপেক্ষমান অথবা কোনো একটি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করার উদ্দেশ্যে আসা বিভিন্ন বয়েসের ছেলেমেয়ে দখল করেনি মূল লাইব্রেরিতে ওঠার নন্দিত সিঁড়ির ধাপগুলো, ঠিক তেমনই একটি বিরল মুহূর্তে নিজেকে চমকে দিয়ে সত্যি সত্যিই চমকে উঠেছিলো আজাহার। আর সেই চমকানোর ভেতর দিয়েই যেন তার অস্তিত্বের পলেস্তারার নিচে ঘাপটি মেরে থাকা এতকালের নৈঃশব্দ, নৈঃসঙ্গ আর জন বিমুখতাকে দৃঢ়তাকে ভেঙে-চূড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিয়েছিলো।
হয়তো সেও তেমনই চমকে উঠেছিলো আজাহারের অন্তর্গত যুগান্তরের নির্জনতা আর নৈঃশব্দের ভাঙার শব্দে। যে কারণে তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আট-দশ বছর বয়সের মেয়েটি তার সঙ্গ ছেড়ে দিয়ে কখন চলে গিয়েছিলো তার জন্য নির্ধারিত পাঠ কক্ষে তা-ই যেন টের পায়নি। আজাহারের মুখের দিকে সে তাকিয়েছিলো কোনো আড়াল থেকে অকস্মাৎ সূর্য বা চাঁদ উঁকি দেওয়ার মতো করে কালো গভীর মায়াময় দুটো চোখ তুলে। বাঁ চোখের পল্লবের ওপর একটি আঁচিল জাতীয় কিছু যা তার দৃষ্টিকে খানিকটা ছোট করে রেখেছিল। তেমনই আরেকটি কালো আঁচিল বাঁ গালের নিচে থুতনীর কাছাকাছি থাকায় দুটি কালো মিলে কোনো এক রহস্যময় কারণে যেন একটি অদৃশ্য লম্ব তৈরি করে রেখেছিলো তার অবয়বে।
আজাহারের মনে হচ্ছিলো যে, তার মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকলেও যেন তখনও কাটেনি তার ঘুমের ঘোর কিংবা সে তাকিয়ে আছে সহস্র কিলোমিটার দূরের কোনো দ্বীপ থেকে। যেখানে সে নিজেও দাঁড়িয়ে আছে একাকী নিদারুণ নৈঃসঙ্গকে আশ্রয় করেই। বরং তার নৈঃসঙ্গের নির্মমতা যতটা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছিলো আজাহারের দৃষ্টিতে বা অনুভবে, আজাহারকেও যেন ঠিক তেমনই কোনো এক মাপকাঠি দিয়ে বিচার করতে পারছিলো অবলীলায়।
তাদের সেই স্তব্ধতা বা সময় বিমূখতা খুব বেশিক্ষণের জন্যে ছিলো না। বড়জোর কয়েক পল মাত্র হতে পারে। আর এতটুকু সময়ের ভেতরই যেন পরস্পর পরস্পরের ভেতরকার আকুতি সমূহের ফুটন্ত বুদবুদের ভাষাও পড়ে নিতে পেরেছিল। যে কারণে তাদের বোধে এমন একটি বিশ্বাসের জন্ম হতে পেরেছিল- আসলে এর জন্যেই আমি এতকাল প্রতীক্ষায় ছিলাম। যে প্রতীক্ষা জন্মান্তরের কিংবা তাদের পরস্পরের ভেতর এমন কোনো এক সম্পর্ক রয়ে গিয়েছিলো যা কোনো কালেই পুরোপুরি বিযুক্ত করতে পারেনি তাদের। অথচ তারা বিচ্ছিন্নই ছিলো এতকাল। কিন্তু তাদের নিউরোন সেলের অদৃশ্য তরঙ্গ ঠিকই পরস্পরকে ছুঁয়ে ছিলো কোনো ভাবে। যে কারণে তারা বুঝে হোক বা না বুঝেই হোক কিংবা সময়ের পরিক্রমনের ধারায় হয়েছিলো ফের কাছাকাছি।
বস্তুত, তারা যে কোনো ভাবেই হোক কাছাকাছিই ছিলো এতকাল। পার্থক্য হচ্ছে, কেউ কাউকে চাক্ষুষ করেনি। আবার এমনও হতে পারে যে, সময় নিজের হাতেই দায়ীত্বটুকু রেখে দিয়েছিলেন। যে কারণে তারা যার অপেক্ষায় নানা তিতিক্ষার ভেতর দিয়ে পালন করছিল তাদের ভিন্ন সত্ত্বার দায়ীত্বগুলো। তারাও নানা ভাবে নেভাতে ব্যস্ত ছিলো তাদের যাবতী দায় ভার। হয়তো বা সে দায়-দায়ীত্ব থেকে খানিকটা অব্যহতি দিয়েছে সময়। মুখোমুখি করে দিতে একটিবার সম মানসিকতার দুটো মানুষকে।
আজাহারের বড্ড ইচ্ছে করছিলো তাকে পাশে নিয়ে হেঁটে যায় তার প্রিয়তম পথে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত কিংবা পাশাপাশি বসে থাকে ক্যান্টিনের পাশে বকুল গাছটির ছাঁয়ায়, ইটের বেদীতে পা ঝুলিয়ে দিয়ে। কখনো ভেবেছে হাত ধরাধরি করে পুরোটা দিন পার করে দেবে জয়নুল আর্ট গ্যালারির বিস্ময়কর ছবিগুলো দেখতে দেখতে অথবা পাশাপাশি বিপুল মুগ্ধতার আভিজাত্যে হারিয়ে যাবে অজন্তা-ইলোরার স্থাপত্য সমূহের নানাবিধ বাঁকের বৈশিষ্ট্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা হাজার বছরের নিঃশ্বাসের ভেতর।
জীবনের ছোটবড় নানা প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে লালিত স্বপ্নের টুঁটি ধরে সে নিয়োজিত থেকেছে অন্য কারো মুখে হাসি ফোটানোর দুশ্চেষ্টায়। কিন্তু ভুল চাবি দিয়ে যেমন খোলা যায় না ভুল দরজার তালা, তেমনই জীবনের অনেকগুলো সময় পার করে দিয়েছে ভুল সংলাপে ভুল হৃদয়ে ঠাঁই পাবার ব্যর্থ প্রচেষ্টায়। চেষ্টা করেছে দিনরাত, প্রাণান্ত। অথচ সন্তুষ্টি দূরে থাক বিন্দুমাত্র সহানুভূতির দৃষ্টিও অর্জন করতে পারেনি। আজাহারের অক্ষেপ মনের ভেতর আহত যন্ত্রণায় তড়পায় কেবল। এমন মায়াভরা দুটি চোখের গহীনে কী এমন আছে যা মানুষকে নিমেষেই কাবু করে ফেলে। তবু যাদের কাছে কিছুই প্রত্যাশিত নয়, তাদের কাছেই হয়তো অযাচিত সব কিছুতেই খানিকটা ভয় আর সন্দেহ লুকিয়ে থাকে। তবু আজাহারের মনে হচ্ছিলো এই প্রথম কারো চোখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকার পরও মনের ভেতর শালীন বা অশালীন বিষয়ে যুক্তি-তর্কের প্লাবন বয়ে যায়নি। মনে হয়নি সভ্যতার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার কথাও।
-আমরা কি কোথাও বসতে পারি না? অবশ্য আপনার যদি তেমন অসুবিধা না হয়!
কী আশ্চর্য! তুমুল বৃষ্টির ভেতর আকস্মিক বিদ্যুল্লতার মতই এমন ভাবনা বার কয়েক ঝিলিক দিয়েছে আজাহারের মনেও। তাহলে কি সে বকুল গাছটার ছাঁয়াটুকু পছন্দ করার কথা না? তাদেরর নিউরোনের তারে তারে যদি সংযোগ ঘটেই থাকে তাহলে তো সে খুশি হয়ে ওঠার কথা। ভাবতে ভাবতে আজাহার জানায়, আমি তো সে কথাই ভাবছিলাম।
-তাহলে চলেন!
আজাহার ক্যান্টিনের কাছাকাছি পৌঁছুলে বকুল গাছটা দেখতে পেয়ে পেছন থেকে সে বলে উঠলো, আরে, এ জায়গাটার কথা তো অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম, কিন্তু সময় করে আসা হয়ে উঠছিলো না!
পেছন থেকে সে নিজেই এগিয়ে যায় সেদিকে। ইটের দেওয়াল তুলে উঁচু করা জায়গাটাতে পা ঝুলিয়ে বসলে আজাহার বলে উঠলো, চা দিতে বলি?
সে মাথা কাত করে সম্মতি জানাতেই আজাহার ছুটে যায় ক্যান্টিনের ভেতর। ক্যাশ কাউন্টারের ওপর একটি পঞ্চাশ টাকার নোট রেখে বলে উঠলো, দুটো চায়ের টোকেন!
কাউন্টারে বসা লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, খুচরা দিতে হবে ভাইজান!
-আমার কাছে আর টাকা নেই।
-আমার ক্যাশেই আছে মোটে চব্বিশ টাকা। বাকি টাকা কোত্থেকে দেবো বলেন?
আজাহার পকেট হাতড়ে দুটো সিকি আর একটি আধুলি বের করে দিতেই লোকটি একটি চায়ের টোকেন তার হাতে ধরিয়ে দেয়। টোকেন জমা দিয়ে চা হাতে করে বেরিয়ে এসে সে কাপটা বাড়িয়ে ধরে পিরিচ সমেত।
আজাহারের কেন যেন মনে হচ্ছিলো যে, চা হাতে নিতেই যেন তার ঘন কালো মায়াময় চোখ দুটো আরো মায়াময় হয়ে উঠলো। সেই সঙ্গে বদলে গেল মুখের রঙও। চা হাতে করে সে তাকিয়ে থাকে অডিটোরিয়ামের প্রবেশ পথের দিকে। আর সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই যেন সে ফের হারিয়ে যায় দূর কোনো লোকে। যেখানকার একাকী কোনো দ্বীপের মাঝে দাঁড়িয়ে প্রথম সে আবিষ্কার করেছিলো আজাহারকে জনারণ্যের ভীড়ে। দৃষ্টিতে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে ছিলো নির্নিমেষ। তাহলে কি সে ফের গুটিয়ে যাচ্ছে নিজের ভেতর?
আজাহারের খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো তার হাতটি নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে কিছুক্ষণ তার পাশটিতে বসে থাকতে। আর তখনই সে দৃষ্টি ফিরিয়ে এক হাতে আজাহারের হাত ধরে টেনে বললো, বসেন না কেন?
তারপর কাপ থেকে পিরিচে চা ঢালতে ঢালতে আবার বললো, আপনার পকেটে কি টাকা নেই?
-আছে তো। পঞ্চাশ টাকা। কিন্তু লোকটির কাছে খুচরো নেই।
-আমি অবশ্য দিতে পারতাম। কিন্তু এক কাপ চা দুজনে ভাগ করে খাওয়ার মতো মজাটা পাওয়া যেতো না।
কাপ ঠোঁটে ছুঁইয়ে চায়ে চুমুক দিতেই যেন আজাহারের বুকের ভেতর দীর্ঘকাল ধরে চাপা পড়ে থাকা একটি দীর্ঘশ্বাস মুহূর্তে পালটে গিয়া একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে। সে কি মনে মনে এমনটিই প্রত্যাশা করছিল কারো কাছে? জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে কতটা ঘাম ঝরালে মানুষ ভুলে যেতে বাধ্য হয় তার স্বপ্নের কথা, বিস্মৃত হতে বাধ্য হয় তার যাবতীয় লক্ষ্য কিংবা গন্তব্য; এ মহিলার কি জানা আছে সে কথা?
আজাহারের ভাবনার মাঝ পথেই সে বলে উঠেছিলো, আচ্ছা, আপনার কি জানা আছে মাটির উল্লাসের ঘ্রাণ কেমন? কখনো কি দেখেছেন নদীর বুকে জলের নিস্তরঙ্গ রূপ অথবা সাধকের নির্লিপ্ত চোখে লালসার আগুন?
যদিও আজাহার এতকাল নিজের শিল্প মনষ্কতার বড়াই করে এসেছে। সাধারণ আট-দশটা মানুষের চেয়ে নিজের অন্তর্গত কৌলিন্যের অহংকারে পাশ কাটিয়ে গেছে কত স্থূল বাসনার লালাসিক্ত দুর্বিনীত মুহূর্ত। অথচ মনে হচ্ছিলো ভদ্রমহিলার রুচির তুলনায় সে নিতান্তই চণ্ডাল গোত্রের কেউ। রুচিহীনতার দিক দিয়ে বা স্থূল মানসিকতার কোনো মানুষের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।
তাদের চা খাওয়া হয়ে গেলে, কোনো এক অদৃশ্য নিয়ন্তা কিংবা তাদের মনের ঘড়ি দুটো একই সময়ে সংকেত দিয়ে জানিয়ে দেয় যে, তাদের জন্য নির্ধারিত সময়টুকু ফুরিয়ে গেছে। এবার তাদের ফিরে যেতে হবে ভিন্নাভিন্ন পথে, যার যার জায়গায় ফিরে যেতে হবে বাকি দায় নেভানোর জন্যে। আর তাই হয়তো তারা পরস্পর বিচ্ছিন্নতা পরবর্তী কোনো বিরহজনিত শূন্যতাবোধে আক্রান্ত হয় না। যে কারণে হয়তো তাদের কাউকে দেখা যায় না একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিতে কিংবা আবার কোনোদিন কোথাও দেখা হবে সেই রকম কোনো আশাবাদও ব্যক্ত করতে শোনা যায় না।
সে চলে গিয়েছিলো একটি সোনালী মুহূর্তকে ধারণ করে, মেয়েটির হাত ধরে পায়চারীর ভঙ্গীতে হেঁটে হেঁটে, গেটের বাইরে। যেন আগের দিনগুলোর মতই স্বাভাবিক ভঙ্গীতে একটি যাত্রীহীন রিকশা থামিয়ে তাতে চড়ে বসলো। খানিক আগে যে ঘটনাটুকু ঘটে গেছে বা যতটুকু আলাপচারীতা হয়েছিলো তার সবই ঠিক ছিলো। কিন্তু মাঝখান থেকে কোন এক বিচিত্র কারণে অকস্মাৎ কয়েকধাপ এগিয়ে বা পিছিয়ে গিয়েছিলো সময় নামক ধ্রুব এককটি। আর তাই হয়তো সে জানতে চায়নি আজাহারের নাম-ধাম। আজাহারও কেন যেন জানতে চায়নি তার ব্যাপারে কিছু। আর এই অজ্ঞতা হেতু তার মনেও জন্ম নেয়নি কোনো রকমের আক্ষেপের।
এরপর এক টানা সতের বছর তারা ভুলে ছিলো পরস্পরকে। সেই সঙ্গে তাদের যাবতীয় জাগতিক দায় চুকাতে গিয়ে এক পর্যায়ে তারা দুজনেই উপনীত হয়েছিলো জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে। যে পর্যায়ে একজন মানুষের আর কোনো চাহিদা থাকে না জীবনের কাছে। প্রত্যাশা থাকে না সমাজের কাছে। এমনকি নিজের আত্মীয়-পরিজনের কাছেও তারা হয়ে ওঠেন অপ্রয়োজনীয়। আরো বেশি প্রয়োজনহীন হয়ে ওঠেন তাদের কাছে, এক সময় যাদের জন্যে তারা তুচ্ছ ভেবেছিলেন নিজেদের প্রয়োজন, আরাম-আয়েশ। সেই তারা তাদের প্রত্যাশার ব্যাপারে ভীত ছিলো অনেক। যে কারনে নানা অজুহাতের জন্ম হতো প্রতিদিন। যদিও তারা দুজন পরস্পরের দৃষ্টির আড়ালে ছিলেন, তবু যেন সতের বছর পর তারা একান্তে অনুভব করতে পেরেছিলেন একে অন্যকে। স্মৃতি কিংবা পারস্পরিক বোধের শক্তিতে তীব্র ভাবে টানছিলেন একে অন্যকে। নিউরোনের তারে তারে যেন ঝংকৃত হচ্ছিলো পরস্পরের আগমন ধ্বনি। এবং কোনো রকম পূর্ব যোগাযোগ ছাড়াই তারা ঠিক একই সময়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন জয়নুল আর্ট গ্যালারির প্রবেশ পথের লাউঞ্জে।
দরজা দিয়ে ঢোকার মুখেই আজাহার দেখতে পেয়েছিলো তাকে, যেন খানিকটা উদ্বেগ নিয়েই বসেছিলেন অন্যান্য অপেক্ষমান দর্শনার্থীর ভীড়ে। আজাহারের দৃষ্টি যেমন ভুল করেনি এতটা বছর পর, তার মনেও যেন বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগেনি আজাহারের ব্যাপারে। তাই যেন দেখা পাওয়া মাত্রই উঠে এসে আজাহারের হাত ধরে অনুযোগের সুরে বলে উঠতে পেরেছিলেন, এতটা দেরি হলো কেন?
আজাহার খানিকটা হেসে উঠে বললেন, আসতেই হবে, এমন কোনো কথা ছিলো?
-সব কথা কি আগে থেকেই ঠিক করা থাকে?
আজাহারের মনে হয় কথা তিনি ভুল শোনেননি। তিনি ভাবছিলেন, আমাদের প্রস্তুতি কি আদৌ ছিলো না? আমার তো মনে হচ্ছে এতকাল পেরিয়ে গেল প্রস্তুত হতে হতেই। যাবতীয় দায়-দায়ীত্ব চুকিয়ে দিয়ে নির্ভার হয়ে পরস্পর ফিরেছেন পরস্পরের কাছে। তারা গ্যালারি ঘুরে ঘুরে নানা ছবি দেখতে দেখতে বিস্মৃত হন তাদের সময়। বিস্মৃত হন গ্যালারি বন্ধের নির্ধারিত সময়। তাদের বুকের ভেতর চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসগুলো যেন আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে দীর্ঘকাল পর। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় তারা যেন স্থবির হয়ে পড়েছিলো কিছুক্ষণের জন্যে হলেও। তারপর পরিবেশ আর পরিস্থিতি বিচার করে স্বস্তির নিঃশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে এক যোগে। তখনই আজাহার বলে উঠলেন, চলেন, বের হই। অল্প কিছুক্ষণের ভেতরই সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
পাশ থেকে তিনি বলে উঠলেন, হোক সন্ধ্যা। রাত হতে দেরি আছে। আজ অনেক টাকা আছে আমার কাছে। চা ভাগাভাগি করে খেতে হবে না।
আজাহার বিস্মিত হয়ে ভাবছিলেন, সতের বছর আগের এক কাপ চা দুজনে ভাগাভাগি করে খাওয়ার তার মনে আছে? নাকি এতকাল মনে ছিলো না কিছুই, আমারই মতো এখনই মনে পড়ল সে কথা?
গ্যালারির বাইরে বেরিয়ে আসতেই বাতাসে কেমন হালকা ভেজা গন্ধ টের পেয়ে আজাহার পাশে তাকিয়ে বললো, বুঝতে পারছেন কিছু?
ভারী চশমার মোটা কাচের ভেতর দিয়ে অবাক করা বড় বড় দুটি চোখে তাকালে আজাহারের মনে হয় যেন অবাক করা দৃষ্টি। আজাহারের দৃষ্টিকেও কি তিনি তেমনই দেখতে পাচ্ছেন? হঠাৎ তিনি আশপাশে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হেসে উঠে বললেন, বৃষ্টির ঘ্রাণ!
-তাহলে চলেন যাই! মাটির উল্লাসের ঘ্রাণ পেতে হলে গ্রামে যেতে হবে।
-গ্রাম কোথায়, কতটা কাছে? বেশি দূর যেতে হলে শরীরের ক্ষমতায় কুলাবে না। আমার দাদুর গ্রাম মেঘনা পেরোলেই।
-আমার গ্রাম আরো কাছে। বুড়িগঙা পেরোলেই।
-বুড়িগঙা নষ্ট হয়ে গেছে। আমার দাদুর গ্রামে চলেন। আমি দু চারমাস পর পরই সেখানে গিয়ে কদিন থেকে আসি।
আজাহার জোর দিয়ে বলতে পারলেন না যে, চলেন, বুড়িগঙা পেরোতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু যেখানে চল্লিশ বছর ধরে যাই না, সেখানে কোথায় গিয়ে উঠবো?
তিনি তখনই আজাহারের একটি হাত ধরে বলে উঠলেন, না, আপনার গ্রামে আমাদের কেউ চেনা-জানা নেই।
আজাহার বললেন, মেঘনার ওপার তো আমারও কেউ জানা-শোনা নেই!
-আমি তো আছি, চলেন!
আজাহারের কেন যেন না করতে ইচ্ছে হয় না। ইচ্ছে হয় না তার কথাটাকে নিজের অনিচ্ছার চাদরে ঢেকে দিতে। তাই হয়তো সে বলে, যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে না?
-চলেন চা খাই। চা খেতে খেতে ভাববো।
তারা শ্লথ অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যান পিজি হাসপাতালের গেটের দিকে। সেখানে বাইরের ফুটপাতের দোকান থেকে চা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খান। অপেক্ষাকৃত কম বয়সের লোকজন উঠে দাঁড়িয়ে তাদের বসতে অনুরোধ জানায় টুলের ওপর। আজাহার হেসে তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমরা বুড়ো তা সত্যি, কিন্তু আমাদের অতটা দুর্বল ভাবা ঠিক হবে না।
তাদের চা খাওয়া হয়ে গেলে, তিনি পার্স থেকে একটি পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে দোকানের ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে ধরলে ছেলেটি হেসে উঠে বলে, দাদি, আমার ক্যাশে ট্যাকাই নাই!
আজাহার বললেন, কত হলো?
ছেলেটি জানায়, দশট্যাকা।
-কিছু টাকা আমার কাছেও আছে। বলে, আজাহার পকেটে হাত দিয়ে বেশ কিছু দোমড়ানো মোচড়ানো টাকা তুলে আনেন মুঠো ভরে। কিন্তু দশটাকার নোট তিনি দেখতে না পেলেও, তিনি হঠাৎ আজাহারের হাতটি ধরে বললেন, আরে, আছে। আমি দেখেছি।
আজাহার ফের মুঠি খুলতেই তিনি দশটাকার নোটটি বের করে ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বললেন, নেরে দাদা ভাই!
ওরা দুজন ফের ফিরে আসেন রাস্তার কাছাকাছি, যেখানে রিকশা, সিএনজি, ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে যাত্রীর অপেক্ষায়। আজাহার হঠাৎ বলে উঠলেন, এই শোনেন, ওদিকে যাচ্ছেন কেন?
তিনি কেমন বিরক্ত হয়ে আজাহারের দিকে ফিরে বললেন, আমার একটা নাম তো থাকতে পারে, নাকি?
আজাহার খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, এ পর্যন্ত নামের তো প্রয়োজন পড়েনি!
-কেউ কাউকে ডাকার প্রয়োজন পড়েনি বলে নাম জানার প্রয়োজন পড়েনি। আমার ডাক নাম ছিলো মায়া। বাচ্চা-কাচ্চার মা হওয়ার পর ও নামে আর কেউ ডাকেনি।
-আমারও একটা ডাক নাম ছিলো তো! বলেই মাথা চুলকান আজাহার। চেষ্টা করেই নিজের নামটা স্মরণ করতে পারছিলেন না। ভাবছিলেন, নিজের নাম ভুলে যাওয়া মানেই সে পাগলখানায় থাকার যোগ্য। তারাশঙ্করের শতাব্দীর মৃত্যু পড়েছিলেন কিছুদিন আগে। সেখানে একটি চরিত্র ছিল মন্মথ নামে। খুব ভালো লেগেছিল। ভাবতে ভাবতে কখন সে নামটা নিজের ডাকনাম হিসেবে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন বুঝতে পারেননি। তখনই মায়া হেসে উঠে বললেন, মন্মথ শুনলেই কেন যেন আমার প্রজাপতির কথা মনে পড়ে।
হয়তো মায়াকে থামাতেই আজাহার বলে উঠলেন, ট্যাক্সির দিকে যাচ্ছিলেন কেন?
-মেঘনা ঘাট যাবো না? অবাক হওয়ার ভঙ্গীতে কথাটা জানালেন মায়া।
-তাহলে আমি আপনার সঙ্গেই যাচ্ছি?
-হ্যাঁ, যাচ্ছেন।
-সেখানে আমার কী পরিচয় দেবেন?
-বুড়োদের অত পরিচয় লাগে না। দোকানের ছেলেটা কি আমার পরিচয় আগে থেকেই জানতো?
আজাহারের হয়তো বলার মতো কিছু ছিলো না। তিনি তাকিয়ে থাকলেন মায়ার দিকে। একটুও জড়তা নেই। বার্ধক্যের আঘাতে যেন বিন্দুমাত্র কাবু হননি। সবই ঠিক আছে কেবল শিল্পীর ভুল রঙের আঁচড়ে বয়সের ছাপটা গাঢ় হয়ে বসে গেছে জীবনের ক্যানভাসে।
লাজুক কিশোরীর মতই হাত ছানি দিয়ে দিয়ে ডাকে মায়া। আজাহার এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে মায়ার পাশে বসেন। আর তখনই মায়া কী মনে করে আজাহারের একটি বাহু দু হাতে আঁকড়ে ধরে বসেন। যেন এতে তারা দুজনেই বেশ অভ্যস্ত কয়েক দশক ধরে। যাত্রাবাড়ির ওদিকের রাস্তায় নাকি সব সময় বেশ জ্যাম হয়। কিন্তু এ নিয়ে মায়ার যেন কোনো দুর্ভাবনা নেই। বেশ প্রশান্ত মুখেই সিটে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তা দেখে আজাহারের ইচ্ছে হয় না জ্যামের মতো একটি নিরস বিষয় নিয়ে তাকে বিরক্ত করতে।
মেঘনা ঘাটে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে তারা লঞ্চ ঘাটে গিয়ে জানতে পারেন যে, সন্ধ্যার পর থেকে কোনো দিক থেকেই লঞ্চ আসতে দেখা যায়নি। তবু আরো অপেক্ষমান যাত্রীর ভীড়ে মিশে গিয়ে মায়া তার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে একটি বড় ট্রলারে যাওয়ার ব্যাবস্থা করে ফেললেন দেখে অবাক না হয়ে পারেন না আজাহার। মনে মনে ভাবছিলেন, তিনি হলে কি পারতেন এমন কিছু একটা ব্যবস্থা করতে? তিনি বরং নিজের ভাবনাকে হয়তোর চেয়ে হয়তো নয়-এর দিকেই ঠেলে দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেন বেশি। যাত্রীদের ভীড়ে আজাহারের কাঁধে হাত রেখে প্রায়ান্ধকার আকাশের দিকে মুখ করে মায়া বলে উঠলেন, আজ চাঁদ থাকলে কিন্তু বেশ হতো। তারপরই তিনি পাশের একজন যাত্রীকে জিজ্ঞেস করে ফেললেন অবলীলায়, বাবা, আইজগা চান্দের কত তারিখ কইতার নি?
লোকটি আঙুলে হিসেব কষে বলে, আইজে-কাইলে আমাবস্যা লাগনের সম্ভাবনা আছে!
আজাহার অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, তাদের দুজনের কথ্য ভাষায় খানিকটা টান আর নদীর ঢেউয়ের মতই যেন একটি উঁচু-নিচু সুরেলা ব্যাপার আছে।
নদীর খোলা হাওয়া বেশ ভালো লাগছিলো আজাহারের। কতকাল পর নৌকার মতো বাহনে চড়েছেন বা নদীপথে যাচ্ছেন বলতে পারবেন না সঠিক। অথচ এক সময় নিজেই নৌকা চালিয়ে বুড়িগঙা পাড়ি দিয়েছেন কতবার সে হিসেব নেই।
মায়ার দাদু বাড়ি যাওয়ার পথে প্রথম যে গ্রামটি পড়ে সেই ঘাটে নেমে পড়তেই দেখা যায় আরো লোকজন নামছে। সেই সঙ্গে গ্রামের দিক থেকে কয়েকজন আরো জায়গার নাম ধরে ডাকাডাকি করছে তাদের রিকশা ভ্যানে যাওয়ার জন্যে। গ্রামের অন্ধকার পথে ভ্যান এগিয়ে যেতে থাকলে আজাহারের মনে খানিকটা ভয় হয় এই ভেবে যে, রাস্তার পাশে কোনো খানা-খন্দে পড়ে গিয়ে না আবার হাত পা ভাঙেন! এই বয়সে ছোটখাটো দুর্ঘটনাও অনেক বড় কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
যদিও আকাশে মেঘ ছিলো। ছিলো বাতাসে ভেজা গন্ধ, তবু বৃষ্টির জন্যে তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিলো পুরো দুটো দিন আর একটি রাত। শেষ দিন মধ্যরাতে টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে আজাহার হঠাৎ শুনতে পান বাইরে থেকে দরজায় করাঘাত করতে করতে মায়া ডাকছেন, মন্মথ, মন্মথ!
আজাহার উঠে দরজা খুলে দিলে মায়া তার হাত ধরে টানেন। তিনি বাইরে বেরোতেই ঝরঝর করে বৃষ্টির ফোঁটা তার পুরো দেহ নিমেষেই ভিজিয়ে দেয়। মাটির ঘ্রাণ তিনি ঘুম ভাঙার পরপরই ঘরে থাকতে পেয়েছিলেন। তা ছাড়া গ্রামের ছেলে তিনি, বাল্যাবস্থা থেকেই জানেন মাটির চরিত্র। কিন্তু বৃষ্টির জল তো দূরের কথা সাধারণ জলই তিনি গরম না করে গোসল করতে পারেন না অনেক বছর। আজ অকস্মাৎ বৃষ্টির জলে সিক্ত হতেই কিছুক্ষণের ভেতর তার শ্বাসনালী সংকুচিত হতে আরম্ভ করলে তিনি হা করে শ্বাস ফেলতে চেষ্টা করেও পারেন না। শিঁকড় উপড়ে পড়ে যাওয়া বৃক্ষের মতই তিনি গড়িয়ে পড়েন কাদা-জলে। মায়ার মন খারাপ হতে পারে ভেবে তিনি আগে থেকেই কথাটা বলতে পারেননি।
আজাহার যখন জ্ঞান ফিরে পেলেন, নিজেকে অনেক যন্ত্রের মাঝে একটি কিম্ভুত ঘরের ভেতর আবিষ্কার করে অবাক হয়ে গেলেন। নাকের ভেতর সরু পাইপ, নাকে অক্সিজেনের মাস্ক দেখতে পেয়ে ভাবতে চেষ্টা করছিলেন তিনি বেঁচে আছেন কিনা। তখনই বিছানার পাশে দাঁড়ানো মায়ার উদ্বিগ্ন মুখ দেখতে পেয়ে গতকাল রাতের ঘটনা মনে পড়তেই অক্সিজেন মাস্কের আড়ালে তার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠতে দেখা যায়।
তার মনে পড়ে বাল্যে একবার কী এক অসুখে জ্ঞান হারিয়েছিলেন আজাহার। জ্ঞান ফিরে চোখ মেলতেই চিরকালের স্নেহ-ভালোবাসা আর মমতার আধার জননীর উদ্বিগ্ন মুখ দেখতে পেয়ে এমনই এক হাসি ফুটে উঠেছিলো মুখে। জননীর দৃষ্টিও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। সেদিনের পর আর আজকের এই মুহূর্ত ছাড়া মধ্যবর্তী সময়গুলোতে অনেকবার অসুস্থ হয়েছেন, অপারেশনের টেবিল থেকে ফিরেও চোখ মেলে তাকিয়েছেন, কিন্তু এমন উদ্বেগ আর দেখতে পাননি কারো চোখেমুখে।
(খসড়া সমাপ্ত)
খসড়া খুব ভাল হয়েছে। নতুন স্বাদের গলপ পড়লাম। খুব ভাল লাগলো। আরো চাই
ওহ বুজি, আগের মতন এতটা সময় পাই না। নিজের লগেই চেইত্যা আছি।
দারুন!
ধন্যবাদ। ভালো থাইকেন।
দারুন লেখা বস...
দারুন
~
বাহ্ দারুন লাগল দাদা। লাইক দিলাম
এইগানটা শুনতে পারে আজাহার--
চমৎকার লেখা। আরও লিখতে থাকুন। ভাল থাকুন।
মন্তব্য করুন