প্রান্তিক এক লেখকের যাপিত কষ্ট-গাথা
বছর দুই আগে বগুড়ায় গিয়েছিলাম। সেখানে বেহুলার বাসর ঘর বলে কথিত ভিটা দেখতে গেলে এক যুবকের পিড়াপিড়িতে একটা চটি বই কিনি। নাম 'বেহুলার বাসর ঘরের ইতিহাস'। লেখক তবিবুর রহমান। তবিবুর রহমান পেশায় ছিলে পোস্ট মাস্টার। জন্ম ১৩৪৯ বঙ্গাব্দ মৃত্যু ১৪০২ বঙ্গাব্দ। তিনি মোট বিশটি বই লিখে গেছেন ধর্ম, ইতিহাস, উপন্যাস, কাব্য ইত্যাদি নিয়ে।
'বেহুলার বাসর ঘরের ইতিহাস' বইটায় লেখক পদ্মপুরান থেকে ও শোনা কিংবদন্তী থেকে বেহুলার কাহিনী বলার প্রয়াস পেয়েছেন। তবে আমার কাছে বইটার সবথেকে আকর্ষণীয় অংশ হলো এর শেষভাগ। যেখানে লেখক ছন্দ কবিতায় নিজের জীবন কাহিনী বর্ণনা করেছেন। লেখকের প্রেমিকাকে না পাওয়ার বেদনা, সাংসারিক যন্ত্রনা, কাঠ মোল্লাদের ফতোয়া তথা সারা জীবনের দুঃখ বঞ্চনার গাথা এখানে ব্যক্ত করেছেন। আমরা জানতে পারি লেখক হতে গিয়ে তার ত্যাগের কথা। বই প্রকাশের নেশায় দরিদ্র হয়েও পরিবারের গঞ্জনা সয়ে জমি বিক্রি করে বই প্রকাশ করেছেন। আবার দেখি ধর্ম নিয়ে তার নিজস্ব ধ্যান ধারণা প্রকাশ করায় তিনটা বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে মোল্লাদের ফতোয়ার কারণে।
দু:খী এই লেখকের নিজের লেখা দুঃখগাথা 'জীবন নাটক' ।
জীবন নাটক - তবিবুর রহমান
বগুড়া জেলার গোকুল গ্রামে আমার কুঁড়েঘর
নিয়তুল্লাহ পিতা, আমার নামটি তবিবর
দাদা ছিল মোল্লা মানুষ, দাদী ছিল হাজী
মাতা-পিতা ছিল সদা ধর্ম কাজে রাজী
পিতামহের পিতামহ ছিল মুসাফির
কেও জানেনা কোন বা দেশে ছিল তাঁহার নীড়
আমি যখন মায়ের কোলে দু'টি ভাইয়ের শেষে
উনিশ' পঁয়তাল্লিশ সাল; যুদ্ধ সকল দেশে।
যখন আমি আঁতুড় ঘরে দিয়েছিলাম পা
কেঁদে কেঁদে এসেছিলাম অঙ্গে পেয়ে ঘা
উঠা-বসা শিখতে গিয়ে হাটু গেছে ছিলে
পিঠটা আমার আজো বাঁকা বড় ভাইয়ের কিলে
শিষ্ট আচার শিক্ষা দিতে মা দেখাতো ভয়
শিশুকালে পেলামনা ভাই শান্তি কারে কয়।
শৈশব ও কৈশোরে মোর হস্তে ছিল বই
গুরু জনের বেত্র খেলাম শান্তি পেলাম কই
স্কুল পালানো দুষ্ট আমি বর্ণ ছিল কালো
চেহারাটা দেকে শুধু মা বাসিত ভাল
সপ্তম শ্রেণীর মাঝে হল লেখাপড়া
তখন থেকেই একটু করে শিখেতেছিনু ছড়া
যুবাকালে গিন্নী এলো লয়ে ফুলের ডালি
ভেবেছিলাম সুখী হব আমি তোয়োবালি
কে জানিত নারী জাতিক বোঝা অতি ভার
চেহারাটা দেখে বধু ফিরিলনা আর
কে বুঝিবে প্রেমের জ্বালা প্রেমে না পড়িয়া
এর চেয়ে মরণ ভালো গলায় দড়ি দিয়া
আজো আমার বক্ষে আঁকা 'সাহেরা' যার নাম
বিচ্ছেদে বুঝিয়া গেলাম ভালোবাসার দাম
এই আগুনে পুড়ে পুড়ে কি বলিব ভাই
মনের মাঝে জমা হল চিত্ত-চিতার ছাই
কিনেছিলাম তবলা-ডুগী, উদাস ছিল মন
ভেবেছিলাম দুঃখ বুঝি হবে নিরসন,
পিতা ছিল মুনশী মানুষ মনটা ছিল গোঁড়া
তবলা-ডুগী গুড়ি দিয়ে চুলোয় দিল পোঁড়া
তখন মনে হল যাহা কি বলিব ভাই
মনে হল ধুতরা গিলে খেয়ে মরে যাই
মনের দুঃখে গৃহ ছেড়ে হলাম ভব ঘুরে
চলে গেলাম ঢাকা ছেড়ে আরো অনেক দূরে।
শোনরে আমার পাঠক ভায়া দুঃখের ইতিহাস
হেথা সেথা ঘুরে আমার কাটল কয়েক মাস
বাড়ী থেকে চিঠি গেল, বুঝিলাম তা পেয়ে
বৃদ্ধ মাতা বসে আছে পথ চেয়ে চেয়ে
মনে হল মায়ের কথা! কি বুঝাব ভাই
আবার এসে চরণে তার নিয়েছিলাম ঠাঁই
মা কহিল , বিয়ে করাই দেখে ভাল কুল
আমি তখন বলেছিলাম করবনা আর ভুল
মা কহিল, সংসারী হউ, কথা রাখিস মোর
গতিমতি এতে বাবা ভালো হবে তোর
খুজিয়া রেখেছি আমি এক সতী নারী
কত গুণ আছে তার বুঝাতে না পারি
রূপে গুণে বেহুলা সে জ্ঞানে সরস্বতী
রহীমার মত সদা স্বামী সেবায় মতি
মার কথা শুনে মনে হল খুঁতখুত
মন থেকে চলে গেল যেন কালো ভূত
মায়ের আদেশ মাথায় নিয়ে বাসর ঘরে বসে
ধরে ছিলাম আবার আমি নারীর চরণ কষে
সংসারেতে অনাসক্তি হতো কভূ কভূ
ঘরনীকে করে নিতে হল তবু।
কে জানিত প্রথম আমি চেয়েছিনু যারে
পারিব না সুখী হতে না পাইলে তারে
কে জানিত পাবনা গো মন দিয়েছি যারে
যারে আমি চাইনি কভু নিতে হবে তারে
চুরি করে যে আমার নিয়ে গেছে মন
যার কথা ভেবে আজো বহে দু'নয়ন
যার কথা ভেবে আজো মনে পড়ে বার বার
জানিনা যে আমি মনে পড়ি কিনা তার
শোনরে আমার পাঠক ভায়া দুঃখের কথা কই
মনের দুঃখে বসে বসে লিখনু দু'টি বই
ছেলে মেয়ে পঞ্চমায়া জন্ম নিল ঘরে
নিত্য নতুন দৈন্যদায়ে শান্তি গেল সরে
ভেবেছিলাম কবি হব আদর পাব ভাই
কে জানিত এ যুগে আর কবির কদর নাই
জমি বেঁচে ছাপনু পুথি, গিন্নী হল কাল
অন্যমুখে শুয়ে থাকে রাগে ফুলায় গাল।
এইখানে যে অনেক কথা! বলা উচিত নয়
ক্ষেত্র বিশেষ তবু যেন বলতে কিছু হয়
গিন্নী কহে, এটেসেটে বেধে মাথায় চুল
তোমার সাথে বিয়ে বসাই হয়েছে মোর ভুল
ভুল করেছে বুড়ো বাপে গিলেছিল তাড়ি
দেখি এবার কৃষ্ণপুরে যাইতে বাবার বাড়ী
গৃহিনীর এ কথাগুলি চুপে চুপে শুনি
মনের মাঝে নানা অঙ্গের কল্পনা-জাল বুনি
কইনু হেসে পরিশেষে আমি তোমার পতি
কেন তুমি বোঝনা মা হয়ে স্বরসতী
এই কথাটি শুনে বধু বিগড়ে গেল আরো
কইল রেগে তুমি দেখি মস্ত বড় জারো?
খাতা কলম কাড়িয়া নিয়া ফেলে দিল ছুঁড়ে
বলতে ছিল আগুন জ্বলে ফেলবো এসব পুড়ে
সারা বছর বসে বসে কি যে ঘন্টা লেখ
সংসার কি হচ্ছে নাহি চক্ষু তুলে দেখ
বিয়ের পর বলেছিলে কয়টা নিবে শাড়ী
গয়না দিব ময়ণা তুমি নিও গাড়ী গাড়ী
এখন দেখি বেঁচে কিনে হচ্ছে তুমি তল
ফেৎরা চেয়ে খেতে হবে কমে এলে বল
কত মানুষ কতভাবে কত করে আয়
ওসব দেখে তোমার বুঝি লজ্জা নাহি পায়
তাইতো বুঝি চলে গেছে মুখে দিয়ে চুন
তুমি তারে ভাব, মনে হয় করি যেন খুন
গৃহ রানীর কথা শুনে কুড়িয়ে আনি খাতা
কইনু হেসে ওগো দেবী ঠান্ডা কর মাথা
কে জানিত কবির কলম কেন কেঁদে কয়
কবি-জীবন দুঃখে ভরা, কবি সুখী নয়।
হৃদয় চুরি হল যবে প্রথম যৌবনে
সেদিন থেকে কলম আমার কেঁদে কেঁদে কয়
এ জগতে সকলি পর আপন কেহ নয়
নিঝুম রাতে একলা বসে কাঁদে যখন মন
কলম শুধু সাথী হয়ে করে জাগরণ
শোনরে আমার পাঠক ভায়া দুঃখের কথা কই
এবার আমি লিখেছিলাম এমন দু'টি বই
ফতোয়া এল কাফের আমি আজাজীলের দাস
কতজনে কতভাবে করল উপহাস
সালাম কালাম কেও দিলনা ঘুরিয়ে নিল মুখ
অনুতাপে চোখের জলে ভাসিয়ে দিলাম বুক
বাজেয়াপ্ত হল পুথি, হলাম অপমান
কোনোমতে রক্ষা যেন পেল শুধু জান
গিন্নী কহে, হেসে হেসে হচ্ছে দেখি বেশ
দেখো এখন কেমন মজা ছাড়তে হবে দেশ।
শোনরে আমার পাঠক ভায়া জ্ঞানী আমি নই
মনের দুঃখে বসে তবে লিখনু আরো বই
বাক্স ভরে রাখিয়াছি পান্ডুলিপি তুলে
ছাপি যদি হয়ত এবার যেতে হবে শূলে
কবি আমি নইকোরে ভাই আমি অর্বাচীন
হয়তো আমি কবির মত একটু উদাসীন
সেতার বাজাতে কিছু পারি টুন টান
লিখি যাহা করে তাহা পাগল প্রমান
হারমনিতে শিখেছিনু সা-রে-গা-মা সুর
গাহিতে কহিলে গলা করে ঘুরঘুর
বাঁশের বাঁশিতে আমি ছিনু বড় পটু
এটুকু গুন ছিল না বলেছি কটু।
দোষের তালিকা যদি দিতে মোর যাই
বাইশ টাকায় করি পোস্ট মাস্টারী
শুনিলে যে হাসি পায় রেগে যায় নারী
গিন্নী কহিত রেগে, ওটা ছেড়ে ডাও
তার চেয়ে অতি ভাল রিক্সা চালাও।
ভেবেছিলাম দরবেশ হব তত্ব দিব দান
ধর্ম নিয়ে চিন্তা করে পাইনে সমাধান
গিন্নী কহে, সবি হবে পাকলে তোমার চুল
দন্ত নড়ে চশমা পরে লাগও আগে গুল।
পৌঢ়কালে দিয়ে আছি স্মৃতির মালা গলে
কেও জানেনা কত আগুন আমার হৃদয়-তলে
বৃদ্ধকালের শিথিলতা ক্ষীণ কলেবর
দীক্ষা দিয়ে গেল আবার শিশু-সুলভ স্বর
ব্যর্থ হল শান্তি সাধন দুঃখ করি জয়
মৃত্যু আসে জানিয়ে দিতে জীবন অভিনয়।
কেঁদেই আসা, বিদায় বেলাও কেঁদেই যেতে হয়
তাইতো জানি এই পৃথিবীটা স্বপ্নপুরী নয়
এই জগৎটা পান্থ নিবাস, আমরা মুসাফির
ভুলে গেছি এই কথাটি হয়ে রাহাগীর
এই জগৎটা মহা সড়ক, ষ্টপেজ এটা ভাই
কেউবা আসে ক্ষণেক দাড়াই, কেউবা চলে যাই
পিতা-মাতা পুত্র আদি কেহই কারো নয়
পথিকে পথিকে শুধু পথেই পরিচয়
এ জগৎটা মায়াপুরী, এটা বালিচর
এইখানে কি হতে পারে স্থায়ী কোনো ঘর?
সম্মুখে ঐ মড়াঘাটি, এটা রণাঙ্গণ
তাবু গেড়ে আছি মোরা থাকব কিছুক্ষণ
এ জগৎটা নাট্যশাল, করছি সবাই অভিনয়
জীবন-নাটক পঞ্চ অংক, সকল দৃশ্য দুঃখময়।
ফার্স্ট কমেন্ট। হাহা মজা পেলুম খুব। এতক্ষণ পরে এসেও এমন একটা সুযোগ ধরতে পেরে।
এই বইটা আমিও দেখে কিনতে চাইসিলাম। লোকটা কোনোদিন ব্লগ খুলতে চাইলে, নিজের সম্পর্কে লেখার ব্যপারে আলাদা করে ভাবতে হবে না। একটা পূর্ণ লেখা তৈরি আছে।
পোস্ট করে সেটা ফার্স্ট পেইজে না দিলে কি হবে? দেখসেন, আমরা ঠিকই সেটা খুঁজে বের করে ফেলসি?
তবিবুর রহমানকে আমারো দরকার, একটা ছন্দ মধুর আত্মজীবনী লেখাতে চাই
ভাইজান আপনের সঙ্গে অনেক অনেকদিন দেখা হয় না।
মন্তব্য করুন