অসমাপ্ত সমাপ্তি
"যতদিন ছোট থাকবে,মন ততদিন পবিত্র থাকবে।বড় হতে শুরু করলেই মন অপবিত্র হতে শুরু করবে।"
"কিন্তু আমিতো জাহান্নামে যেতে চাই,তাহলে এত পবিত্রতা দিয়ে কী হবে?"
"জাহান্নামে তো তুমি যাবেই,সেটা তোমার জন্য হোক বা আমার জন্যই হোক।মন পবিত্র রাখবে জান্নাতে যাওয়ার জন্য না,চারপাশের পরিবেশের সৌন্দর্য অনুভব করার জন্য।তা না হলে জাহান্নামে গিয়েও বিরক্ত লাগবে।"
বাবা যখন কথাগুলো বলেছিলেন,তখন স্বর্গের বয়স মাত্র দশ।বাবার যে কথাগুলো উপলব্ধি করতে পারেনি সেগুলো ডায়রিতে লিখে রেখেছিল ও।আজ ১৫ বছর পর ডায়রিটা বের করল।ভোরে বাবাকে স্বপ্নে দেখে ঘুম ভেঙে যায় স্বর্গের।ঘুম থেকে উঠেই মা'র আলমারির কোণে অযত্নে পরে থাকা সবুজ মলাটের ডায়রিটা বের করে,উপরে আধো আধো অক্ষরে লেখা 'অসমাপ্ত সমাপ্তি।শুরুতেই মনের পবিত্রতা বিষয়ক বাবার বিশ্লেষণ।সেদিন বাবার এই কথাগুলো শুনতে শুনতে বাবার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল স্বর্গ।আজও তার ব্যতিক্রম হলনা।পার্থক্যটা কেবল পরম মমতার স্পর্শ আর জীর্ণ কিছু কাগজের।
ঘুম ভাঙল রনির ডাকে।রনি সামনের চায়ের দোকানে কাজ করে,৮-১০ বছর বয়স হবে।রোজ সকালে চা নিয়ে এসে স্বর্গকে ডেকে তোলে ও।স্বর্গ দরজা রনি চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
"ভাইজান,রাইতে কি নেটে ঘুমাইছেন?"
স্বর্গ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,"না তো,কেন?"
"মেলাক্ষণ আগে চা নিয়া আইছিলাম,আপনে উঠেন নাই।চা তো ঠান্ডায় জইমা গেছিল,আবার বানায়ে আনছি।"
"ও"
"আইচ্ছা ভাইজান আসি",রনি চলে যাচ্ছিল।
"শোন,এক প্যাকেট ফাইভ ফিফটি ফাইভ দিয়ে যা",ওকে ডেকে বলল স্বর্গ।
রনি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,"ভাইজান,হেইডা কী জিনিস?"
স্বর্গ বুঝতে পারল বাবার স্মৃতির সাথে সাথে তাঁর ব্যবহার্য সবকিছুই ওর কাছে বাস্তব হয়ে উঠছে।অন্যমনষ্ক হয়ে বলল,"এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয়।"
"আইচ্ছা ভাইজান",বলেই রনি বিদায় নিল।
সেলফোনে রিং হচ্ছে।আলাউদ্দীন ভাই ফোন করেছে।স্বর্গ ফোন রিসিভ করল,
"স্বর্গ,একটা ভাল খবর আছে"
"কী?" স্বর্গের সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন।
"কাটা বক্করের খবর পাইছি"
"হুম,কোথায় আছে সে?"
"হারামজাদা ভাগতাছে ঢাকা ছাইড়া।জয়নালরে পাঠাইতাছি,তুই জলদি আইয়া পর।সব কইতাছি।"
"জ্বি আচ্ছা,আসছি",আলাউদ্দীন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল,স্বর্গ লাইন কেটে দিল।
নিজের অজান্তেই বাবার দেয়া গাঢ় সবুজ পাঞ্জাবীটা পড়ল স্বর্গ।গত বছর জন্মদিনে পাঞ্জাবীটা কুরিয়ার করে পাঠিয়ে ছিলেন।সাথে একটা চিরকুটে লেখা ছিল,"মানুষের চারপাশের প্রকৃতি যতটা পবিত্র,তারজাগতিক কর্মকান্ড ঠিক ততটাই অপবিত্র।এই অপবিত্রতাকে ঢাকতে সে প্রায়ই প্রকৃতির বর্ণ গায়ে জড়িয়ে রাখে।আমি চাই তুমি এই বর্ণ মনে জড়িয়ে রাখ।"
স্বর্গের বয়স যখন ১৫,তখন হঠাত্ একদিন ওর বাবা ২-৩ বছরের একটা মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসে।এর পরের দু'দিন তুমুল ঝগড়া চলে ওর বাবা আর মা'র।স্বর্গ ঝগড়ার কারণ জানার চেষ্টা করেনি।সেসময় ওর ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষা চলছিল।সারাদিন ও ছাদের ঘরটায় দরজা লাগিয়ে কাটিয়েছে।ক'দিন পর বাবা আনুষ্ঠানিকভাবে বাড়ির সবাইকে বিদায় জানিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে চলে যান।তত্ক্ষকণাত্ ঘটনাটা স্বর্গের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়নি।যাবার আগে বাবাকে সে শুধু একটা প্রশ্ন করেছিল,"আমারতো মনে হয়না তোমার স্বর্গে যাওয়ার কোন ইচ্ছা আছে।তাহলে আমার নাম স্বর্গ রাখলে কেন?"
বাবা এই প্রশ্নের উত্তর দেননি।শুধু মৃদু হেসেছিলেন।
বাবার অনুপস্থিতি যখন স্বর্গ অনুভব করতে শুরু করেছে,বাবাকে তখন অনেক খোঁজার চেষ্টা করেছ।কোন লাভ হয়নি।স্বর্গের ছোট মামা কোন এক বিশ্বস্ত সূত্র থেকে খবর এনে দেন,উনি নাকি ওই বাচ্চার মাকে বিয়ে করে সংসার করছেন।
বাবা মাঝে মধ্যে স্বর্গকে চিঠি দেয়।এ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ওকে।
রাস্তার ধারে আলাউদ্দীন ভাইয়ের কালো প্রাডো দাঁড়ানো।সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল স্বর্গ,রনির ডাকে দাড়াল।রনি একটা সবুজ খাম এগিয়ে দিয়ে বলল,"ভাইজান,একটা বাইট্টা আপনারে হেইডা দিতে কইছে।খুব নাকি সার্জেন্ট।"
স্বর্গ খামটা নিয়ে গাড়িতে উঠল,কোন কথা বলল না।এই নীরব মানুষটার সাথে আজই প্রথম পরিচয় রনির।পরিচয়ের ব্যাপ্তিটা হয়ত আজকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে,এমন আশা নিয়ে রনি তাকিয়ে থাকল গাড়িটা অদৃশ্য হওয়ার অপেক্ষায়।
আলাউদ্দীন ভাইয়ের নতুন ড্রাইভারটা অতিরিক্ত কথা বলে।গাড়িতে ওঠার পর থেকে সে অনরগল কথা বলে যাচ্ছে।স্বর্গ এই কথার মাঝেই সবুজ খামটা খুলল।ঠিক তখনই আলাউদ্দীন ভাইয়ের ফোন,
"তোরা কতদূর?"
"রমনা পার্ক",স্বর্গ জবাব দিল।
"কাটা বক্কর রমনা পার্কে।হের আশপাশে আমার লোক ঘুরাঘুরি করতাছে,এরা তোরে সব দেখায়ে দিবে।জয়নালরে বলগাড়ি সাইড করে রাখতে।"
"ওকে"
স্বর্গ ফোন রাখতেই জয়নাল জিজ্ঞেস করল,"হেয় কই?"
"রমনা পার্কে"
"হালার পার্কে কাম কী?বুইড়া বয়সে ভিমরতি ধরছে!জীবনে কয়টা খুন করছে,হেয় নিজেও তো তার হিসাব দিতে পারব না,মরণের দিন পার্কে রঙ্গ করতে আইছে?"
স্বর্গ খানিকটা ধমকের স্বরে বলল,"জয়নাল,গাড়ি থামাও।"
জয়নাল গাড়ি থামাল,মুখ থামালনা।
কাটা বক্করকে স্বর্গ আগে কখনও দেখেনি,আজও হয়তো দেখা হবেনা।সে দু'হাত ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে,তার গায়ে গাঢ় সবুজ পাঞ্জাবী।স্বর্গ তার কয়েক মিটার পেছনে কৃষ্ণচূড়া গাছটার আড়ালে রিভলবার তাক করে দাঁড়িয়ে আছে।ওর পাশে জয়নাল।গাছের ডালে এক ঝাঁক কাক নীরবে বসে আছে।
কয়েক সেকেন্ড পর গাছের ডালে বসা কাকগুলো দল বেঁধে কা কা করতে করতে উড়ে গেল।জয়নাল তখনও থামেনি ।
বাবার আর কোন চিঠি পায়নি স্বর্গ।অসমাপ্ত ডায়রিটা নিয়েই বাবার স্মৃতি অম্লান করে রেখেছে হৃদয়ে।পাঞ্জাবীর পকেটে রাখা সবুজ খামটাও খুঁজে পায়নি।দ্রুত গাড়িতে ওঠার সময় হয়তো পকেট থেকে পড়ে গেছে,হারিয়ে গেছে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচের লাল-সবুজ আল্পনায় ।
পরিশিষ্ট
স্বর্গ,
তুমি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলে,আমি তোমার নাম স্বর্গ রেখেছি কেন?সেদিন তোমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আসেনি,আজ সে সময় এসেছে।তুমি ঠিকই বলেছিলে,আমার স্বর্গে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই,আসলে কোন যৌক্তিকতাও নেই।তাই আমি তোমাকে দিয়ে একটা কৃত্রিম স্বর্গ সৃষ্টি করেছিলাম।আমার এই কৃত্রিম স্বর্গের বোঝাটা সারাজীবন তোমাকে বইতে হবে।
বাবা,আমি জীবনে কতগুলো খুন করেছি,তার হিসাব আমার জানা নেই।এতে আমি তেমন কোন কষ্ট পাইনি,যতটা না কষ্ট পেয়েছি তোমার মা'কে কষ্ট দিয়ে।আমার মরূ সমান পাপকে বালিকণা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করেছিলাম ছোট একটি মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টা করে।তা না হলে ওর বাবা ওকে বেঁচে দিত।অবশ্য তাকেও আমি বাঁচাতে পারিনি।ম্'ত্যুর আগে তোমার মা আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।আমি জানি এই স্বর্গীয় গূণ তোমার মাঝেও বর্তমান।
জানি,তুমি আমাকে খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছ।আমার আসল পরিচয় জানলে হয়তো সে চেষ্টাও করতে না।বিদায়......
তোমার জাহান্নামী পিতা
কাটা বক্কর।
ভালই তবে কেমন খাপছাড়া। ১৫ বছরের ছেলে বাবাকে দেখলে চিনবে না? সে যতই মুখোশ পরুক। ১৫বছরের ছেলে বাবা মার সম্পর্ক খারাপের দিকে গেলে যতই পড়াশুনা থাকুক হেল্প করবেই। গল্প লেখার আগে একটু গুছিয়ে নিন। ধন্যবাদ।
বাবা-মা'র সাথে বড় হওয়ার পরও যেখানে তাঁদেরকে খুন করাটা যেমন প্রকৃতির নির্মম বাস্তবতা,তেমনি বহু বছর পর পেছন থেকে বাবাকে দেখে না চেনাটা একই রকমের নির্মম বাস্তবতা।পৃথিবী কি সবসময় আশানুরূপ গতিতে চলে??
ভালোই। আরও পড়ুন, আরও লিখুন।
খারাপ লাগেনি তবে আরো ভাল হতে পারতো
মন্তব্য করুন