এমন যদি হত
ঊনিশ তলার উপর থেকে কোন কিছুই স্পষ্ট দেখা সম্ভব না, অথচ আমি ওকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। রিক্সা থেকে নেমে রাস্তা পার হচ্ছে,ওর এক হাতে সিগারেট আর অন্য হাতে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের বেল্টটা ধরা।আজ ও হলুদ টি-শার্ট টা পরে এসেছে,সাথে ওই সবুজ প্যান্টটাও।এই পোশাকে অনিকে দেখলেই তো হাসি পায়।সেদিন লাইব্রেরী রুমে পড়ছিলাম আমি,অনি,রোমেল আর নিশা।এদের মধ্যে পড়ার মত পড়ছিল শুধু নিশাই।বাকি তিনজন ছিলাম হুমায়ূন আহমেদের টি-মাস্টার হয়ে।এই নামটা আমার দেয়া না,নিশার দেয়া।প্রায় প্রতিদিনই আমরা একসাথে পড়তে বসি,নিশা পড়ে আর আমরা যথারীতি ফাইজলামি করি যার ফলস্বরূপ আমাদের এই নাম দেয়া হয়েছে।জীবনে কিছু করতে না পারলেও হুমায়ূন আহমেদ স্যার এর তিনটা চরিত্র তো হতে পেরেছি!
ওইদিন অনি বেশ ফানি মুডে ছিল আর বলির বাখড়া ছিলাম আমি।টপিক টা না হয় বাদই দিলাম!সেদিন ও কেন এত এক্সাইটেড ছিল সেটা বোঝা যাচ্ছিলনা।হঠাৎ রোমেল বলে উঠল, “অনি তোমার ঘাড়ে কিসের দাগ?”বলা বাহুল্য রোমেল ছেলেটা কথাবার্তা কম বলে,নীরবে উপভোগ করাটাই বোধ হয় ওর নীতি।সবাই ওকে তুই করে বললেও রোমেল সবাইকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে।
অনির টি-শার্টের ওপরের দাগটা ছিল লিপস্টিকের।এর বিশ্লেষণ না করাটাই বোধহয় শ্রেয়।হলুদ টি-শার্টের ওপর লাল দাগটা বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল।অনি এই উজ্জ্বলতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল পানি দিয়ে দাগ ওঠানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে।এর ফলে যে লাভটা হয়েছে সেটা ডেস্কে বসে থাকা মামা’র, উনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।আর পড়ার ব্যাস্ততায় পুরো বিষয়টা মিস করেছিল নিশা।
এই ঘটনা বেশ কয়েক মাস আগের।আজও ওর টি-শার্টে লিপস্টিকের দাগটা স্পষ্ট।হাতের কাছে ফোনটাও নেই যে ওকে ফোন করে বলব একটু সাবধানে থাকতে।ওই যে বাবা ভাঙাচোরা ফোনটা নিয়ে গেল, আর তো দিয়ে গেলনা!
প্রচণ্ড রোদ পড়েছে আজকে।রাস্তায় চলাফেরা করা মানুষগুলোকে দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে।গাড়িতে চড়া লোকগুলো থেকে শুরু করে রাস্তার টোকাই,সবাই দর দর করে ঘামছে।চেহারা কুঁচকানো,তবে মুখের হাসিটা সবারই আলাদা করা যাচ্ছে।এই দেশের মানুষগুলো আসলেই অনেক সুখি,হাজার দুঃখ-কষ্টের মাঝেও তাদের হাসি কখনো ম্লান হয়না।আমি এই সুখি মানুষগুলোকে শুধু দেখতেই পাচ্ছি,এদের সুখ অনুভব করতে পারছিনা।ভাদ্র মাসের কাঠ ফাটা রোদেও আমার শরীর হিমশীতল হয়ে আছে।
অনি,রোমেল আর নিশার সাথে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মুন।মুনের সাথে সবসময় সায়েমকে দেখা যায়,আজ ও নেই।এদের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক কিসের তা বোঝা মুশকিল।দুজন প্রায় লেগেই থাকে বলা যায়।আবার এদের দুজনের মধ্যে অভিমানটাও অনেক বেশি।গতকাল সায়েম এসে মুনকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে,বারবার কানে ফোনটা নিয়ে বিরক্তিকর মুখে আবার রেখে দিচ্ছিল। মনেহয় সুইচড অফ ছিল।এই মেয়েটার ফোন অবশ্য প্রায়ই বন্ধ থাকে,ও একটু আউলা টাইপের।এতে কেউ কিছু মনে করেনা,স্বাভাবিকভাবেই নেয়।কিন্তু আমি শিওর মুনের উপর অভিমান করে সায়েম আজকে আসেনি।ক্লাস টেস্ট ছিল,সেটাও দেয়নি।নিশা সায়েমের এই খামখেয়ালি নিয়ে বেশ চিন্তিত,ও সায়েমকে ফোন করছিল,তখনই সায়েম কোত্থেকে ছুটে এল।উপস্থিত সবাই ওর উপর বিরক্ত,নিশা মনেহয় একটু বেশিই বিরক্ত।ঠিক বিরক্ত বললে ভুল হবে, এটা অতিরিক্ত দায়িত্বশীলতার বহিঃপ্রকাশ। নিশার এই অতিরিক্ত কেয়ারিং অ্যাপ্রোচ সায়েমের কাছে স্পষ্ট না।সায়েম এসেই কোন কথাবার্তা না বলে সিগারেট ধরাল।ও অনবরত নিঃশ্বাস ফেলছে,মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত।সায়েম সিগারেটে একটা করে টান দিচ্ছে আর নিশা রাগে তত গজ গজ করছে।আমার মনে হচ্ছে নিশা এখনই সায়েমের গালে একটা চড় বসিয়ে দেবে।আমি ভাবতে ভাবতেই নিশা কাজটা করে ফেলল।আশেপাশের লোকজন হা করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।অথচ সায়েম নির্বিকার,ঠোঁট থেকে পড়ে যাওয়া সিগারেটটা তুলে ও আবার টানতে শুরু করল।নিশার হাতে চড় খাওয়া ওর কাছে নতুন কিছু না।অবশ্য সিগারেট খাওয়ার অপরাধে আমাকে আর অনিকেও নিশার হাতে চড় খেতে হয়েছে,এরপর থেকে আমরা ধুমপানের কাজটা আড়ালে করতে শুরু করি,রাস্তাঘাটে মান সম্মানের একটা ব্যাপার আছে!কিন্তু সায়েম তো ওসবের ধার ধারেনা।
“তুমি কোথায় ছিলা?” এতক্ষণে মুখ খুলল রোমেল।
প্রশ্ন শোনার পর সায়েমকে বেশ চিন্তিত মনে হল।ও কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে,আবার না বলেও থাকতে পারছেনা।রোমেলের করা প্রশ্ন সবার চেহারায় ভেসে আসতেই ও বলল, “অর্ণবকে তোরা কেউ দেখছিস?”
“অর্ণব!” দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুন,সাথে বাকিরাও।
গত বছর ওরা গিয়েছিল বান্দরবান।তখন বর্ষাকাল,বর্ষাকালে হিলট্র্যাকস ভ্রমনে যাওয়ার আইডিয়াটা ছিল অর্ণবেরই।যেদিন ওরা বান্দরবানে ঢুকল, সেদিন তুমুল বৃষ্টি।কথা ছিল বান্দরবান থেকে খাগড়াছড়ি রওনা হবে ওরা।কিন্তু অর্ণব কোত্থেকে একটা চাঁদের গাড়ি জোগাড় করে এনে বলল, “চল,নীলগিরি পাহাড় ঘুরে আসি।” অফ সিজন,লোকজন কম,তাছাড়া কম খরচে চাঁদের গাড়ি পেয়ে যাওয়ায় রাজি হয়ে গেল সবাই।ওরা যখন রওনা দিল,তখন বৃষ্টিও কমে গেছে। আকাশে মেঘ ঘুরোঘুরি করছে।পরিবেশটা খুব চমৎকার,মেঘের দেশে ঘোরার স্বপ্ন তাহলে পূরণ হচ্ছে ওদের!সারাদিন কিভাবে পাড় হয়েছে ওরা কেউ বুঝতেই পারেনি।যখন ফিরবে তখন প্রায় সন্ধ্যা।ফেরার সময় ওরা লক্ষ্য করল অর্ণব কোথাও নেই।এমন লুকোচুরি খেলার অভ্যাস ওর আছে।কিন্তু এই পাহাড়ের উপর লুকানোর জায়গাটা কোথায়?ওদের বেশিক্ষণ খুঁজতে হলনা।পাহাড়ের কোনায় খাঁড়া ঢালের সাথে লাগোয়া অচেনা শুকনো গাছের ডালে ওর ডিএসএলআর টা ঝুলতে দেখা গেল,তার একটু নীচে পাহাড়ের খাঁজে ওর ভেঙ্গে যাওয়া ফোনটা।কারো বুঝতে বাকি রইলনা অর্ণব কোথায়।সেদিন সবার চোখে পানি এসেছিল একমাত্র মুন ছাড়া।
অর্ণবের বাবাকে ওর জিনিসগুলো দেয়ার সময় তিনি শুধু বলেছিলেন, “বছরে একবার করে হলেও তোমাদের মায়ের সাথে দেখা করে যেও।”
অর্ণবের ডিএসএলআর এর ব্যাগে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা এখনও মুনের কাছে।মুন সেটা সাথে রাখে সবসময়।সায়েমের সিগারেট শেষ হয়ে গেলে সে অনেকবার সেই প্যাকেট থেকে সিগারেট নেয়ার চেষ্টা করেছে,মুন দেয়নি।এই নিষিদ্ধ জিনিসটাই বা কেন ও সবসময় সাথে রাখে সেটাও কারো কাছে পরিষ্কার না।
নিশা বিরক্ত হয়ে বলল, “অর্ণবকে কিভাবে দেখব?”এই বিরক্তিটা দায়িত্বশীলতার না,সহানুভূতির। সায়েম মনমরা হয়ে বলল, “পাশের বিল্ডিং থেকে দেখলাম ও ঊনিশ তলার ছাদে দাঁড়িয়ে হাসছে। তারপর তাড়াহুড়ো করে সেখানে গিয়ে দেখি কেউ নাই।”
কেউ কোন কথা বলল না,সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।ঠিক তখনই কোন রকমের পূর্বাভাস ছাড়াই বৃষ্টি নামল।চারিদিকে লোকজন ছুটোছুটি করছে,ছাউনি খুঁজছে।আর ওরা ক’জন নীরবে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে।
ওদের মত খোলা আকাশের নীচে আমিও দাঁড়িয়ে আছি,কিন্তু আমার গায়ে এক ফোঁটা পানিও পড়ছে না।চোখের সামনে যখন প্রিয় মানুষগুলো সৃষ্টিকর্তার রহমতে সিক্ত,তখন আমি হিমশীতল শরীরে দাঁড়িয়ে অভিশপ্ত শুষ্কতার আল্পনা আঁকছি!
ধীরে ধীরে বৃষ্টি থেমে গেল।ওরা বিদায় নিয়ে যে যার পথে পা বাড়াল।
আজ বৃহস্পতিবার,আগামী দুদিন ওদের কারো সাথে দেখা হবে না।এই এক জায়গায় থাকতে আর ভালও লাগেনা।ইচ্ছে হয় অন্য কোথাও চলে যাই,যাযাবরের মত ঘুরে বেড়াই দেশ থেকে দেশান্তরে। কিন্তু চাইলেই কি সব পাওয়া যায়!মৃত্যুর আগে আমরা বাঁধা থাকি সমাজের বাঁধনে,আর মৃত্যুর পর কোন এক অজানা বাঁধন,যে বাঁধন আরও দৃঢ়,অবিনশ্বর।
বাবাকে দেয়া কথা অনুযায়ী কাল ওরা মা’কে দেখতে যাচ্ছে কিছু না জানিয়ে।কিন্তু মা কোনভাবে পেয়ে গেছেন ওদের আগমন বার্তা।পাবেননাই বা কেন?ওদের সাথে আমিও তো যাচ্ছি!আগের মত সচল শরীরটা নিয়ে হয়তো না,হিমশীতল অদৃশ্য অবয়বটা নিয়ে কিংবা এক টুকরো নিথর স্মৃতি হয়ে।
এমন যদি হত,মৃত্যুর পরও আমাদের প্রিয় মানুষগুলো এভাবেই আমাদের সাথে বিচরণ করত!!
আমাদের প্রিয় মানুষগুলো এভাবেই আমাদের সাথে বিচরণ করত!! কি বলব? সবাই তার নিজস্বক্ষেত্রে ভাল থাকুক।
vai khobe valo lagblo golpota .casue ei golper sateh amar onek mil .amio chay porokale jeno amra sob bondho ek sathe thakte pari
এই মৃত মানুষটির জায়গায় নিজেকে ভেবেই কল্পনাটা করেছিলাম।
ভাল লেগেছে, আলাদ স্বাদ
মন্তব্য করুন