নিজেরে করিতে গৌরব দান...!
কবিকে দিও না দুঃখ, তাহলে সে তার দুঃখ ছড়িয়ে দেবে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে...
কবিকে আমরা দুঃখ দিতে চাই না। তারপরও অজান্তেই কবি দুঃখ পান, কষ্ট পান—আমরা ব্যথিত হই, কিন্তু কিছুই করার থাকে না।
কে কবি আর কে কবি নয়—কোনো মানদণ্ড নেই।
কে ছোট কবি আর কে বড় কবি—তারও কোনো মানদণ্ড নেই।
তবুও কবিরা কষ্ট পান, হয়তো কষ্ট পেতে ভালোবাসেন। তাদের এই কষ্টবিলাসটা যখন আমাদের মতো গোবেচারা, নির্বিরোধী মানুষকেও আক্রান্ত করে—পীড়িত না হয়ে উপায় থাকে না!
মাসিক পত্রিকায় ছেপেছিলাম একজন 'শক্তিশালী' কবির কবিতা। তিনি ক্ষুব্ধ, তার কবিতা অনেক পেছনে ছাপা হয়েছে। যোগ্যতা বিবেচনায় তার কবিতাই আগে থাকার কথা ছিলো! বয়সেও তিনি অনেক বড়। হাঁটুর বয়সী কবির কবিতার নিচে কবিতা ছেপে তাকে অপমান করা হয়েছে। তিনি বিদায় নিলেন; এই পত্রিকায় আর লিখবেন না। আমরাও সসম্মানে তাঁকে বিদায় দিলাম। এমন মহান কবির মর্যাদা আসলেই আমরা করতে পারবো না। তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ কী!
পরের সংখ্যায় আরেকজন শ্রদ্ধেয় বড় ভাই মাইন্ড খেলেন। অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কবির কবিতার নিচে তাঁর কবিতা ছাপা হয়েছে। বললাম, এক জায়গায় থাকলেই হলো—মলাটের ভেতরেই তো! সিনিয়র-জুনিয়রের হিসাব দিয়ে বললেন তিনি, কবিতার তুলনামূলক ভালোমন্দ বিচার না করলেও তিনি সিনিয়র। সিনিয়র হিসেবে অবশ্যই তাঁর আগে জায়গা পাওয়া উচিত। এও বললেন, এখনকার সাহিত্য সম্পাদকরা এটা মেনে চলেন। সাহিত্য সংকলকদের দিকে যাবো না, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
সমস্যা হচ্ছে, কার বয়স কত ক্যালকুলেটর নিয়ে আমরা বসে থাকি না। কে ছোট আর কে বড় এটা এখনো অতটা মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠেনি। নাগরিক জীবনের হাজারো চাহিদা মেটাতে সময় ব্যয় করেই যেখানে কূল পাওয়া যায় না, সেখানে এসব বাড়তি ঝামেলা।
দশকের হিসাবও আছে! অমুক তো শূন্য দশক আর আমি ষাট/সত্তর/আশি/নব্বইয়ের...!
ব্যক্তিগতভাবে আমার অভিমত হলো, কোথায় ছাপা হলো সেটা বড় কথা নয়। কে আগে কে পরে, সেটা বড় কোনো বিষয় নয়। কারো কবিতা যদি সত্যিই কবিতা হয়ে ওঠে, দ্যুতি থাকে তাহলে অন্ধকারে সে দ্যুতি ঠিকই ঠিকরে উঠবে। উপর-নিচ কাউকে ছোট-বড় বানাতে পারে না।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্ত-র কবিতার উপরে-নিচে কার কার কবিতা ছাপা হয়েছিলো, সেই খবর কি আমরা রাখি—ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে?
পত্রিকা পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক একজন শিক্ষক ফোন করে বললেন, 'অনেক অকবির কবিতাও ছাপিয়েছেন দেখছি!'
এই কামড়াকামড়ি নতুন নয়। বিশেষ করে ছোট-বড় দ্বন্দ্বের।
চট্টগ্রাম থেকে 'ঢেউ' নামে চমৎকার একটি লিটলম্যাগ করতেন সবুজ তাপস। কামড়াকামড়ির ঠেলায় অস্থির হয়ে তিনি বেছে নিলেন আদ্যক্ষর পদ্ধতি—অ, আ, ই, ঈ...। তাতেও কি আর ঠাণ্ডা করা যায় শ্রেষ্ঠ মানবদের!
কারো কবিতা ছেপে দেয়ার দায় আমাদের নেই। নিতান্তই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই কাজ করা। এখন কেউ যদি জোর করে সম্মান, সমীহ আদায় করতে চান—সেটা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। নতুন করে ভাবতে হয় অনেককিছু।
একজন কবি হবেন শ্রেষ্ঠতম মানুষ। তাকে কেন 'মুই কী হনুরে' চিন্তা আক্রান্ত করবে? কবি কেন অন্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করবেন!
অন্যকে সম্মান করার মানসিকতা আমাদের নেই। যদি থাকতো, ছোট ভাইবোনদের (জুনিয়র কবি) সহানুভূতি দেখিয়ে এটা আমরা মানতে পারতাম। পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধও তলানিতে। তাই অবলীলায় ঘোষণা দিয়ে দেয়া যায়—'আরে অমুকের তো কবিতাই হয় না!'
বিনয় জিনিসটা শুধু বিনয় মজুমদারের নয়—সকল কবির ধারণ করা বাঞ্ছনাীয়।
শিল্প তো সহমর্মী, সমব্যথীই হতে শেখায়; বিনির্মাণ করে উচ্চতর জীবনবোধ। সেটা যদি না হয়, কীসের শিল্প, কীসের শিল্পী...!
এ শুধু কবিতার বেলায় নয়, সব জায়গায় একই কারবার।
আমাদের জাতীগত স্বভাব
আমরা জাতিগত ভাবেই পরশ্রীকাতর, নীচ ও আত্মঘাতী।
মন্তব্য করুন