একেই কি বলে "অসহায়ের আত্মসমর্পণ"!
১.
আমি ভিষণ আবেগী মানুষ। আমার স্কুল, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বন্ধু, কিছু প্রিয়মুখ নিয়ে আমি গোঁয়াড়। বড্ড গোঁয়াড়। আমার আবেগের একটা বড় অংশ দেশ নিয়ে। আমি আমার দেশটাকে অত্যন্ত ভালোবাসি। দেশের মানুষকে ভলোবাসি। ধুলাবালি- যানজট-ধমর্ঘট সবই ভালোবাসি। এজন্যই শনিবার রাতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সিরিজ জয় হবার পর কত আনন্দ নিয়েই ঘুমাতে গেলাম। পরদিন জার্সি পড়ে অফিস যাবো। আনন্দ- আড্ডা সবই হবে। সেই ইচ্ছাতে অবরোধের মাঝে আমার অসম্ভব অপছন্দের কলেজ "তিতুমীরের" সামনে দিয়ে রওনা দিলাম। "কোনমতে অফিসে পৌছাতে পারলেই কেল্লা ফতে" টাইপ অবস্থা। এখন থেকে অবশ্য বলতে হবে "প্রাণে বেঁচে অফিস পৌছাঁনোই আসল"..'
২
রবিবারের যা ঘটনা তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। বিশ্বজিৎ নামের মানুষটির মৃত্যু কিছু অমানুষের হাতে। সারাদিন ধরে টিভিতে তার বাঁচার চেষ্টা দেখলাম। রাতে ভিডিওটা দেখলাম বারবার। মিডিয়ার যা অবস্থা, ভাগ্যিস ছেলেটি "বিশ্বজিৎ" ছিল না হলে ঐ খুনীগুলো এই হত্যাকাণ্ডকেও হালাল করে নিতো।
৩
মানুষ যে ধর্মের হোক, যে বর্ণের হোক, যে পোশাকই পড়া থাকুক না কেন- তাকে মেরে ফেলার লাইসেন্স কোন ননসেন্স কিছু সেন্সলেসের হাতে দিয়েছে তা আমার জানা নেই! আব্বা বেঁচে থাকাকালে রক্ষীবাহিনীর টুকটাক এমন গল্প শুনেছি। যেহেতু তিনি বেঁচে নেই সেহেতু সেটা নিয়ে পেচাঁবো না।
৪.
সারারাত ঘুম হয়নি। এমন ভুল জায়গাতে দাঁড়িয়ে প্রাণ কি শুধু বিশ্বজিতের মতো কোন অপরিচিতেরই যাবে! আমার পরম আত্মীয় সেখানে থাকতে পারতো। আমার কোন প্রিয় বন্ধু বা সহকর্মী! অথবা আমি নিজেই! কারণ আমরা রোজ সকালে কাজের জন্য বাসা থেকে বের হয়- অথবা অকারণেই বের হই। আমাদের মৃত্যু কি এমনভাবে হবে? আল্লাহ মাফ করুন। যেন এমন দিন দেখতে না হয়। কি জানি আবার হতেই পারে। কারণ বাংলাদেশে এখন নানা প্রকারের মানুষ থাকে। সাধারণ মানুষও এক প্রকারের মাঝে পড়ে যাদের নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। না শোবার ঘরে, না রাস্তায়।
৫.
মন খারাপের কারণটা ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছে। ভিডিওটা যখনই দেখি, দেখি বেচারা বিশ্বজিতের আশেপাশে তার মৃত্যুর "রিয়েলিটি শো" দেখতে হাজির অনেক "মানুষ"! অনেক ক্যামেরা। অনেক মাইক। ছেলেটা মার খাচ্ছে। ছেলেটার গা থেকে রক্ত ঝরছে। ফেসবুকে লিখলাম, কেউ কি তাকে সহায্য করতে পারতো না? নিজ এলাকায় যে ছেলেটা মরে গেল সেই এলাকার কি পঞ্চাশটা সাহসী মানুষ নেই যারা অমানুষগুলোকে হটিয়ে দিতে পারতো! বা সংবাদকর্মীরা কি ক্যামেরাটা রেখে সংঘবদ্ধ হয়ে অমানুষ গুলোকে ধাওয়া দিতে পারতো না!
ফেসবুকের পোস্ট শেষে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন। কেউ সরাসরি করলো কেউ ভদ্রতা করে আড়ালে "বাঁশ" মারার চেষ্টা করলো। যে, "মুখে অনেক কথা বলা যায়, অমন জায়গাতে উপস্থিত থাকলে কেউই এগিয়ে আসতো না"- বা "নিজের জান বাঁচানো ফরজ" টাইপ। এসব দেখে রাগ হলো না। মন খারাপ হলো। ওদের জন্য করুনা হলো। এরা আমাদের নতুন প্রজন্ম। এরা বাংলার বাঘ! হায়রে বাঘ.. তোমরা শিকারীর ভয়ে হুঙ্কার করতে ভুলে গেছ! একেই হয়তো বলে "অসহায়ের আত্মসমর্পণ"...
৬
তোমাদের বলছি,
আমাদের জন্ম আশির দশকে। তোমাদের চোখে আমরা ব্যাকডেটেড। আউট অফ ফ্যাশন। কথা সত্য বাবারা। তোমরা সবার আগে নিজের গদি এবং পশ্চাতদেশ বাঁচানোর চেষ্টা করো। আমরা এখনই বৃহত্তর ভাবনাটা ভাবি। আজও আমাদের কেউ কেউ রাস্তায় কাঁদতে থাকা ফেরিওয়ালাকে সাহায্য করে। হারিয়ে যাওয়া টাকা তুলে দেয় অন্যান্য পথচারীর কাছ থেকে নিজে হাত পেতে। আমাদের মাঝোই কেউ কেউ গাড়ি থামিয়ে গাঁটের পয়সা খরচ করে মা আর তার শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করায়। আমাদের মাঝে একদল পাই পাই পয়সা জমিয়ে মেডিকেলে পড়া কিছু ছাত্রের পড়ার খরচ যোগায়। আমরা পারি-আমরা করি।
আমরা তাদের দেখে সেই বল পাই যারা নব্বই-এ খালি হাতে স্বৈরাচারী নিধনে রাস্তায় নেমেছিল। সেই অনুপ্রেরণা আছে বলেই আমাদের মাঝে কেউ কেউ রোকেয়া হলে হামলার প্রতিবাদে সশস্ত্র বাহিনীর সামনে ঝাপিয়ে পড়ে।
শোন বাবারা, আমাদের হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। বুকে সাহস ছিল- আছে। সেই বিশ্বাস থেকেই বলছি, এমন মানুষ যদি সেসময় ঐ এলাকায় থাকতো- বিশ্বজিত আজ বেঁচে থাকতো।
৭.
নিজেই লিখেছিলাম, "একচল্লিশ বছর আগে - বেয়োনেটের বিরুদ্ধে জয় হয়েছিল মনোবলের"। আজ বলতে কষ্ট হচ্ছে, বেয়োনেট তো অনেক দূরে- আজকালকার কোন যুদ্ধে ছুড়ি-চাকুর সামনেও দাঁড়াতে ভয় পাবে বাঘেরা! হয়তো একারণেই মনে হয়- আল্লাহর অশেষ রহমতে এমন সময় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে যখন মানুষ বিবেক দিয়ে ভাবতো- ভালোমন্দের বিচার করতো.. নিজেকে নিয়ে নয় দেশকে নিয়ে ভাবতো..
৮.
তারপরও একটি ছেলে - রিন্টু। একা একটা ছেলে "রেড ব্লাড" নামে একটি গ্রুপ খুলে লোকজনকে অনুপ্রেরণা দিয়ে এগিয়ে আসে রামুর অসহায় লোকদের সহায়তা করতে। কই সে তো কারো জন্য অপেক্ষা করেনি! দেখেনি- আগে কে আসে..! তার বিবেকের ডাক সে শুনেছে। বিশ্বজিতের পাশে যারা ছিল তারা শোনেনি। আর আজকে যারা গা-বাচানোর কথা বলছে তারা তো নয়ই। আমরা কি পারি না রিন্টুর মতো কোন ইয়ং ব্লাডকে ভোট দিয়ে দেশকে পরিবার তন্ত্রের হাত থেকে বাঁচাতে?
৯.
এখনকার বাংলার বাঘরা বড্ড বেশি সচেতন। তাদের পরিবার আছে, নিজের জীবন আছে..তোমরা আজ যারা নিজেদের বাচাঁতে বড্ডবেশি আগ্রহি তাদের উদ্দেশ্যে অনেক কষ্ট নিয়ে বলছি.. মুক্তিযোদ্ধা রুমিরও মা ছিলেন.. ডা: মিলনেরও মেয়ে ছিল আর নুর হোসেন বেঁচে থাকলে তারও পরিবার থাকতো!!
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সম্ভাবনা- বিশ্বজিতের জায়গায় আমরা যে কেউ থাকতে পারতাম।
১০.
আবেগের কোন দাম নেই। সেটা বরাবরই। আবেগের লেখাও যথাযথ হয় না। তাই আজকালকার মানুষ আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে সটকে পড়ে সুযোগ বুঝে। কিন্তু ভেবে দেখার সময় এসেছে। যদি বুদ্ধি করেও বাংলাদেশের মানুষ এক হয় সব অমানুষদের খেদানো শুরু করে তাহলে বিজয় কাদের হবে বলে মনে হয়?
(কাউকে না জেনে আঘাত করে থাকলে দু:খিত)
কষ্টের কথাগুলো লিখে মন হালকা হলো কিনা জানি না । কাল থেকেই মনটা ভারি হয়ে আছে । কি যে অস্থির সময় পার করছি আমরা! এর শেষ কোথায় কে জানে!
না হয় নাই.. কোথায় যে পড়লাম "সংখ্যালঘু" বলেই বিশ্বজিত মারা হয়েছে.. !! বিষয়টা আমার কাছে ঘোলাটে.. বিশ্বজিত কি "আমি হিন্দু" "আমি হিন্দু" বলে হাঁটছিল! সে যে সংখ্যালঘু খুনীরা জানলো কি করে? আরো মেজাজ গরম হলো..
আপনার লেখাটা পইড়া মাকসুদ এর গনতন্ত্র গানটার কথা মনে পড়লো।
এখন ব্যান্ডের গানগুলোতে এতই "তুমি-আমি" যে দেশ হারিয়ে যায়.. মাকসুদ- নোভা- প্রমিথিউস তাও তো দেশের জন্য গান করেছে...আর এখন "দেশের জন্য গান" না হয়ে হয় কর্পোরেটদের কাছে বেচার জন্য গান...
কিছু বলার নাই
আমি আমাদের "তরুন প্রজন্মের আচরণে" ভাষাহীণ...
ইয়েস বোন, আজ বাংলার মানুষ বড় সহায়হীণ । আমার জনম '৫০ এর দশকের গোড়ার দিকে । তখন মানুষ আরো সত/বিবেকী এবং সাহসী ছিল ।আমারতো মনে হয় এখন মানুষ আর মানুষ নাই । দুই ডাইনীর লোলা চোষা ছাড়া আজকের তারুণ্যের আর কোন কাজ নাই । কবে যে এই পিচাশদের খপপর থেকে দেশ মুকত হয় !
যতদিন যাচ্ছে সাহস ততই কমছে...বিষয়টা হতাশাজনক...
আমরা পারি করতে অনেক কিছুই। কিন্তু করছি না কেন? আমরাই কেন উদ্যোগী হই না?
হয়তো .. উদ্যোগী আমাদের মাঝেই অনেকে.. কিন্তু সংঘবদ্ধ নয়
বইনে.. একদম মনের কথা বলেছ.. কতটা অসহায় আমরা...
অনেক অসহায় রে আমরা.. অনেক বেশি.. কেউ এখন নিজেকে ছাড়া আর কারো কথা ভাবতেই পারেনা...
নতুন জেনারেশন অনেক স্বারথপর। নিজেকে ছাড়া তারা কিছুই বুঝে না। বিদেশে এসে এগুলো আরো নিজেকে মেলে ধরে।
বিশ্বজিত আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের জনমই অপঘাতে মরার জন্যে। বিশ্বজিতের হত্যা কাজ দিয়েছে। আজ অনেকেই হরতালের ভয়ে বাড়ি থেকে বের হয়নি। জামাতীরা যা করতে পারেনি, লীগেরা তা করে দেখিয়েছে জনগনকে
কোনদিন ভাবিনি বিদেশে চলে যাবো.. আজকাল এসব স্বার্থপরতা দেখলে ঐ ভাবনাটাও চলে আসে..
অনেকে মনে করছেন ওই সময় অসংখ্য সাংবাদিক ছিল। এটা ঠিক না। টেলিভিশন ক্যামেরাম্যান ছিলেন দুই জন। ফটোগ্রাফারো ২/৩ জন। এরমধ্যে সাংবাদিকেরা ডেন্টাল ক্লিনিতে উঠতে চাইলে অস্ত্র ধরা হয়েছিল। কেউ কেউ বিশ্বজিৎকে পাশের ন্যাশনাল হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলে। তাও তারা করতে দেয়নি।
আবার সাংবাদিকদের কাজ কি এ বিতকর্ বহু পুরোনো, এখনো চলে, আগামিতেও চলবে। কেভিন কার্টার তো বড় উদাহরণ।
তারপরেও বলা যায় সবাই মিলেই আমরা বিশ্বজিৎকে মারলাম।
মাসুম ভাই, সমাজের অনেক টানাপোড়েন নিয়ে সাংবাদিকরা লিখেন বলেই সাংবাদিকদের ওপর মানুষের আশা থাকে, অন্যায় দেখলে তারা এগিয়ে আসবেন। সমাজের দায়িত্ববান ও সচেতন মানুষ হিসেবে সাংবাদিকরা পূজিত হন। সংখ্যা থেকে নয় পেশাগত গুরুত্ব থেকে দেখে হয়তো কথাটা উঠেছে
সংখ্যার কথা এ জন্য বললাম যে, অনেকে দেখলাম এফিবিতে বলছে, এতো সাংবাদিক ছিল, ছবি না তুলে বিশ্বজিৎকে বাচালো না কেন-এই প্রশ্ন তুলছে।
যারা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটালো তারা তো ছিল সশস্ত্র দলীয় ক্যাডার, সাধারণ মানুষ তো ওদের কাছে জিম্মি!
ভাবতে অবাক লাগে দিন দিন আমরা কত নিচে নেমে যাচ্ছি !
এই পোষ্টটা দেয়ার সাথে সাথেই আমি ফেসবুকে শেয়ার দিছিলাম কারন আমাদের সবার অসহায়ত্বের দারুন ভাবে বলা। কমেন্ট করতে ইচ্ছে করে নাই ভেবেছি কি বলবো? কিবা বলার আছে?
মন্তব্য করুন