কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি গদ্য ও কয়েকটি কবিতা
পঞ্চাশ দশকের প্রধান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার প্রিয় কবি। ২৩ মার্চ তাঁর ১৫তম মৃত্যু বার্ষিকী।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: কাব্য- ‘সোনার মাছি খুন করেছি’, ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’, ‘ধর্মে আছো জিরাফেও আছো’, ‘ছিন্নবিচ্ছিন্ন’, ‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই’, ‘পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি’ প্রভৃতি।
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গদ্য
শেষ দিনটি
(বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুর স্মৃতি)
আমি কখনো কোনো শোক মিছিলে যাই না। শুধু, সুধীন্দ্রনাথ মারা গেলে তাঁর শবের অনুগামী হয়েছিলুম। তাঁর ছাত্র ছিলুম তথন, যাদবপুরে। বুদ্ধদেব আমাদের বিভাগের প্রধান ছিলেন তখন। তারপর অনেকেই গেলেন- প্রায় সকলেই অপ্রত্যাশিতভাবে গেলেন। নারায়ণবাবু চলে গেলেন, শান্তিদা- শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেলেন হঠাৎ, নরেনদা গেলেন। তার কিছুকাল আগেই গেছেন বুদ্ধদেব। শেষ গেলেন অচিন্ত্যকুমার আর ঋত্বিক। এঁরা আমার চেনাশুনো, আপনার জন। আপনার জনের এই হঠাৎ-যাওয়া আমি সহ্য করতে পারি না। কিন্তু, সহ্য করতেই হয়। আমি শুধু যা পারি, তা এই শবানুগমনে না থাকা। শ্রাদ্ধশান্তিতে যোগ না দেওয়া। পালিয়ে-যাওয়া মানুষের সঙ্গে কোনো সংশ্রব না থাকুক- এই চাই।
বুদ্ধদেব নেই- আকাশবানী থেকে প্রচারিত সংবাদটুকু শুনে বালিশে মুখ গুজেঁ শুয়ে পড়েছি- তখন সকাল। জানালা-দরোজা বন্ধ করে অন্ধকার বানিয়েছি। শুয়েই ছিলাম, আমার বন্ধুরা এসে জোর করে নিয়ে গেল। যামিনী রায়ের পুত্র মণিদা ছিলেন, গাড়ি নিয়ে। তাঁর সংগে আমি আর নিখিল নাকতলা যাই। সেখানে পৌছেঁই সব মানুষের অবনত মাথা আর ফুলগন্ধ আমাকে ভীষণ জব্দ করে। তখনো তাঁর ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখিনি। সেখানে স্তব্ধতা আর মানুষের অসহনীয় ভীড়। কারুকে কাঁদতে দেখলেই আমার চোখে জল এসে পড়ে। বুকের ভেতরটা কেমন খালি-খালি লাগে। যেখানে সবার চোখে জল, মুখ বিষাদ-থমথমে, আমি সেখানে দাঁড়াতে পারি না। কেন এলুম? নিজেকে ভর্ৎসনা করতে থাকি, মনে মনে। অনহ্য এক বেদনার নীলরঙ আমার মুখে চোখে জুড়ে বসে। আমরা এক ঝলক তাঁকে দেখে, পাশে, দেবব্রতর ফ্লাটে চলে যাই। সেখানে গিয়ে অবিরাম সীধুপান চলে। গান হয়, চোখ জলে ভাসে- ওঁর সম্পর্কে কথা একেবারেই হয় না। যেন এক সমূহ দৃশ্য থেকে উদ্ধার পেতে, স্মৃতি থেকে পার- আমরা গলাধঃকরণ করতে থাকি অগ্নি। যা তাকেঁও, কিছুকাল বাদে, বৃত্তাকারে ঘিরে ধরবে। অনুমান করি।
কিছুক্ষণ বাদে স্টেসম্যান কাগজের অরণি আসেন, নরেশ গুহ তাকেঁ বুদ্ধদেব সম্পর্কে রচনা তৈরি করতে সাহায্য করেন। আমরা মাঝে মধ্যে শুনি। অরণির হাতের কাগজ পুড়ে যায় অকস্মাৎ। আমাদের মনে হয়, তিনি তাঁর সম্পর্কে কোনোরকম রচনাই চান না। আমরা ঐ ঘটনার পর, কেমন অন্যরকম হয়ে যাই। অরণি আবার শুরু করেন। নরেশদাকে বলিঃ এমন কোনো কথা বলবেন না যাতে ওঁকে আবার কাগজ পুড়িয়ে দিতে হয়!
সারাদিন আমরা আর ঐ খুপরি থেকে বেরুই না। কেউ কেউ বেরোয়। আমি, নিখিল আর মণিদা ঠায় বসে থাকি। সন্ধে নাগাদ ওরা কেওড়াতলা যায়, আমাকেও যেতে হয়। না যাওয়াই ভালো ছিল। সেখানে আমি, পরে শুনেছি, প্রচণ্ড গোলযোগ করেছি- যাতে কিছুতেই অগ্নি তাকেঁ স্পর্শ না করে- আমি এমন দাবী করেছিলুম পাগলের মতো। বলেছিলুম, ওঁর দেহ আমাদের দিয়ে দেওয়া হোক, আমরা কাছে রাখব।
পাগলের কথা কেউ শোনেনি। প্রতিবাদে সমস্ত পাগল স্থানত্যাগ করে সেদিন।
বুদ্ধদেবের সঙ্গে আমাদের যোগাযাগ প্রায় বিশ বছরের। বিশ বছরের স্মৃতি একটা সার্থক পাহাড়। এখানে সেই শেষ দিনটির সামান্য চিত্র তুলে ধরা হল।
(শব্দমন্ত্র, বুদ্ধদেব বসু সংখ্যা, তারিখ নেই। ১৯৭৪?)
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
অবনী বাড়ি আছো
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’
আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছ
যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?
ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।
এতো কালো মেখেছি দু হাতে
এতোকাল ধরে!
কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি।
এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়
যেতে পারি
যে-কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাবো?
সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো
যাবো
কিন্তু, এখনি যাবো না
একাকী যাবো না অসময়ে।।
আমি যাই
যেখানেই থাকো
এপথে আসতেই হবে
ছাড়ান্ নেই
সম্বল বলতে সেই
দিন কয়েকের গল্প
অল্প অল্পই
আমি যাই
তোমরা পরে এসো
ঘড়ি-ঘন্টা মিলিয়ে
শাক-সবজি বিলিয়ে
তোমরা এসো
কিছু মায়া রয়ে গেলো
সকল প্রতাপ হল প্রায় অবসিত…
জ্বালাহীন হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে
কিছু মায়া রয়ে গেলো দিনান্তের,
শুধু এই –
কোনোভাবে বেঁচে থেকে প্রণাম জানানো
পৃথিবীকে।
মূঢ়তার অপনোদনের শান্তি,
শুধু এই –
ঘৃনা নেই, নেই তঞ্চকতা,
জীবনজাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু।
এক অসুখে দুজন অন্ধ
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ
দীর্ঘ দাঁতের করাত ও ঢেউ নীল দিগন্ত সমান করে
বালিতে আধ-কোমর বন্ধ
এই আনন্দময় কবরে
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ |
হাত দুখানি জড়ায় গলা, সাঁড়াশি সেই সোনার অধিক
উজ্জ্বলতায় প্রখর কিন্তু উষ্ণ এবং রোমাঞ্চকর
আলিঙ্গনের মধেযে আমার হৃদয় কি পায় পুচ্ছে শিকড়
আঁকড়ে ধরে মাটির মতন চিবুক থেকে নখ অবধি ?
সঙ্গে আছেই
রুপোর গুঁড়ো, উড়ন্ত নুন, হল্লা হাওয়ার মধ্যে, কাছে
সঙ্গে আছে
হয়নি পাগল
এই বাতাসে পাল্লা আগল
বন্ধ ক’রে
সঙ্গে আছে …
এক অসুখে দুজন অন্ধ !
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ ।
আতাচোরা
আতাচোরা পাখিরে
কোন তুলিতে আঁকি রে
হলুদ ?
বাঁশ বাগানে যইনে
ফুল তুলিতে পাইনে
কলুদ
হলুদ বনের কলুদ ফুল
বটের শিরা জবার মূল
পাইতে
দুধের পাহাড় কুলের বন
পেরিয়ে গিরি গোবর্ধন
নাইতে
ঝুমরি তিলাইয়ার কাছে
যে নদিটি থমকে আছে
তাইতে
আতাচোরা পাখিরে
কোন তুলিতে আঁকি রে
—হলুদ ?
একবার তুমি
একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা কর –
দেখবে, নদির ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে
পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল
নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল
একবার তুমি ভাল বাসতে চেষ্টা কর |
বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল - ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়
সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে
যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার, যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সলমা-চুমকি-জরি-মাখা প্রতিমা
বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটেনক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি |
বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল
চিঠি-পত্রের বাক্স বলতে তো কিছু নেই - পাথরের ফাঁক-ফোকরে রেখে এলেই কাজ হাসিল -
অনেক সময় তো ঘর গড়তেও মন চায় |
মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে
আমাদের সবই দরকার | আমরা ঘরবাড়ি গড়বো - সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো |
রূপোলি মাছ পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে
একবার তুমি ভালবাসতে চেষ্টা করো |
এবার হয়েছে সন্ধ্যা
এবার হয়েছে সন্ধ্যা। সারাদিন ভেঙেছো পাথর
পাহাড়ের কোলে
আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলো শালের জঙ্গলে
তোমারও তো শ্রান্ত হলো মুঠি
অন্যায় হবে না - নাও ছুটি
বিদেশেই চলো
যে কথা বলনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো।
শ্রাবনের মেঘ কি মন্থর!
তোমার সর্বাঙ্গ জুড়ে জ্বর
ছলোছলো
যে কথা বলনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো।
এবার হয়েছে সন্ধ্যা, দিনের ব্যস্ততা গেছে চুকে
নির্বাক মাথাটি পাতি, এলায়ে পড়িব তব বুকে
কিশলয়, সবুজ পারুল
পৃথিবীতে ঘটনার ভুল
চিরদিন হবে
এবার সন্ধ্যায় তাকে শুদ্ধ করে নেওয়া কি সম্ভবে?
তুমি ভালোবেসেছিলে সব
বিরহে বিখ্যাত অনুভব
তিলপরিমাণ
স্মৃতির গুঞ্জন - নাকি গান
আমার সর্বাঙ্গ করে ভর?
সারাদিন ভেঙ্গেছো পাথর
পাহাড়ের কোলে
আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলো শালের জঙ্গলে
তবু নও ব্যথায় রাতুল
আমার সর্বাংশে হলো ভুল
একে একে শ্রান্তিতে পড়েছি নুয়ে। সকলে বিদ্রূপভরে দ্যাখে।
চাবি
আমার কাছে এখনো পড়ে আছে
তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি
কেমন করে তোরংগ আজ খোলো?
থুতনিপরে তিল তো তোমার আছে
এখন? ও মন নতুন দেশে যাবি?
চিঠি তোমায় হঠাত্ লিখতে হলো ।
চাবি তোমার পরম যত্নে কাছে
রেখেছিলাম, আজই সময় হলো -
লিখিও, উহা ফিরত্ চাহো কিনা?
অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু-ঝলোমলো
লিখিও, উহা ফিরত্ চাহো কি না?
দিন যায়
সুখের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শীতের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
অর্ধেক কপাল জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শুধু ঝড় থমকে আছে গাছের মাথায়
আকাশমনির ।
ঝড় মানে ঝোড়ো হাওয়া, বাদ্ লা হাওয়া নয়
ক্রন্দনরঙের মত নয় ফুলগুলি
চন্দ্রমল্লিকার ।
জয়দেবের মেলা থেকে গান ভেসে আসে
সঙ্গে ওড়ে ধুলোবালি, পায়ের নূপুর
সুখের চট্ কা ভাঙে গৈরিক আবাসে
দিন যায় রে বিষাদে, ষাদে, মিছে দিন যায় …
পাবো প্রেম কান পেতে রেখে
বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে ব’সে আছো, দেবতা আমার |
শিকড়ে, বিহ্বল প্রান্তে, কান পেতে আছি নিশিদিন
সম্ভ্রমের মূল কোথা এ-মাটির নিথর বিস্তারে ;
সেইখানে শুয়ে আছি মনে পড়ে, তার মনে পড়ে ?
যেখানে শুইয়ে গেলে ধিরে-ধিরে কত দূরে আজ !
স্মারক বাগানখনি গাছ হ’য়ে আমার ভিতরে
শুধু স্বপ্ন দীর্ঘকায়, তার ফুল-পাতা-ফল-শাখা
তোমাদের খোঁডা-বাসা শূন্য ক’রে পলাতক হলো |
আপনারে খুঁজি আর খুঁজি তারে সঞ্চারে আমার
পুরানো স্পর্শের মগ্ন কোথা আছো ? বুঝি ভুলে গেলে |
নীলিমা ঔদাস্তে মনে পড়ে নাকো গোষ্ঠের সংকেত ;
দেবতা সুদূর বৃক্ষে, পাবো প্রেম কান পেতে রেখে |
ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ
ইচ্ছে ছিলো তোমার কাছে ঘুরতে-ঘুরতে যাবোই
আমার পুবের হাওয়া।
কিন্তু এখন যাবার কথায়
কলম খোঁজে অস্ত্র কোথায়
এবং এখন তোমার পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা কুঞ্জলতায়
রক্তমাখা চাঁদ ঢেকেছে
আকুল চোখ ও মুখের মলিন
আজকে তোমার ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ পুবের হাওয়া।।
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি - যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয় –
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু - প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন –
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে
(কবির ৩২ তম জন্ম দিনে (২৬/১১/১৯৬৫) লেখা এই কবিতাটি কবিপত্নি শ্রীমতী মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের
সৌজন্যে প্রাপ্ত।)
শিশিরভেজা শুকনো খড়
শিশিরভেজা শুকনো খড় শিকড়বাকড় টানছে
মিছুবাড়ির জনলা দোর ভিতের দিকে টানছে
প্রশাখাছাড় হৃদয় আজ মূলের দিকে টানছে
ভাল ছিলুম জীর্ণ দিন আলোর ছিল তৃষ্ণা
শ্বেতবিধুর পাথর কুঁদে গড়েছিলুম কৃষ্ণা
নিরবয়ব মূর্তি তার, নদীর কোলে জলাপাহার …
বনতলের মাটির ঘরে জাতক ধান ভানছে
শুভশাঁখের আওয়াজ মেলে জাতক ধান ভানছে
করুণাময় ঊষার কোলে জাতক ধান ভানছে
অপরিসীম দুঃখসুখ ফিরিয়েছিলো তার মুখ
প্রসারণের উদাসীনতা কোথাও ব’সে কাঁদছে
প্রশাখাছাড় হৃদয় আজ মূলের দিকে টানছে
(কবির ৫০ তম জন্ম দিনে (২৬/১১/১৯৮৩) লেখা এই কবিতাটি কবিপত্নি শ্রীমতী মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের
সৌজন্যে প্রাপ্ত।)
স্টেশন ভাসিয়ে বৃষ্টি
মনে পড়ে স্টেশন ভাসিয়ে বৃষ্টি রাজপথ ধ’রে ক্রমাগত
সাইকেল ঘন্টির মতো চলে গেছে, পথিক সাবধান…
শুধু স্বেচ্ছাচারী আমি, হাওয়া আর ভিক্ষুকের ঝুলি
যেতে-যেতে ফিরে চায়, কুড়োতে-কুড়োতে দেয় ফেলে
যেন তুমি, আলস্যে এলে না কাছে, নিছক সুদূর
হয়ে থাকলে নিরাত্মীয় ; কিন্তু কেন? কেন, তা জানো না।
মনে পড়বার জন্য? হবেও বা । স্বাধীনতাপ্রিয়
ব’লে কি আক্ষেপ? কিন্তু বন্দী হয়ে আমি ভালো আছি।
তবু কোনো খর রৌদ্রে, পাটকিলে কাকের চেরা ঠোঁটে
তৃষ্ণার চেহারা দেখে কষ্ট পাই, বুঝে নিতে পারি
জলের অভাবে নয়, কোন টক লালার কান্নায়
তার মর্মছেঁড়া ডাক; কাক যেন তোমারই প্রতীক
রূপে নয়, বরং স্বভাবে - মনে পড়ে, মনে পড়ে যায়
কোথায় বিমূঢ় হয়ে বসে আছো হাঁ-করা তৃষ্ণায়!
কবিপত্নীর সৌজন্যে প্রাপ্ত কবিতাগুলো কি কোথাও প্রকাশিত হয়নি? আপনার নিজস্ব উদ্যোগে সংগৃহীত?
আপনার গল্প চাই। ভালো থাকুন কুলদা দা।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অপ্রকাশিত রচনা ও অন্যান্য গ্রন্থ থেকে সংগ্রক করা হয়েছে।
গল্প রচিত হয়েছে। টাইপ করে দেব।
'কাকমানুষের চকখড়ি' পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। অনভিজ্ঞ অযত্নে প্রকাশের কারণে বইটি আমার মত ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। এত দূর থেকে আমার কিছু করার ছিল না। আপনি কি একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা লিখবেন?
আপনি আমার হাবিজাবি ব্লগ পড়েছেন জেনে খুশি হলাম। পূর্ণাঙ্গ আলোচনা লেখার ক্ষমতা থাকলে লিখতাম দাদা।
আপনার কিন্তু সে ক্ষমতা আছে বলে আমি বিশ্বাস করি @নুশেরা
আপনার আলোচনাটি ভাল লেগেছে। এর আগেতো কেউ আলোচনা করে নি। আপনিই যা করেছেন।
গল্পগুলো আমি তিনমাসে লিখেছিলাম। এগুলো টানা লেখা। নিজের স্মৃতিগুলো, অভিজ্ঞতাগুলো, রূপকথাগুলো--আমারগুলোকে নিয়ে লিখেছি। সংশোধন করা হয় নি।
এবং লেখাগুলোর কোনো পূর্ব প্রস্তুতিও ছিল না। কাগজ আর কলমগুলো নিয়ে বসে পড়া আর কি। লিখছি তা রিখছি। শব্দ আসছে। বাক্য আসছে। একটি গল্পের মতো হয়ে উঠছে। কখনো মনে হয়েছে--এগুলো গল্প নয়। কাউকে শোনানো কথা। কোনো এক বিকেলে শান্ত ছা্য়ায় বসে বলা। মূল বিষয়গুলো এসেছে একাত্তর থেকে। আমার ছোট্টাবেলার নিজের দেখা দিনগুলো যতটুকু মনে আছে সেগুলো নিয়ে মার সঙ্গে কথা বলে, দিদির সঙ্গে কথা বলে, দাদার সঙ্গে আলোচনা করেছি মাঝে মাঝে। আর লেখাগুলোতো অন্তর্জালের জন্যই লেখা। কোনো পত্রপত্রিকায়র জন্য নয়। সেজন্য অন্তর্জালীয় একটি আঁটোসাঁটো চেহারা এসেছে। সাহিত্যমানে দূর্বল।
ব্লগে আমরা অনেকেই এখন অন্তর্জাল কেন্দ্রিক পাঠক। তাই হয়তো আঁটোসাঁটো গদ্যে অভ্যস্ততা থেকে ভালো লাগাও এসে গেছে। মাহমুদুল হকের খেলাঘর উপন্যাসে টেঁপি/আন্না/রেহানা/লতার বয়ানে তার ছোটবেলার গল্পগুলো পড়তে যেমন লেগেছে, আমার কাছে আপনার গল্পগুলো পাঠের অনুভূতি অনেকটা সেরকম। এই গল্পগুলো লেখার পিছনের গল্প (চিকিৎসকের পরামর্শে লেখার কথাটা কৌতূহলোদ্দীপক) নিয়ে ব্লগ লেখার অনুরোধ রইলো।
এ গল্প বলেছি আমার বইটির ভূমিকথায় এবং অন্য আরেকটি গল্পের মধ্যে উপগল্প হিসাবে।
অসংখ্যবার পড়া কবিতাগুলো। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ পোস্টটার জন্য। বুদ্ধদেব বসুর লেখাটা মন ছুঁয়ে গেল।
আমি কবির একটা কবিতা কোথাও খুঁজে পাইনি, বছর দশেক আগে কোন পত্রিকায় পড়েছিলাম কবিতাটা , শুরুর কটা লাইন মনে আছে... 'এভাবে নয় এভাবে ঠিক হয় না, নদীর বুকে বৃষ্টি ঝরে পাহাড় তারে সয় না। কিভাবে হয় কেমন করে হয়! .....'
দুই বাংলা মিলিয়ে বাংলা ভাষায় আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে কবির লেখা একটা কবিতা তুলে দেওয়ার লোভটা একদমই সামলাতে পারলাম না :
ইচ্ছে ছিলো তোমার কাছে ঘুরতে-ঘুরতে যাবোই
আমার পুবের হাওয়া।
কিন্তু এখন যাবার কথায়
কলম খোঁজে অস্ত্র কোথায়
এবং এখন তোমার পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা কুঞ্জলতায়
রক্তমাখা চাঁদ ঢেকেছে
আকুল চোখ ও মুখের মলিন
আজকে তোমার ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ পুবের হাওয়া।।
(ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ)
কবিতাটা পোস্টেই আছে, কিন্তু এটা গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গায় ১৯৭১ এর জুলাই সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হইছিলো
খুব প্রিয় কবি শক্তি। তাঁকে নিয়ে লিখলেন বলে ধন্যবাদ। আজ আমার খুব ইচ্ছে ছিলো শহীদুল জহিরকে নিয়ে লিখতে। কিন্তু সময় করে উঠতে পারলাম না। আর এখন ক্লান্তি ভর করেছে।
প্রিয় কবিতাগুলো এই অবসরে আবার পড়ে নিলাম
শহীদুল জহীরের মুখের দিকে দেখি- পেয়েছি কুইনস লাইব্রেরীতে। পড়া শুরু করব এখন পড়ছি দেবেশ রায়ের নভেলজোড়।
তাপসের একটা আলোচনা আছে শহীদুল জহীরকে নিয়ে। অনুমোদন করলে ওটা জোগাড় করতে পারি। তারপর একটা জোর আলোচনা হোক। রাজী?
দেবেশ রায়ের তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত ভালো লেগেছিলো।
আমি অনুমোদন করার কেউ না। সেটা মডুদের মামলা। তবে আমার মনে হয় তাপসের আলোচনাটা নিয়ে আপনি আলোচনা করলে তাতে মডুদের আপত্তি থাকার কোনো কারণ থাকবে না। তখন আমরাও পড়ে ফেলতে পারবো সেই আলোচনা। অংশও নিতে পারবো।
প্রিয়তে রেখে দিলাম।
খুব ভালো লাগলো। শক্তি শক্তিমান লেখক।
মন্তব্য করুন