আদুরির শব্দকঙ্কাল : পুনঃপাঠ : পর্ব এক ও দুই এক সঙ্গে
পাগল ছাগলের পাল্লায় পড়লে যা হয়। সময়টা গোল্লায় যাচ্ছে। ভাবনা আসছে। লিখতে বসছি। কিন্তু তখনি ব্যা ব্যা ডাক। লেখালেখি বাদ। এরকম করে হয় না। পিছিয়ে পড়ছি বারবার। আর নিজেরও কিছু ফালতু আবেগ আছে। গ্রাম গ্রাম ভাব পুষে রাখলে যা হয় আর কি। আবার শুরু করা যাক আমার বন্ধুতে যদি এডমিন পারমিশন দেন--
(এই গল্পটি লিখতে শুরু করেছি। এর আদিও জানি না, অন্তও জানি না। লিখতে লিখতে যাচ্ছি। শুধু জানি একটি জলের ভিতর থেকে একটি শহর উঠে আসছে। তার গাছগাছালি, গরু ছাগল, আর যন্তরমন্তরের হাড়গোড়। যতটুকু লিখব ততটুকু আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব।)
আদুরির শব্দকঙ্কাল : পর্ব এক
ছাতিমগাছের ডালে পাখিটি বসে আছে। হলুদ পাখি। ছাতিম পাতা অবুজ সবুজ। আর হাৎতা-ফাৎতা। এর আড়াল থেকে মাঝে মাঝে পাখিটিকে দেখা যায়। টুব টুব করে তাকায়। খুব খুব করে বাঁকায়। আবার পাতার আড়ালে হারিয়ে যায়। সতুবাবৃ চশমার কাঁচ ধূতির খুঁটে বার কয়েক মুছে নিলেন। কিন্তু পখিটি ঘন হলুদ পালকের জন্যই চোখে পড়েছিল। কিন্তু এবার দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি ভুরু কুঁচছে ডাকলেন, ভুতো, ভুতো…।
ভুতো তখন দরোজার পিছনে হা করে ঘুমোচ্ছিল। আর ফত ফত করে নাক ডাকছিল। গরমে ঘেমে উঠেছ্। আর গোটা কয়েক নীল মাছি ভন ভন করে উড়ে বেড়াচ্ছে। গতরাতে সিঙ্গিদের বাড়ি নৌকাবিলাস পালায় গিয়েছিল। রাধা ঠাকুরুণ নীলশাড়ি পরেছে। হাঁটুর নিচের পায়ের গোছায় ঝম ঝম নূপুর থমকে আছে। আর বৈঠা হাতে কৃষ্ণ মিটি মিটি হাসছে। বিশাখা রাধাকে কনুই দিয়ে লম্বা একটা ঠেলা মেরে নৌকায় উঠে পড়ল। বিশাখার বুক থেকে আচঁল সরে গেছে। গোছ গোছ তুলো দেখা যাচ্ছে। যোগিনের মুখ হা হয়ে গেল। কি মনে করে শিস দিয়ে উঠল। আর অমনি কে এক ছোকরা মাজা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গেয়ে উঠল--
এমনি যদি চাইয়া রবি হাটে যাবি কবে,
জলের মৈদ্যে জল নামিছে তেষ্টা কেন তবে।
ও সখি,
মরণ তাপে চরণ জোড়ায় মাখ্খন গলে যায়,
আমার কী হবে উপায়।।
ঠিক এমনি সময় সতুবাবু চশমাটা চোখের সামনে তুলে ধরলেন। কাঁচে হিজিবিজি বিজ বিজ। নাভির উপর পেটটা খিজি ঘিজ ঘিজ। চেঁচিয়ে ডাকলেন, ভুতো…।
ভুতো চোখ ডলতে ডলতে উঠে পড়ল। আর মাছিগুলে ভয়ে ভয়ে একটু তফাতে গেল। সতুবাবু নয়, রাধা ঠাকুরুন তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের নিচে উলুক ঝুলুক। বলছে, কি গাইছিলিরে ছোড়া?
--গান।
--কিয়ের গান?
--মাখ্খনের গান।
মরণ তাপে চরণ জোড়ায় মাখ্খন গলে যায়…
--বদ, তুই বদেরও বদ। দাঁড়া, তোর মাখ্খন গলাচ্ছি। বলেই রাধা ঠাকুরুণ তার বক্ষোদেশ থেকে ভাঙা পাতিলের একটি টুকরো বের করে ছুড়ে মারল। তার অতিশয় স্ফীত বক্ষোদেশ উন্মোচিত হল। তুলন ভুলন নাই। উহা কালোন। মুখের মতো ধলন ফলন নয়। এই ক্ষণে ভুতোর অবাক হওয়ার সুযোগ নাই। রাধা ঠাকুরুণের চক্ষু লাল। আর গণ্ডেদেশ লালন। ছুড়ে মেরেছে ভাঙা পাতিলের টুকরো। মাথাটা সরিয়ে না নিলে ফটেং ফট হয়ে যেত। রাধার বক্ষে একপাল কালো কাক। তারস্বরে ডাকছে, কা-কা-।
এই সময় রাস্তার উপর দিয়ে একদল লোক হেঁটে আসছিল। তাদের খালি পা। কপালে কারো কারো তিলক। ঘামে হাব জাব। এক তিলক বুড়ি থেকে থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। তাকে ধরে রাখা মুশকিল। চেঁচিয়ে বলছে, ওরে আমার শুক, তুই গেলি কুনহানে…। তার পেছনে আধো ঘোমটা বউটির বুকে সেটে আছে একটি শিশু। মাই চুষছে। আর বউটির চোখ দিয়ে জল ঝরছে। ভুতো ছুটে বেরিয়ে তার পেছনে জুটে গেল। আর তার দিকে তাকিয়ে শিশুটি একটু থেমে আবার মাই চুষতে লাগল।
সতুবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। মুখে বিরক্তি। হাতপাখা নামিয়ে রাখলেন। জানালা দিয়ে হাওয়া উঠে আসছে। পরমের দোকোনে জিলিপি ভাজা হচ্ছে। তেলে বলগ ঝলক উঠেছে। টাইপের খোপে ময়লা জমেছে। মুখ ফুলিয়ে ফুঁ দিলেন। ময়লা উড়ে এসে চোখে মুখে লাগল। আর ডান হাত তুলে আনল পাইকা টাইপ। একটা একটা করে। নির্ভুল।
যে সকল প্রাণ গ্রীষ্মের খরতাপে মৃত্তিকার ন্যায় শুষ্কপ্রায়, চৌচির হইয়া গিয়াছে—তৃষ্ণায় ওষ্টাগত, দগ্ধপ্রায়—একটি সলিলবিন্দুর জন্য হাহাকার করিতে করিতে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে—কোথাও কোনো আশার সরোবর মিলিতেছে না, হতাশ্বাসে মৃত্যু তাহাদের চক্ষুর নিচে উৎসব করিতে আরম্ভ করিয়াছে…
ঠিক তখুনি জানালার ওপাশ থেকে পদ্ম উঁকি দিল। মুখে কৌতুক। নাকে নথ ফৎ ফৎ। শিক ধরে বলল, বাবা, ও বাবা।
সতুবাবু তখনো মগ্নচৈতনে আবিল। গলার নিচে থর থর করে কাঁপছে। আর পিঠে থকথক ঘাম। তার হাতের মধ্যে সিসার ছোট ছোট অক্ষর।
…এই কৃষ্ণকায় মৃত্যোৎসবের মধ্য দিয়া জগদীশ্বর যখন দেখা দেন—তখন তাহার হস্তস্থিত নির্মল সলিল প্রাণের সঙ্কেত বহিয়া আনে। বলে, ওরে মন, আর ভয় নাই। তোর জীবন এবং জীবনের জন্য যতটুকু খেদ মৃত্যুর নিকট হইতে তোকে ফিরাইয়া আনিতে চাহে…
পদ্ম ফিসফিস করে বলল, বাবা—ও বাবা। জিলাপি।
পরমের দোকানে জিলাপির উপর মাছিগুলো ছুটে গেছে। আর ভন ভন করছে। পদ্ম বলছে, ও বাবা, খিদা লাগছে।
সতুবাবু তখন ঘোরের মধ্যে অক্ষর নিয়ে সলিলবিন্দুর স্বরূপ নির্ণয়ে মেতে গেছেন। আর পদ্ম ডাকাডাকি করে থেমে গেল। জানালার পাশে ছাতিম গাছটির দীর্ঘ ছায়া পড়েছে। সবুজ অবুজ ঘাস। পদ্ম ঘাসের উপর হাত্তু পাত্তু করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। গায়ে ডুরে কাপড়। পায়ে মল। কাজল কালন চোখ। মুখখালি ঢলোমলো। দুএকটা ছাতিম পাতা তার গায়ের উপরে খুব চুপখু্প এসে পড়ছে। আর সেই হলুদ পাখিটা দেখল, আশে পাশে কেউ নেই। পাতার আড়াল থেকে এই ফাঁকে বেরিয়ে এল। ডানা ছড়িয়ে খড়িয়ে পদ্মর গায়ের উপর বসল। কী মনে করে কাপড়ের সুতোর ভিতরে উবে গেল। কাপড়টি তখন আর আন্তা খান্তা নেই। পুরোটাই হলুদ।
রাস্তা দিয়ে দল বেঁধে যারা যাচ্ছিল দক্ষিণ পাড়ায়—তাদের কেউ কেউ কেঁদে কেঁদে উঠছে, ওরে শুক। আমরা কেন শুকহারা হৈলাম রে শুক।
আদুরির শব্দকঙ্কাল-২
মতির থেকে থেকে ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু ঘুমোতে পারছে না। কার্নিট সাহেব খবর পাঠিয়েছেন—তিনি আসবেন। তিনি বাহ্যে বসেছেন। শেষ না হলে নড়ন চড়ন নট। কখন শেষ হবে ঠিক নাই। মতি রাত থেকে এখানে আছে। খাওয়া হয়নি। চোখ দুটি লালন।
নমোপাড়ার লোকজন কাছে ঘেষতে পারছে না। মতি বড় একটি চক্র দেঁগে রেখেছে। এর কাছে যাওয়া নিষেধ। ডিক্রি জারি করে দিয়েছে। এই ডিক্রি ভাঙা কারো সাধ্য নাই। জয় কি রানী ভিকটোরিয়া, জয়।
গোস্ট বুড়ি খুব ঝালন করছে। বারবার ছুটে ফুটে আসছিল। ধরে রাখা যাচ্ছিল না। মতি জানে বুড়ি আসতে পারলে আর কাউকেই ঠেকানো যাবে না। সবকিছু ছাকা নাকা হয়ে যাবে। বাহ্য সেরে কার্নিট সাহেব এসে পড়বেন, তখন তাকে কি জবাব দেবে? গোস্ট বুড়ি যখন পাগল প্রায়—মতি তখন তার ত্যালা ম্যালা লাঠিটা মাটিতে গেঁথে শুধু একবার চেঁচিয়ে উঠল—হল্টো!
আর কেউ না বুঝলেও গদাই নমু ঠিকই বুঝতে পারে কত ধানে কত চাল। পিছন থেকে ছুটে এসে গোস্ট বুড়িকে ছোঁ মেরে সরিয়ে নিয়েছে। তাকে ঘিরে আছে বউ ঝিরা। থেকে থেকে বুড়ি মাতম দিচ্ছে। এখন সূর্যটা তেড়ে ফুড়ে উঠেছে। বেদগাঁ, চেচানিকান্দি, মানিহার, গোবরা থেকে লোকজন আসছে। ছোট ছোট পাট গাছ। তার ফাঁকে থাকে বসে পড়েছে। কে একজন গুণগুণ করে গেয়ে উঠছে, পোষা পাখি উড়ে যাবে/ একদিন, ভাবি নাই তো মনে। আরেকজন গুবগুবাটি বের করে নিয়েছে। যোগিন এদিক ওদিক চেয়ে ভুতোকে বলল, দ্যাখতো নরুকাহু আইল নিকি?
নরুকাহু অনেক আগেই কড়াই গাছের নিচে বসে আছে। নিচু হয়ে মলয় মাঝির সঙ্গে ফিস খিস করে কথা বলছে। মলয় মাঝি আবার কানে খাটো। শুনতে পাচ্ছিল না ঠিক মত। এদিক ওদিক তাকিয়ে হ্যাজা প্যাজা করে বলে উঠল, আরো জোরে কও। কি ম্যান্তা খ্যান্তা কৈরা কও কি? নরকাহু মলয়ের কানের কাছে মুখটি এনে ভূখটি করে যা বলল বা বলতে চাইল—তা শুনে মলয় মাঝির মেজাজটা ভ্যাগা চ্যাগা হয়ে গেল। কানটা সরিয়ে নিয়ে ধমকে উঠল, এতো জোরে কস ক্যান? আমি কি বয়রা নিকি?
এই ধমক ঠমক নরুকাহুর অসহ্য। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল, হারাধন এক মনে ছিলুম টানছে। তার পিঠটা ভরা কুঁজ। কুজের পাশে দুটো দাসমাছি হ্যাল্লাত ব্যাল্লাত করে বসে আছে। অন্য সময় হলে চুলকে নিত। এখন ছিলুম টানতে টানতে তার দুপায়ের ফাঁকে কেরা বেরা করা ঘুঘরা পোকাটিকেও দেখতে পাচ্ছে না। পায়ের ফাঁকে দগদগে ঘা। সেখানে পোকাটি মহা আনন্দে চৈতন্য আকার ধারণ করেছে হে।
নেত্যকালীল মেয়েদুটো একটি নাড়ার গাদায় হাটকি ফাটকি করে পেয়ে গেছে কয়েকটি শালুক। চিবুতে চিবুতে ছোট মেয়েটির মাজা থেকে তাগা খুলে গেছে। নেত্যকালী সোনাতনের মায়ের কাছে লক্ষ্মী দীঘা ধানের খবর জানতে চাইছে। কাল তার খৈ নিয়ে সিঙ্গী বাবুর বাড়ি যেতে হবে। মেজো রানী নলেন গুড় জোগাড় করে বসে আছে। গেলে এক ধামা খুদকুড়ো পাওয়া যাবে।
সোনাতনের মায়ের গর্ভ হয়েছে। তার ছোট নাতিটি বড় এক গুয়ে। বাপের সঙ্গে খালে যেতে চায় না। গেলে খালুইটা ধরতে পারে। মাঝে মাঝে তামুকটা সেজে দিতে পারে। এদিকে তার মন নাই। বরইতলায় আগডুম বাগডুম করে। খাগের কলম খোজে। তালপাতা জাগ দেয়। শুকিয়ে গজাল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একে ওকে ধরে। বায়না ধরে--দাও না, বন্ন লিখে। কে তাকে লিখে দেব? এই নিয়ে বাপে পোয়ে ঝাগড় পাগড় লেগেই আছে। এদিকে সোনাতনের বাপ মাগ মানে না, ছাগ মানে না। নাতি ডিঙ ডিঙিয়ে উঠছে। আর সোনাতনের মার ছাড়ন নাই। নতুন করে গর্ভ হল। বেটি ছেলে বাও করে চায়। হাও করে হাসে। তারও ছমাস চলে।
নাড়ার গাদায় কি একটা ফোঁস করে উঠেছে। ছোট বোন পেতির হাত ধরে একটু ছিটকে সরে এল নেত্যকালীর বড় মেয়ে খেপিকালি। ভয়ে থর থর করে কাঁপছে। বিজুলি বালা ছুটে এল। দূর করে খুব খেয়াল করে দেখতে লাগল। নড়ে চড়ে উঠেছে নাড়ার গাদা। কিছু নাড়া চলতে শুরু করেছে। পেতি দিদি খেপির হাত ধরে চেঁচিয়ে উঠল, ভূত, ভুত, ভূত।
ভুতটি তখন একটু এগোয়—একটু থামে। খড়ের ভুত। উপরে একটি ব্যাঙ বসেছিল। লাফ দিয়ে পড়ল। আর বিজুলি বালা চেঁচিয়ে উঠল, ও কাগু, কাকুরে, তাড়াতাড়ি আইস।
গদাই নমু খেপিকালি পেতিকালিকে শূন্যি করে দূরে সরিয়ে দিল। এগিয়ে গেল চলমান নাড়াগাদার দিকে। দুহাত পেছন থেকে গাড়ার নিচে দিতে যাবে বলে আট ঘাট করছে, আর তক্ষুণি গোস্ট বুড়ি বলে উঠল, উরে, কচ্ছিস কি, কচ্ছিস কি?
ততক্ষণে নাড়া দূরে সরে যাচ্ছে। ভেতর থেকে সিঁদুর লেপটানো পিঠ দেখা যাচ্ছে। যোগিন থমকে চেয়ে দেখছে, শুধু পিঠ নয়—মাথার উপরে গদাচক্রের আভাস। গোষ্ঠী বুড়ি থপ হপ করে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বিড় বিড় করে কি সব বলতে লাগল। নেতি আর পেতি নেত্যকালীর কোলের ভেতরে সেধিয়ে গেছে। নিচু হয়ে নেত্যকালী মাটিতে চারপেয়ে দাগ থেকে কিছুটা মাটি তুলে মেয়ে দুটির কপালে মেখে দিল। সোনাতনের মা পেটের উপরে হাতটা রেখে বলে উঠল, ঠাকুর ঠাকুর।
ধুলো ঘসটে পসটে কূর্ম ঠাকুর ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে ছোট ছোট পাট খাট পেরিয়ে, শামা ঘাস হেলিয়ে পেলিয়ে, ছড়ানো ছিটানো নাড়া গাড়ার উপর দিয়ে—অনন্ত জলেল দিকে। ধীরে ধীরে জলরেখা তাকে একটু একটু করে নিজের মধ্যে টেনে নিচ্ছে। তখন কূর্মঠাকুরটি কূর্মটি নেই। হুরমো হয়ে জলের আধারে জলময় হয়ে উঠেছে।
বিজুলি বালারবুকের ভিতরে ততক্ষণে শির শির করে কেঁপে উঠেছে। নিচেকে দেখতে পায়—জলের ভিতরে সেও এক জলনারী, ডুবে আছে জলেতরে। মিশে আছে উষ্ণ জলের জলের তাড়া। আর ডুব খুব শব্দটি আর কুর্ম ঠাকুরের মত সিধুর মাখা চক্রের আভাস তার নতুন জেগে ওঠা বুকে। বুকের গভীরে এবং রক্তের উষ্ণ আলোয়। এইসব আলো অনন্তের ভর থেকে চলে আসা। বিজুলি বালা তখন গাঢ় স্বরে বলে উঠল, পদ্ম পদ্ম।
ঘোড়া আজিজ আরেকটু হলেই বিজুলি বালার দিকে তীর বেগে ছুটে আসত। মেয়েটি পড়ে গেছে ধুলো ও মাটির উপরে। তাকে কেউ খেয়াল করছে না। সবাই ছুটছে কূর্ম ঠাকুরের উদ্দেশ্যে। পোষা পাখি একদিন উড়ে যাবে ভাবি নাই তো মনে—যারা এতক্ষণ এই গানটি গুবগুবাগুব করে গাইছিল, তাদের কে একজন দুহাত তুলে দিল,
অই যায় আমার ঠাকুর
কে তারে ফেরায় এখন
এই মাতম সবার ভিতরে ছড়িয়ে গেল বিদ্যুৎ লতার মত। খোলা মাঠের মধ্যে উপরে আকাশ, অদূরে অনন্ত জলের বিল, আর কচি শচি পাট গাছ—আর জলের মত লোকজন দুহাত উর্ধে তুলে নেচে গেয়ে আকুল—
অই যায় আমার ঠাকুর
কে তারে ফেরায় এখন।
ও ঠাকুর সন্ধে হলে—
কে আমায় তরায় এখন।।
সিঙ্গিবাবু ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন এই খাল পাড়ের ঘন পল্লবিত গাছের ছায়া, ছোটা খোট ছনের চলিাটি, আর চিলতে উঠোন, একপাশে বকুল তলা, অশোক গাছটি চিনতে পেরে থমকে গেলেন। তুলসী গাছটির দিকে চোখ ফিরিয়ে মন্দ্র গলায় ডাকলেন, আজিজ। আজিজ তখন কড়াই গাছের তলায় দাড়িয়ে বিজুলি বালার লাল পেড়ে শাড়িটি দেখছিল। পিছন ফিরে সিঙ্গিবাবুর কাছে এল। মুখে পাকানো গুম্ফো তির তির করে কাঁপছে। সিঙ্গিবাবুর গিলে করা পাঞ্জাবী, পাট করা চুল। আঙুল জুড়ে আঙটির ঝকমকা। বাঁহাতে ধূতির কোছাটি। আজিজ হারু মণ্ডলের দিকে ঘুরে জলদ গম্ভীর গলায় হেঁকে উঠল, হারু।
হারু পালানদের নিয়ে মাটির ভিতর থেকে মাটি তুলে একটি মানুষের আকার গড়ে তূলছিল। অদূরের ‘অই যায আমার ঠাকুর’, খোল-করতাল বোল, মাতমে ডুবে যুবে ভাবছিল, এই শব্দের মধ্যে আর কোনো শব্দ নেই। কোদালে খুপ মুপ শব্দও মুছে গেছে। শুধু মাটিকে প্রাণের মত যত্নে সাজানো ছাড়া আর কোন কর্ম নাই। এই কর্মের টানে মাটির স্তরে স্তরে ঝড়মড় করে ঝরে পড়ছে অনন্ত চোখের জল হে।
অই যায় আমার ঠাকুর
কে তারে ফেরায় এখন।
ও ঠাকুর সন্ধ্যে হলে
কে আমায় তরায় এখন।
কালি কালো আন্ধার কালো
কে তারে জ্বালায় এখন।।
সিঙ্গি বাবু এই শান্ত পল্লবিত আঙিনা ছেড়ে বজরার দিকে এগিয়ে গেলেন। তার লখনৌ চটি শব্দহীন। কিন্তু বাড়ির আঙিনা ছেড়ে যাওয়ার আগে চটি থেকে শব্দ উঠল—একবার। আর তক্ষুণি হারু পালানদের চোখের পলকে আজিজজ আর কালিকা পরসাদ শব্দ করে গর্তের ভিতরে উপরে তুলে রাখা মাটির গাদা ঠেলে ফেলতে লাগল।
আজ রাতে সিঙ্গিবাড়ির দরজায় যে পালাটি হবে—তার নাম রাধিকার মান ভঞ্জন। কৃষ্ণ ছেলেটি সকাল সকাল ঘুমিয়ে নেবে। আর রাধা আর বিশাখা মুখে মেখে নেবে কাঁচা হলুদের লেই। চুলে গিলে বাটা। হারান বাঁশুড়ে একপাক কাটাশুরের পাড়া থেকে ঘুরে আসবে। এই সব সিঙ্গিবাবুর কথা হয়ে আছে।
হারু –পালানরা এগিয়ে আসছে। মলয় মাঝি হারুদের উদ্দেশ্যে বলল, হল তোগো?
হারু আর পালানরা কোনো কথা বলে না। মলয় মাঝি রেগে গেল। বলে উঠল, হল তোদের? কি রে কথা কস না ক্যান? বাবু হইছিস নিকিরে?
হারু তেমনি মাথা নিচু করে হেঁটে গেল। পালান মাটি ঘসটে মসটে পিছনে পিছনে আসছে। হারু মাঝির এইসব অসহ্য। ধা করে একটি চড় কষিয়ে দিল। পাঁচ আঙুল বসে গেছে পলানের গালে। হারু ফিরেও তাকাল না। পলান গালে হাত না দিয়েই হারুর পিছনে পিছনে একই ভাবে চলল। হারুর বুড়োটে মুখ শক্ত হয়ে গেছে। হন হন করে ছুটে গেল খালপাড়ের দিকে।
হারাধন ছিলুম টানতে টানতে হঠাৎ করে থেমে গেল। জ্বলন্ত কল্কিটা নামিয়ে রাখল পাশে। নাড়ার গাদায় গনগণে কল্কির আগুন পড়েছে। ততক্ষণে নারুকাহু এগিয়ে গেছে। পালানের দিকে ছুটেছে। পালানের গালে রক্ত জমা। পাঁচটি আঙুলের দগমগে দাগ। কপালে বিন্দু সিন্দু ঘাম। টপ টপ করে শুকনো মাটিতে পড়ছে। মুখে কোনো রা নেই। ওকে ছেড়ে হারুর দিকে এগুলো। হারুও থামল না। হাতটা হালকা করে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। নারুকাহুরও রাগ চড়ে যাচ্ছিল। রাগ চড়ে গেলে তার জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে যায়। গো ফো করে কি সব বলতে বলতে হাত পা ছোড়ে। লোকজন এই শব্দে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। যারা উচ্চস্বরে খোল করতাল বাজাচ্ছিল—তারা বোল মৃদু করে ফেলেছে। কিন্ত থামাথামি নেই। এইভাবে অষ্ট প্রহর চালাতে হবে। মতির দিকে বাজাতে বাজাতে এগিয়ে গেল। মতি মাটিতে বসেছিল। গতরাত নির্ঘুম। সারাদিন খাওয়া হয়নি। চক্ষু দুটো লালন। কার্নিট সাহেব বাহ্য শেষে রওনা হবেন। ততক্ষণ দরোজার বাইরে দাড়িয়ে আছে বাসন্তি। কার্নিট সাহেবের হলে পরে ভাড় ঘাড়ে করে চলে যাবে। ততক্ষণে মতি মাটিতে তার দেগে দেওয়া চক্র ভেদ করে কাউকে কাছে আসতে দেবে না।
গো ফো শব্দ শুনে মতির তন্দ্রা ছুটে গেল। হাতের লাঠিটা বাগিয়ে চেঁচিয়ে লাফিয়ে উঠল—হল্টো।
কেউ না বুঝলেও গদাই নমু জানে শব্দটির কি মানে। বিজুলির বালার দিকে একবার, আরেকবার মতির দিকে তাকাল। এগুবে কি এগুবে না ভাবতে ভাবতে মাথা খাড়া করে দাঁড়াল। বিজুলি বালা তখনো মাটির ভিতরে শুয়ে আছে। নেত্যকালি মাথায় থাবড়ে হাবড়ে জল দিয়েছে। মেয়েটি একটিবার মাত্র চোখ খুলেছিল। মাত্র একবারই। এখনও নড়ন চড়ন নট।
লোকজন হল্টো শব্দটিকে শুনতেই পায়নি। চারিদিক থেকে মতির দিকে এগিয়ে আসছে। মতি বারবার হল্টো বলছে আর মাথার উপরে লাঠিটিকে ঘোরাতে শুরু করেছে। তার দাগানো চক্রটির চারিদিকে ঘুরে ঘুরে প্রলয় নাচন করছে-মুখ ব্যাদান করে মরণ পণ ঠেকাতে চেষ্টা এই জনস্রোত। হাঁপাতে হাঁপাতে তার জিহ্বা বেরিয়ে গেছে। চোখ ঠেলে বের হয়ে আসছে।
তুমুল বেগে পুনরায় খোল-করতালের বোল উঠেছে। হারাধন যেখানে বসেছিল, সেখানে নাড়ার গাড়া থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করেছে। হারাধনের পায়ের নিচ থেকে ঘুঘরা পোকাটি সটকে পড়েছে। কিন্তু হারাধনের চেতন ফেতন নাই। ভূতো দৌঁড়ে এসে একটি শোলার কাঠি গাদার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। আগুন উস্কে উঠল। দপিয়ে হপিয়ে আগুনটা জ্বলে উঠেছে। আর কেউ না জানলেও গদাই নমু জানে এই আগুনের কী অর্থ। ভুতোর দিকে একবার মাত্র চোখ টিপল। আর কি করার আছে এই কোলাহলে? প্রজ্জলিত নাড়া নিয়ে ভুতো দৌঁড়ে দৌঁড়ে জমির আইলে আইলে ছড়ানো ছিটানো নাড়ার গাদায় আগুন পৌঁছে দিল। চারিদিকে ধোঁয়া উড়তে শুরু করেছে। বাতাসও ঢেউ খেলেছে। এই সময় ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল। আর শোনা গেল গুলির শব্দ।
মুহুর্তের মধ্যে থমকে গেল মতিচ্ছন্ন লোকজন। ঘোড়ায় চড়ে আসতে আসতে কার্নিট সাহেবের বন্দুক থেমে থেমে গর্জে মর্জে উঠছে। সবাই দিকবিদিক শূন্য হয়ে ছুটে গেল। মতির দেগে দেওয়া চক্রের কাছটিতে কেউ নেই। মতি লাঠিয়ে নিয়ে মুখ ব্যাদান করে নাচন টাচন করেই চলেছে। আর পাকিয়ে তাকিয়ে উঠেছে ধোয়া। ধোঁয়া চক্রেরভিতরেও আসতে শুরু করেছে। ফর ফর করে জ্বলে উঠেছে আগুন। কার্নিট সাহেব ঘোড়া থেকে নামার আগেই একটি নারী মূর্তি মুহুর্তের মধ্যে ছুটে এল। মতির চক্রের ভিতরে পড়ে থাকা শুকের শরীরটা কাঁধে তুলে নিল। তার ললাট অগ্নি বর্ণ। কেশদামে জটাজাল। অগ্নি পায়ে ধোঁয়ার ভিতরে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। ধীর পায়ে হেটে চলে চলে গেল দূরে। রোদের থেকে বেরিয়ে আসা পল্লবিত ছায়ার ভিতরে ঢুকে গেল। মিলিয়ে গেল ক্রম অগ্রসরমান অন্ধকারে।
কার্নিট সাহেব অন্ধকারের দিকে চেয়ে বন্ধুক উঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, হল্ট।
চলুক দাদা।
আপনার লেখার অপেক্ষায় ছিলাম। নিয়মিত থাকেন আমাদের সাথে।
পুনঃপাঠেও ভালো লাগলো ...
লেখাটি নীতিমালার 'গ' অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে আপনার নিজের ব্লগে প্রকাশ করা হলো।
'আমরা বন্ধু' আপনার কাছ থেকে নতুন লেখাই আশা করে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনার নতুন লেখায় 'আমরা বন্ধু'র নীড়পাতা সমৃদ্ধ হোক, এই কামনায়।
মন্তব্য করুন