ইউজার লগইন

শ্রদ্ধার্ঘ্য!

আজ আটাশে জুলাই। নিঃসন্দেহে গুরুত্বপুর্ন দিন। কারন আজ চারু মজুমদারকে হত্যা করার দিন, ছফার অকস্মাৎ প্রয়ান দিবস, বিখ্যাত সাংবাদিক শাহাদাত চৌধুরীর জন্মদিন। আরো হয়তো কিছু থাকতে পারে, যা আমার জানা নাই। জীবিত লোকদের আমার কেন জানি ভালো লাগে কম। মরে যাবার পরেই তার সমগ্রতাটুকু আমার চোখে ধরা পড়ে বেশি। এই যেমন ধরেন শামসুর রাহমানের কবিতা আগে আমার খুব বেশী ভালো লাগে নাই। কিন্তু যেদিন উনি মারা গেলেন, আমার প্রচন্ড মন খারাপ হলো। উনার বাসা যেহেতু কাছেই, যাওয়া যায় কি না ভাবছিলাম। কিন্তু আর যাওয়া হয় নি। বন্ধুর কাছ থেকে সংগ্রহ করলাম শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা নামে এক বই। তাই পড়ে গেলাম খুব মন দিয়ে। খুব বেশি কাব্য রস আস্বাদন- আমার মেধাতে নাই। তাও এক দুর্নিবার আকর্ষন অনুভব করলাম পাঠে। আমার এখনও মনে আছে পরের দিন সম্ভবত ছিলো শুক্রবার। চ্যানেল আইতে গোলাম মর্তুজার উপস্থাপনায় সকালের অনুষ্ঠানে আব্দুল মান্নান সৈয়দ ছিলো। লোকজন কতো বড় আবাল! অনেকেই লাইভ অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করা শুরু করলেন কবি কি ইসলামে বিশ্বাস করতেন? এরকম নাখান্দা প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ সাবকে প্রমান দিয়ে বলতে হলো- না তিনি ধর্ম চেতনার লোক। কবির বাবার নামের আগে সব সময় আলহাজ্ব লিখতেন সেটাই প্রমান। কি লেইম সিচুয়েশন, আজাইরা কোয়েশ্চেন, ভাবাই যায় না! মরহুম হবার পরেই আমাদের মনে কেন জানি এইসব প্রশ্নের খালি শুরু হয়!

আমি অবশ্য সাধারণ মানুষদের মতোই চিন্তার প্রতিফলন ঘটাই। যেমন ধরেন রশীদ করিমের আমি এক ধরনের ভক্ত পাঠক ছিলাম। তিনি চলে যাবার পরে তার সবই আমার ভালো লাগা শুরু করলো। এমন কি উনার প্রবন্ধ গুলাও এখন খুব মন দিয়ে পড়ি। পড়া জরুরী ভেবে। তেমনি আহমদ ছফার আমি খুবই গুনমুগ্ধ। তবে তা পীরমুর্শেদী না। উনাকে আমি দোষ গুনের একজন মানুষ হিসেবেই মনে করি। আমার ছফা পাঠ শুরু ২০০৬ থেকে। তার মানে হলো তার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর থেকে। উনার জীবন যাপন, সাহিত্যভাবনা, প্রবন্ধ, ইতিহাস বোধ, তীব্র জেদ, দেশপ্রেম, স্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে কথা বলা, সব নিয়েই এক ধরনের ভক্তিবাদের রোমান্টিসিজমে ভুগি। এই অযথা রোমান্টিসিজমে হয়তো উনি বেচে থাকলে ভুগতাম না। বেচে থেকে যদি উনি উনার বন্ধুর ফরহাদ মজাহারের মতো হতেন, তাহলে আরেক বিপদ ছিলো। এখন তো আবার দেখতেছি ছফাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া শুরু হলো। দুই গ্রুপই সুবিধা মতো ছফাকে নানা প্রসঙ্গে নানান কায়দায় ফেরত আনছে! একদিকে সলিমুল্লাহ আরেক দিকে নাস্তিক মোল্লা? কাল দেখলাম একজন স্টেটাস দিছে- ছফা তুমি কার? ফরহাদ না সলিমুল্লাহ র? তবে আমি বিশ্বাস করি ছফা আমাদের সবার। তাঁর উদ্ভট ব্যাতিক্রমী জীবন, তাঁর সাহিত্য, তাঁর ভাবনা, তাঁর আপোষ, তাঁর জেদ, তাঁর অনুবাদ, তাঁর বিকল্প ভাবনা সবই এই সাধারণ মানুষদের জন্য। এখন সলিমুল্লাহ খানেরা রাষ্ট্রসভা নামক প্রতিষ্ঠান বানিয়ে টানা ১০-১২ বছর ধরে সেমিনার ও প্রকাশনা করে যাচ্ছে। আরেকদিকে এই নাস্তিক মোল্লা উনার বিভিন্ন বক্তব্য ও অভিমত ছাপিয়ে দিচ্ছে নিজের বক্তব্যের জায়েজ করার সুবিধায়। তবে জীবিত থাকতেই, এই ফরহাদই মাঝেমাঝে ছফাকে বিএনপির দালাল বলে ধিক্কার জানাতেন। আবার তার কিছুদিন পরেই শ্রেষ্ঠ বন্ধু বলে গলায় গলায় পিরীত করছেন। ছফার রেফারেন্সে অনেক তরুনকেই নিজের এনজিতে চাকরী দিছেন! ছফা মরে গিয়েই ভালো করছেন। বেচে থাকলে সবার এই অধঃপতন দেখে মনোকষ্ট পেতেন। আর আমার মতো পাঠকদের কাছে ২৭৫০ টাকার এক সমগ্র রেখে গেছেন তাই আমাদের সম্ভল!

চারু মজুমদারও আমার খুব প্রিয়। উনার সমন্ধে পড়তে ভালো লাগে, আরো ভালো লাগে সেই সময়ের গল্প শুনতে। কি একটা অস্থির সময় তখন ছিল ভাবতেই কেমন জানি লাগে। নেসার আহমেদ রচিত মুক্তিযুদ্ধে উনার আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির প্রত্যক্ষ সমর্থনের ইতিহাস পড়ে খুব দারুন লাগছিলো। আরো পড়তে চাই উনাকে নিয়ে, নকশাল বাড়ী আন্দোলন নিয়ে, সেই সময়ে ভাবনা, অস্থির সান্ধ্য আইনের দিন যাপন নিয়ে। আমার ফেসবুক বন্ধু প্রমিথের একটা স্ট্যাটাস আজ খুব ভালো লাগলো না শেয়ার করে পারলাম না!

এসেছিলো সে সদর্পে । ইতিহাসের লেখকেরা তাকে তাজ্য করেছে , করেনি একাগ্র পাঠকেরা । সে ফিরে আসে ।

স্মরণকালের মধ্যে পৃথিবীর সর্বত্র ইতিহাস তার উন্মাতাল খেলায় সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি যেমনটা নিয়ে গিয়েছিলো অবিস্মরণীয় ষাটের শেষার্ধ - সত্তুর দশকে । ভিয়েতনামের জনগণ মাতৃভূমির টানকেও ছাপিয়ে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছে নিপীড়িতদের জন্য । সারা বিশ্বের নিপীড়িতরা ভিয়েতনামীদের দেখছে প্রাণ ভরে । শুধু কি ভিয়েতনাম ? পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো মার্ক্স, এঙ্গেলসের মর্ম বুঝেছে । মাও সে তুঙের বিখ্যাত ' সাংস্কৃতিক বিপ্লব ' বিপ্লবের পতাকাতলের মাঝেও ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা ঘৃণিত বুর্জোয়াদের নাকের জলে , চোখের জলে একাকার করে দিচ্ছে । মার্ক্সবাদ , লেনিনবাদের টর্চ বহনকারীর ছদ্মবেশধারীদের মুখোশ খুলে যাচ্ছে প্রতিদিন । কাটা হাত পা সহ চে গুয়েভারাদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে , সাথে বেড়ে যাচ্ছে স্ফূলিঙ্গ । নৃশংস , পশ্চাৎপদ পশ্চীম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পুর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রতিদিন টগবগ করে ফুটছে । এশিয়া , ল্যাটিন আমেরিকাতে ঘৃণিত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাবানল জ্বলে উঠেছে । বিপরীতে বিশ্বাসঘাতকেরাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে । ক্রুশ্চেভরা ডাক দিচ্ছে শান্তিপুর্ণ পথে সাম্যবাদে উত্তোরণের । সকলের জন্য ' রাষ্ট্রের ' দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়ে মার্ক্সবাদের জগাখিচুড়ী খাইয়ে প্রতারিত করছে কোটি কোটি মানুষকে । লেনিন , স্ট্যালিনেরা মৃত হয়েছে কিন্তু সোভিয়েতের আপামর জনগণ তাদের মনে রেখেছে এই সত্য বিস্মৃত হয়ে । ৪৫ কোটি মানুষ সংবলিত সুবিশাল ভূখন্ড ভারতবর্ষেও তখন চলছে মার্ক্সবাদের নামে লেজুড়বৃত্তির নির্লজ্জ সার্কাস । নির্বাচনীর সিঁড়ি বেয়ে সমাজতন্ত্রের চূড়ায় উঠাবার ডাহা মিথ্যা স্বপ্ন দেখাচ্ছে তখন প্রমোদ দাশগুপ্তরা । কংগ্রেসের ধুতির কোনা ধরে টিকে থাকবার ঘৃণ্য প্রয়াসে মগ্ন গণশত্রুরা অগ্নিগর্ভ সময়ের অস্তিত্ব টের পায়নি । ধামাচাঁপা দিয়ে রাখতে চাইছিলো এই ভূখন্ডের ঐতিহাসিক সংগ্রামসমূহকে । ঠিক এমন সময়েই মঞ্চে আবির্ভূত হলেন চারু মজুমদার । ' দি অল্টারনেটিভ । '

৯৬ পাউন্ডের এই চারু মজুমদার ইতিহাসের পাঠেই এক বৈচিত্র্যময় চরিত্র । ইতিহাস লিখিয়েদের কাছে তিনি হিংসার রাজা , নৃশংসতার অবিসংবাদিত সম্রাট । কিন্তু ইতিহাসের সচেতন পাঠকের কাছে ? তাদের কাছে চারু মজুমদার সেই পরম প্রত্যাশিত নায়ক যার আবির্ভাবের প্রয়োজনীয়তাও ঐতিহাসিক সেই সময়ের গর্ভে ।
তাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায় তার পরম প্রিয় ভারতবর্ষের কোটি কোটি নিপীড়িত মানুষদের কোটি কোটি চোখজোড়া দ্বারা । চারু মজুমদার সেই নির্ভীক স্পষ্ট সত্যবাদীর অপর নাম যিনি জাতীয়তাবাদী খেলো , অসার সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ করেন ভারতের চীন আক্রমন স্রেফ ভারতের শাসকশ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের একটি প্রামান্য চিত্র । জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল সেই চরিত্রকে প্রত্যাখ্যান করার দৃড় মনোভাব দিনের শেষে চারু মজুমদারকে স্পষ্টতই সঠিক বলে প্রমাণ করে । কোটি কোটি নিপীড়িত মানুষের কাছে চারু মজুমদার পরম আকাঙ্খিত সেই ব্যাক্তি যার লেখার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে দ্ব্যর্থহীনকন্ঠে স্পষ্ট সত্য উচ্চারিত হয় । মুখোশ খুলে দেওয়া হয় সেইসব বেজন্মাদের যারা মুক্তির আলোকবর্তিকার মেকি অবয়ব ধারণ করে প্রতারনা করে মানুষের জীবন নিয়ে । খেলে বেড়ায় মানুষের বিপ্লবস্পন্দিত আবেগ নিয়ে । যাদের হাতের মুঠো থেকে মানুষকে বের করে নিয়ে আসতে না পারলে আরেক সুদীর্ঘ পর্ব জুড়ে স্রেফ ক্ষুধার জ্বলন্ত আগুণ এবং দারিদ্র্যের নিদারুণ কষাঘাত । চারু মজুমদার পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন তার সব । বিখ্যাত আট দলিলে স্পষ্ট , পরিষ্কার ভাষায় লিখে গিয়েছিলেন কি করতে হবে , কেন করতে হবে , কাদের জন্য করতে হবে তার সব । ট্রেড ইউনিয়ন , কৃষক সভা করেই বাড়ির ছাদ থেকে ঘোলাটে চোখে মুক্তি দেখতে যাওয়াটা কতটা ভ্রান্তিপূর্ণ দেখিয়ে দিয়েছিলেন । নির্বাচনী মোড়কে জনগণের সেবা হয়না , হয় প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীর তাবেদারী লিখে গিয়েছেন তার ইতিবৃত্ত পাতার পর পাতা । চারু মজুমদার লিখে গিয়েছিলেন এর সব । এতোসব স্পষ্ট করে সব এখানে আর কে অতীতে লিখে গিয়েছে ?

এই ভূখণ্ডের আজন্ম ইতিহাস ঔপনিবেশিক শাসনের তলে পিষ্ট থাকবার ইতিহাস । এই ভূখন্ডের ইতিহাস মানেই বিশ্বাসঘাতকতা , ঔপনিবেশিকতার ছায়াতলে মুক্তির মিথ্যা আশ্বাসের বাকচাতুর্যতা । চারু মজুমদার পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন সবকিছুই । আততায়ীর বেশে মার্ক্সবাদ , লেনিনবাদের পীঠে ছুরি মেরে দেওয়া ডাঙ্গের ছবি পার্টি অফিস থেকে ফেলে দিয়ে দৃড়কন্ঠে আর কেই বা বলতে পারে " আর কেউ না থাকলে আমিই পার্টি , আই এম দা অল্টারনেটিভ " ? ঔপনিবেশিক মানসকাঠামোয় পথভ্রষ্ট এবং বিপর্যস্ত তরুণ প্রজন্মকে আর কেই বা স্পষ্ট করে বলে যেতে পারে " এই শিক্ষা ব্যবস্থায় যতই পড়বে ততই মূর্খ হবে " ? সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে প্রানান্তকর লড়াই ছাড়া মুক্তির পথে এক পাও এগিয়ে যাওয়া যাবেনা এই চরম সত্য প্রতিটি কথায় , প্রতিটি লেখায় স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়া চারু মজুমদার অল্টারনেটিভ হবেন না তো আর কে হবেন ? বুর্জোয়াদের পতাকা তলে আশ্রয় নেওয়া ভ্রষ্ট কমিউনিস্টদের জয়জয়কারের সময়ে নকশালবাড়ির তরাইয়ে আর কে ঘোষণা করতে পারেন ' বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের ' ? এই ভূখন্ডে প্রথমবারের মত আর কার পক্ষে সম্ভব হয় স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ডাক দেওয়ার ? তার শরীরের ওজন মাত্র ৯৬ পাউন্ডের হতে পারে কিন্তু এই মানুষটিই প্রায় অর্ধশত কোটি মানুষের জীবনকে নিজের জীবন বলে গণ্য করেছিলেন । তার সাহস , ত্যাগ-তিতিক্ষার ওজন নিঃসন্দেহে অপরিমেয় ।

তবুও কথা থেকেই যায় । পরাজয়ের গ্লানিময় গল্পগাঁথা রয়ে যায় অব্যক্ত । ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই শিলিগুড়ির দীপক বিশ্বাসের বিশ্বাসঘাতকতায় পুলিশের কাছে ধরা পড়া চারু মজুমদারকে অবর্ণনীয় অত্যাচারের পর মেরে ফেলা হয় ২৮ জুলাই । সেই সময়ে কার্ডিয়াক এজমার রোগী চারু মজুমদারের ওষুধের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয় । মনে করা হয় প্রবল চড়াই - উৎরাইয়ের একটি পর্বকে শেষ করে দেওয়া গেছে । ভেবে নেওয়া হয় অগ্নিগর্ভ একটি সময়ের প্রধান রুপকারকে হত্যা করে ইতিহাসকে ইচ্ছামত লিখিয়ে নেওয়া যাবে । তবুও সফল হওয়া যায়না । কলম হাতে আমাদের সামনে চলে আসেন মহাশ্বেতা দেবী , জয়া মিত্র , মণি মুখোপাধ্যায় , নবারুণ ভট্টাচার্যরা । মহাশ্বেতার হাত দিয়ে বের হয় ' হাজার চুরাশির মা ' , ' গণতন্ত্র ও গোপাল কাহার ' গল্পের লেখক মণি মুখোপাধ্যায় স্পষ্ট উচ্চারণে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন গণতন্ত্র ও এই ভূখন্ডের বাস্তবতা পরস্পর থেকে কতটা দূরের । নবারুণ উঠে আসেন ' হারবার্ট ' উপন্যাস নিয়ে । নকশালবাড়ি নিয়ে কুৎসা রটানো হয় অজস্র , প্রতিক্রিয়াশীলদের ম্যানিপুলেটেড ইতিহাস দিয়ে চারু মজুমদার , সরোজ দত্তদের দেখানো হয় ঘৃণিত শত্রু হিসাবে । বলা হয় নকশালবাড়ির আন্দোলন গোটা একটি প্রজন্মকে ধ্বংস করেছে । কিন্তু সচেতন ইতিহাস পাঠক মাত্রই জানেন অজস্র প্রজন্ম বিনা যুদ্ধে নষ্ট হয়েছে নকশালবাড়ির পূর্বে , নকশালবাড়ী পরবর্তী প্রজন্মগুলোও ক্রিকেট গ্ল্যামার আর বলিউডের মাদকতায় সত্য - মিথ্যা নিরুপণে অক্ষম । স্রেফ জীবন্ত লাশ হয়ে চারপাশে উৎকট পঁচা গন্ধ নিয়ে তারা ঘুরে বেড়ায় । নকশালবাড়ির আন্দোলন চেয়েছিলো এই ধ্বংস থেকে তাদের বাঁচাতে । পারেনি তা তর্কাতীত সত্য কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে বাঁচাবার চেষ্টা করতে হয় ।

২৮ জুলাই নৃশংস , ঘৃণিত ব্যক্তিত্ব চারু মজুমদারের মৃত্যুদিবস নয় । ২৮ জুলাই স্পষ্ট , নির্ভীক , আপোষকামীতাকে ঘৃণা করা রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব চারু মজুমদারের মৃত্যুদিবস । ইতিহাসকে এতো সংক্ষিপ্ত কিন্তু মর্মস্পর্শী কিছু লাইনে আর কেউ ব্যাখ্যা করতে পেরেছে বলে জানা নেই ।

" ঘটনা যখন ঘটে যায়
তখন
আমরা তাকে জানতে পারি;
কিন্তু
এই ঘটনা ঘটানোর পেছনে
কত দুঃখ
কত চোখের জল
কত বীরত্বের কাহিনী
লুকিয়ে আছে
তা আমরা
কখনোই জানতে পারিনা । "

আজ বিখ্যাত সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীর জন্মদিন। আমি বিচিত্রার আমলের লোক না। তাই বিচিত্রার তাৎপর্য ভালো মতো বলতে পারবো না। তবে আমি বিচিত্রার পাঠক অন্যভাবে। নীলক্ষেতে আজ থেকে প্রায় ছয় সাত বছর আগে যখন সমানে চষে বেড়াতম। তখন কেজি দরে যায়যায়দিন আর বিচিত্রা কিনে আনতাম প্রতিদিন। যায়যায়দিনের বিশেষ সংখ্যাগুলান না, তাদের যে সাপ্তাহিক সংখ্যা গুলো পড়ছি তাতে মুগ্ধ হইছি। কারন তখনও যায়যায়দিন বিএনপির দখলে যায় নাই। তবে যায় যায় দিনের বিশেষ সংখ্যা গুলো খুব একটা যুতের ছিলো না তখন। রুচিহীন সব গল্প। তাও মানুষজনের তীব্র পছন্দ। এই সব গজব মার্কা গল্প কিভাবে সেই সময়ের লোকেরা হজম করতো আবার লিখতো তা বুঝে পাই না। কিন্তু বিচিত্রা ছিলো রুচির পত্রিকা। অন্তত আমি যেগুলা পড়ছি সেগুলা খুব উন্নত মানের লেখা। আসিফ নজরুল রা তখন রিপোর্টার তাদের সময়কার গুলা। এবং বিচিত্রা খুব মানবিক। এমন সব ফিচার করতো যেগুলো দেশপ্রেম ও মুল্যবোধের কথা বলে। দুঃখের বিষয় হলো এই অজস্র যায়যায়দিন বিচিত্রা গুলো সব ইদুরে খেয়েই শেষ করলো বাসায়। শাহাদাত চৌধুরীকেও এখন আর কেউ মনে রাখে নাই। তিনটা দশকে তিনি যে একটা বিশাল অবদান রেখে গেছেন তাঁর কথা কেউ বলে না। সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক গোলাম মর্তুজা সাহেব আজ তা নিয়ে লিখলেন দারুন ভাবেঃ

অকৃতজ্ঞ সমাজ...

আজ এই মানুষটির জন্ম দিন। তাকে চিনতে পারছেন না অনেকেই। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। একজন মানুষ কতভাবে যে অবদান রেখে গেছেন আমাদের রাষ্ট্র-সমাজ গঠনে। বলছি শাহাদত চৌধুরীর কথা। মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী। বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী।
শাহাদত চৌধুরীর বিশাল কর্মযজ্ঞের কয়েকটি উল্লেখ করছি মাত্রÑ
১. শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠনের নেপথ্যের অন্যতম প্রধান রূপকার।
২. স্বাধীনতার পর বাঙালি মধ্যবিত্তের রুচি গঠন ও বিকাশের গাইড ছিল শাহাদত চৌধুরীর বিচিত্রা।
৩. আমাদের আজকের যে দেশীয় পোশাকের বিশাল সম্ভার, তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক শাহাদত চৌধুরী। দেশীয় পোশাক নিয়ে ‘বিচিত্রা ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা’ শাহাদত চৌধুরীর সূচনা।
৪. ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতার সূচনা লগ্নে দেশে সেই অর্থে মডেল ছিল না। নিজের এবং আত্মীয় পরিজনের সন্তানদের দেশীয় পোশাক পরিয়ে ছবি তুলে সূচনা করেছিলেন।
৫. শাহাদত চৌধুরী এদেশে ফটোসুন্দরী প্রতিযোগিতা শুরু করেছিলেন। মৌসুমী, মৌ, পপি, অপি, কুসুম... আরও অনেকে শাহাদত চৌধুরীর আবিষ্কার। আজকে যে লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টারের এক ঝাঁক তারকা। সেই ফটোসুন্দরী প্রতিযোগিতারই আরেক ধাপ।
৬. খালেদ মোশারফের ২ নম্বর সেক্টরে গেরিলা শাহাদত চৌধুরী। গেরিলা তারা তিন ভাই শাহাদত চৌধুরী, ফতেহ চৌধুরী, মোরশেদ চৌধুরী। ’৭১-এ ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম ঘাঁটি ছিল শাহাদত চৌধুরীদের হাটখোলার বাড়ি।
৭. শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’র পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছেন শাহাদত চৌধুরী।
৮. আজকের বড় বড় সম্পাদকরাও বড় সম্পাদক মনে করতেন শাহাদত চৌধুরীকে। বাংলাদেশে ‘ঈদসংখ্যা’র প্রবর্তক শাহাদত চৌধুরী। শওকত আলী, সৈয়দ হক থেকে হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল... তাদের প্রতিষ্ঠার পেছনে শাহাদত চৌধুরীর বিশাল অবদান। তাকে নিয়ে সৈয়দ হক লেখেন, ‘আমার সম্পাদক’। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘শাহাদতের কাছে ঋণী হয়ে আমরা ধনী হয়েছি।’
৯. এই মানুষটি জন্মেছিলেন ১৯৪৩ সালের ২৮ জুলাই। আজ নিরবে-নিভৃতে কেটে যাবে তার জন্মদিনের দিনটি! কেউ স্মরণ করবেন না!! অথচ এই সমাজের লেখক-সাংস্কৃতিক নেতা, রাজনীতিক-ব্যবসায়ী প্রায় সবাই তার সিনিয়র বা জুনিয়র বন্ধু-শুভাকাক্সক্ষী। শাহাদত চৌধুরীর হাতে গড়া সাংবাদিকরা দেশে বিদেশে কতজন কত জায়গায় ছড়িয়ে আছেন।
‘শাহাদত চৌধুরীর বন্ধু’ শুধু এই পরিচয়ে কত ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
তারা কেউ আজ এই মানুষটিকে স্মরণ করার, শ্রদ্ধা করার প্রয়োজন মনে করেন না। এমনকি তার নিজের গড়া প্রতিষ্ঠানও না।
শাহাদত চৌধুরীর স্ত্রী সেলিনা চৌধুরী, দুই মেয়ে শাশা, এষা, জামাতা সাইমন- হয়ত পারিবারিকভাবে স্মরণ করবেন এই মানুষটিকে। আমি যে কথাগুলো বললাম, কে জানে- এই অভিমান হয়ত তাদের মনেও!
২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর শাহাদত চৌধুরী এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।

শ্রদ্ধা জানাই এই তিন মহান মানুষকেই। উনাদের নিয়ে চর্চা বাড়ুক। নতুন প্রজন্ম উনাদের মতো মানুষদের চিনুক!

পোস্টটি ৭ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


শ্রদ্ধা জানাই এই তিন মহান
মানুষকেই। উনাদের
নিয়ে চর্চা বাড়ুক। নতুন প্রজন্ম
উনাদের মতো মানুষদের চিনুক!

সহমত।

আরাফাত শান্ত's picture


ধন্যবাদ!

শামান সাত্ত্বিক's picture


অনেক কিছু জানলাম। ধন্যবাদ আরাফাত শান্ত।

আরাফাত শান্ত's picture


থ্যাঙ্কস এ লট!

মানুষ's picture


Smile

আরাফাত শান্ত's picture


Laughing out loud

সামছা আকিদা জাহান's picture


শ্রদ্ধা জানাই এই তিনজন মহান

মানুষকই। উনােদর

িনেয় চচা বাড়ুক। নতুন প্রজন্ম

উনােদর মতা মানুষদর চিনুক
সশ্রদ্ধ নিবেদন।

আরাফাত শান্ত's picture


ধন্যবাদ আপু। Smile

জেবীন's picture


তিনজন বড় মানুষকে নিয়ে এই যে লেখাটা, কিছু কিছু হলেও তো অনেককে জানায় উনাদের সম্পর্কে।

দিনলিপির পাশাপাশি এই ধাচেঁর লেখাও বেশি লিখো। কমেন্ট দেই না দেই, ভালো লেখা ঠিকই পড়ে যায় সবাই

১০

আরাফাত শান্ত's picture


ভালো থাকবেন আপু!

১১

রায়েহাত শুভ's picture


তোমারে কৈলে তো মানবা না, কিন্তু তোমার এই ক্যাজুয়াল ভঙ্গীতে লেখার স্টাইল অনেক বড় লেখকেরও নাই। অভিমান কইরা লেখা বন্ধ কইরোনা ভাই...

১২

জ্যোতি's picture


আমার কমেন্ট আপনি চুরি করলেন, এখন আমি কি বলি !

১৩

আরাফাত শান্ত's picture


বন্ধ করতেছি না ভাই। তবে বাড়ীতে থাকলে আর ঈদে লেখা হবে না। আবার ঢাকায় এসে লেখা। মোবাইলেও লেখা যায় না, হ্যাং করে Stare

১৪

শওকত মাসুম's picture


তিনজনই আমার প্রিয়, তবে অন্ধ না। আহমদ ছফার লিবিয়া কানেকশন নিয়ে একটু বিব্রত লাগে। চারু মজামদারের গলাকাটা নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলি। আর বিচিত্রা তো ছিল আমার জীবন যাপনের অঙ্গ। বৃহস্পতিবারের জন্য অপেক্ষায় থাকতাম। এক সময় সবগুলো সংখ্যা সংগ্রহে ছিল। কিছু আর নেই। আবার এটাও ভুলি না যে, ক্ষমতায় সেনাবাহিনীর অংশীদার করা নিয়ে এরশাদের প্রথম সাক্ষাৎকার শাহাদাত চৌধুরীর বিচিত্রাতেই ছাপা হয়েছিল।

১৫

আরাফাত শান্ত's picture


লিবিয়া জার্মান কানেকসন লইয়া আমিও বিব্রত। কিন্তু কি আর করা দোষে গুনে মানুষ!

চারু মজুমদার নিয়ে আমার পড়াশুনা কম। তবে একটা জেনারেশনের কাছে তিনি পুরো হ্যামিলনের বাশীওয়ালার মতো ছিলেন। সবাইকে তিনি টেনে আনতে পারার ক্ষমতা রাখতেন!

শাহাদাত সাহেব মাস্টার ক্লাস মানুষ। এমন মানুষের সংখ্যা খালি কমছেই!

থ্যাংকস এ লট ভাইয়া!

১৬

রাসেল আশরাফ's picture


পড়লাম Smile

১৭

আরাফাত শান্ত's picture


Smile

১৮

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


তিনজনকেই শ্রদ্ধা আর তোমাকে ধন্যবাদ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার জন্য।

১৯

আরাফাত শান্ত's picture


ধন্যবাদ বড় ভাই!

২০

টোকাই's picture


প্রথম দুইজনের লেখা পড়ি নাই। তবে বিচিত্রা সত্যি আমার জীবনের অংগ ছিল। সেইক্ষেতে শাহাদাত চৌধুরীর অবদান্ অনস্বীকার্য। বিচিত্রার প্রবাস থেকে কলাম, ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন , আর ধারাবাহিক কখনো মিস করতাম না। যায় যায় দিন ও খুব ভাল পত্রিকা ছিল। দিনের পর দিনের কথোপকথন ছিল উপভোগ করার মত। আরেকটা সাপ্তাহিক ছিল "বিচিন্তা" । বন্ধু মিনার মাহমুদ সম্পাদনা করতো। দারুন সব লেখা থাকতো। পরে এরশাদের দৌরানি খেয়ে আমেরিকায় পালিয়েছিলো মিনার মাহমুদ। কিছুদিন আগে দেশে ফিরে গিয়ে কি কারনে জানিনা আত্মহত্যা করলো।
অনেক ধন্যবাদ শান্ত এত সুন্দর বিষয় নিয়ে লিখার জন্য

২১

আরাফাত শান্ত's picture


মিনার মাহমুদের জন্য মন খারাপ হয়! বেচারা কি অমিত সম্ভাবনা ময় মানুষ স্বেচ্ছায় চলে গেলেন। ভালো লাগলো বিচিত্রার গল্প শুনে। বিচিত্রা যায়যায়দিনের মতো পত্রিকা আর কোনোদিন বাংলাদেশে আসবে না! Sad

২২

তানবীরা's picture


বিচিত্রা নিয়ে মূল্যায়ন ভাল লাগল। শাহাদাত চৌধুরীকে নিয়েও। একমত।

তোমার এই ধরনের লেখা আরো অনেক বেশি আসা উচিত তোমার সেই ক্যাপাবিলিটি আছে আর বস আছে মাসুম ভাই পথ দেখানোর জন্যে

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

আরাফাত শান্ত's picture

নিজের সম্পর্কে

দুই কলমের বিদ্যা লইয়া শরীরে আমার গরম নাই!