৪৩ বছর পরেও কোমরের ব্যাথায় কষ্ট পান তিনি
"২২শে নভেম্বর দুপুরে হঠাৎ দেখি আমার বাবাকে সাথে করে এক জীপ সৈন্য এসেছে এবং আমাকে খোঁজ করছে। বুঝলাম আমার মুক্ত জীবনের আয়ু আর বেশি নেই। মাকে সালাম করে ওদের সাথে জীপে গিয়ে উঠলাম। জীপে উঠেই এক অসীম সাহস বুঝে এলো। মনের ভেতরে শুধু একটি মুখ ভেসে উঠেছে, তা মুজিবের। একটি মুখ মানুষকে এত শক্তি দিতে পারে তা আগে জানতাম না। মুজিব মানেই তো বাংলা মুখ।"
এরপর সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব সালেহ মোস্তফা জামিলকে নিয়ে হাজির করা হয় তেজগাঁও ড্রাম ফ্যাক্টরির একটি তিনতলা বাড়ীতে। নীচ তলায় মেজর সালিকের অফিস এবং দোতলায় তাদের নির্যাতন কক্ষ। তিন তলায় রাখা হতো বন্দীদের। জামিল ভাইকে নিয়ে রাখা হলো এক রান্না ঘরে। সেখানে আগে থেকেই বন্দি ছিলো আরো পাঁচজন। তাদের মধ্যে একজন উনারই বড় ভাই, পাড়ার চায়ের দোকানের কালু, নিউমার্কেটের কাপড়ের ব্যবসায়ী একজন। বাকী দুইজনের একজন চাকমা এবং অন্যজন এক শিশু মুক্তিযোদ্ধা।
বিকেলে উনাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। গোপন করার কিছুই ছিলো না, উনার কাজ কর্ম সবই তাদের জানা ছিলো আগে থেকেই। সন্ধ্যার পর ৫/৬ জন সৈন্যসহ নিয়ে যাওয়া হলো রামপুরায়। জামিল ভাইয়ের কলেজ জীবনের বন্ধু আশরাফের বাসা ছিলো রামপুরা টেলিভিশন ভবনের পিছনে। সেখানেই প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। উনাদের সেই ক্যাম্পের নাম ছিল শেখের পাড়া।
গলির মুখে পাকিস্তানী সৈন্যবাহী জীপে জামিল ভাইকে দেখে তারা বুঝে গিয়েছিল ঘটনা। সরে পরে আশরাফ সহ বাকীরা। ঢাকায় একটি অপারেশনের জন্য আনা কিছু অস্ত্র ছিলো আশরাফদের ঘরে যা তার দুই তিনদিন আগেই সরিয়ে নেয়া হয়েছিলো। তাই পাওয়া গেলো না কোন অস্ত্র। জামিল ভাইকে নিয়ে যাওয়া হলো পাশে মসজিদে আশরাফের বাবার খোঁজে। মসজিদে তারাবীর নামাজ হচ্ছে। উনাকে বলা হলো আশরাফের বাবাকে সনাক্ত করার জন্য। আশরাফের বাবার সাথে চোখাচোখি হয় জামিল ভাইয়ের। পাকিস্তানী সৈন্যদের তিনি বললেন, "আমি তাকে এখানে খুঁজে পাচ্ছিনা। উনি এখানে নেই।"
ফিরে আসার পরে একটি কাগজ দিয়ে লিখতে বলা হলো তিনি যা যা জানেন তা। তিনি তাই লিখলেন যা তারা আগে থেকেই জানতো। রাতে আবার হাজির করা হলো মেজরের সামনে। জিজ্ঞেস করা হলো সবকিছু। তিনি কিছুই বলতে অস্বীকৃতি জানানোতে পাঠানো হলো দোতলায় নির্যাতন কক্ষে। যেই আওয়াজ নীচ তলা এবং তিন তলা থেকে আগে শুনেছেন তা নিজে প্রত্যক্ষ করলেন এবার। জানালার শিকের উপরে পা রেখে মেঝের দিকে মুখ দিয়ে হাতের উপর বর করিয়ে রেখে চামড়ার মোটা বেল্ট, লোহার রড এবং কাঠ দিয়ে আঘাত করা শুরু হলো কোমরে এবং পিছনে। দোতলার নির্যাতন কক্ষ তদারকীর দায়িত্বে যারা ছিলো তাদের চেহারার যেই বর্ণনা পাওয়া যায় উনার ভাষ্য থেকে তা থেকে বুঝা যায় তারা কতটা ভয়ংকর ছিলো। অদ্ভুত চেহারার অধিকারী এক এক জন ছিল উচ্চতায় ৭ফুটের মতন এবং কালো। প্রচন্ড আলোর দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো সারারাত। এভাবে দিনরাত চলতো নির্যাতন।
পরদিন আবারো নিয়ে যাওয়া হয় রামপুরায়। আশরাফরা ততক্ষণে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে, তাই আর কিছুই পাওয়া গেলো না। ২৭শে নভেম্বর অনেক চেষ্টার পর উনাদের দুই ভাইকে ছাড়িয়ে আনলেও ৪৩ বছর পরেও কোমরের ব্যাথায় কষ্ট পান তিনি প্রায় সময়। বাকী জীবনটা এই ব্যাথা নিয়েই কাটাতে হবে....
বিনম্র শ্রদ্ধা!
মন্তব্য করুন