শুভমিতার চিঠি-৮
প্রিয় শুভমিতা,
আজ অনেক দিন পর আবার লিখতে বসলাম। অঘ্রাণের ধান কাটতে কাটতে শীত এসেই গেল। প্রতি শীতই আমাকে স্মৃতিকাতর করে তুলে। এই ঋতু আমার পুরোপুরি প্রিয় না হলেও অপ্রিয়ও নয়। কেননা ছেলেবেলার সিংহভাগ আনন্দ এই ঋতু ঘিরেই। এই সময়ে মায়ের খুব কাছে কাছে বলতে গেলে একেবারে সন্নিবিষ্ট থাকতাম মায়ের আঁচলে শুধুমাত্র উষ্ণতার জন্যই নয়, তা বলাও সহজ নয়। এই সময়টাতে মায়ের ব্যস্ততা অনেকগুন বেড়ে যেত। গোলায় ধান তোলা থেকে শুরু করে চাল কুড়ুতে দেয়া, চাল ধোয়া, গুড়ো করা, এরপরই রয়েছে আমার অতি পছন্দের চিতই পিঠা, ভাপাপিঠা, পাটিসাপটা - সবই মা নিজ হাতে সামলাতেন। আরেকটা আনুষঙ্গ হল খেজুরের রস। এই রসকে জ্বাল দিয়ে দিয়ে কড়া খয়েরি রঙের করে ফেলতেন মা। আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় একে বলতাম "রাপ।" এই রাপের সাথে দুধ মিশিয়ে ভাপাপিঠা ভিজিয়ে খেতে দারুন মজার ব্যাপার। দুধের জন্য গরু পালনের কাজটাও মা'ই করতেন। শুধু কি তাই এই সময়ই খই-মুড়ি-মোয়া বানানোর ধুম পড়ত। তাও বাড়ির মা-কাকীরাই করতেন। আবার আমাদের গ্রামের একমাত্র প্রাইমারি স্কুলে চাকরিও করতেন মা। যদি কোন দিন অতিরিক্ত জ্বালাতন করতাম, মা বলে উঠতেন- "আমার কি মাদূর্গার মত দশটা হাত?" এই ডায়ালগটা আমি কখনোই ভুলতে পারব না। বাস্তবিক অর্থে মায়ের দুইটা হাতেই যেন দশ হাতের কাজ করতেন।
শীতের সকালটা ছিল কোন ছাত্রের বার্ষিক পরীক্ষায় লেখা রচনার মত। কুয়াশার চাদর জড়ানো সূর্যের আগেই উম বিছানা ছাড়তাম কারন অন্য আকর্ষণ অপেক্ষা করে আছে। উঠেই দেখতাম আগেরদিনের ধান-মারাইয়ের অবশিষ্ঠ ছোবলাস্তুপে আগুন লাগিয়ে উম নিচ্ছে কাকা-জ্যাঠা-বড় ভাই বোনেরা। চাদরমুড়ি দিয়ে সেখানে গিয়ে খড় জড় করে বসে পরতাম। এই আগুনকে ঘিরে বেশ একটা আড্ডা হত। এই সাত সকালে কোন জরুরী আলাপ হত না বরং ঠাট্টা তামাশাই বেশী চলত। এই তামাশার কেন্দ্রে গিয়ে পড়তাম আমরা ছোটরাই। কারন বাচ্চাদের রাগানো সহজ, সেখান থেকে আবার মজাও তোলা যায়। এর একটা ছিল যেদিন বেশী ধুঁয়া উঠত, সেদিন বড় কেউ একজন বলে উঠত গতকাল ওমুক শৌচকাজ করেনি তাই ওর দিকে ধুঁয়া যাচ্ছে বেশী। মাঝে মাঝে ধানগাছের শিরার সাথে লেগে থাকা অবশিষ্ট ধানকে আগুনের কাছাকাছি রেখে এর থেকে খই বানিয়ে নিতাম। এরপরের রুটিনে থাকত ডাঙ্গুলি অথবা ফুটবল। ক্রিকেট খেলার প্রচলন তখন ছিল না। দুপুরে খেজুরগাছ কাটতে যেতাম ভাইদের সাথে। বিকেল বেলায় দলবেঁধে চলত গোল্লাছুট, কানামাছি আর বড় ভাইরা খেলত ব্যাটমিন্টন। এক শীতে খেজুরগাছ কাটার সময় আমার হাত কেটে ফেলি। কেটে যাওয়া চামড়া দুইদিক থেকে ফাঁক করতেই দেখি সাদা রঙের হাড়। সেই কাটা দাগ এখনো আমার হাতে রয়ে গেছে আমার সুখসময়ের চিহ্ন হিসেবে। সুখের দিনগুলো হয়ত বেশী করে আঁচড় কাটবে বলেই কিছু কাটাছেঁড়া, দুঃখ ভোগ নিয়ে আসে।
আজ বীচে গেলাম সাঁতার কাটব বলে। দেখলাম কত বাচ্চা হুটোহুটি আর লুটোপুটি খেলছে কতৃপক্ষের ব্যবস্থা করা স্লাইডিং ও জাম্পিং প্লেস্টেশানে। শহরের দিনগুলোতে গ্রাম্য মধ্যযুগীয় সেইসব বিনোদন নেই। এমনকি গ্রামেও অনেকক্ষেত্রেই হারিয়ে গেছে। গ্রামে কোথাও কোথাও শীতকালীন যাত্রাপালা হত। মৌলবাদীদের ঝামেলার মুখে সেসব অনেক জায়গায় বন্ধ হয়ে গেছে। এখন তারা ভিসিআর টিভিতে বস্থাপঁচা সিনেমা দেখে বিনোদন জমায়। মৌলিক বিনোদন হারিয়ে গেলে বহিরাগত সংস্কৃতি সেই জায়গা দখল করবে আর মানবিক মূল্যবোধও সেইভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এই পরিবর্তন অনেকক্ষেত্রেই শুভ হয় নি। গ্রামগুলোর দিকে নজর দিলেই সেটা চোখে পড়ে। আজ গ্রামের স্কুল আর হাটবাজারের মোড়ে মোড়ে বখাটেরা আড্ডা বসায় আর স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীদের উত্যক্ত করে। এই বখাটেরা কোন না কোন রাজনৈতিক দলে জড়িত হয়ে পড়ে, না হয় শহরে গিয়ে ছিনতাই করে। তাদের দ্বারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা খুবই দুষ্কর, কেননা যাদের অতীত অন্ধকার তাদের দ্বারা এই দুর্মূল্যের বাজারে টিকে থাকা খুবই কষ্টকর। এই শ্রেনীর লোকদের একাংশ আবার জায়গা-জমি বিক্রি করে কোনরকমে মধ্যপ্রাচ্যে চলে আসে চাকরীর সন্ধানে এরপর মানবেতর জীবনযাপন করে একসময় বুঝতে পারে জীবনের একগুরুত্বপূর্ণ অংশ হারিয়ে গেছে।
যাই হোক, মিতা, ধান ভানতে শিবের গাঁজনের মত সমাজের কঠিন বাস্তব রূপ আঁকতে চলে গিয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি যে আমাদের গ্রামগুলো অন্ধকারে চলে যাচ্ছে গ্রামের শিক্ষিত শ্রেণীদের গ্রাম ছেড়ে শহরমূখী হওয়ায়, যেমন করে আমি এখন শহুরে। জীবনে আর কোন দিন গ্রামে ফিরে যাব কিনা সন্দেহ আছে। তবে জীবনে মাঝামাঝি সময়ে চলে এসে আমি বুঝতে পারছি পৃথিবী ধীরে ধীরে আমাকে বিদায় জানাচ্ছে। এই পৃথিবী নবীন পিয়াসী। তার রূপ রস গন্ধ আনন্দ বেদনা সবই কেবল শিশুদের জন্য। আমাদের দেশে ঈদ-পূজা আসলে তা যেন আরো বেশী করে ধরা পড়ে। ধর্মীয় চিরাচরিত উৎসবগুলো যেন ধীরে ধীরে প্রাণহীন হয়ে পড়ছে আমাদের মাঝে, অথচ এরা শিশুদের কাছে ঠিকই আনন্দে ধরা দেয়। পিতা-মাতার আনন্দগুলোও হয় এই বাচ্চাদের ঘিরে।
আজ সমুদ্রস্নানে সফেদ ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দিয়ে একাকী জীবনে রস নিংড়ানোর চেষ্টা করলাম। ভাবছি আমার আনন্দ আসলে কোথায়। সমুদ্রের অথৈ জলে কেলি করার চিন্তা করতেই আনন্দে নেচে উঠতাম একদিন, আজ মনে হল সেই দেহবালিকা দেহবুড়িতে পরিণত হয়েছে, চিকন লুজফিটিং শরীর আর টান কাচুলিতেও পীণ করতে না পারা স্তনের কেউ; যে অস্তঃমিত সূর্য আমার কাছে এক সময় সোনালী আভায় সাগরজলের ঢেউয়ের ফেনায় মায়াবীরূপে হাজির হত, আজ আমি পেলাম শীতল সূর্যের ভেজা বাতাসের শৈত্য কেবল। বুঝতে পারছি এই শরীরেই জীবন, যৌবন, প্রেম, কাম, ভক্তি; আমার উচ্ছ্বলতা, সাগরপাড়ে সোনালী আলোতে তোমায় দেখার মুগ্ধতা সবই আমার শরীরের দান। না শুধু শরীর নয়, প্রাণও যুক্ত ছিল। প্রিয় প্রিয় শুভমিতা, একদিন আমি বুড়িয়ে বুড়িয়ে ফুরিয়ে যাব। একদিন আমার চোখ আর সাঁই দিবে না কোন আনন্দ উৎসবে, না কোন রমনীর অতিপ্রাকৃতিক শরীরের মানবীয় ভাঁজের ধাঁধানো আলোকে। সেদিন আমি হয়ত কোন বালকের ছুটোছুটি দেখেই আনন্দ কুড়োব। তবু তোমার যে প্রাণকে আমি ভালবেসেছিলাম, যে হাসিতে আমি জীবনের আলো দেখেছিলাম তা আমার শুধু চোখ দিয়ে নয় যে সময়ের আবর্তে মুছে যাবে। এ চিরন্তন আমার দুর্বিনীত স্বর্গীয় সুষমায় দেখা একান্তই 'তুমি'। পশ্চিম দিগন্তে ভেসে আসে রবীর সুর...
"তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে চলে এসেছি ।
কেউ কি তা জানে ॥
তোমার আছে গানে গানে গাওয়া,
আমার কেবল চোখে চোখে চাওয়া–
মনে মনে মনের কথাখানি বলে এসেছি কেউ কি তা জানে॥"
মিতা আমার প্রাণের মিতা, এই পৃথিবী বিদায় জানাবে কিন্তু তুমি কখনো বিদায় বলবে না এই বিশ্বাসেই বাঁচি।
ইতি
তোমারই অকিঞ্চন
চমৎকার!!!!
"আমার কি মা দূর্গার মত দশটা হাত? -------------ছোট বেলার কথা খুব মনে পড়ে!
ভাই, শুভমিতা কে?
শুভমিতার চিঠি-৮ পড়লাম।
গদ্যটা বেশ ঝরঝরে।
শীত ,প্রণয়,প্রকৃতি ও মা কতই কিছুই তো এসে গেল।
খেজুরের রাপ -পিঠাপুলির কথা ভালো লেগেছে।
শুভেচ্ছা নিন। ভাল থাকুন।
অনেক ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা রইল দাদা।
শীতের পিঠা আর খেজুরের রস, নষটালজিক হয়ে গেলাম
একদম নস্টালজিক করে দিলেন অকিঞ্চন ভাই। কতোদিন খেজুর রস/ পায়েশ খাওয়া হয় না ।

=============================
এদিকে যে আমার মিতাকে পাই না
অনন্যতার ঘ্রাণে সেই অব্যক্ত শব্দমালা; ভালো লাগলো- খুব ভালো।
অনেক শুভেচ্ছা রইল
নস্টালজিক করে দিলেন অকিঞ্চনদা !
পড়ার জন্য ধন্যবাদ
হুম নস্টালজিয়া আমারও
চমৎকার।
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ
মন্তব্য করুন